ভারতশিল্পে মূর্তি/ভূমিকা
ভূমিকা
আমার প্রিয় সুহৃদ শ্রীযুক্ত অর্ধেন্দ্রকুমার গঙ্গোপাধ্যায় মহাশয়কে এবং তাঁহার যত্নে মাদ্রাজ হইতে কলিকাতায় আনীত শ্রীগুরুস্বামী স্থপতিকে এবং আমার প্রিয় শিষ্য শ্রীমান্ বেঙ্কটাপ্পা ও শ্রীমান নন্দলাল বসুকে ধন্যবাদ দিয়া, মূর্তি সম্বন্ধে এই সংগ্রহটি প্রকাশ করিবার পূর্বে পাঠকবর্গকে এবং বিশেষ করিয়া নিখিল শিল্পসাগর-সংগমে আমার সহযাত্রী বন্ধু ও শিষ্যবৰ্গকে এই অনুরোধ যে, শিল্পশাস্ত্রের বচন ও শাস্ত্রোক্ত মূর্তিলক্ষণ ও তাহার মানপ্রমাণাদির বন্ধন অচ্ছেদ্য ও অলঙ্ঘনীয় বলিয়া তাহারা যেন গ্রহণ না করেন, অথবা নিজের নিজের শিল্পকর্মকে চিরদিন শাস্ত্রপ্রমাণের গণ্ডির ভিতরে আবদ্ধ রাখিয়া স্বাধীনতার অমৃতস্পর্শ হইতে বঞ্চিত না করেন।
উড়িতে শক্তি যতদিন না পাইয়াছি ততদিনই নীড় ও তাহার গণ্ডি। গণ্ডির ভিতরে বসিয়াই গণ্ডি পার হইবার শক্তি আমাদের লাভ করিতে হয়, তার পর একদিন বাধ ভাঙিয়া বাহির হইয়া পড়াতেই চেষ্টার সার্থকতা সম্পূর্ণ হইয়া উঠে। এটা মনে রাখা চাই যে আগে শিল্পী ও তাহার সৃষ্টি, পরে শিল্পশাস্ত্র ও শাস্ত্রকার—শাস্ত্রের জন্য শিল্প নয়, শিল্পের জন্য শাস্ত্র। আগে মূর্তি রচিত হয়; পরে মূর্তিলক্ষণ, মূর্তিবিচার, মূর্তিনির্মাণের মান-পরিমাণ নির্দিষ্ট ও শাস্ত্রাকারে নিবদ্ধ হয়। বাঁধন, চলিতে শিখিবার পূর্বে আমাদের বিপথ হইতে ফিরাইবার জন্য, দুই পায়ে নির্ভর করিয়া দাঁড়াইতে শিখিবার অবসর দিবার জন্য; চিরদিন ঘরের কোণে আমাদের অশক্ত অবস্থায় বাঁধিয়া রাখিবার জন্য নয়। মুক্তি ধাৰ্মিকের; আর ধর্মার্থীর জন্য ধর্মশাস্ত্রের নাগপাশ। তেমনি শিল্পশাস্ত্রের বাঁধাবাঁধি শিল্পশিক্ষার্থীর জন্য; আর শিল্পীর জন্য তাল, মান, অঙ্গুল, লাইট-শেড, পার্সপেক্টিভ আর অ্যানাটমির বন্ধনমুক্তি।
ধর্মশাস্ত্র কণ্ঠস্থ করিয়া কেহ যেমন ধাৰ্মিক হয় না তেমনি শিল্পশাস্ত্র মুখস্থ করিয়া বা তাহার গণ্ডির ভিতরে আবদ্ধ রহিয়া কেহ শিল্পী হয় না। সে কী বিষম ভ্রান্ত যে মনে করে মাপিয়া-জুখিয়া শাস্ত্রসম্মত মূর্তি প্রস্তুত করিলেই শিল্পজগতের সিংহদ্বার অতিক্রম করিয়া শিল্পলোকের আনন্দবাজারে প্রবেশাধিকার লাভ করা যায়।
শ্রীক্ষেত্রের যাত্রী যখন প্রথম জগবন্ধু দর্শনে চলে তখন পাণ্ডা তাহার হাত ধরিয়া উঁচ-নীচা ডাহিন-বাঁয়া এইরূপ বলিতে বলিতে দেবতাদর্শন করাইতে লইয়া যায়; ক্রমে যত দিন যায় পথও তত সড়গড় হইয়া আসে এবং পাণ্ডারও প্রয়োজন রহে না, পরে দেবতা যে দিন দর্শন দেন সে দিন দেউল মন্দির পূর্বদ্বার পশ্চিমদ্বার ধ্বজ চূড়া উঁচা-নীচ দেবতার পাণ্ডা ও অঙ্কশাস্ত্রের কড়া-গণ্ডা সকলই লোপ পায়।
