অযাচিত

 “শুধু সেই জন্য তুমি আমাকে বিয়ে করতে চাও না, না আর কিছু কারণ আছে?” জমিদার হৃদয়নাথ একটু উত্তেজিত ভাবে এই প্রশ্ন করিয়া ব্যগ্রভাবে অদূরবর্ত্তিনী প্রস্তরমূর্ত্তিবৎ স্থির রমণীর পানে চাহিলেন। পার্শ্বস্থ ঝোপওয়ালা ঝাঁটী গাছটীর উপর সে বাম হস্তের ফুলের সাজিটি রাখিয়া লজ্জা ও বিষাদে চক্ষু নত করিল, উত্তর দিল না। হৃদয়নাথ নিকটবর্ত্তী একটা মাধবী লতার ফুল ছিঁড়িয়া আবার প্রশ্ন করিলেন, “ভয় করবার দরকার নাই, সুমিত্রা, আমাদের মধ্যেকার অবস্থার ব্যবধান ভুলে যাও। আমি জোর ক’রে তোমায় আমার স্ত্রী কর‍্তে চাই না, তা তুমি দেখ‍্তেই পাচ্ছ। সে ইচ্ছা থাকলে তোমার বাবাকে বল‍্তে পারতুম। আমি জানি, আমি দেখিতে সুন্দর নই,— শুধু তাই নয়, বরং দেখিতে কুৎসিতই। কোন সুন্দরী স্ত্রীলোকের পক্ষে আমায় পছন্দ করা সম্ভব নয়। সেই জন্য এতদিন সে চেষ্টা করিওনি। কে জানে যাহাকে বিয়ে কর‍্ব, সে আমায় পচ্ছন্দ করিবে কি না; কিন্তু এখন যেন এ নিঃসঙ্গ জীবন ক্রমেই অসহ হয়ে উঠেছে।”

 সুমিত্রা ঈষৎ ভীতভাবে মুখ নত করিয়াই ধীরে ধীরে বলিল, “কিন্তু সে ব্যবধান যে ভোলবার নয়! আমি আপনার এক জনগরীব প্রজার মেয়ে, লোকে আপনাকে কি বল‍্বে?”

 হৃদয়নাথ ঈষৎ হাসিয়া প্রসন্নমুখে বলিয়া উঠিলেন, “শুধু এই যদি তোমার আপত্তির কারণ হয়, তা’হলে তুমি সে ভয় করো না, লোকে হৃদয়নাথকে চেনে। এখন আমায় বল সুমিত্রা, আমি তোমায় আমার ভাবী পত্নী ব’লে আশা কর‍্তে পারি কি না? ‘না’ বলো না সুমিত্রা, আমার আশা ভঙ্গ করো না।”

 সুমিত্রা কম্পিত হস্তে সাজিটা তুলিয়া লইয়া এক বার চকিতমাত্র প্রস্তাবকারীর মুখের পানে চাহিয়া অক্ষুটস্বরে বলিল, “আচ্ছা।”

 জমিদার হৃদয়নাথ এবার গ্রীষ্মের সময় তাঁহার পল্লীভবনে আসিয়া অবধি এই যুবতী কুমারীটিকে প্রত্যহ তাঁহাদের বাটীর সহিত সংলগ্ন নবসংস্থাপিত ক্ষুদ্র স্কুলগৃহের বাগানের পাশ দিয়া গমনাগমন করিতে দেখিতেছিলেন। প্রথম দুই চারি দিন তিনি নব প্রণালীতে পরা মোটা সাড়ির লম্বিত অঞ্চলখানি দূর হইতে দেখিতে পাইলেই সসম্ভ্রমে সরিয়া যাইতেন—একটা ক্ষণিক দৃষ্টি দ্বারাও ছায়াপাত করিতে শঙ্কা ও লজ্জা বোধ করিতেন। তথাপি এই দূর পল্লীগ্রামের মধ্যে এইরূপ সঙ্কোচহীন আত্মনির্ভরতার একটা মহৎ দৃষ্টান্ত তাঁহাকে তাহার প্রতি আকৃষ্ট করিয়া তুলিতেছিল।

