ভারত পথিক/পূর্বকথা

তৃতীয় পরিচ্ছেদ

পূর্বকথা

অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষভাগে ইংরেজরা ভারত দখল করবার পর দেশের সামাজিক জীবনে যে বিরাট পরিবর্তন ঘটেছিল তার স্বর‍ূপ কল্পনা করা এ যুগের লোকের পক্ষে মোটেই সহজ নয়, কিন্তু মোটামুটি তার একটি ছবি মনে না থাকলে আজকের দিনে দেশের বুকে চলচ্চিত্রের মধ্যে যেসব পরিবর্তন ঘটে যাচ্ছে তার মূল সূত্রটি ঠিক খুঁজে পাওয়া যাবে না। বৃটিশ শাসনের গোড়াপত্তন বাঙলাদেশে— সুতরাং বৃটিশ শাসনে দেশের যে পরিবর্তন হয়েছে তারও শ‍ুর‍ু বাঙলাদেশেই। দেশীয় শাসনতন্ত্রের অবসানের সঙ্গে সঙ্গে সামন্তশক্তির প্রাধান্য একেবারে কমে যায়। এদের স্থান দখল করে নতুন এক সম্প্রদায়। ইংরেজরা এদেশে এসেছিল বাণিজ্য করতে, অবস্থার পরিবর্তনে ক্রমে তাদের হাতে এলো রাজদণ্ড। কিন্তু মুষ্টিমেয় একদল ইংরেজের পক্ষে দেশীয় লোকের সহায়তা ছাড়া বাণিজ্য বা রাজ্যশাসন কোনোটাই সম্ভব ছিল না। এই অবস্থায় যারা দেশের ভাগ্যবিবর্তনকে মেনে নিয়ে বুদ্ধি ও কর্মকুশলতার জোৱে ইংরেজদের কাছে নিজেদের অপরিহার্য করে তুলেছিল তারাই সমাজে শীর্ষস্থান অধিকার করেছিল। এরাই বৃটিশ আমলের অভিজাত-সম্প্রদায়।

বৃটিশ শাসনের গোড়ার দিকে বহুদিন পর্যন্ত মুসলমানেরা রাষ্টিক ও সামাজিক কোনো ব্যাপারেই মুখ্য অংশ গ্রহণ করেনি। এর কারণ নানাভাবে বিশ্লেষিত হয়েছে। একদল বলেন, বাঙলা ও অন্যান্য প্রদেশের যে শাসকদের পরাজিত করে ইংরেজরা এদেশে রাজ্য স্থাপন করেছিল তাঁরা সকলেই ছিলেন মুসলমান ধর্মাবলম্বী, তাই মুসলমানেরা ইংরেজ শাসন ও সংস্কৃতি সন্বন্ধে বহুকাল পর্যন্ত অত্যন্ত বিরুদ্ধভাবাপন্ন ছিল। আর একদল বলেন যে, ভারতে ইংরেজ শাসন প্রবর্তিত হবার বহু আগে থেকেই মুসলমান অভিজাত সম্প্রদায়ের মধ্যে ভাঙ্গন ধরেছিল। তাছাড়া প্রথম প্রথম আধুনিক বিজ্ঞান ও সত্যতা সম্বন্ধে মুসলমানদের ধর্মগত আপত্তিও ছিল। এর ফলে বৃটিশ শাসনের প্রথম যুগে মুসলমানদের প্রাধান্য সম্পূর্ণ লুপ্ত হয়েছিল। আমি এই দুটি মতের কোনোটাই মানতে রাজি নই, কারণ সাৱা ভারতে মুসলমানদের সংখ্যার অনুপাতে দেশের রাষ্ট্রীয় জীবনে তাদের প্রাধান্য ইংরেজ আমলে বা তারও আগে কখনো কমেনি বলেই আমার ধারণা। আজকাল হিন্দু-মুসলমানদের মধ্যে যে সাম্প্রদায়িক বিভেদের কথা প্রায়ই প্রচার করা হয় সেটা নেহাৎই কৃত্রিম, অনেকটা