ভারতবর্ষে/ভারতবর্ষে বারাণসী
ভারতবর্ষে বারাণসী।
নাট্য দৃশ্যের হঠাৎ পরিবর্ত্তন হইল। ২৪ ঘণ্টা উত্তর বাঙ্গলার রেলপথে ও ২১ ঘণ্টা গ্রেট পেনিন্সুলার রেলপথে ভ্রমণ করিয়া কাল সন্ধ্যার সময় এখানে পৌঁছিলাম। পথে কিছুই বিশেষ দেখিবার নাই। মোঙ্গলীয় শীতল (দার্জিলিং) প্রদেশ হইতে নামিয়া একেবারে ভারতের পুণ্যভূমিতে—সনাতনী গঙ্গাদেবীর পুণ্য তটে আসিয়া উপস্থিত।
এইখানেই সেই প্রাচীন ভারতবর্ষ—হিন্দুর ভারতবর্ষ। এখানে যুরোপীয়েরা বাস করে না, এখান দিয়া কেবল যাতায়াত করে মাত্র। ইংরাজ ইহার কিছুই পরিবর্ত্তন করিতে পারে নাই; বণিক কিম্বা কারখানাওয়ালা হইয়া ইংরাজেরা এখানে রীতিমত আড্ডা গাড়ে নাই। এই নগরী—এই হিন্দুরা–এই সকল মন্দির দশ শতাব্দি পূর্ব্বে যাহা ছিল এখনও তাহাই আছে। ইহা হিন্দুজগতের হৃদয়-দেশ—সেই অগ্নিস্থান যেখানে ব্রাহ্মণ্য অনল সর্ব্বদাই প্রজ্জলিত রহিয়াছে। সেই পুরাকালের ব্রাহ্মণেরা, যাঁহারা পুত্র-মুখ দেখিবার পর ঘোর অরণ্যে প্রবেশ করিয়া বিজনে বিশ্বজনীন মূলতত্ত্বের ধ্যান করিতেন, তাঁহারা এই বারাণসী কিম্বা এই গাঙ্গেয় উপত্যকার নিকটবর্ত্তী প্রদেশের অধিবাসী। এই স্থানেই হিন্দুচিন্তার পরিণামস্বরূপ মহা-মহা ছয়ট দর্শন বিরচিত হইয়াছিল। পঞ্চবিংশতি শতাব্দিতেও এই নগর বিখ্যাত ছিল। হাঁ, যখন নিনিভার সহিত ব্যাবিলনের দ্বন্দ্ব চলিতেছিল, যখন টায়ার মধ্যধরাশায়ী-সাগরের উপকূলে উপনিবেশ স্থাপন করিতেছিল, যখন এথেন্স নগরের হাটবাজার বাগ্মীদিগের বাক্যোচ্ছ্বাসে প্রতিধ্বনিত হইত এবং সেখানকার মন্দিরসকল প্রস্তর মূর্ত্তিতে পূর্ণ হইতেছিল; যখন রোম, কৃষকদিগের নিবাসস্বরূপ একটি ক্ষুদ্র নগরমাত্র ছিল, যখন পুরাতন মিসরীয় ধর্ম্মমতের প্রাদুর্ভাব ছিল, সেই সময়ে এই প্রখ্যাত মহানগরী আজিকার ন্যায় তখনও গৌরবর্ণ ব্রাহ্মণে পরিপূর্ণ। তখনও ব্রাহ্মণদিগের যে সকল লক্ষণ ছিল, এখনও তাহাই দেখা যায়; কর্ম্মকাণ্ডের অনুষ্ঠানের পীড়নে দেহযষ্টি একেবারে নত হইয়া পড়িয়ছে, আপনার মধ্যে আপনি পুঁটুলি বাঁধিয়া আছে, দার্শনিক স্বপ্নদর্শনে নিমগ্ন, চিন্তার সূক্ষ্ম তন্তুজাল আরও সূক্ষ্মতর করিতে করিতে মাথা ঘুরিয়া যাইতেছে—খেয়াল দেখিতেছে—তাঁহাদের নিকট এই নীরেট জগৎ স্খলিত গণিত হইয়া এমন একটি প্রশান্ত নাস্তিত্বে পরিণত হইয়াছে, যেখান হইতে অস্তিত্বের প্রতীয়মান আবির্ভাব মাত্র নিরন্তর সমুত্থিত