 ক্রমে কৌতূহল লজ্জাকে জয় করিতে লাগিল। হৃদয়নাথ একদিন স্কুল পরিদর্শনে গিয়া বর্ষীয়সী প্রধান শিক্ষয়িত্রীর অন্তর্বর্ত্তিনী দ্বিতীয় শিক্ষয়িত্রী বিশ্বাসকুমারীর সঙ্গে পরিচিত হইয়া আসিলেন। সে পরিচয়ে সুমিত্রা তাঁহার সহৃদয়তা ও হৃদয়নাথ বিশ্বাস-কুমারীর ভক্তি ও সম্ভ্রম লাভ করিলেন।

 ইহার পর হইতে হৃদয়নাথ স্কুলটীর উন্নতি-বিধানে অত্যন্ত মনোেযোগী হইলেন। সর্ব্বদাই তিনি স্কুলগৃহে যাতায়াত করিতে আরম্ভ করিলেন ও অবশেষে একদিন স্কুলের ফেরত, সুমিত্রা যখন তাঁহার নির্জ্জন বাগানে সাজি ভরিয়া ফুল তুলিতেছিল, সেই সময় সহসা সে তাহাদের জমিদারের আকস্মিক আগমনে লজ্জিত ও ঈষৎ অপ্রতিভ হইয়া তাড়াতাড়ি ফিরিতে গিয়া বাধা প্রাপ্ত হইল। হৃদয়নাথ দুঃখিত হইয়া বলিলেন, “আমার বাগানের ফুল যদি তাদের সৌভাগ্যক্রমে তোমার হাতের স্পর্শলাভে গর্ব্বিত হয়েছিল, সেটুকু থেকে কি আমার দোষে তারা বঞ্চিত হবে?” তারপর লজ্জাকুণ্ঠিত। সুমিত্রা আকাশ-কুসুমের মত অসম্ভব প্রস্তাব শুনিয়া বিস্ময়ে হতবুদ্ধি হইয়া গিয়াছিল।

 দরিদ্র হরিহর বিশ্বাস যখন তাহার বৃদ্ধা জননীর নির্ব্বন্ধাতিশয্যে এক দরিদ্রতর ভদ্রলোকের কন্যাকে তাঁহার পত্নীরূপে গ্রহণ করিয়া তাহার পরোপকারিতার পরিচয় দান করে, তখন সে স্বপ্নেও ভাবে নাই যে, সেই বিবাহবন্ধন তাহার গলবন্ধন-রজ্জু হইয়া শীঘ্রই তাহার কণ্ঠকে নির্দ্দয়রূপে চাপিয়া ধরিবে। আমাদের দেশের অধিকাংশ হতভাগ্যের মত সেও ভবিষ্যৎ আশার কুহকে ভুলিয়া, দারিদ্র্য-পীড়িত গৃহে গৃহলক্ষ্মী বরণ করিয়া তুলিবার পরিবর্ত্তে অলক্ষ্মীরূপিণী দারিদ্র্যকেই আবাহন করিয়া বসিল। জমীদারের স্কুলে থার্ডক্লাশ পর্য্যন্ত পড়িয়া সে তাহার ভবিষ্যৎ জীবনটাকে রাজধানীর কোন এক অপরিচিত ক্ষুদ্র মেসের মধ্য দিয়া সাধারণের প্রশংসা দৃষ্টির সম্মুখে পরিচিত করিয়া তুলিবার যে সুদূর কল্পনা করিয়া রাখিয়াছিল, তাহা এই গলরজ্জু-বন্ধনের প্রথম ফল ফলিতেই ঘুরিয়া গেল। চারিটি প্রাণীর আহার যোগাইয়া কলিকাতায় গিয়া পড়াশুনা করা সম্ভব নয়। অনেক চেষ্টার পর হরিহর জমিদার সেরেস্তায় একটী ২০ টাকা মাহিনার কাজ পাইল। তাঁহার উন্নতি ও উৎসাহের এইখানেই সমাধি হইয়াছিল।