আয়র্ল‍্যাণ্ডের ক্যাথলিক-প্রোটেস্ট্যাণ্ট বিরোধের মতো—এবং এর জন্য যে আমাদের বর্তমান শাসকেরাই বহুল পরিমাণে দায়ী সে কথা অস্বীকার করবার উপায় নেই। ইংরেজরা এদেশে আসবার আগে দেশের শাসনতন্ত্র মুসলমানদের হাতে ছিল বললে সম্পূর্ণটা বলা হয় না, কারণ দিল্লীর মোগল বাদশাহের সময়েই বলুন বা বাঙলার মুসলমান নবাবদের আমলেই বলুন, হিন্দু-মুসলমান পরস্পর সহযোগিতা না করলে শাসনকার্য চালানো কোনোমতেই সম্ভব ছিল না। মোগল বাদশাহ এবং মুসলমান নবাবদের মন্ত্রী ও সেনাপতিদের মধ্যে অনেক হিন্দুও ছিল। ভারতে মোগল সাম্রাজ্যের প্রসারও সম্ভব হয়েছিল হিন্দু সেনাপতিদের সাহায্যেই। ১৭৫৭ সালে পলাশীর যুদ্ধক্ষেত্রে নবাব সিরাজদৌল্লার যে সেনাপতি ইংরেজদের সঙ্গে যুদ্ধ করেন, তিনি হিন্দু ছিলেন। আর ১৮৫৭ সালে ইংরেজদের বিরুদ্ধে হিন্দু-মুসলমানের সম্মিলিত বিদ্রোহের নেতা ছিলেন একজন মুসলমান—বাহাদুর শাহ।

যাই হোক, ইংরেজরা ভারত দখল করবার পর বাঙলাদেশে যে ক'জন মনীষীর আবির্ভাব হয়েছিল, যে কারণেই হোক তাঁদের অধিকাংশই ছিলেন হিন্দু। এদের মধ্যে রাজা রামমোহন রায় (১৭৭২-১৮৩৩) অন্যতম। ১৮২৮ সালে ইনি ব্রাহ্মসমাজ প্রতিষ্ঠিত করেন। ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রারম্ভে বাঙলাদেশে ধর্ম ও সংস্কৃতির ক্ষেত্রে এক নতুন ধারার সুচনা দেখা দেয়। এর মূলে ছিল নবগঠিত ব্রাহ্মসমাজ। এই আন্দোলন অনেকটা রেনেসাঁস ও রেফরমেশন-এর একটি সমন্বয়ের মতো। এদিকে এই আন্দোলন দেশের স্বকীয় ঐতিহ্যের পূনর‍ূদ্ধার এবং ধর্মের সংস্কারের পক্ষপাতী ছিল এবং অন্য দিকে, অন্যান্য দেশের ধর্ম ও সংস্কৃতি থেকে ভালো জিনিসটুকু গ্রহণ করতেও কম উৎসুক ছিল না। এই নবজাগরণের অগ্রদত ছিলেন রামমোহন রায়। ভারতবর্ষের ইতিহাসে তিনি এক নতুন অধ্যায় সৃষ্টি করে গেছেন। তিনি যে কাজ আরম্ভ করেছিলেন, তাঁর মৃত্যুর পর কবিবর রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পিতা মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৮১৮-১৯০৫) এবং ব্রহ্মানন্দ কেশবচন্দ্র সেন তার ভার গ্রহণ করেন। ব্রাহ্মসমাজের প্রভাব ক্রমেই বৃদ্ধি পেতে থাকে। এক সময়ে ব্রাহ্মসমাজই যে দেশের সব রকম প্রগতিশীল আন্দোলনের কর্ণধার ছিল সে কথা সকলেই স্বীকার করবে। প্রথম থেকেই ব্রাহ্মসমাজের দৃষ্টিভঙ্গীতে পাশ্চাত্য বিজ্ঞান ও দর্শনের প্রভাব পড়েছিল