ভারতবর্ষে/ভারতবর্ষে—জয়পুর

ভারতবর্ষে—জয়পুর।

 “কলিকাতায় ইংরাজী ভারতবর্ষ; কাশীতে ব্রাহ্মণের ভারতবর্ষ; আগ্রায় মোগলের ভারতবর্ষ; এখানে রাজাদের ভারতবর্ষ, উপন্যাসের ভারতবর্ষ, গীতিনাট্যের ভারতবর্ষ। ... ... ... এই রাজপুতানাকে কেহই জয় করিতে পারে নাই। কত বিভিন্ন জাতি ভারতবর্ষের প্রভু হইল, কিন্তু সকলেরই বিরুদ্ধে রাজপুতেরা আপনাদের স্বাধীনতা রক্ষা করিয়া আসিয়াছে। রামায়ণের পৌরাণিক যুগে ইহারা যে আর্য্যজাতি ছিল, এখনও ইহারা সেই আর্যজাতিই আছে। এখানকার রাজার বংশ-সুত্র ১৩৯ পুরুষ ভেদ করিয়া সূর্য্যবংশে সমুত্থিত—যে সূর্য্যবংশ হইতে মহানুভব রামচন্দ্রের উৎপত্তি। ইনি এখনও, সেই পুরাতন হিন্দু রাজাদের প্রথা অনুসারে, মনুর ব্যবস্থা অবলম্বন করিয়া রাজ্য শাসন করিয়া থাকেন। রাজার অধীনস্থ ঠাকুরেরাও চন্দ্র সূর্য্য বংশ হইতে প্রসূত—ইঁহাদেরও বংশাবলী কালের অন্ধকারে মিলাইয়া গিয়াছে। এখানকার সাধারণ লোকেরাও গৌরবর্ণ আর্য্যজাতি হইতে প্রসূত—ইহারা বিভিন্ন শ্রেণীতে ও গোত্রে বিভক্ত। রাজপুতমাত্রই জাতিতে ক্ষত্রিয়। এই যোদ্ধৃ জাতি ব্রাহ্মণ-ব্যতীত আর কাহাকেও আপনাদের অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ বলিয়া স্বীকার করে না। এই নিমিত্ত, এখানকার একজন কৃষকও আপনাকে রাজার সমকক্ষ বলিয়া মনে করে; “রাজপুত” অর্থাৎ রাজপুত্র বলিয়া আপনার পরিচয় দেয়। ইহাদের মধ্যে সদৰ্প পুরুষোচিত আত্ম-মর্য্যাদার ভাব বিদ্যমান; একটি অশ্ব, একটি বল্লম, একটি ঢাল ইহাদের সম্বল; যুদ্ধ উপস্থিত হইলে, ইহারা নিজ-নিজ গোত্র-পতির অধীনে যুদ্ধে অগ্রসর হয়; আপনাদের নগর ও দেবতাকে রক্ষা করিবার জন্য পিতৃস্বরূপ রাজার পতাকাতলে আসিয়া সম্মিলিত হয়।

 হোটেল হইতে জয়পুরের যাহা কিছু দেখিতে পাই তাহাতে মনে হয় যেন একটি নূতন জগতে আসিয়াছি। সাদা-সাদা ছোট-ছোট দুর্গভূষিত পাহাড় এবং দুর্গের বুরুজ-শ্রেণী দিগন্তে বিস্তৃত। যুরোপীয় মধ্যযুগের সরঞ্জাম এই উষ্ণ প্রাচ্যদেশে দেখিব আশা করি নাই। রাস্তায় ছোট-ছোট গাধার পাল, তাহার মধ্যে দলে দলে স্ত্রীলোকেরা গান গাইতে গাইতে চলিয়াছে; সওয়ারেরা উৎকৃষ্ট আরব ঘোড়া ছুটাইয়া চলিয়াছে; কোমর-বন্ধে ঢাল, পার্শ্বে তলবার, মাথায় লাল পাগ্‌ড়ি, ইহাদের বড় বড় দাড়ি বিভক্ত হইয়া দুই পাশে বিস্তৃত—এবং বামে ডাহিনে কাঁটার ন্যায় খাড়া হইয়া উঠিয়াছে; ইহার খুব আস্ফালন সহকারে চলিয়াছে। ভারতবর্ষে আসিয়া সাধারণ লোকের মুখে যেরূপ স্ত্রী-সুলভ কোমলতা, আলস্য ও স্বপ্নময় ভাব সচরাচর দেখা যায়, ইহাদের মুখে সেরূপ কোন ভাব নাই। ইহারা খুব কার্য্যতৎপর। পেয়াদা, ঘোড়-সওয়ার, উট, হাতী, বড় বড় প্রকাণ্ড গরুর গাড়ি, এবং ছোট-ছোট গাধায় রাস্তা ভারাক্রান্ত; ধূলা ও রৌদ্রের মধ্য হইতে ইহাদের গোলযোগ শোনা যাইতেছে।

 রাস্তা দিয়া চলিতে চলিতে আধ ঘণ্টার মধ্যেই দুর্গবদ্ধ-নগর-প্রাচীরের একটি তোরণের নিকট আসা যায়। সমুচ্চ বুরুজশ্রেণীর তল দিয়া একটি দুর্গ-সেতু পার হইতে হয়, তাহার পর একটি ভিতরকার প্রাঙ্গণ, সেই প্রাঙ্গণে উটেরা বোঝা খালাস করিবার জন্য হাঁটু গাড়িয়া বসিয়াছে। এই প্রাঙ্গণ পার হইবামাত্র গীতিনাট্যের দৃশ্য-পটের ন্যায় হঠাৎ একটা অদ্ভুত অপরূপ, কুয়াশাবৎ, বর্ণনাতীত দৃশ্য নেত্রসমক্ষে উপস্থিত হয়।