হয়। ইহাদের মধ্যে শাক্যমুনি একজন। এখান হইতে ত্রিশ ক্রোশ দূরে ইঁহার জন্মস্থান এবং পাঁচ বৎসর কাল ধ্যান ধারণার সাধনা করিয়া বারাণসীতে ইনি নিজ মত প্রচার করিতে আসিয়াছিলেন। আজি আমাদের পুরাকালীন পাশ্চাত্যের কিছুমাত্র অবশিষ্ট নাই। সে জগৎ একেবারেই মৃত—তাহার শেষ হইয়া গিয়াছে—কালের অন্ধকারে তাহাকে একেবারেই গ্রাস করিয়া ফেলিয়াছে। কিন্তু এই কাশী নগর চিরকালই ভারতের সেই মহিমান্বিত কাশীধাম।
প্রভাতে, যখন সূর্য্যমণ্ডল স্পন্দিত-হৃদয়ে গঙ্গার পশ্চাতে উদিত হয় তখন পঁচিশ হাজার ব্রাহ্মণ, হিন্দু-জনতার সম্মুখে, নদীর তটদেশে উপবিষ্ট হইয়া এখনও তারকার উদেশে, পুণ্য নদীর উদ্দেশে, আদিম শক্তিসমূহের উদেশে, প্রাণের দৃশ্যমান উৎপত্তি স্থানসমূহের উদ্দেশে, সেই প্রাচীন বৈদিক স্তুতিগান সকল পাঠ করিয়া থাকে। রোম নগর ক্যাথলিক সম্প্রদায়ের নিকট যত না পবিত্র, কাশী হিন্দুর নিকট তদপেক্ষা অধিক পবিত্র। উহার প্রত্যেক প্রস্তরখণ্ড পবিত্র। কাশীতে যাহার মৃত্যু হয়, কোনও মলিনতা কোনও পাপই তাহাকে স্পর্শ করিতে পারে না। খৃষ্টিয়ান হউক, মুসলমান হউক, গোহত্যাই করুক বা গোমাংসই আহার করুক, সে নিশ্চয়ই কৈলাসধামে—শিবলোকে গমন করে। অতএব সেই ব্যক্তি ভাগ্যবান, জীবনের শেষভাগ যে কাশীতে কাটাইতে পারে। দুই লক্ষেরও অধিক যাত্রী ভারতের সকল দিক্ হইতে এইখানে আসিয়া উপস্থিত হয়। তাহাদের মধ্যে অনেকে বৃদ্ধ ও মৃতকল্প। দুর্ভাগ্যবশতঃ যদি কাহারও কাশীপ্রাপ্তি না হয়, অন্ততঃ তাহার অন্তিম ভস্মরাশি কাশীধামে পরে পাঠান হয়। এই উদ্দেশে পাঠান হয় যে, গঙ্গাপুত্রেরা অন্ত্যেষ্টি-মন্ত্র পাঠ করিয়া তাহার অন্তিম-ভস্ম গঙ্গাদেবীকে সমর্পণ করিবে। হিন্দুরা বলে, ‘কাশী—পুণ্যধাম কাশী—কাশীকে ধ্যান করিলেই শান্তিতে মৃত্যু হয়।’
বাস্তবিকই এই নগরটি অসাধারণ। অন্যত্র, ধর্ম্মাচরণ, প্রকাশ্য জীবনের এক অংশমাত্র, কিন্তু কাশীতে ধর্ম্ম ছাড়া আর কিছুই দেখা যায় না। ধর্ম্ম এখানে সমস্ত গ্রাস করিয়া আছে—মানবজীবনের প্রত্যেক মুহূর্ত্ত পুর্ণ করিয়া আছে—নগরকে মন্দিরে মন্দিরে ছাইয়া ফেলিয়াছে। উনবিংশতি সহস্রেরও অধিক মন্দির, এতদ্ব্যতীত ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দেবালয় অসংখ্য। মুর্ত্তির সংখ্যা যদি ধর তো সে কাশীর জনসংখ্যার দ্বিগুণ। প্রায় পাঁচ লক্ষ হইবে। কাল সন্ধ্যায় যখন পৌঁছিলাম, দিনের