এবং সদ্যপ্রতিষ্ঠিত বৃটিশ সরকার যখন স্থির করে উঠতে পারছিলেন না যে এদেশে তাঁরা সম্পূর্ণ দেশীয় শিক্ষাব্যবস্থাই সমর্থন করবেন, না পাশ্চাত্য সংস্কৃতি প্রচার করবেন, তখন রাজা রামমোহন রায় মুক্তকণ্ঠে পাশ্চাত্য সভ্যতার স্বপক্ষে রায় দেন। তাঁর আদর্শ টমাস ব্যাবিংটন মেকলেকে কতখানি প্রভাবান্বিত করেছিল মেকলের বিখ্যাত ‘মিনিট অন এডুকেশন'এ তার পরিচয় পাওয়া যায়। রামমোহন রায়ের আদর্শকেই সরকারের পক্ষ থেকে গ্রহণ করা হয়। রামমোহন তাঁর গভীর অন্তর্দৃষ্টি দিয়ে বহুদিন আগেই বুঝেছিলেন পাশ্চাত্য বিজ্ঞান ও দর্শনকে গ্রহণ না করলে দেশের উন্নতি অসম্ভব।

অবশ্য এই সাংস্কৃতিক বিপ্লব শ‍ুধু, যে ব্রাহ্মসমাজেই নিবদ্ধ ছিল তা নয়। যাঁরা ব্রাহ্মদের সমাজদ্রোহী ও ধর্মবিরোধী বলে মনে করতেন তাঁরাও স্বদেশের প্রাচীন সংস্কৃতিকে পুনর‍ুজ্জীবিত করবার জন্য উৎসুক হয়ে উঠেছিলেন। পাশ্চাত্য সংস্কৃতির সঙ্গে সমতালে চলবার অন্য ব্রাহ্ম এবং অন্যান্য প্রগতিপন্থী সম্প্রদায় যখন পাশ্চাত্য সভ্যতার সার জিনিসগ‍ুলি আহরণ করতে ব্যস্ত তথন অধিকতর গোঁড়া সম্প্রদায়ের লোকেরা হিন্দুসমাজের মহিমা কীর্তন করতে ব্যগ্র হয়ে পড়লেন এবং প্রচার করতে লাগলেন হিন্দুসমাজে সবই অভ্রান্ত। এমন কি তাঁরা এও দাবি করলেন যে পাশ্চাত্য সভ্যতা যেসব নতুন নতুন বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার নিয়ে আজ গর্ব করছে সেসবই ভারতের প্রাচীন মুনিঋষিরা বহুদিন আগেই আবিষ্কার করে গেছেন। এইভাবে পাশ্চাত্য সভ্যতার সঙ্গে সংঘর্ষের ফলে অত্যন্ত গোঁড়া সম্প্রদায়ও কর্মতৎপর হয়ে উঠেছিল। এদের মধ্যে অনেকেই সাহিত্যিক হিসেবে যথেষ্ট নাম করেছিলেন—শশধর তর্কচূড়ামণির নাম তার মধ্যে সবচেয়ে বিখ্যাত। কিন্তু এঁদের রচনার প্রধান উদ্দেশ্যই ছিল খৃস্টান মিশনারিদের প্রভাব খর্ব করে হিন্দুধর্মের প্রচার করা। এ ব্যাপারে অবশ্য ব্রাহ্মদের সঙ্গে গোঁড়া পণ্ডিতদের মতৈক্য ছিল, কিন্তু অন্য সব ব্যাপারে তাঁদের মধ্যে কখনো মতের মিল দেখা যায়নি। পুরাতনপন্থীদের সঙ্গে নতুনের, পণ্ডিতদের সঙ্গে ব্রাহ্মদের এই সংঘর্যের ফলে আর একটি নতুন মতের উদ্ভব হয়েছিল। এই নতুন মতের প্রধান সমর্থক হলেন পণ্ডিত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর। এই মতের সমর্থকেরা প্রগতিপন্থী ছিলেন, এবং তাঁরা দেশীয় ও পাশ্চাত্য সংস্কৃতির