 গোলাপি রঙের দৃশ্য সর্ব্বপ্রথমেই নেত্রসমক্ষে উপস্থিত। এখানে সকলই গোলাপী। পাঠক যেন কল্পনা করেন, এখানকার যে-কোন ছবি তার সম্মুখে ধরিব, সকলই গোলাপী রঙ্গে চিত্রিত। সুপ্রশস্ত রাজপথের দুই ধারে গোলাপী বাড়ি, গোলাপী দেবমন্দির, গোলাপী প্রাসাদ, গোলাপী সৌধ-চূড়া এবং গোলাপী তাম্বু-আকারের গৃহ। এই গোলাপী রং একটু ফিঁকা ও কোমল সুকুমার ধরণের; এই রংটি রাস্তার এক সীমা হইতে আর এক সীমা পর্য্যন্ত বরাবর সিধা চলিয়াছে। গোলাপী বাড়ি, দোকান, সব ঘেঁষাঘেঁষি পাশাপাশি সিধাভাবে চলিয়াছে, ক্রমে সমস্তই যেন অপূর্ব্ব গোলাপী রঙের বাম্পে মিলাইয়া গিয়াছে। এই রঙ্গীন বাষ্পের মধ্যে একটিও কালো দাগ নাই, একটিও বিলাতী গাড়ি নাই; রাস্তার জনতার মধ্যেও বিচিত্র বর্ণচ্ছটা ভিন্ন আর কিছুই দেখা যায় না। রাস্তার দুই ধারের বাঁধানো-পদপথের উপর খোলা বাজার বসিয়াছে, দোকানদারেরা হাঁটু গাড়িয়া সারি সারি বসিয়া আছে এবং সেই পদ-পথের উপর বিছানো লাল নীল রঙের শতরঞ্জির উপর নানা প্রকার চাকচিক্যময় দ্রব্য সাজানো রহিয়াছে। জরির চটি জুতা, রাশীকৃত কলা ও নারিঙ্গি নেবু, রংকর মূর্ত্তি, রৌদ্রদগ্ধ নানা প্রকারের কাপড়, কি বামে কি ডাহিনে যে দিকে চাই, সকলই চক্‌চক্‌ করিতেছে, ঝক্‌ঝক্‌ করিতেছে। একটি সমস্ত দিন ধরিয়া জয়পুরে ঘুরিয়া বেড়াইতে ইচ্ছা করে—সমস্ত জিনিসের খুঁটিনাটি মনে করিয়া রাখিতে ইচ্ছা করে। এখানে চক্ষুর ক্লান্তি উপস্থিত হইবার সময় নাই। আমি কোচ্‌মানকে এত বলিতেছি “আস্তে আস্তে”— তবু সে গাড়ি শীঘ্র হাঁকাইবে। শেষে কি করি, গাড়ি হইতে নাবিয়া পড়িলাম—এবং আপনার ইচ্ছামত ঢিমাচালে চলিতে লাগিলাম।

 রাজপুত ঠাকুরেরা ও কর্ম্মচারীগণ, নাটকের অভিনেতাদিগের ন্যায়, ফুল-কাটা জরির পোষাক-পরিহিত এবং ইহাদের বিপুল গর্ব্বিত শ্মশ্রুরাজি হাত-পাখার আকারে মণ্ডলাকারে বিস্তৃত; মসৃণদেহ সুন্দর অশ্ববৃন্দ—ঢাল-তলোবারধারী ঔপন্যাসিক সৈনিকগণ, বিদ্যালয়ের ছাত্র, প্রাসাদের রক্ষিদল, নগ্নশিশু ক্রোড়ে করিয়া অশ্বারোহী স্ত্রীলোক—এই সমস্ত পাৎলা-কুয়াশাচ্ছন্ন রাস্তা দিয়া সারি সারি চলিয়াছে। দোকানদারেরা তাহাদিগের দোকান হইতে হাত বাড়াইয়া সস্মিত মুখে আমাকে নানাপ্রকার রংকরা পাথরের দেবমূর্ত্তি প্রদর্শন করিতেছে, সকল দেয়ালে নীলরঙে নানাপ্রকার ছবি আঁকা; হাতি, চিতা, গাছ, রেলগাড়ির কল— হাস্যজনক বড় বড় আলখাল্লা কোর্ত্তা-পরা টক্‌টকে লাল আড়ষ্টভাবে-দণ্ডায়মান যুরোপীয় মূর্ত্তি চিত্রিত। ৩০ বৎসর বয়সের পূর্ণবয়স্ক লোকেরা ঘুড়ি উড়াইতেছে ও স্কুলের ছাত্রদিগের ন্যায় ছুটাছুটি করিতেছে। এই সমস্ত শিশুপ্রকৃতি লোকেরা হাসিতেছে খেলিতেছে— ইহাদিগকে দেখিয়া মনে হয় কোন কবি অদ্ভূত-রসপূর্ণ কল্পনার খেয়ালে এমন একটি স্বপ্নজগৎ সৃষ্টি করিয়াছেন যেখানে সকলই লঘুপ্রকৃতি, অদ্ভুত, সুখী, হাওয়ার-ন্যায়-ফুর্‌ফুরে—যেখানে কোন দুঃখ নাই, কোন কুৎসিত বস্তু নাই। এই জগতের লোকেরা জন্তুদিগের সহিত ভ্রাতৃভাবে একত্র বাস করিতেছে, ইহারা আমাদিগের অপেক্ষা ঢের সরল ও খোলা-প্রাণ। এই দেখ ছোট ছোট গাধা ও উটের সারি; উটেরা হেলিয়া-দুলিয়া ধীরগতিতে চলিয়াছে এবং রাস্তার ভীড় ছাড়াইয়া আপনাদিগের উন্নত কণ্ঠ উৰ্দ্ধে উত্তোলন করিয়াছে; গৃহের ছাদে কটা-কটা বানরেরা বসিয়া আছে; ঐ দেখ কতকগুলি গরু, উহাদের বড় বড় হরিদ্বর্ণ সিং; উহাদের দেহ সমস্ত সাদা—মনে হয় যেন মার্ব্বল পাথরে খুদিয়া-বাহির-করা।