 ইহার পর প্রতি বৎসর একটী প্রাণীকে তাহাদের হ্রসমান আহার্য্যের অংশ-প্রদান, এবং দুর্ব্বল ও রুগ্ন বালকবালিকাগুলির রোগশয্যা পার্শ্বে বিনিদ্র রাত্রিযপনান্তে ভোরের আলোয় দুখানি বাসি রুটী দ্বারা রোগজীর্ণ পাকযন্ত্রের অত্যল্প অভাব ঘুচাইয়া ছিন্ন পাদুকযুগলের মধ্যে ভারবহনে অসম্মত পদদ্বয় জোর করিয়া প্রবেশ করাইয়া, তালি দেওয়া পুরাণ কালের ছাতাখানি ঘাড়ে করিয়া—শ্লথগতিতে জমিদারী কাছারী উদ্দেশে গমন ভিন্ন তাহার জীবনে স্মরণীয় কিছুই ঘটে নাই। কেবল মাত্র এক বার কলেরায় ও একবার ম্যালেরিয়ায় তাহাদের দুঃখ-জীবনের অংশ, দুইটা সন্তানকে পথ্য ও চিকিৎসার অভাবে হারাইয়া তাহার অকালপক্ক কেশ ও শ্মশ্রু অধিক পরিমাণে শুভ্র হইয়া উঠিয়াছিল এবং তাহার ম্যালেরিয়াক্রান্ত পত্নী সেই সময় হইতে তীব্র শিরঃপীড়ায় আক্রান্ত হইয়া প্রায় শয্যাগত হইয়াছেন।

 হরিহরের অনেকগুলি পুত্রকন্যার মধ্যে সুমিত্রা ও কল্যাণী সকলের বড়। সুমিত্রা ও কল্যাণী এতদিন কলিকাতায় তাহাদের মাসীর বাড়ীতেই থাকিত। মাসীর অবস্থা তাহাদের চেয়ে অনেক ভাল ছিল এবং তিনি বোনের ছেলে-মেয়েদের মধ্যে সুস্থ ও সুন্দর বলিয়া এই দুইটীকেই বেশী ভালবাসিতেন। মাসীর মেয়েদের সহিত স্কুলে গিয়া তাহারা কিছু লেখাপড়াও শিখিয়াছিল। মাসী সুমিত্রার জন্য একটা মেডিকেল কলেজের ছাত্রকে পাত্র স্থির করিয়াছিলেন। প্রভাস সুমিত্রার মাসীর বাড়ীতে থাকিয়া কলেজে পড়িত। তাহার অবস্থাও তেমন ভাল ছিল না, কিন্তু তাহার উদ্যমপূর্ণ হৃদয়ে ভবিষ্যতের যে আশা সঞ্চিত ছিল, কলেজের অধ্যক্ষগণ তাহার পোষকতাই করিতেন। মাসী তাহার শেষ পরীক্ষার দিন গণিতেছিলেন, সুমিত্রা তাহার শান্ত হৃদয়ের মধ্যে একটা উজ্জ্বল সুখের চিত্র নীরবে অঙ্কিত করিয়া তুলিতেছিল। এমন সময় তাহাদের সংসারে এক অভাবনীয় ঘটনা ঘটিল।