নদী এক পাড় ভাঙে নূতন পাড় গড়িবার জন্য, শিল্পীও শিল্পশাস্ত্রের বাঁধ ভঙ্গ করেন সেই একই কারণে। এটা যে আমাদের প্রাচীন শিল্পশাস্ত্রকারগণ না বুঝিতেন তাহা নয় এবং শাস্ত্রপ্রমাণের সুদৃঢ় বন্ধনে শিল্পীকে আষ্টেপৃষ্ঠে বাঁধিলে শিল্পও যে বাঁধা নৌকার মতো কোনোদিন কাহাকেও পরপারের আনন্দবাজারে উত্তীর্ণ করিয়া দিতে অগ্রসর হইবে না সেটাও যে তাঁহারা না ভাবিয়ছিলেন তাহা নয়।
পাণ্ডিত্যের টীকা হাতে করিয়া শিল্পশাস্ত্র পড়িতে বসিলে শাস্ত্রের বাঁধনগুলার দিকেই আমাদের দৃষ্টি পড়ে, কিন্তু বজ্র-আঁটুনির ভিতরে ভিতরে যে ফস্কা গেরোগুলি আচার্যগণ শিল্পের অমরত্ব কামনা করিয়া সযত্নে সংগোপনে রাখিয়া গেছেন তাহার দিকে মোটেই আমাদের চোখ পড়ে না। সেব্যসেবকভাবেষু প্রতিমালক্ষণং স্মৃতম্; এ কথার অর্থ কি শিল্পীকে বলা নয় যে, যখন পূজার জন্য প্রতিমা গঠন করিবে কেবল তখনই শাস্ত্রের মত মানিয়া চলিবে, অন্যপ্রকার মূর্তি-গঠনকালে তোমার যথা-অভিরুচি গঠন করিতে পার। আমি এই প্রবন্ধে ত্রিভঙ্গ মৃতির দুইটি পৃথক চিত্র দিয়াছি—একটি শাস্ত্রসম্মত মাপজোখ ঠিক রাখিয়া, অন্যটি ভারতশিল্পীরচিত শতসহস্র ত্রিভঙ্গ মূর্তি হইতে যে কোনো একটি বাছিয়া লইয়া—শাস্ত্রীয় টান আর শিল্পীর টান দুই টানে দুই ত্রিভঙ্গ কিরূপ ফুটিয়াছে তাহাই দেখাইবার জন্য।
সৌন্দর্যকে দৈত্যগুরু শুক্রাচার্য যে দিন শাস্ত্রোক্ত মান-পরিমাণ দিয়া ধরিবার চেষ্টা করিতেছিলেন সেদিন হয়তে সৌন্দর্যলক্ষ্মী কোনো এক অজ্ঞাত শিল্পীর রচিত শাস্ত্রছাড়া সৃষ্টিছাড়া মূর্তিতে ধরা দিয়া তাঁহার সম্মুখে আসিয়া বলিয়াছিলেন: আমার দিকে চাহিয়া দেখো! আচার্য দেখিয়াছিলেন, দেখিয়া বুঝিয়াছিলেন ও বুঝিয়াই বলিয়াছিলেন: সেব্যসেবকভাবেষু প্রতিমালক্ষণং স্মৃতম্—লক্ষ্মী, আমার শাস্ত্র ও প্রতিমালক্ষণ তোমার জন্য নয়, কিন্তু সেই-সকল মূর্তির জন্য যেগুলি লোকে পূজা করিতে মূল্য দিয়া গড়াইয়া লয়। তুমি বিচিত্রলক্ষণা! শাস্ত্র দিয়া তোমায় ধরা যায় না, মূল্য দিয়া তোমায় কেনা যায় না!
সর্বাঙ্গৈঃ সৰ্বরম্যো হি কশ্চিল্লক্ষে প্রজায়তে।
শাস্ত্রমানেন যে রম্যঃ স রম্যো নান্য এবহি॥
একেষামেব তদ্ রম্যং লগ্নং যত্রচ যস্য হৃৎ।
শাস্ত্রমানবিহীনং যদ্ রম্যং তদবিপশ্চিতাম্॥
পণ্ডিতে বলেন শাস্ত্রমূর্তিই সুন্দর মূর্তি, কিন্তু হায় পূর্ণ সুন্দর লাখে তো এক মিলে না। একে বলে, শাস্ত্রছাড়া সুন্দর কি? আরে বলে, সুন্দর সে যে হৃদয় টানে, প্রাণে লাগে।