 কতকগুলি কুকুর দেখিলাম, তাহদের গা হল্‌দিয়া, নীল ও লাল রঙে রঞ্জিত। আর একটু দূরে একটা চকের মধ্যে পায়রার ঝাঁক দেখিতে পাইলাম, বৃহৎকায় হস্তীরা যাইবামাত্র তাহারা উড়িয়া অন্যত্র বসিতেছে। এই সকল জীবন্ত পশুপক্ষীর মধ্যে, দেবত্বপ্রাপ্ত বৃক্ষ, হস্তী, বানর প্রভৃতির ক্ষুদ্র মূর্ত্তিসকলও ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র মন্দিরে প্রতিষ্ঠিত। একটা বৃহৎ চৌমাথা রাস্তা—এই চৌমাথা দিয়া আর একটা রাস্তা ধরা গেল। এ রাস্তাটাও পূর্ব্বের ন্যায় বৃহৎ, সিধা ও গোলাপী রঙে রঞ্জিত। এখানেও কতকগুলি মন্দির দেখিলাম, হস্তীর প্রস্তরমূর্ত্তিসকল মন্দিরের পাদদেশে প্রতিষ্ঠিত। এই গোলমালের সীমা নাই—পথিকের দল, ফুলের রাশি, গর্দভ, উষ্ট্র, ঘোড়সওয়ার, দোকানদার প্রভৃতিতে পরিপূর্ণ। পায়রার ঝাঁক্ মাটিতে খুঁটিয়া খুঁটিয়া খাইতেছে, তাহার মধ্যে শত শত নিদ্রালু নির্ব্বোধ গাভী শয়ান—লোকজনের গোলমালে তাহাদের ভ্রক্ষেপ মাত্র নাই। কতকগুলি বালক বাঁশের লম্বা কচি-কচি ডাল লইয়া দণ্ডায়মান—ভক্তেরা সেই সকল ডাল ক্রয় করিয়া গাভীদের পদতলে উপহার দিতেছে; গাভীরা ঋণস্বরূপ উহা গ্রহণ করিয়া প্রশান্তভাবে চর্ব্বণ করিতেছে। বৃক্ষশাখা হইতে শেওলাপড়া মাটির ভাঁড়সকল ঝুলিতেছে, তাহার উপর ঝাঁকে-ঝাঁকে টিয়া পাখি আসিয়া বসিতেছে—তাহাদের গোল-গোল সুন্দর মাথার চারিধারে লোহিত রেখার ঘের। ... ... হঠাৎ ঘোড়ার পদক্ষেপশব্দ;—এই গর্ব্বিত অশ্বারোহীবৃন্দ না জানি কারা! অশ্বদিগের মসৃণ গাত্র চিক্‌চিক্‌ করিতেছে—সুন্দর অশ্বারোহীদিগের অস্ত্র সকল চক্চক্ করিতেছে। ইনি রাজার ভ্রাতা—ইঁহার পশ্চাতে রাজপুত ঠাকুরেরা, পুরোভাগে আসা-সোটাধারী পদাতিকেরা দৌড়িতেছে। ইঁহার মাথায় মখ্‌মলের পাগড়ি—গায়ে সবুজরঙের ফুলকাটা চাপকান, নিজ অশ্বকে সম্পূর্ণ আয়ত্ত করিয়া নাচাইয়া নাচাইয়া চালাইতেছেন। ক্ষণকালের জন্য ইহাকে দেখিতে পাইয়াছিলাম। ইঁহার উদার সাহসিক মুখশ্রীতে উচ্চকুল, পুরাতন শোণিত, চিরাভ্যস্ত প্রভুত্বের ভাব যেন স্পষ্ট অনুভব করা যায়। ইনি একজন প্রকৃত ক্ষত্রিয়, ভারতবর্ষের আদিম বিজয়ীগণের সাক্ষাৎ বংশধর।

 হস্তিবৃন্দ হস্তিশালায় প্রবেশ করিল। ঐ দেখ, সাতটা হস্তী— কৃষ্ণবর্ণ প্রকাণ্ড স্তুপাকৃতি, গম্ভীর “ফিলজফর”, ধীরগতি, স্বকীয় দেহনিম্নস্থ কোলাহলময় তাবৎ জীবপ্রবাহের উপর কৃপাদৃষ্টি করিতেছে। শুণ্ডদ্বারা মৃত্তিকা ঈষৎ ছুঁইয়া, প্রকাণ্ড মস্তকের উপর মাহুতকে ধারণ করিয়া ইহারা একে একে দ্বারমধ্যে অন্তৰ্হিত হইল। মানুষের ন্যায় পা নোয়াইয়া, কোমল পদতল ধীরে ধীরে বাহির করিয়া, ইহারা চলিতে থাকে—ছায়ার ন্যায় একেবারে নিস্তব্ধ। ইহাদের প্রকাণ্ড বিষণ্ণ মস্তকের অভ্যন্তরে না জানি কি গভীর চিন্তা প্রবাহিত হইতেছে, যে সকল নিকৃষ্ট জীবজন্তু ও লোকজন ইহাদের সন্মুখ দিয়া যাইতেছে তাহাদের প্রতি দৃক্‌পাত নাই। ইহাদিগকে দেখিলে বুঝা যায়, কেন গজমুণ্ডধারী গণেশ জ্ঞানের দেবত হইয়াছেন। ... ...

 প্রতিমুহূর্ত্তে চিত্র পরিবর্ত্তিত হইতেছে। আমি এই চলন্ত ছবি আঁকিবার চেষ্টা করিতেছি। প্রাসাদের একটা উচ্চ দ্বারের সম্মুখে স্থূলচর্ম্মী জন্তুসকল, উষ্ট্র, লোকজন, বাজপক্ষীর ঝাঁক্। তোরণের উপরে কুলাঙ্গির অভ্যন্তরে একটা লোহিত হস্তিমূর্ত্তি সুসুপ্ত—তাহার সম্মুখে লোকেরা ঘুরিতেছে, চীৎকার করিতেছে। এবং তীক্ষ্ণধ্বনি তুরি ভেরী হইতে হিন্দু-সঙ্গীত উত্থিত হইতেছে।

