৫৩

শান্তিনিকেতন

 ইতিমধ্যে আমার দৈনিক কার্য্যকলাপের একটুখানি scene ব’দলে গেছে। সেই বড়ো ঘরটা ছেড়ে দিয়েচি, সেটা রাস্তার ধারে থাকাতে যখন-তখন যে-সে এসে উৎপাত ক’র্‌তো। এখন এসেচি দক্ষিণের বারান্দার পূর্ব্ব কোণে, না’বার ঘরটার ঠিক বিপরীত প্রান্তে, একটি ছোটো ঘরে। এ ঘরটার গোড়াপত্তন তুমি বোধ হয় দেখেছিলে। আমার সেই কালো শ্লেট-বাঁধানো লেখ্‌বার টেবিলে ঘরের প্রায় সমস্ত জায়গা জুড়ে গিয়েচে, কেবল আর-একটিমাত্র চৌকি আছে। ঘরের মধ্যে লোকের ভিড় হবার জায়গা রাখিনি।

 এখন মধ্যাহ্ন, ক-টা বেজেচে ঠিক ব’ল্‌তে পারিনে, কারণ আমার ঘড়ি বন্ধ। বন্ধ না থাক্‌লেও-যে ঠিক সময় পাওয়া যেতো তা নয়; তুমি আমার সেই ঘড়ির পরিচয় জানো। এইটুকু ব’ল্‌তে পারি, কিছু পূর্ব্বেই একখানা পরোটা ডাল ও তরকারী সংযোগে আহার ক’রে লিখ্‌তে ব’সেচি।

 রৌদ্র প্রখর, শরতের শাদা মেঘ স্তরে স্তরে আকাশের যেখানে-সেখানে স্ফীত হ’য়ে প’ড়ে আছে, বাইরে থেকে শালিখ পাখীর ডাক শুনতে পাচ্চি, বামের রাস্তা দিয়ে ক্যাঁচ ক্যাঁচ ক’র্‌তে ক’র্‌তে মন্দগমনে গোরুর গাড়ি চ’লেচে, আমার ডানদিকের দক্ষিণের জানালা দিয়ে কচি ধানের ক্ষেতের প্রান্তে সুদূর তালগাছের সার দেখা যাচ্চে, তন্দ্রালস ধরণীর দীর্ঘনিশ্বাসটি নিয়ে আতপ্ত হাওয়া ধীরে ধীরে আমার পিঠে এসে লাগ্‌চে।

 এ রকম দিনে কাজ ক’র্‌তে ইচ্ছে করে না, এই মেঘগুলোর মতোই অকেজো হাওয়ায় মনটা বিনা কারণে দিগন্ত পার হ’য়ে ভেসে যেতে চায়। জানলার বাইরে মাঝে মাঝে যখন চোখ ফেরাই তখন মনে হয় যেন সুর-বালকেরা স্বর্গের পাঠশালা থেকে গুরুমহাশয়কে না ব’লে পালিয়ে এসেচে। আকাশের এ-কোণ ও-কোণ থেকে সবুজ পৃথিবীর দিকে তা’রা উঁকি মার্‌চে। হাওয়ায় হাওয়ায় তাদের কানাকানি শুনে আমার মনটাও উতলা হ’য়ে দৌড় মার্‌বার চেষ্টা কর্‌চে।

 কিন্তু আমরা যে পৃথিবীর ভারাকর্ষণের টানে বাঁধা; মাটি আমাদের পা জড়িয়ে থাকে, কিছুতেই ছাড়্‌তে চায় না। অতএব মনের একটা ভাগ জানালার বাইরে দিয়ে যতই উড়্‌তে থাক্‌, আর-একটা ভাগ ডেস্কের সঙ্গে যুক্ত হ’য়ে পত্ররচনায় ব্যস্ত। দূরে কোথাও যদি যাবার ব্যবস্থা হয়, মনটাকে রেলভাড়ার কথা ভাব্‌তে হয়; দেবতার মতো শরতের মেঘের উপর চ’ড়ে মালতী-সুগন্ধী হাওয়ার হিল্লোলে বেণুবনের পাতায় পাতায় দোল খেয়ে খেয়ে বিনা ব্যয়ে ভ্রমণ ক’রে বেড়াতে পারে না। ইতি, ৩১ ভাদ্র, ১৩৩০।