 সুমিত্রার স্নেহময়ী মাসীমা হঠাৎ একদিন প্লেগে মারা গেলেন। ওদিকে তাহার মা শয্যাগত, সংসারের সমুদয় ভার ঘাড়ে লইয়া পিতা হাবুডুবু খাইতেছেন। সুমিত্রা ও কল্যাণী বাড়ী ফিরিয়া আসিল। কিন্তু সংসার এদিকে অচলপ্রায়। বৃদ্ধ পিতার জীবনের বিন্দু বিন্দু ক্ষয় করা ঐ কুড়িটা টাকা ঘরের দ্বার হইতেই পাওনাদারের বাড়ী চলিয়া যায়; সমুদয় মাসটা বুভুক্ষা ও অভাব মুখব্যাদান করিয়া প্রত্যেক প্রাণীটিকে গ্রাস করিতে আইসে। সকলের নিন্দা ভর্ৎসনা অগ্রাহ্য করিয়া সুমিত্রা নূতন স্থাপিত বালিকা-পাঠশালায় শিক্ষয়িত্রীর কাজ গ্রহণ করিল। প্রথম লোকনিন্দায় উত্ত্যক্ত হইয়া হরিহর সুমিত্রার এ স্বাবলম্বন বৃত্তি গ্রহণে আপত্তি করিয়াছিল। কিন্তু শেষে মাসিক পনেরো টাকার লোভ ত্যাগ করা তাহার পক্ষে দুঃসাধ্য হইয়া উঠিল। বিশেষতঃ কল্যাণী যখন তাহার দৃঢ়প্রতিজ্ঞাব্যঞ্জক ললাট কুঞ্চিত করিয়া উজ্জ্বল চক্ষে তীব্রম্বরে বলিয়া উঠিল, “যারা নিন্দে কর‍্ছিল তারা কি আমাদের বিপদের দিনে এতটুকু সাহায্য করেছিল, বাবা?” তখন হরিহর চক্ষু পুনঃ পুনঃ মার্জ্জনা করিয়া গম্ভীরস্বরে কহিলেন “তোরাই আমার ছেলে। মা, ধর্ম্ম আর এই বৃদ্ধ পিতাকে সর্ব্বদা স্মরণ রেখে কর্ত্তব্য ক’রে যাও, ভগবানের অভিশাপ আমার সঙ্গেই থাকবে, তোমাদের স্পর্শ কর‍্বে না, তিনি কর্ত্তব্যের পুরস্কার দিতে জানেন।” একে আইবুড়া হাতীর মত মেয়ে দেখিয়াই গ্রামের লোক আশ্চর্য্য হইয়া গিয়াছিল, তাহার উপর সেই ধেড়ে মেয়ে যখন গুরুমা সাজিল, তখন আর তাহারা বিস্ময় ও লজ্জা রাখিবার স্থান পাইল না।

 সে দিন আকস্মিক ভাগ্যপরিবর্ত্তনে বিস্ময়াভিভূতা সুমিত্রা ঘরে ফিরিয়াই তাহার সুখ দুঃখের চিরসঙ্গিনী কল্যাণীকে সকল কথা বলিল। কল্যাণী আরব্য উপন্যাসের গল্প যেমন বিস্ময়ের সহিত দিদির কাছে শুনিত, তেমনই বিস্ময়ের সহিত সকল কথা শুনিয়া স্থির হইয়া বসিয়া রহিল; কোন মতামতই সে তখন প্রকাশ করিল না। সুমিত্রা বিস্মিত হইল। সে আশা করিতেছিল, আশাতিরিক্ত সুসংবাদ-দানে চঞ্চলা কল্যাণীকে কিরূপ আশ্চর্যান্বিত ও আনন্দিত করিয়া তুলিবে। সে হয়ত এই মুহূর্ত্তেই তাহার ভগ্নহৃদয় পিতা মাতাকে এই অপূর্ব্ব সুসংবাদ দিতে ছুটিয়া যাইবে ও মুহূর্ত্তে নিরানন্দ গৃহে আনন্দের উৎস প্রবাহিত করিয়া তাহাকে তাহার কর্ত্তব্যের পুরস্কার দান করিবে। কিন্তু তাহার কিছুই হইল না। সুমিত্রা ছেঁড়া জামা সেলাই করিতে করিতে দুই একবার বোনের সহসা গম্ভীর মুখের দিকে চাহিয়া দেখিল। কল্যাণীর গম্ভীর মুখকে সকলেই একটু ভয় করিত। তাই সেও একটু আশ্চর্য্য হইল।

 সহসা কল্যাণী জিজ্ঞাসা করিল, “তুমি তা’হলে হৃদয় বাবুকে বিয়ে করতে রাজী হয়েছ?”

 সুমিত্রা ঈষৎ অপ্রতিভ হইয়া নত মুখে উত্তর দিল, “হাঁ। না হয়েই বা কি করি?” “কেন?”

