তাল ও মান

 আমাদের প্রাচীন শিল্পকারগণ মূর্তিকে পাঁচ শ্রেণীতে বিভক্ত করিয়াছেন, যথা—নর, ক্রূর, আসুর, বালা, এবং কুমার। এই পাঁচ শ্রেণীর মূর্তি গঠনের জন্য বিভিন্ন পাঁচ প্রকার তাল ও মান নির্দিষ্ট হইয়াছে, যথা—

নবমূর্তি: দশতাল
ক্রূরমূর্তি: দ্বাদশতাল
আসুরমূর্তি: ষোড়শতাল
বালামূর্তি: পঞ্চতাল
কুমারমূর্তি: ষট্‌তাল

 এক তালের পরিমাণ শিল্পকারগণ এইরূপ নির্দেশ করেন, যথা—শিল্পীর নিজমুষ্টির এক-চতুর্থাংশকে এক অঙ্গুল কহে, এইরূপ দ্বাদশ অঙ্গুলিতে এক তাল হয়।

 নর বা দশ তাল পরিমাণে নবনারায়ণ, রাম, নৃসিংহ, বাণ, বলী, ইন্দ্র, ভার্গব ও অর্জুন প্রভৃতি মূর্তি গঠন করা বিধেয়।

 ক্রূর বা দ্বাদশ তাল পরিমাণে চণ্ডী, ভৈরব, নরসিংহ, হয়গ্রীব, বরাহ ইত্যাদি মূর্তি গঠন করা বিধেয়।

 আসুর বা ষোড়শ তাল পরিমাণে হিরণ্যকশিপু, বৃত্র, হিরণ্যাক্ষ, রাবণ, কুম্ভকর্ণ, নমুচি, নিশুম্ভ, শুস্ত, মহিষাসুর, রক্তবীজ ইত্যাদি মূর্তি গঠনীয়।

 বালা বা পঞ্চ তাল পরিমাণে শিশুমূর্তি, যেমন বটকৃষ্ণ, গোপাল প্রভৃতি। এবং—

 কুমার বা ষট্ তাল পরিমাণে শৈশবাতিক্রান্ত অথচ অতরুণ, যেমন উমা, বামন, কৃষ্ণসখা ইত্যাদি মূর্তি গঠন করা বিধেয়।

উত্তম নবতাল
 দশ, দ্বাদশ, ষোড়শ, ষট্, এবং পঞ্চতাল ছাড়া মূর্তিগঠনে উত্তম নবতাল পরিমাণ ভারতশিল্পীগণকে প্রায়ই ব্যবহার করিতে দেখা যায়। এই উত্তম নবতাল পরিমাণ অনুসারে মূর্তির আপাদমস্তক সমান নয় ভাগে বিভক্ত করা হয় এবং এই এক-এক ভাগকে তাল কহে। তালের এক-চতুর্থ ভাগকে এক অংশ কহে। এইরূপ চারি অংশে এক তাল হয় এবং মূর্তির আপাদমস্তকের দৈর্ঘ্য বা খাড়াই ছত্রিশ অংশ বা নয় তাল নির্দিষ্ট হইয়া থাকে। পূর্বমুদ্রিত চিত্রটি উত্তম নবতাল পরিমাণে অঙ্কিত।

 উত্তম নবতাল পরিমাণে মূর্তির দৈর্ঘ্য বা খাড়াই, যথা—ললাটেব মধ্য হইতে চিবুকের নিম্নভাগ ১ তাল, কণ্ঠমূল হইতে বক্ষ ১ তাল, বক্ষ হইতে নাভি ১ তাল, নাভি হইতে নিতম্ব ১ তাল, নিতম্ব হইতে জানু ২ তাল, এবং জানু হইতে পদতল ২ তাল, ব্রহ্মরণ্‌ধ্র হইতে ললাটমধ্য ১ অংশ, কণ্ঠ ১ অংশ, জানু ১ অংশ, পদ ১ অংশ। প্রস্থ বা বিস্তার, যথা—মস্তক ১ তাল, কণ্ঠ ২॥০ অংশ, এক স্কন্ধ হইতে আর-এক স্কন্ধ ৩ তাল, বক্ষ ৬ অংশ, দেহমধ্য ৫ অংশ, নিতম্ব ২ তাল, জানু ২ অংশ, গুল্‌ফ ১ অংশ, পদ ৫ অংশ। উত্তম নবতাল পরিমাণে মূর্তির হস্তের দৈর্ঘ্য বা খাড়াই, যথা—স্কন্ধ হইতে কফোণী (কনুই) ২ তাল, কফোণী হইতে মণিবন্ধ ৬ অংশ, পাণিতল ১ তাল। প্রস্থ বা বিস্তার, যথা—কক্ষমূল ২ অংশ, কফোণী (কনুই) ১॥০ অংশ, মণিবন্ধ ১ অংশ।