 সেই প্রশস্ত মুক্তস্থানের চতুর্দ্দিকে, মন্দির, স্মরণস্তম্ভ, বিশ্ববিদ্যালয়, প্রাসাদশ্রেণী বিরাজিত। ইহাদের মধ্যে একটি অট্টালিকা ঘোর গোলাপীবর্ণ, পিরামিডের ন্যায় সমুত্থিত। ইহার নয় তলা ও শত চূড়া এবং ইহার চৌষট্টি বহিরুদগত গবাক্ষদ্বার; বারাণ্ডা, স্তম্ভশ্রেণী, ও প্রস্তর-খোদিত শত শত কৃত্রিম পুষ্পে ইহা বিভূষিত। সমস্ত গঠনপ্রণালী বাষ্পবৎ বায়ুবৎ লঘু, অসাধারণ ও অদ্ভুত। ইহা বায়ু-প্রাসাদ। এই নামটি অতি সুন্দর। এই প্রকার, নগরের চারিধারের ছোট-ছোট পাহাড়ের উপর মেঘ-প্রাসাদ ও সূর্য্যমন্দির সকল দেখিতে পাওয়া যায়। নগরের অপর প্রান্তে যে গোলাপী রঙের দ্বার দেখা যায় তাহার নাম “পান্নাদ্বার।” আমরা যেন প্রাচ্যদেশের পরী-উপাখ্যানের দৃশ্য-মধ্যে আসিয়া পড়িয়াছি।

 তুরীনিনাদ শোনা যাইতেছে। করতালের এরূপ ঘোরতর রব হইতেছে যে, অন্যদিকে মুখ ফিরাইয়া থাকিতে হয়। শবসহযাত্রী উল্লাসপূর্ণ এক দল বাদক দ্রুতপদে চলিয়াছে—সুক্ষ্ম শুভ্র বস্ত্রে আচ্ছাদিত মৃতদেহকে বাঁশে বাঁধিয়া লোকেরা লইয়। যাইতেছে। পরিবারবর্গ করতাল বাজাইতে বাজাইতে, লাফাইয়া লাফাইয়া চলিয়াছে এবং মধ্যে মধ্যে “রাম রাম” বলিয়া চীৎকার করিয়া উঠিতেছে। শববাহীদল অন্তৰ্হিত হইল। এক্ষণে দেখিতেছি, শৃঙ্খলবদ্ধ শিকারী কুকুরবৃন্দ—বেগ্‌নি রঙের পরিচ্ছদে আবৃত। উদ্যানে খাটয়ার উপর, মহারাজার শিকারী নেক্‌ড়ে বাঘ, সুনম্য কৃশদেহ অদ্ভুত জীব, দেখিতে উদার-প্রকৃতি, ইহার তীক্ষ্ণ চক্ষে যেন বিদ্যুত খেলিতেছে, রক্ষকেরা মুঠা বাড়াইয়া দিতেছে, আর সে কণ্টকিত জিহ্বার দ্বারা তাহা চাটতেছে। অন্যত্র, একটা বিবাহ-ব্যাপার। চল্লিশ জন গায়িকা স্ত্রীলোক, জরদ রঙের রেশ্‌মি কাপড়ে সজ্জিত হইয়া ভূতলে বসিয়া আছে। কন্যার বয়স দশ বৎসর, সে কেবল গায়িকাদিগের মধ্যে দাঁড়াইয়া আছে। রাস্তার শেষভাগে পদ-পথের উপর একটা গরাদের পিছনে, দশটা নরাহারী ব্যাঘ্ররাজ মস্তক নত করিয়া তাহাদের কারাগৃহের মধ্যে ধীরে ধীরে পায়চালি করিতেছে। লোকেরা উহাদিগকে “সাহেব” অর্থাৎ প্রভু বলিয়া সম্বোধন করিতেছে—“সাহেব” নামের উপযুক্ত বটে। উহাদের মধ্যে যাহাকে সর্ব্বাপেক্ষা দেখিতে ভাল, সে ষোলটা স্ত্রীলোককে বধ করিয়াছে। ... ... ... ... ... ...

 এই বিচিত্র দৃশ্যের মধ্যে, একটি দৃশ্য প্রায়ই দেখা যায়—সে দৃশ্যটি বড়ই সুন্দর। ছোট ছোট ছেলেদের নগ্নদেহের কি নমনীয়তা, কি লাবণ্য! যত দেখি ততই ভাল লাগে—দেখিয়া ক্লান্ত হই না। ছোট-ছোট ছেলেমেয়েদিগের সুগোল ট্যাবাটোবা ক্ষীণদেহ দেখিতে অতি চমৎকার। দীর্ঘ কৃষ্ণবর্ণ কেশগুচ্ছ তাহাদের সুন্দর বিহ্বল মুখের উপর এবং সুকুমার-গঠন সুন্দর বক্ষের উপর ঝুলিয়া পড়িয়াছে। সেই নবীন পেশীরাশি ও শোণিতের বল ও স্বাস্থ্য যেন স্পষ্ট অনুভব করা যায়। সে অতি চমৎকার। তাহাদের শ্যামবর্ণ দেহচর্ম্ম, আলোক ও বিশুদ্ধ বায়ুতে আচ্ছন্ন —তাহাতে আলোক ও ছায়া কেমন সুন্দররূপে মিশিতেছে। যুবতী স্ত্রীলোকদিগের বক্ষের নিম্নদেশ হইতে উদরের মধ্যদেশ পর্য্যন্ত অনাবৃত—তাহারা যেরূপ পরিচ্ছদ পরে তাহা অতি সুন্দর। তাহাদের পরিহিত কোমল পরিচ্ছদ যেরূপ দেখিতে মধুর, নয়ন-তৃপ্তি কর, সাদাসিধা ও শান্তিময় এমন আর কোথাও নাই। যে সকল বালিকারা অপেক্ষাকৃত কৃশ, তাহদের আভ্যন্তরিক দেহপঞ্জরের আন্দোলন স্পষ্ট যেন দেখিতে পাওয়া যাইতেছে।