 কল্যাণীর গম্ভীর প্রশ্নে সুমিত্রা একটু উত্তেজিত হইয়া কহিল, “কেন, তা আর জিজ্ঞেস করোনা। মার এই এত বড় রোগের চিকিৎসা নাই, বাবার এই অবস্থা, ভাইবোন গুলির এই দুর্দ্দশা, এই মুহূর্ত্তেই সে সব ঘুচে যাবে জান, তবু জিজ্ঞাসা করচো, কেন?”— কল্যাণী একটু বেদনার সহিত কাপড়ের রিপু করা বন্ধ করিয়া বলিল, “সব সত্যি, কিন্তু তুমি কি সুখী হবে? সেই কথাটা ভাবো।”

 সুমিত্রা জোর করিয়া যে ব্যথাটা মন হইতে সরাইয়া ফেলিতেছিল, সেই বেদনাটার উপরই আঘাত পড়িল। তাই বোধ করি সে কিছুক্ষণ কথা কহিতে পারিল না। তার পর জোর করিয়া হাসিয়া বলিল, “আমার আবার সুখ কি? সবাই সুখী হ’লেই সেই সুখে আমি সুখী হব।”

 তথাপি তাহার কণ্ঠে বিষাদের সুর বাজিয়া উঠিল। চোখের জলের আভাসে সম্মুখের কাজ বাধা পাইতে লাগিল। কল্যাণী সেলাইটা ফেলিয়া দিয়া উদ্ধত ভাবে বলিয়া উঠিল, “আমাদের আসবার দিনও, প্রভাস বাবু কত আশা ক’রে বলেছেন, ‘আর এই কটামাস তোমরা অপেক্ষা করো। আমি আমার যথাশক্তি তোমাদের জন্য করবো।’ তাঁকে তুমি কি অপরাধে ত্যাগ কর‍্বে দিদি? এতে যে মহাপাতক হবে। আজ দু তিন বৎসর ধ’রে মাসিমা তাঁকে কথা দিয়ে রেখেছেন, তিনি তোমার জন্য নিজের প্রাণোৎসর্গ ক’রে মানুষ হবার চেষ্টা করছেন। এখন হঠাৎ এত বড় বিশ্বাসঘাতকতা কর‍্লে সে কি ধর্ম্মেই সইবে?” সুমিত্রা হঠাৎ সেলাইটা ফেলিয়া দিয়া বোনের কাঁধে মুখ লুকাইল। “কলী, চুপ কর ভাই! তাঁকে বলিস, দিদি তার বাপ মাকে রক্ষা করবার জন্য আত্মবলি দিয়েছে। জীবনে যে নরক যন্ত্রণা সইতে যাচ্চে, তার মরণের পরে নরকের ভয় কোথা?” কল্যাণী চুপ করিয়া রহিল।

 রাত্রে ছোট ভাই বোনগুলিকে ঘুম পাড়াইয়া, রুগ্না মাতার পায় হাত বুলাইয়া তাহাকে ঘুম পাড়াইয়া কল্যাণী রান্নাঘরে গিয়া দেখিল, হাঁড়ি হেঁসেল তুলিয়া সুমিত্রা কল্যাণীর ভাত একখানি পাথরে বাড়িয়া লইয়া বসিয়া আছে। কেরোসিনের ডিবের আলো অনর্গল ধূম বাহির করিতে করিতে মিট মিট করিয়া জ্বলিতেছে, আর সেই দিনের আলোরও অপ্রবেশ্য ক্ষুদ্র ঘরের দারুণ অন্ধকার ঈষৎ মাত্র দূর ও ঝুলের প্রচুরতা বৃদ্ধি করিতেছে। কল্যাণী মাটীর কলসী হইতে দুইটী ছোট চুমকি ঘটিতে জল গড়াইয়া আনিল। দুইখানি দেবদারু কাঠের পিঁড়ী আঁচল দিয়া মুছিয়া ঘরের বাহিরে রোয়াকের উপর পাতিল এবং জল-হাত দিয়া স্থানটী মুছিয়া হাত ধুইয়া ঘরে ঢুকিয়া বলিল, “দিদি এসো, ওমা! এতকটি ভাত কেন? কুলয়নি বুঝি?” সুমিত্রা বাড়া ভাতের পাথর খানা হাতে করিয়া তাড়াতাড়ি বলিয়া উঠিল, “না, না, তা কেন, আমার আজ ক্ষিধে নেই, তুই খেতে বস্।” কল্যাণীর মুখ গম্ভীর হইয়া আসিল। সে দ্বারে পিঠ দিয়া কঠিন হইয়া দাঁড়াইল। গম্ভীর মুখে বলিল, “আজ তিন দিন হ’ল রোজই তোমার রাত্রে ক্ষিধে থাকে না, সকালেও রোজ কম পড়ে। আজ সকালেতো খাওয়াই হয়নি, এমন করে না খেয়ে ক’দিন বাঁচবে, দিদি? তুমি খাও, আমি আজ খাব না, আমিত ওবেলা পেট ভরে খেয়েছি।” সুমিত্রা ম্লান মুখে কষ্টে হাসি আনিয়া বলিল, “কি বলিস্ তার ঠিক নেই; সত্যি বলছি, আমার ক্ষিধে নেই, না হ’লে দুটী আর রেঁধে নিতে পারতুম না?”