আলো তখনও ছিল, তাই বেড়াইতে বেড়াইতে নদীর ধার পর্য্যন্ত গেলাম। নগরের আঁকা-বাকা গলিসকল অৰ্দ্ধনগ্ন মানবকুলের গতিবিধিতে পরিপূর্ণ। দেবালয়ের দ্বারের সম্মুখে লোকের বেশি ভীড়। গৌরবর্ণ ব্রাহ্মণেরা ঠেলাঠেলি করিয়া চলিয়াছে; সন্ন্যাসীরা আসন করিয়া উপবিষ্ট—ভষ্মমাখা নগ্নদেহ—স্থির দৃষ্টি—চারিদিকের চঞ্চল গতিবিধির মধ্যে প্রস্তরবৎ অচল।
হল্দে ফুলের হার, মালা, প্রস্তরের শিবলিঙ্গ প্রভৃতি নানাবিধ ধর্ম্মোপকরণে এখানকার দোকান সকল পরিপূর্ণ। ঘরের দেয়ালে, দ্বারের উপরিভাগে, কুলঙ্গির উপর, নানাপ্রকার কদাকার দেবমূর্ত্তি—কাহারও বা গজমুণ্ড—কাহারও বা গায়ে সাপ জড়ানো। স্থানে স্থানে কূপ—তাহা হইতে পচা ফুলের দুর্গন্ধ বাহির হইতেছে। সেই সকল কূপে দেবতার বাস—তাহার চারিদিকে লোকের অত্যন্ত ভীড়। প্রাচীরের গায়ে নীলরঙে চিত্রিত হিন্দু দেবদেবীর পৌরাণিক কাহিনী। দেবদেবীর অশ্লীল মূর্ত্তিসকল মালার আকারে মন্দিরের চারিদিকে বেষ্টিত। এত দেবদেবীর মূর্ত্তি যে, বড় বড় মন্দিরেও যেন আর ধরে না—রাস্তার মধ্যে ছোট ছোট দেবালয়েও দেবতাদিগকে আশ্রয় লইতে হইয়াছে—তাহাতে লম্বোদর গণেশ অথবা ভীষণ-মূর্ত্তি কালীদেবী অধিষ্ঠিত। মন্দির বেদীর উপর যে জুঁই ফুল থাকে তাহাতে গঙ্গাজলের ছিটা দেওয়া হয়। এই গঙ্গাজলে ভিজিয়া ভিজিয়া ফুলসকল পচিয়া উঠে—তৎপরে গোবর ও এই পচা ফুলে মিশিয়া একপ্রকার কর্দ্দম উৎপন্ন হয়। এই কর্দ্দমের উপর দিয়া পিছলিয়া পিছলিয়া চলিতেছি—আর দুর্গন্ধ ভোগ করিতেছি। এই মানব-জনতার মধ্যে আবার বানরেরা লাফালাফি করিতেছে—খেলিতেছে—ঘরের ছাদে বসিয়া আছে; এবং বন্ধনমুক্ত গাভীসকল ইতস্তত বিচরণ করিয়া ফুল খাইতেছে। প্রাচীন হিন্দু মহাকাব্যে অসংখ্য যুগযুগান্তর কথা, অসংখ্য দেবদেবীর কথা, অসংখ্য জীবজন্তু উদ্ভিজ্জের কথা পড়িয়া যেমন হতবুদ্ধি হইয়া পড়িতে হয়, এইখানকার ব্যাপারসকল দর্শন করিয়া আমার কতকটা সেই রকম মনের ভাব হইয়াছে। আমাদের স্বাভাবিক মনের গতি ও অভ্যাস যেন একেবারে ওলটপালট হইয়া গিয়াছে। মনে হয় যেন এমন একটা দেশে আসিয়াছি যেখানে মানুষ পায়ে না হাঁটিয়া মাথায় হাঁটে। এই মানবজাতি যেরূপে চিন্তা করে, অনুভব করে, জীবনযাত্রা নির্ব্বাহ করে তাহা সম্পূর্ণ আমাদের বিপরীত—আমাদের ভাবের সঙ্গে আদৌ মিশ খায় না। কাশীতে আসিয়া মনে হয়, যেন খেয়াল দেখাই এখানকার স্বাভাবিক অবস্থা। ......