 একটা মন্দিরের মধ্যে প্রবেশ করিলাম, তাহার প্রকাণ্ড সোপান রাস্তা পর্য্যন্ত আসিয়া পড়িয়াছে। নিম্নদেশে, উষ্ট্রেরা হাঁটু গাড়িয়া ঘুমাইতেছে এবং সোপানের ধাপের উপর কুকুরেরা রৌদ্রে শুইয়া আছে। সোপান দিয়া উঠিয়া একটা প্রাঙ্গণের সম্মুখে আসিলাম, সেই মার্ব্বল-আচ্ছাদিত প্রাঙ্গণে গাভীবৃন্দ মুক্তভাবে বিচরণ করিতেছে। ইহার এক কোণে দুইটি পবিত্র বৃক্ষ প্রতিষ্ঠিত—একটি পুরুষ-বৃক্ষ বট এবং আর একটি স্ত্রী-বৃক্ষ, তাহার নাম পিপ্পল। একজন বৃদ্ধ প্রথম বৃক্ষটির চারিদিকে দ্রুতভাবে প্রদক্ষিণ করিতেছে, আর একটি বৃদ্ধ দ্বিতীয় বৃক্ষটির পাতায় জল ঢালিতেছে। ইহার ধারে আর একটি দ্বিতীয় প্রাঙ্গণ, ইহা স্তম্ভ-পরিধৃত বারাণ্ডার দ্বারা বেষ্টিত; এইখানে, ছায়াতলে বসিয়া লোহিত বসনাবৃত কতকগুলি স্ত্রীলোক, পুরোহিতের মুখ হইতে নাকী-সুরে উচ্চারিত রামায়ণ-গান শান্তভাবে শুনিতেছে। ঘোমটার নীচে যে সুন্দর মুখগুলি দেখা যাইতেছে, তাহারা যে খুব ধ্যানে মগ্ন এরূপ বোধ হয় না। এখানে সকলেই এক পরিবারের-মত অবস্থিত। পুরোহিতের গলায় মালা, তিনি আসনে উপবিষ্ট, রামায়ণ পড়িবার সময় কখন সুর উচ্চে উঠিতেছে, কখন বা নীচে নাবিতেছে—এবং সেই ছন্দানুসারে তাঁহার দেহ আন্দোলিত হইতেছে। অনেকগুলি চড়াইপাখী এই ভক্তবৃন্দের মধ্যে নির্ভয়ে বিচরণ করিতেছে, এবং বড় বড় কাক, নিদ্রিত গরুদের কাঁধের উপর লাফাইয়া লাফাইয়া বসিতেছে। হিন্দুধর্ম্মেরই এইটি বিশেষ লক্ষণ, এই ধর্ম্ম মুক্তবায়ুতে অনুষ্ঠিত। পূজার এই পবিত্র স্থান—এইখানে, মন্দুরা, পক্ষীশালা ও মন্দির সকলই একত্রিত। পুরোহিতের পশ্চাতে, দালানের প্রান্তদেশে, অন্ধকারাবৃত একটা দেবসিংহাসন, তাহাতে একটা পুত্তলিকা দেখিতে পাওয়া যায়—কালো মুখ-ওয়ালা একটি ছোট পুতুল পার্ব্বতী, লাল-কাপড়-পরা দুটি সিংহ পাহারা দিতেছে। তাঁহার নীচে তাঁহার স্বামী মহাদেব; স্বয়ং মহাদেব নহে—তাঁহার লিঙ্গমূর্ত্তি স্থাপিত। লিঙ্গমূর্ত্তি প্রাণের রূপক-চিহ্ন। বন্ধ্যা স্ত্রীলোকেরা এবং স্বামী-প্রার্থী যুবতীরা এইখানে প্রার্থনা করিতে আইসে।

 লোকপূর্ণ চৌরাস্তার অপর ধারে, মন্দিরের সম্মুখে, মহারাজার বিদ্যালয় সমুত্থিত। বায়ু মন্দিরের ন্যায় ইহারও গঠন অদ্ভূত ও রং গোলাপী; আমি দেখিয়া মনে মনে তারিফ করিতেছিলাম, এমন সময়ে বিদ্যালয়ের একজন ছাত্র আমাকে আহ্বান করিয়া ভিতরে লইয়া গেল। কালেজের প্রধান অধ্যক্ষের সহিত আমার পরিচয় করিয়া দেওয়া হইল; তিনি একটা অন্ধকেরে ছোট ঘরে, রাশীকৃত কেতাবের সম্মুখে বসিয়াছিলেন। তাহার হিন্দু-মুখশ্রী অতি মধুর, অতি সুন্দর, একটু চিন্তান্বিত, সমস্ত মুখের গঠন বিদ্যানুরক্ত ব্যক্তির ন্যায় কৃশ ও উন্নতললাটসম্পন্ন; তাঁহার পরিচ্ছদের মধ্যে সাদাসিধা একটি কালো রঙের লম্বাচাপ্‌কান মাত্র। অতি সংযত অঙ্গভঙ্গীর সহিত, খুব খাঁটি ইংরাজিতে দুইচারিটি স্বাগতোক্তি ব্যক্ত করিয়া আমাকে পাঠশালার মধ্যে লইয়া গেলেন। উচ্চ শ্রেণী ছাত্রদিগের পরীক্ষা নিকটবর্ত্তী হওয়ায় তাহারা তজ্জন্য বাড়িতেই প্রস্তুত হইতেছে, কালেজে আইসে না; কেবল কালেজের প্রথম ও দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রদিগকে দেখিলাম। স্তম্ভ-শোভিত বৃহৎ শালার মধ্যে, এক-এক দল ছাত্র, এক একটি শিক্ষককে ঘিরিয়া বসিয়া আছে। চৌকি নাই, বেঞ্চ নাই, ডেস্ক নাই। আমরা প্রবেশ করিবামাত্র সকলে দাঁড়াইয়া উঠিল এবং আগ্রহ ও ভদ্রতার সহিত অত্যন্ত অবনত ভাবে আমাদিগকে সেলাম করিল। কিন্তু পাঠশালার আর একটি কাম্‌রায় কতকগুলি ছাত্র দাঁড়াইল না—বসিয়া রহিল। প্রধানধ্যক্ষ বলিলেন, “এই বিশেষ শ্রেণীটি কেবল সূর্য্যবংশীয় রাজপুত্র ও ওম্‌রাহদিগের পুত্রদিগের জন্য রক্ষিত। ইহারা বংশগর্ব্বে গর্ব্বিত, তাই আমাদিগকে সেলাম করিল না।”

