ভানুসিংহের পত্রাবলী/৪৯
৪৯
আত্রাই নামক একটি নদীর উপর বোটে ক’রে ভেসে চ’লেচি। বর্ষার মেঘ ঘন হ’য়ে আকাশ আচ্ছন্ন ক’রেচে, একটু ঝোড়ো বাতাসের মতো বইচে, পাল তুলে দিয়েচে। নদী কূলে কূলে পরিপূর্ণ, স্রোত, খরতর, দলে দলে শৈবাল ভেসে আস্চে। পল্লীর আঙিনার কাছ পর্য্যন্ত জল উঠেচে; ঘন বাঁশের ঝাড়; আম কাঠাল তেঁতুল কুল শিমুল নিবিড় হ’য়ে উঠে গ্রামগুলিকে আচ্ছন্ন ক’রে ফেলেচে; মাঝে মাঝে নদীর তীরে তীরে কাঁচা ধানের ক্ষেতে জল উঠেচে, কচি ধানের মাথা জলের উপর জেগে আছে। দুই তটে স্তরে স্তরে সবুজ রঙের ঘনিমা ফুলে ফুলে উঠেচে, তারি মাঝখান দিয়ে বর্ষার খোলা নদীটি তা’র গেরুয়া রঙের ধারা বহন ক’রে ব্যস্ত হ’য়ে চ’লেচে, সমস্তটার উপর বাদল-সায়াহ্নের ছায়া। বৃষ্টি নেমে এলো—দূরে মেঘের ফাঁক দিয়ে সূর্য্যাস্তের একটা ম্লান আভা এই বৃষ্টিধারার আবেগের উপর যেন সান্ত্বনার ক্ষীণ প্রয়াসের মতো এসে প’ড়েচে।
আমার এই বোট ছাড়া নদীতে আর নৌকা নেই। এই জলস্থল আকাশের ছায়াবিষ্ট নিভৃত শ্যামলতার সঙ্গে মিল ক’রে একটি গান তৈরি ক’র্তে ইচ্ছে ক’র্চে, কিন্তু হয় তো হ’য়ে উঠ্বে না। আমার দুই চক্ষু এখন বাইরের দিকে চেয়ে থাকতে চায়,—খাতার দিকে চোখ রাখ্বার এখন সময় নয়। অনেক দিন বোলপুরে শুক্নো ডাঙায় কাটিয়ে এসেচি, এখন এই নদীর উপর এসে মনে হ’চ্চে,—পৃথিবীর যেন মনের কথাটি শুন্তে পাওয়া যাচ্চে। নদী আমি ভারি ভালোবাসি; আর ভালোবাসি আকাশ। নদীতে আকাশে চমৎকার মিলন, রঙে রঙে, আলোয় ছায়ায়, —ঠিক যেন আকাশের প্রতিধ্বনির মতো। আকাশ পৃথিবীতে আর কোথাও আপনার সাড়া পায় না এই জলের উপর ছাড়া।
আজ রাত্রের গাড়িতেই ক’ল্কাতায় যাবো মনে ক’রে ভালো লাগ্চে না। ইতি ২ শ্রাবণ, ১৩২৯।