 “চাল কোথায় যে, রাঁধবে? রোজ রোজ চাল কিনে কি চলে? একেবারে কিন‍্লেই হয়।”

 সুমিত্রা বাধা দিয়া বেদনার স্বরে কহিল, “টাকা কোথায় যে একবারে কিন‍্বো বল? ধারেই তো সব চলচে। কলী, বস্ ভাই, খেয়ে নে, মাথাটা বড্ড ধরেছে, আর দাঁড়াতে পাচ্ছিনে।”

 কল্যাণী একটা সুদীর্ঘ নিশ্বাস ফেলিয়া বলিল, “তবে এস, দুজনেই এই ভাতকটা ভাগ ক’রে খাই, তা না হ’লে আমিও আজ কিছুতেই খাব না।”

 সে রাত্রে কল্যাণী কিছুতেই ঘুমাইতে পারিল না। ভাবনার পর ভাবনা আসিয়া তাহার চিত্তকে একেবারে পীড়িত করিয়া তুলিতে লাগিল। সে কিছুক্ষণ চুপ করিয়া বিছানায় পড়িয়া ভাবিতে লাগিল। তারপর ধীরে ধীরে উঠিয়া পাশের ঘুমন্ত ভাইটীকে নিজের বিছানায় তুলিয়া শোয়াইয়া দিয়া সে তাহার দিদির কাছে গিয়া শুইল। সে বুঝিতে পারিয়াছিল, তাহার দিদিও আজ তাহারই মত ঘুমাইতে পারে নাই। কল্যাণীর কাছে আসিয়া শোয়াতে সুমিত্রা সহসা চমকাইয়া জিজ্ঞাসা করিল, “কিরে কলী, এখনও ঘুমুস‍্নি যে?”

 কল্যাণী সুমিত্রার কণ্ঠস্বরে বুঝিতে পারিল যে, সে এতক্ষণ কাঁদিতেছিল। ধীর স্বরে উত্তর দিল, “ঘুম হচ্ছে না, ভারী গরম, তুমিও ত জেগে আছ।”

 “হাঁ মাথাটা বড় ধরেছে, জানালাটা না হয় খুলে দে না।”

 “না, থাক, ছেলেদের আবার ঠাণ্ডা লাগ‍্বে। এস তোমার মাথাটা একটু টিপে দি; তাহলে ছেড়ে যাবে এখন।” সুমিত্রার আপত্তি না মানিয়া কল্যাণী তাহার মাথার কাছে বসিয়া কপালে হাত বুলাইতে লাগিল। সুমিত্রা নিশ্বাস ফেলিয়া আবার বলিল, “সকালেই সেই খাট‍্নি আছে। শুয়ে ঘুম, কলী।” কল্যাণী আপনার জিদ্ কখনও ছাড়ে না, কাজেই শেষে সে নিজেই থামিয়া গেল।