 এখানকার সমস্ত অধ্যাপনা-কার্য্য সরকারী ব্যয়ে দেশীয় অধ্যাপকগণ-কর্ত্তৃক সম্পন্ন হয় এবং পরীক্ষোর্ত্তীর্ণ ছাত্রেরা রাজসরকারে কাজকর্ম্ম পাইয়া থাকে। এখানে অঙ্কশাস্ত্র, ইংরাজি ভাষা ও সাহিত্য, ভারতবর্ষের বিভিন্ন ভাষা, পারস্যভাষা প্রভৃতি শিক্ষা দেওয়া হয়। ইহা ব্যতীত, কালেজের প্রধানাধ্যক্ষ বলিলেন, উচ্চশ্রেণীর ছাত্রদিগকে সংস্কৃত ও পালী ভাষা এবং ব্রাহ্মণ্য বৌদ্ধ পারস্য ও আধুনিক দর্শনশাস্ত্র বিষয়েও শিক্ষা দেওয়া হয়। ষ্টুয়ার্ট মিল এবং স্পেন্সর রীতিমত পঠিত হয়। কালেজের প্রধানাধ্যক্ষ বাঙ্গালী, তিনি স্বতঃপ্রবৃত্ত হইয়া আমার সঙ্গে বিবিধ বিষয়ে কথাবার্ত্তা কহিতে লাগিলেন; দেখিলাম, ইংলণ্ডে—এমন কি সমস্ত যুরোপে আজ কাল যাহা কিছু হইতেছে তিনি তদ্বিধয়ে সম্যক্‌ অভিজ্ঞ। তিনি ফরাসী পণ্ডিত বুর্নুফ্‌, বার্থলেমি স্যাঁৎ হিলোয়ার, বের্‌গেইন্‌ এবং ফরাসী দেশীয় সংস্কৃতপণ্ডিতদিগের উল্লেখ করিয়া প্রভূত প্রশংসা করিলেন। অবশেষে বলিলেন—“মোদ্দা কথা, যুরোপের বিষয় আমরা যাহা কিছু দেখিতে পাই, তাহা ইংলণ্ডের ভিতর দিয়া। ছাত্র যুবকেরা উচ্চশিক্ষার শ্রেণীতে প্রবেশ করিয়া ইংরাজি প্রাচীন সাহিত্য পাঠ করিতে আরম্ভ করে। সেক্সপিয়ার, মিল্টন, (হিন্দু মস্তিষ্কের পক্ষে সুন্দর আরম্ভ) তৎপরে অ্যাডিসন, পোপ্‌—তাহার পর দর্শন ও বার্ত্তা-শাস্ত্রের গ্রন্থকার লক্‌, হিউম, অ্যাডাম স্মিথ্‌, বৰ্ক, অষ্টাদশ ও উনবিংশতি শতাব্দীর লেখকগণ, স্পেন্সর পর্য্যন্ত সমস্তই পঠিত হয়। ইহার মধ্যে স্পেন্সরের প্রভাব সর্ব্বাপেক্ষা অধিক। তবে, ফরাসী ও জর্ম্মান লেখকদের রচনাসকল যাহা কিছু আমরা জানিতে পাই, তাহা মূল হইতে না—ইংরাজি অনুবাদ হইতে। সাধারণতঃ ফরাসী ও জর্ম্মান ভাষা আমরা প্রায় কেহই জানি না। কিন্তু আজকাল ইংলণ্ড ছাড়া অন্য দেশের প্রতিও আমাদের শ্রদ্ধা আকৃষ্ট হইতে আরম্ভ হইয়াছে। হেগেল, ফিখ্‌টের সহিত আমরা ঘনিষ্ঠরূপে পরিচিত নহি বটে, কিন্তু আমরা প্রাচ্য দর্শন-শাস্ত্র পাঠ করিয়া থাকি; বিশেষতঃ উপনিষদ্‌ ও প্রাচীন বেদান্ত-শাস্ত্র—উহার মধ্যেই স্পিনোজা, কাণ্ট্‌, হেগেল, সপেন্‌হয়ার সমস্তই একাধারে পাওয়া যায়।” ... ...

 একটু একটু করিয়া তিনি ক্রমশঃ মাতিয়া উঠিলেন—ক্রমে দেখিলাম তাঁহার স্বদেশীয় প্রাচীনশাস্ত্রের প্রতি প্রগাঢ় ভক্তি। তিনি বলিলেন, “পাঁচ ছয় বৎসর হইতে, আমাদের স্বদেশীয় শাস্ত্রের অনুকূলে স্রোত ফিরিয়াছে। ইতিপূর্ব্বে, ইংরাজি শিক্ষার প্রভাবে, কলিকাতার লেখকেরা হিন্দুধর্ম্মের অন্তর্নিহিত দুর্নীতি ও অযৌক্তিকতার উল্লেখ করিয়া বিস্তর নিন্দা করিত। এখন আমরা বুঝিতে আরম্ভ করিয়াছি, হিন্দুধর্ম্মের অতিরঞ্জিত উক্তিসকলের মধ্যেও একটা গভীর তত্ত্ব প্রচ্ছন্ন আছে। এখন আমাদের চিন্তাশীল লেখকেরা হিন্দুধর্ম্ম সমর্থন করিয়া থাকেন। আমাদের এখন এই উচ্চ আকাঙ্ক্ষাটি বলবতী হইয়াছে যে, আমরা আপনাতে আপনি ফিরিয়া আসি—আমাদের নিজত্ব ফিরিয়া পাই। দেখুন, মহারাজা এই ইংরাজী ব্যাপার-সকল এখানে তো প্রবর্ত্তিত করিয়াছেন, কালেজ, মিউজিয়ম্, শ্রমশিল্প-বিদ্যালয় স্থাপন করিয়াছেন, কিন্তু তিনি হিন্দুধর্ম্মের বিরুদ্ধে কিছুই করেন না। তাঁহার “অম্বর” প্রাসাদে কালীদেবীর সম্মুখে ছাগ বলি হয়। আমরা সাঙ্কেতিক চিহ্নের মধ্যে উদ্দেশ্য দেখিতে পাই, অক্ষরের মধ্যে অর্থ দেখিতে পাই—যে সকল বাহ্য অনুষ্ঠান অজ্ঞ সাধারণের জন্য কল্পিত হইয়াছে, তাহার মধ্যে গূঢ় অভিপ্রায় আছে। ভারতবর্ষের মধ্যে সেরা বুদ্ধিমান বাঙ্গালার নব্য সম্প্রদায় যে ইংরাজী একেশ্বরবাদ এত আগ্রহ ও উৎসাহের সহিত গ্রহণ করিয়াছিলেন, সেই একেশ্বরবাদের প্রতিকূলে আজকাল উল্টা স্রোত বহিতে আরম্ভ হইয়াছে। আমরা এখন বুঝিতেছি, উহা অপেক্ষা একটা গভীরতর তত্ত্বের আমরা অধিকারী এবং সেই তত্ত্বটি আমাদের দেশের নিজস্ব ধন। স্পেন্সরের লেখা আমরা পড়িতে ভালবাসি, তাহার কারণ স্পেন্সরও ঈশ্বরের ব্যক্তিগত অস্তিত্বের বিরোধী। তাঁহার মতে ঈশ্বরের সগুণ কল্পনা মানবীকরণের প্রকারান্তর মাত্র। তাঁহার মতে ঈশ্বরের স্বরূপ অজ্ঞেয়, অনির্ব্বচনীয়, এক, কিন্তু সেই এক হইতেই কল্পেকল্পে বিবিধ জীব ও সর্ব্বপ্রকার আকার ক্রমশঃ অভিব্যক্ত হইতেছে, তাই তাঁহার লেখা আমাদের বেদান্তের ব্রহ্মকে অনেকটা স্মরণ করাইয়া দেয়।”