 মূর্তির মুখ তিন সমান ভাগে বিভক্ত করা হয়, যথা—ললাটের মধ্য হইতে চক্ষুতারকার মধ্য, চক্ষুর মধ্য হইতে নাসিকার অগ্র, নাসাগ্র হইতে চিবুক, এই তিন ভাগ।

 শুক্রাচার্যের মতে নবতাল-পরিমিত মূর্তির প্রত্যঙ্গসমূহের পরিমাণ, যথা—শিখা হইতে কেশান্ত ৩ অঙ্গুলি খাড়াই, ললাট ৪ অঙ্গুলি, নাসিকা ৪ অঙ্গুলি, নাসাগ্র হইতে চিবুক ৪ অঙ্গুলি, গ্রীবা ৪ অঙ্গুলি খাড়াই। ভ্রূর পরিমাণ লম্বা ৪ এবং চওড়া অর্ধ অঙ্গুলি, নেত্রের পরিমাণ লম্বা ৩ অঙ্গুলি, চওড়া ২ অঙ্গুলি। নেত্রতারকা নেত্রের তিন ভাগের এক ভাগ। কর্ণের পরিমাণ—খাড়াই ৪ অঙ্গুলি, চওড়া ৩ অঙ্গুলি। কর্ণের খাড়াই এবং ভ্রূর দৈর্ঘ্য সমান হইয়া থাকে। পাণিতল দৈর্ঘ্যে ৭ অঙ্গুলি, মধ্যমাঙ্গুলির দৈর্ঘ্য ৬ এবং অঙ্গুষ্ঠের দৈর্ঘ্য ৩॥৹ অঙ্গুলি, অঙ্গুষ্ঠের দৈর্ঘ্য তর্জনীর প্রথম পর্ব পর্যন্ত। অঙ্গুষ্ঠের দুইটি মাত্র পর্ব বা গাঁঠ এবং তর্জনী প্রভৃতি আর-সকল অঙ্গুলির তিন তিন গাঁঠ হইয়া থাকে। অনামিকা মধ্যমাঙ্গুলি অপেক্ষা অর্ধ পর্ব, কনিষ্ঠাঙ্গুলি অনামিকা অপেক্ষা এক পর্ব, এবং তর্জনি মধ্যমাঙ্গুলি অপেক্ষা এক পর্ব খাটো হইয়া থাকে। পদতল দৈর্ঘ্যে ১৪ অঙ্গুলি, অঙ্গুষ্ঠ ২, তর্জনি ২॥৹ বা ২ অঙ্গুলি, মধ্যমা ১॥৹, অনামিক ১॥০, কনিষ্ঠা ১॥০।

 স্ত্রীমূর্তির পরিমাণ পুরুষমূর্তি অপেক্ষা প্রায় এক অংশ খাটো করিয়া গঠন করা বিধেয়।

 শিশুমূর্তির পরিমাণ, যথা—কণ্ঠের অধোভাগ হইতে পদ পর্যন্ত শিশুর দেহ তাহার নিজমুখের সাড়ে চার গুণ অর্থাৎ কণ্ঠের অধোভাগ হইতে উরুমূল দুই গুণ এবং শিশুদেহের বাকি অর্ধাংশ মস্তকের আড়াই গুণ। শিশুমূর্তির বাহু তাহার মুখের বা পদতলের দুই গুণ হইয়া থাকে। এবং শিশুর গ্রীবা খাটো, মস্তক বড়ো হয় ও বয়সের বৃদ্ধির সঙ্গে শিশুর শরীর যে পরিমাণে বৃদ্ধি পায় মস্তক সেরূপ বৃদ্ধি পায় না।