৫২

কলিকাতা

 ক’ল্‌কাতায় সব দলবল নিয়ে উপস্থিত হ’য়েচি। আমাদের জোড়াসাঁকোর বাড়ি একতলা থেকে তিনতলা পর্য্যন্ত কলরবে মুখরিত হয়ে উঠেচে; পা ফেল্‌তে সাবধান হ’তে হয়, পাছে একটা না একটা ছেলেকে মাড়িয়ে দিই, এমনি ভিড়। আমি অন্যমনস্ক মানুষ, কোন্ দিকে তাকিয়ে চলি তা’র ঠিক নেই। ওরা যখন-তখন কোনো খবর না দিয়ে আমার পায়ের কাছে এসে প’ড়ে প্রণাম করে। কখন্ তাদের মাটির সঙ্গে চ্যাপ্টা ক’রে দিয়ে তাদের উপর দিয়ে চ’লে যাবো এই ভয়ে এই ক-দিন ধূলোর দিকে চেয়ে চেয়ে চ’ল্‌চি।

 মেয়ের দলও এবার নেহাৎ কম নয়। নুটু থেকে আরম্ভ ক’রে অতি সূক্ষ্ম অতি ক্ষুদ্র লতিকা পর্য্যন্ত। ননীবালা তাদের দিনরাত সাম্‌লাতে সাম্‌লাতে হয়রাণ হ’য়ে প’ড়েচে। কিন্তু আমাকে দেখ্‌বার লোক কেউ নেই; স্বয়ং এণ্ড্‌রুজ সাহেব পাঞ্জাবে আকালীদের নাকাল সম্বন্ধে তদন্ত ক’র্‌তে অমৃতসরে চ’লে গেচেন। লেভি সাহেবেরা গেচেন বোম্বাই; বৌমা আছেন শান্তিনিকেতনে। সুতরাং আমাকে ঠিকমতো শাসনে রাখ্‌তে পারে এমন অভিভাবক কেউ না থাকাতে আমি হয় তো উচ্ছৃঙ্খল হ’য়ে যেতে পারি এমন আশঙ্কা আছে। আপাততঃ যা-তা বই প’ড়্‌তে আরম্ভ ক’রেচি, কেউ নেই আমাকে ঠেকায়। তা’র মধ্যে লজিকের বই একখানাও নেই। এমনি ক’রে পড়া ফাঁকি দিয়ে বাজে পড়া প’ড়ে সাতাশ বছর কেটে গেল, এখন চেতনা হওয়া উচিত ছিল, কিন্তু তা’র কোনো লক্ষণ নেই।

 আমি ভেবেছিলুম—সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি তোমাদের ছুটি; তা যখন নেই তখন শারদোৎসব দেখা তোমাদের পক্ষে অসম্ভব; কারণ ওটা হ’চ্চে ছুটির নাটক। ওর সময়ও ছুটির, ওর বিষয়ও ছুটির। রাজা ছুটি নিয়েচে রাজত্ব থেকে, ছেলের ছুটি নিয়েচে পাঠশালা থেকে। তাদের আর কোনো মহৎ উদ্দেশ্য নেই কেবল একমাত্র হ’চ্চে—“বিনা কাজে বাজিয়ে বাঁশী কাট্‌বে সকল বেলা।” ওর মধ্যে একটা উপনন্দ কাজ ক’র্‌চে, কিন্তু সেও তা’র ঋণ থেকে ছুটি পাবার কাজ।

 তোমরা যখন ছুটি পাবে, আমরা তখন বোম্বাই অভিমুখে রেলপথে ছুট্‌চি। কিন্তু সে-পথ মোগলসরাই দিয়ে যায় না, সে হ’চ্চে বেঙ্গল নাগপুর লাইন। তা’রপরে বোম্বাই হ’য়ে মাদ্রাজ, মাদ্রাজ হ’য়ে মালাবার, মালাবার হ’য়ে সিংহল, সিংহল হ’য়ে পুনশ্চ বোম্বাই। এমনি বোঁ বোঁ শব্দে ঘুরপাক খেতে খেতে অবশেষে একদিন নভেম্বর মাসের কোন্ তারিখে শান্তিনিকেতনে এসে একখানা লম্বা কেদারার উপর চিৎ হ’য়ে প’ড়্‌বো। তা’রপরেই আবার শুরু হবে সাতই পৌষের পালা। তা’রপরে আরো কত কী আছে তা’র ঠিক নেই। ছুটির নাটক লিখ্‌লেই কি ছুটি পাওয়া যায়? আমি ইস্কুল পালিয়েও ছুটি পেলুম না, ইস্কুলের আবর্ত্তের মধ্যে লাটিমের মতো ঘুর্‌তে লাগ্‌লুম। অঙ্ক ক’ষতে ঢিলেমি ক’র্‌লুম, আজ চাঁদার অঙ্কের ধ্যান ক’র্‌তে ক’র্‌তে আহার নিদ্রা বন্ধ। ইংরেজি প্রবাদে এই রকম ব্যাপারকেই ব’লে থাকে ভাগ্যের বিদ্রূপ।

 এতদিন পরে আমাদের এখানে রৌদ্রোজ্জ্বল চেহারা দেখা দিয়েচে। মাঝে মাঝে বৃষ্টি হ’চ্চে কিন্তু সে শরতের ক্ষণিক বৃষ্টি। দিন সুন্দর, রাত্রি নির্ম্মল, মেঘ রঙিন, বাতাস শিশির-স্নিগ্ধ। এ হেন কালে অতলস্পর্শ অকর্ম্মণ্যতার মধ্যে ডুবে থাকাই ছিল বিধির বিধি, কিন্তু ভাগ্যের লিখন বিধির বিধিকেও অতিক্রম করে, এই কথা স্মরণ ক’রে দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে এই পত্র সমাপন করি। ইতি, ২৪ ভাদ্র, ১৩২৯।