পাঁচটার সময় উঠিলাম, সাড়ে ছটার সময় নদীর ধারে উপনীত হইলাম। প্রভাতের তরুণ আলোকে দিগন্ত পর্য্যন্ত সমস্ত স্থান তরল রজতবৎ শুভ্রকান্তি। বৃহৎ গঙ্গা নিজ শ্যামল বক্ষ উদ্ঘাটন করিয়া, কর্দ্দমময় ভাঙা-ভাঙা তরঙ্গলহরী বিস্তার করিয়া দুই কূলের মধ্য দিয়া চলিয়াছে। একদিকে বালুকাময় বিস্তীর্ণ মরু—আর একদিকে মন্দির, প্রাসাদ, মসজিদ, মর্ম্মর-প্রস্তরের প্রাচীর—যাহার রেখাসূত্র গোলাবী কুয়াশার গভীরতম দেশে ক্রমশ মিলাইয়া গিয়াছে। ঘাটের প্রশস্ত ধাপসকল উদারভাবে নদী পর্য্যন্ত নামিয়াছে এবং সূর্য্যালোকে ঝক্ঝক্ করিতেছে। এইখানে হিন্দুদিগের ভীড়। যাত্রী, পুরোহিত, ভক্তের দল সবাই প্রাভাতিক অর্চ্চনা সমাধা করিবার জন্য—উদীয়মান সূর্য্যকে ও গঙ্গাদেবীকে পূজা দিবার জন্য এখানে সমাগত। সহস্ৰ সহস্ৰ লোক। গৌরবর্ণ ব্রাহ্মণরা—ত্রিবলীশোভিত লম্বোদর—দীপ্তিমান মুণ্ডিত মস্তক—বৃহৎ বৃহৎ তৃণাচ্ছাদিত ছত্র তলে, প্রস্তর ফলকের উপর উপবিষ্ট হইয়া পথিকদিগের নিকট শাস্ত্র হইতে শ্লোক পাঠ করিতেছে। শ্যামবর্ণ শূদ্রেরা মুণ্ডিতমস্তক, কেবলমাত্র অল্প এক গুচ্ছ কেশ ঘাড়ের দিকে লম্বমান—অর্দ্ধ নগ্ন চটুল দেহ। স্ত্রীলোকেরা উজ্জ্বল রঙের কাপড়ে আপাদমস্তক আচ্ছাদিত। তাহারা দাঁড়াইয়া সূর্য্যের দিকে বাহু উত্তোলন করিয়া করযোড়ে পূজা করিতেছে। যতই আমাদের নৌকা জলের উপর দিয়া অগ্রসর হইতে লাগিল ততই মন্দির ও লোকের সংখ্যা বৃদ্ধি হইতে লাগিল। চারি শত ফুট প্রশস্ত বড় বড় সোপানশ্রেণী প্রকাণ্ড পিরামিডের ন্যায় উর্দ্ধে উঠিয়াছে, তাহাদের সহস্ৰ সহস্র ধাপ—সেই ধাপসমূহের সমান রেখাপাত। গুরুভার অষ্টকোণ স্তম্ভসকল জলমধ্যে নিমগ্ন; হর্ম্ম্য-শ্রেণীর চৌকোনা সম্মুখভাগ—লাল পাথরে ফুলকাটা বড় বড় চূড়া—মার্ব্বলের ভিতর খোদা কুলঙ্গি সকল একটার পর একটা দৃষ্টিপথে আসিতেছে। পুরাতন মিসরের ন্যায়, আসিরিয়ার পৌরাণিক নগরের ন্যায় এখানে পাথরের প্রকাণ্ড প্রকাণ্ড স্তূপ, জ্যামিতিক গঠন-প্রণালী-অনুসারে উপর্য্যুপরি ন্যস্ত। এই সকল অট্টালিকার নিম্নে বহুপুরাতন নদীর ধারে শতসহস্র হিন্দু গতিবিধি করিতেছে—ধর্ম্মানুষ্ঠান করিতেছে।