সমন্বয়ের সমর্থন করতেন। কিন্তু পাশ্চাত্য সংস্কৃতির ধারাকে মোটামুটি সমর্থন করলেও এঁরা কখনো হিন্দুসমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন হতে রাজি হননি এবং প্রথম যুগের ব্রাহ্মদের মতো পাশ্চাত্য রীতিনীতির অন্ধ অনুকরণকেও সমর্থন করেননি। গোঁড়া পণ্ডিতর‍ূপে শিক্ষিত হলেও ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর পাশ্চাত্য বিজ্ঞান ও সংস্কৃতির একজন প্রধান সমর্থক ছিলেন। তাঁর মহানুভবতা এবং সমাজসংস্কারের প্রচেষ্টা তো সর্বজনবিদিত। এ ছাড়া আধুনিক বাঙলা গদ্যের জনক হিসেবেও বাঙলা সাহিত্যে তাঁর স্থান সুপ্রতিষ্ঠিত। কিন্তু এত প্রগতিপন্থী হলেও বিদ্যাসাগর ব্যক্তিগত জীবনে চিরকাল অত্যন্ত নিষ্ঠাবান পণ্ডিতের মতো অনাড়ম্বর জীবনযাপন করেছেন। বিধবা বিবাহের স্বপক্ষে তুমুল আন্দোলন করে তিনি রক্ষণশীল সম্প্রদায়ের বিরাগভাজন হয়েছিলেন— কিন্তু তিনি প্রমাণ করেছিলেন যে বিধবা বিবাহ সম্পূর্ণ শাস্ত্রসম্মত। ঈশ্বরচন্দ্র যে মানসিক উদারতা ও মানবহিতৈষণার প্রতিভূস্বর‍ূপ ছিলেন ধর্মে ও দর্শনে তার প্রকাশ পেয়েছিল রামকৃষ্ণ পরমহংসদেব (১৮৩৪-৯৮৮৬) ও তাঁর যোগ্য শিষ্য স্বামী বিবেকানন্দের (১৮৬০-১৯০২ মধ্যে। ১৯০২ সালে স্বামী বিবেকানন্দ মারা গেলে এই আধ্যাত্মিক আন্দোলনের ধারা বহন করবার ভাৱ পড়ল অরবিন্দ ঘোযের উপর। কিন্তু অরবিন্দ রাজনীতি এড়িয়ে চলেননি, বরং রাজনীতি নিয়ে বিশেষভাবেই মেতে উঠেছিলেন, যার ফলে ১৯০৮ সালে দেশের রাজনৈতিক নেতাদের মধ্যে তিনিই সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিলেন। আরবিন্দের মধ্যে রাজনীতি ও আধ্যাত্মিকতার অপর সমন্বয় ঘটেছিল। ১৯০৯ সালে অরবিন্দ রাজনীতি থেকে অবসর গ্রহণ করে আধ্যাত্মিক চর্চায় মনোনিবেশ করেন। অরবিন্দের মধ্যে রাজনীতি ও আধ্যাত্মিকতার যে সময় দেখা গিয়েছিল তার ধারা বহন করতে লাগলেন লোকমান্য বালগঙ্গাধর তিলক (১৮৫৬-১৯২০) এবং মহাত্মা গান্ধী (১৮৬৯-১৯৪৮)।

বইয়ের এই সংক্ষিপ্ত ঐতিহাসিক পটভূমিকা থেকে আমার বাবা যখন কলকাতার অ্যালবার্ট স্কুলের ছাত্র ছিলেন সেই সময়কার সামাজিক অবস্থার মোটামুটি একটা ধারণা পাওয়া যাবে। সমাজের শীর্ষস্থান অধিকার করেছিল তখন এক নব্য অভিজাত সম্প্রদায়, বৃটিশ শাসনের আওতায় যাদেৱ জন্ম। আজকের দিনে সোশ্যালিস্টদের ভাষায় এদের বলা চলে ‘বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদের মিত্র’। এই নব্য অভিজাত সম্প্রদায় তিনভাগে বিভক্ত ছিল—(১) জমিদার, (২) আইনজীবী এবং সিভিল সার্ভেণ্ট, (৩) ধনী ব্যবসায়ী। বৃটিশ শাসকেরা তাদের শাসন ও শোষণ নীতি অবাধে চালাবার জন্যই এদের সষ্টি করেছিল।