 এই হিন্দু যাহা বলিলেন তাহা কি সত্য? ভারতবর্ষ আত্মচেতনা লাভ করিয়া সত্যই কি ইংলণ্ডীয় জ্ঞান বুদ্ধির অধীনতার যুগ-কাষ্ঠ আপনার স্কন্ধ হইতে দূরে নিক্ষেপ করিয়াছে? সত্যই কি ভারতবর্ষ জগৎ ও জীবন সম্বন্ধীয় স্বকীয় মতকে ইংরাজী জাতীয় মতের বিরুদ্ধে দাঁড় করাইবার চেষ্টা করিতেছে? মুসলমানের অত্যাচারে হিন্দুর মস্তিষ্ক অনেক দিন পর্য্যন্ত অসাড় হইয়াছিল, এখন কি ব্রিটানিয়ার শান্তি-ছায়ায় থাকিয়া সেই মস্তিষ্ক কাজ করিতে আরম্ভ করিয়াছে? কোথা হইতে এইরূপ হইল? যাহা হউক এ বড় আশ্চর্য্য দৃশ্য—দুইটি বিপরীত সীমার মানবজাতি পরস্পর মুখামুখী করিয়া অবস্থিত। এক দিকে উদ্যম, কার্য্যকরী ইচ্ছাশক্তি, ইংরাজী কেজোভাব, আর এক দিকে হিন্দুর চিন্তাকল্পন—সেই দার্শনিক স্বপ্নদর্শনের প্রবণতা, যাহার প্রভাবে চিন্তা বিজয়ী হইয়া বাসনা ও মায়ার উপর প্রভুত্ব লাভ করে এবং মনের সমস্ত কার্য্যকরী প্রবৃত্তিকে ধ্বংস করিয়া ফেলে।

 ... ... ... ... ... ... ...

 নেত্রের তৃপ্তি সাধন করিয়া, একাকী সেই আশ্চর্য্য গোলাপী রাস্তার মধ্যে আপনাকে হারাইয়া, বিচিত্রবর্ণের আননে প্রাণকে পূর্ণ করিয়া, এই জয়পুরের অদ্ভুত কল্পনায় উন্মত্ত হইয়া আজিকার দিনটা অতিবাহিত করিলাম। পরে, নগরের বাহিরে গিয়া যে পথটি অম্বরের দিকে গিয়াছে সেই পথটি অনুসরণ করিলাম। শুভ্র সুন্দর একটি কটিবন্ধের ন্যায় এই পথটি, ক্ষুদ্রতরু-প্রমাণ অদ্ভুত একপ্রকার হরিদ্বর্ণ ঘাসের মধ্য দিয়া ঘুরিয়া ঘুরিয়া গিয়াছে। এই কণ্টকাকীর্ণ পুষ্ট ঘাস অনেকদূর পর্যন্ত ভূমিকে আচ্ছন্ন করিয়া রাখিয়াছে। এই অচল কঠিন উদ্ভিজ্জ যেন পৃথিবী ছাড়া অন্য কোন গ্রহের বলিয়া মনে হয়। এই ঘাসের অরণ্যের অপর প্রান্ত হইতে, পুরাকালের ইমারৎসকল—শত শত অট্টালিকা, শত শত মর্ম্মরপ্রস্তরের মন্দির, উজ্জ্বল সূর্য্যরশ্মির মধ্যে ঝক্ ঝক করিয়া জ্বলিতেছে। লাল ও নীল পরিচ্ছদভূষিত নরনারীর দল আনন্দ-মনে চলিয়াছে। এত ময়ূরের ঝাঁক্‌ আমি কখনও দেখি নাই—আর এমন সুন্দর ময়ূর। পথের মধ্যেই ময়ূরেরা বিচরণ করিতেছে এবং তাহদের মণিময় পাখা সূর্য্যালোকে ঝিক্‌ ঝিক্‌ করিতেছে। এই ময়ূরেরা মুক্ত অথচ পোষা, ইহারা কাহারও সম্পত্তি নহে এবং বিশ্বস্ত ভাবে লোকের মধ্যে বাস করিতেছে। সকল প্রকার নিরীহ জীবজন্তু হিন্দুদিগের নিকট পবিত্র; ময়ূরও এই কারণে হিন্দুদিগের সেব্য—তাহাদিগকে ছোলা খাইতে দেওয়া লোকে পুণ্য কার্য্য বলিয়া মনে করে। আমার ভৃত্য ছেদিলাল, আমাকে গম্ভীর ভাবে বলিল, “এই ময়ূরেরা কাহারও কিছু হানি করে না, কিন্তু ইংরাজেরা এমনি দুষ্ট, ইহাদিগকে পাথর ছুঁড়িয়া মারে।”