চারি ঘণ্টা ধরিয়া আমি নদীর উপর নৌকা করিয়া যাতায়াত করিলাম—এই সকল অশেষ বিচিত্রতা—আকার ও ভঙ্গীর অনন্ত তরঙ্গ আমি কি করিয়া বর্ণনা করিব? আলোক-ধবল প্রশস্ত ধাপের উপর বাঁধা পোস্তার ধারে—ভগ্নাবশিষ্ট মন্দিরের রাশীকৃত প্রস্তরের উপর—আরও উচ্চে গবাক্ষের উপর—প্রকাণ্ড প্রস্তরস্তূপের ছাদে—তৃণময় ছত্রারণের তলে—শ্যামল দেহসকল পিল্পিল্ করিতেছে—বিচিত্র রঙের বুদ্বুদ যেন ভাসিতেছে। পাঁচটি নগ্নদেহ একটা থামের উপর হইতে এক লম্ফে জলে ঝাঁপ দিয়া পড়িল—জলকণার স্ফুলিঙ্গ উচ্ছ্বসিত হইয়া উঠিল।
তাহাদের পশ্চাতে ব্রাহ্মণেরা বিড়্ বিড়্ করিয়া মন্ত্র পাঠ করিতে করিতে বৃক্ষশাখা আস্ফালন করিয়া জলে ক্রমাগত আঘাত করিতেছে। আরও নীচে, গম্ভীর ও উন্নতকায় স্ত্রীলোকেরা জল হইতে উঠতেছে—সিক্ত নীল সাড়া হইতে টস্টস্ করিয়া জল পড়িতেছে। জনতা হইতে বিচ্ছিন্ন হইয়া, লোহিত পট্টবস্ত্রে আবৃত হইয়া, শাস্ত্রানুমোদিত আসন রচনা করিয়া, একটা প্রস্তরস্তূপের উপর উপবিষ্ট হইয়া এক ব্যক্তি একদৃষ্টে সূর্য্যের পানে চাহিয়া আছে—কত অদ্ভুত ভঙ্গী ও মুদ্রা করিতেছে, দেখিলে মনে হয় উন্মাদগ্রস্ত; দুইজন স্ত্রীলোক এক হস্তে নাক টিপিয়া ধরিয়া আছে, অপর হস্তে বুক চাপ্ড়াইতেছে; একটি বৃদ্ধা একেবারে বক্রীভূত—সর্ব্বাঙ্গ কম্পমান—তাহার গাত্রলগ্নসিক্ত সাড়ী হইতে তাহার শীর্ণতার রেখা বেশ স্পষ্ট উপলব্ধি হইতেছে—বলীরেখাঙ্কিত হস্ত যোড় করিয়া সে ছয়বার পাক্ দিয়া ঘুরিতেছে। আর সকলে, ওষ্ঠাধরের দ্রুত স্পন্দন সহকারে, মধ্যে মধ্যে করপুটে জল উঠাইয়া সম্মুখে নিক্ষেপ করিতেছে।
... ... ... ... ... ...