বৃটিশ শাসনে যে জমিদার সম্প্রদায় বিশেষ প্রাধান্য লাভ করেছিল তাদের স্বাধীন বা অর্ধস্বাধীন সামন্তরাজাদের পর্যায়ে ফেলা চলে না, কারণ একমাত্র রাজস্ব আদায় করা ছাড়া এদের কোনো কাজই ছিল না বৃটিশ সরকারও এদের ট্যাক্স-কালেক্টরের বেশি মর্যাদা কখনো দেয়নি। ১৮৫৭ সালের বিদ্রোহের সময়ে যখন ইংরেজদের পতন প্রায় অবশ্যম্ভাবী হয়ে উঠেছিল সেই সময়ে এরা রাজভক্তির যে পরাকাষ্ঠা, দেখিয়েছিল তারই প্রতিদানে বৃটিশ সরকার এদের জমিদার পদমর্যাদা দিয়ে পুরস্কৃত করেছিল।

বিদেশী শাসকের গড়া এই নব্য অভিজাত সম্প্রদায় যে তখনকার সমাজে শীর্ষস্থান অধিকার করেছিল সে কথা অস্বীকার করার উপায় নেই। মহারাজা যতীন্দ্রমোহন ঠাকুর, রাজা বিনয়কৃষ্ণ দেববাহাদুর প্রমুখ লোকদের সরকারপক্ষ সমাজের নেতা বলে গ্রহণও করেছিল। কিন্তু সাধারণ লোকের উপর এদের নৈতিক বা সাংস্কৃতিক কোনো প্রভাবই ছিল না। আমার পিতার যৌবনকালে এই প্রভাব বিস্তার করেছিলেন কেশবচন্দ্র সেন এবং কিছু পরিমাণে পণ্ডিত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর। কেশবচন্দ্রের শিষ্য ছিল অগণন, তিনি যেখানেই যেতেন বিরাট জনতা তাঁকে ঘিরে থাকত। তাঁর বক্ত‌ৃতার আধ্যাত্মিক ভাবধারা সমাজের উপর বিশেষ প্রভাব বিস্তার করেছিল। বিশেষত যুবসম্প্রদায়ের উপর তার প্রভাব ছিল অপরিমেয়। অন্যান্য ছাত্রদের মতো আমার পিতাও কেশবচন্দ্রের অসাধারণ ব্যক্তিত্বে প্রভাবান্বিত। হয়েছিলেন, এমন কি এক সময়ে তিনি ব্রাহ্মধর্মে দীক্ষা নেবার উদ্যোগও করেছিলেন। যাই হোক, আমার পিতার জীবনে কেশবচন্দ্রের প্রভাব যে খুব বেশি ছিল সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। এর বহুদিন পরে কটকপ্রবাসের সময়ে এই মহাপুরুষের অনেক ছবি আমাদের বাড়ির দেয়ালে টাঙ্গানো দেখেছি। স্থানীয় ব্রাহ্মসমাজের সঙ্গেও আমার পিতার অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল।