 কিয়ৎক্ষণ পরে কল্যাণী হঠাৎ জিজ্ঞাসা করিল, ‘আচ্ছা দিদি, হৃদয় বাবু দেশ বিদেশে এত মেয়ে থাক‍্তে তোমাকেই যে হঠাৎ বিয়ে কর‍্তে চাইলেন, এর মানে কি? তিনি কি তোমায় ভালবাসেন?” সুমিত্রা এ সম্বন্ধে কোন কথাই ভাবিয়া দেখে নাই। সে ভাবিয়াছে, তাহাদের দারিদ্র্য ভয়ানক অসহ্য হইয়া দাঁড়াইয়াছে। এ বিবাহে সে দরিদ্রতা ঘুচাইয়া সচ্ছলতা লাভ করিতে পারিবে। সে ভাবিয়াছিল, তাহার চিরদুঃখিনী মা ঔষধ পথ্যের অভাবে এই চিরদুঃখের জীবন সাঙ্গ করিয়া তাহাদের জন্মের মত ছাড়িতে উদ্যত। এইবার বুঝি তবে সে তাহাকে ধরিয়া রাখিবার পথ পাইল। একটু বিস্ময়ের সহিত উত্তর দিল, “তাতো জানিনে; হয়তো তাই বা, না হ’লে হঠাৎ বিয়ে করতে চাইবেন কেন?”

 উত্তরটা কল্যাণীর মতের সহিত মিলিল না। সে সেই অন্ধকারে দিদির মুখের উপর বিরক্ত দৃষ্টি নিক্ষেপ করিয়া ঈষৎ তীব্রভাবে বলিয়া উঠিল, “তা বই কি? বড়লোকের আবার ভালবাসা! বোধ হয়, তোমার সুন্দর রূপ দেখেই বিয়ে কর‍্তে চেয়েছেন।” সুমিত্রা ধীরভাবে কহিল, “তাও হ’তে পারে, তবে সুন্দর এমন কি দেখলেন!” কল্যাণীর মুখ গভীর চিন্তায় গম্ভীর হইয়া আসিল। সে শুইয়া পড়িয়া ধীরে ধীরে চিন্তাযুক্ত ভাবে বলিল, “তাই বোধ হয় হবে।”

 পর দিন সকালে উঠিয়া সুমিত্রা প্রতিদিনকার মত ঘরের কাজ-কর্ম্ম সারিতে গিয়া দেখিল, কল্যাণী তাহার আগে উঠিয়া বাসিকাজ সারিয়া ফেলিয়া উনানে আগুন দিতেছে। সুমিত্রার সাড়া পাইয়া সে ধোঁয়ায় অদৃশ্য প্রায় মুখ তুলিয়া বলিল, “দিদি আজ আর তুমি স্কুলে যেয়ো না, লোকে যদি শুনে থাকে, তবে কি বল্‌বে? আমি তোমার বদলে যাচ্ছি।” জেলখানার খোলা দরজার সম্মুখে মুক্তির পরওয়ানা শুনিলে কয়েদের আসামী যেমন গভীর আনন্দের সহিত নির্ব্বাক্ ভাবে চাহিয়া থাকে, সুমিত্রা তেমন করিয়া কতক্ষণ বোনের পানে চাহিয়া, স্নান করিতে চলিয়া গেল।

 কল্যাণী কলিকাতা হইতে আসিয়া অবধি নিজের অঙ্গের দিকে চাহিয়া দেখিতে অবসর পায় নাই। আজ সে এক পয়সার বেশম আনাইয়া আধঘণ্টা ধরিয়া গায়ের কালী তুলিতে বসিল। গরম তৈলের ছিটায় হাতে কতকগুলা ফোস্কা উঠিয়াছিল। ঘর্ষণে তাহা ছিঁড়িয়া গিয়া জ্বালা করিতে লাগিল। তথাপি সে অঙ্গ মার্জ্জন বন্ধ করিল। কাপড় ছাড়িয়া যখন রান্না ঘরে আসিয়া ভাত চাহিল, তখন অকস্মাৎ মুখ তুলিয়াই সুমিত্রা সবিস্ময়ে তাহার পানে চাহিয়া রহিল। একি তাহারই বোন কল্যাণী? ভস্মাচ্ছাদিত বহ্নির মত ভিতরে ভিতরে কি সৌন্দর্য্যই লুকান ছিল! সুমিত্রা বুকের কাছে কুণ্ডলিত নিশ্বাসটা টানিয়া লইল। সে স্বার্থপরের মত এখনও দ্বিধা করিতেছে। না, সবার সুখের জন্য সে নিজের সকল স্বার্থ ভুলিবে। নহিলে এই সব স্নেহের পুতুলের কি হইবে?