শিবের নিকট, গণেশের নিকট, সূর্য্যের নিকট, অসংখ্য স্তুতি বন্দন উত্থিত হইতেছে। একমুহূর্ত্তের জন্য এক একবার সেই গুরুভারাক্রান্ত অভিভূতভাব হৃদয়ে উপলব্ধি করা যায়, যে ভাব পুরুষানুক্রমে ক্রমাগত বর্দ্ধিত হইয়া আর্য্য-মস্তিকের গঠন-পরিবর্ত্তন করিয়া হিন্দুদর্শন ও হিন্দুকাব্যের আকারে পরিণত হইয়াছে। এইরূপ উপলব্ধি হয় যে, বিশেষ বিশেষ নশ্বর সত্তার পশ্চাতে একটা মহাশক্তি বিদ্যমান, যে শক্তি সর্ব্বপ্রকার পদার্থ ও সত্তা উৎপাদন করে, যাহা অবিনশ্বর, যাহা অনন্তকাল বর্ত্তমান, সহস্ৰ সহস্ৰ জন্মমৃত্যুর মধ্যে যাহার প্রকাশ এবং যাহার কদাচ ক্ষয় হয় না। এই শক্তিকেই হিন্দুরা পূজা করে—এই শক্তিপূজাই তাহাদের ধর্ম্মের ভিত্তিভূমি। এই কথাটা যদি একবার উপলব্ধি করা যায়, তাহ হইলে সর্ব্বপ্রকার অসঙ্গতির ব্যাখ্যা আপনা আপনি হইয়া যায়। হিন্দুধর্ম্মের মধ্যে অসভ্যজাতিসুলভ পৌত্তলিকতার সহিত অতিসূক্ষ্ম তত্ত্বচিন্তার সম্মিলন হইয়াছে। এই হিন্দুরা তেত্রিশকোটি দেবতা মানে, তা ছাড়া পঞ্চভূত, পশুপক্ষী বৃক্ষ তারকা প্রস্তর সকলকেই পূজা করে। জগদ্ব্রহ্মবাদ—একেশ্বরবাদ—বহুদেববাদ সমস্তই ইহার মধ্যে একাধারে বর্ত্তমান। বিশ্বের সার্ব্বভৌমিক সত্তাকে কিম্বা তাহার বাহ্য প্রকাশকে এক করিয়া দেখ, কি বহু করিয়া দেখ, জড়ভাবে দেখ, কি আত্মাভাবে দেখ—যে ভাবে দেখো, তাহারই উপর এই বিশেষ মতবাদ নির্ভর করে। একবার ইহা বুঝিতে পারিলে তাহাদের বাতুল কল্পনার অর্থ পাওয়া যায়, তাহাদের কাব্যগত অদ্ভুত স্বপ্নকাহিনীর ব্যাখ্যা হয়। হিন্দুরা প্রকৃতির মধ্যে মগ্ন হইয়া গিয়া, হস্তী বানর ভল্লুক কীট পতঙ্গ উদ্ভিজ্জ সকলকেই আপনাদের সমকক্ষ সঙ্গী করিয়া লইয়াছে। অধিকন্তু, তাহারা একটা মহাপ্রাণ উপলব্ধি করিয়াছে, যে প্রাণ তরল তরঙ্গময়, যাহা মরিতেছে, জন্মিতেছে, বৃদ্ধি পাইতেছে এবং যে প্রাণ বিচিত্র ও চিরপরিবর্ত্তনশীল। কিন্তু যখন আমি এই লোকারণ্যের মধ্যে এই সকল মন্দিরের মধ্যে, মুসলমান মস্জিদের দুইটি সমুন্নত সৌধ-ধবল মিনার সুনীল গগনপটে অঙ্কিত দেখিলাম তখন আমার একটা খুব তফাৎ মনে হইল। এই মিনার দুটি গগন ভেদ করিয়া কেমন, সিধা উঠিয়াছে। প্রার্থনার ঐকান্তিক আগ্রহ—অন্তরের একটি আকুল ধ্বনি যেন মূর্ত্তিমান হইয়া অপ্রতিহতবেগে উর্দ্ধে ছুটিয়াছে। এই মিনারের গঠনে এমন একটি জাতির হস্ত দেখিতে পাওয়া যায়, যে জাতি অনাড়ম্বরপ্রিয়, ইচ্ছাশক্তিসম্পন্ন, একেশ্বরবাদী এবং যাহার হৃদয় প্রবল আবেগে পূর্ণ।