আমার পিতার প্রথম বয়সে দেশে এক ধরনের নৈতিক জাগরণ দেখা গিয়েছিল সত্যি, কিন্ত‌ু রাজনীতির দিক থেকে তখন পর্যন্ত দেশের লোকের মধ্যে কোনো সাড়াই জাগেনি। কেশবচন্দ্র ও ঈশ্বরচন্দ্র—সমাজসংস্কারক হিসেবে দুজনেই বিশেষ প্রভাবশালী ছিলেন, কিন্তু এঁরা কেউই বৃটিশ সরকারের বিরোধী ছিলেন না। বরং কেশবচন্দ্র খোলাখুলিভাবেই বলতেন যে বৃটিশ শাসন এদেশে ভগবানের আশীর্বাদস্বর‍ূপ। স্বাধীনচেতা ও আত্মমর্যাদাসম্পন্ন লোক হলেও ঈশ্বরচন্দ্রও কখনো সরকার বা ইংরেজ জাতির সঙ্গে বিরোধিতা করেননি। আমার পিতাও প্রখর নীতিজ্ঞানসম্পন্ন হলেও সরকারবিরোধী ছিলেন না। এবং এজন্যই তিনি সরকারপক্ষের উকিল ও পাব‍্লিক প্রোসিকিউটরের পদ এবং সরকারী খেতাব গ্রহণ করেছিলেন। আমার জ্যেঠামশাই অধ্যক্ষ দেবেন্দ্রনাথ বসুর প্রকৃতি ঠিক বাবার মতোই ছিল। তাঁর নিষ্কলঙ্ক চরিত্র এবং অসাধারণ মনীষার জন্য ছাত্ররা তাঁকে দেবতার মতো ভক্তি করত। তিনিও শিক্ষাবিভাগে সরকারী চাকরি করতেন। একই কারণে বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের (১৮৩৮-১৮৯৪) পক্ষে “বন্দে মাতরম্” গানটি রচনা করেও সরকারী চাকরি করা সম্ভব ছিল এবং ম্যাজিস্ট্রেট হয়েও ডি. এল. রায়ের পক্ষে স্বদেশী গান রচনা করা অস্বাভাবিক মনে হয়নি। যে যুগসন্ধিক্ষণে এ ধরনের মনোভাব সম্ভবপর ছিল সে সময়ে দেশের লোকেদের মধ্যে রাজনৈতিক চেতনা ছিল না বললেই চলে। ১৯০৫ সালে জনমতের বিরুদ্ধে বঙ্গবিভাগ হবার পর থেকেই দেশে রাজনৈতিক সচেতনতা দেখা দেয় এবং তখন থেকেই সরকারের সঙ্গে জনসাধারণের বিরোধের সুত্রপাত। আজকের দিনে সরকার সম্বন্ধে জনসাধারণ অত্যন্ত বির‍ুদ্ধভাবাপন্ন এবং সরকারও জনসাধারণের কার্যকলাপ সম্বন্ধে অতিমাত্রায় সন্দিগ্ধ। এখন আর ন্যায়-অন্যায় বোধকে রাজনীতি থেকে আলাদা করে দেখা চলে না—এবং ন্যায়ের পথ ধরলে রাজনৈতিক সংঘর্ষ অবশ্যম্ভাবী। জাতীয় জীবনের অভিজ্ঞতা ধারা খণ্ডিতভাবে প্রত্যেকের ব্যক্তিগত জীবনেই প্রতিফলিত হয়—আমার জীবনেও তার ব্যতিক্রম হয়নি। আমি এককালে ভাবতাম সম্পূর্ণভাবে রাজনীতি এড়িয়েও নৈতিক ও সাংস্কৃতিক উন্নতি সম্ভব। কিন্তু আমার ভুল ভাঙতে বেশি দেরি হয়নি। জীবনকে এভাবে রাজনীতির প্রভাব থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেখলে জীবনের অনেকখানিই অসম্পূর্ণ থেকে যায়—খণ্ডিত আদর্শের কোনো মূল্যই নেই, কোনো একটি আদর্শকে সফল করে তুলতে হলে সমগ্র জীবন দিয়ে তাকে মানতে হবে। অন্ধকার ঘরে যদি একটি আলো রাখা যায় তবে সমস্ত ঘরটাই কি আলোকিত হয়ে উঠবে না!