 আরও দূরে, একটি পরিত্যক্ত প্রাসাদ, বুনো ঘাসে সবুজ হইয়া গিয়াছে—মনে হয় যেন উহা একটি প্রকাণ্ড সরসীর আর্শিতলে প্রতিষ্ঠিত। ইহার কালো বিষাক্ত জল অল্প অল্প ঝিক্ ঝিক্‌ করিতেছে। ইহার তটদেশে কুম্ভীরেরা স্থিরভাবে নিদ্রা যাইতেছে। চারিদিকে সুন্দর স্বর্ণোজ্জল পর্ব্বত-শ্রেণী আলোকে পরিপূর্ণ এবং প্রশান্ত নীল গগনকে বেষ্টন করিয়া আছে। সূর্য্যের মৃদু উত্তাপ, বায়ু সূক্ষ্ম, লঘু, সুখস্পর্শ এবং একটু মাদকতা-বিশিষ্ট। ... ...

 তাড়াতাড়ি আমরা মহারাজার প্রাসাদ দেখিতে গেলাম। আস্তাবলে শত শত আরব ঘোড়া পদাস্ফালন করিতেছে, কুক্কুরগৃহে শিকারী কুক্কুর সকল রহিয়াছে, হাতিশালায় হাতিরা শৃঙ্খলাবদ্ধ, উদ্ভিজ্জ-মণ্ডপে বিবিধ উদ্ভিজ্জ রক্ষিত। এইবার গোলাপী নগরের নিকট বিদায় লইয়া যাইতে হইতেছে। ষ্টেসনের নিকটে, হিন্দুস্থানী পুস্তকরাশির ভারে ভারাক্রান্ত একটি অল্পবয়স্ক রাজপুত ছাত্র আমাকে মধুর ভাবে “গুড্‌ আফ্‌টরনুন্‌” বলিয়া অভিবাদন করিল।

 য়ুরোপীয় সাজসজ্জায় বেষ্টিত রেল-গাড়িতে আবার যখন উঠিলাম, তখন মনে হইল যেন এমন একটি উন্মত্তকারী রঙ্গালয় হইতে বহির্গত হইলাম যেখানকার নাট্য-দৃশ্য দেখিয়া আত্মহারা হইতে হয়, যেখানে সেক্সপিয়রের কমেডির ন্যায় কিম্বা ওয়াটোর প্যাষ্টোরালের ন্যায় বাস্তবকে ভুলিয়া যাইতে হয়। এই পিতৃবৎ-শাসিত জনসমাজ, এই সকল গোত্র, এই সকল সূর্য্যবংশীয় অশ্বারোহী রাজপুত ঠাকুরের দল, এই সুবিজ্ঞ রাজা যাঁহাকে প্রজারা ভালবাসে, যিনি স্বেচ্ছাতন্ত্রী[১] পিতৃস্থানীয়; ঢালবল্লমধারী এই সকল যোদ্ধৃগণ, ইহাদের অদ্ভুত শ্মশ্রুরাজি, ইহাদের সৌখীন পরিচ্ছদ, রাস্তার হাস্যময় সুখী লোকজন, নীলরঙের কুকুর, শিকারী নেক্‌ড়ে বাঘ—এই সমস্তই গীতিনাট্যের জগৎ—স্বপ্নজগৎ। কর-মর্দ্দিত ষ্ট্রবেরি-ফলের রঙের ও গোলাপী রঙের বাড়ীসকল যাহা পাথরের বলিয়া মনে হয় না, ছোট ছোট পাহাড়ের উপর বুরুজ-শোভিত দুর্গ-নিবাস, অদ্ভুত লঘু-ধরণের ইমারৎসকল, ‘সূর্য্য-মন্দির’ ‘বায়ু-প্রাসাদ’ ‘মেঘ-প্রাসাদ’, ‘পান্নার দ্বার’, “শোভা-শালা” বাষ্পবৎ লঘু পর্ণ-জাতীয় (Fern) উদ্ভিজ্জ-পরিপূর্ণ উদ্ভিজ্জ-মণ্ডপ, ঘাসে পরিপূর্ণ মাঠ, ঝোপ-নিবাসী নীলকণ্ঠ ময়ূর, কৃঞ্চসলিলা-সরসা-শোভিত পরিত্যক্ত প্রাসাদ মন্দির—এই সমস্ত গীতিনাট্যের দৃশ্যাবলী। এখানকার জীবনযাত্রাও গীতিনাট্যের উপযুক্ত। এখানে কোনও দায়িত্বপূর্ণ গাম্ভীর্য্য নাই, কোনও গুরুতা নাই, দুঃখকষ্টের কোনও ভাব নাই—এই হাস্যময় শিল্পীজাতির আর কোনও কাজ নাই—আর কোনও ভাবনা নাই; ইহারা কেবল মর্ম্মর-প্রস্তরের ছোট-ছোট দেবমূর্ত্তি পশুমূর্ত্তি গড়িতেছে, জরির জুতা তৈয়ারি করিতেছে, গৃহ-প্রাচীর নীল রঙের ছবির দ্বারা চিত্রিত করিতেছে, সুন্দর আরব ঘোড়ায় সওয়ার হইতেছে, আকাশের পক্ষীদিগকে পোষণ করিতেছে, ঘুড়ি উড়াইতেছে এবং বিশ্বস্তচিত্তে মুক্ত আলোকে সুখ-স্বচ্ছন্দে জীবনযাত্রা নির্ব্বাহ করিতেছে। হাঁ! ইহাদের জীবন সাদাসিধা, সুখী, শিশু-প্রায়—ইহাদের মধ্যে সঙ্গীতের বিরাম নাই—আনন্দের অবসান নাই। আমাদের দুঃখময় তমোময় যুরোপে ফিরিয়া যাইবার সময় আমি এই সমুজ্জ্বল কবিতাময় স্বপ্নটিকে সঙ্গে লইয়া যাইতেছি।


  1. তাহার দৃষ্টান্ত, রাজার অনুমতি ব্যতীত জয়পুরে ফেটোগ্রাফ্‌ তোলা যায় না।