কল্যাণী আহারে বসিয়া স্কুল সম্বন্ধে দিদিকে প্রয়োজনীয় প্রশ্ন করিতেছিল। কিন্তু তাহার চিত্ত ভিতরে ভিতরে অত্যন্ত উদ্বেগ-ব্যাকুল হইয়া উঠিতেছে, তাহা তাহার মুখের চক্ষের ভাবে প্রকাশ হইয়া পড়িতেছিল। সুমিত্রা মিষ্ট ভর্ৎসনা করিয়া কহিল, “কিছুতেই যে খেতে পার‍্লি না, কল্যাণী”। কল্যাণী অন্যমনস্কভাবে জলের গ্লাস তুলিতেছিল, হাত কাঁপিয়া জল শুদ্ধ গ্লাসটা থালার উপর পড়িয়া গেল। লজ্জায় ও বিরক্তিতে ঈষৎ লাল হইয়া সে ধীরে ধীরে উত্তর দিল, “সকালে খাওয়া ত আর আমার অভ্যাস নেই।”

 সেদিন হৃদয়নাথ অন্য দিনের অপেক্ষা সকাল সকাল আহার সারিয়া খিড়কির বাগানে সেই লোহার বেঞ্চের উপর কামিনী গাছের ছায়ায় বসিয়াছিলেন। সমস্ত বাগানটা ভরিয়া আজ একটী নবীনত্বের হিল্লোল উঠিতেছিল। বসন্ত আসিতে দেখিলে যেমন মলয়ানিল তাহার আগমনবার্তা পূর্ব্বেই ঘোষণা করিতে থাকে, তেমনই বোধ হয়, আগতপ্রায় মিলনে একটী মধুর উচ্ছাসে বিগতপ্রায় দেবেন-সীমার প্রান্তবর্ত্তী গম্ভীর-প্রকৃতি প্রৌঢ়কে ঈষৎ উচ্ছ্বসিত করিয়াই শুধু ক্ষান্ত হয় নাই, তাহারই হৃদয়-ডালির আহরিত অর্ঘ্যে প্রেমও চারিপাশে পুষ্পসৌরভরূপে উদ্দাম হইয়া উঠিয়াছে। বাতাসে আকাশে পত্রে পুষ্পে সঙ্গীতের ঝঙ্কার উঠিতেছে। সে সঙ্গীতের প্রতি চরণই তাহাদের গৃহলক্ষ্মীর বন্দনা-গানে অমৃতময়।

 হৃদয়নাথ কোলের উপর একখানা বাঁধান বই রাখিয়া পুনঃ পুনঃ গ্রাম্য পথের পানে দৃষ্টি নিক্ষেপ করিতেছিলেন। একবার হঠাৎ তাঁহার মুখখানা আনন্দের জ্যোতিতে সম্পূর্ণ উজ্জল হইয়া উঠিল। বাতাসে স্থানভ্রষ্ট কেশ কয়গাছি সাবধানে স্বস্থানে স্থাপিত করিয়া রুমালে মুখবানা মুছিয়া ফেলিয়া সংযত ভাবে তিনি পুস্তক পাঠে মনঃসংযোগ করিলেন। অল্পক্ষণ পরে বেড়ার পাশে কাহার পায়ের মৃদু শব্দ হইল। হাতের চুড়ি কয়গাছি ঠন্ ঠুন্ করিয়া একটা কি যেন অস্ফুট সন্দেহের কথা বলিতে চাহিতেছিল। হৃদয়নাথ স্তম্ভিত বক্ষে বসিয়া রহিলেন। ইচ্ছাসত্ত্বেও চাহিয়া দেখিতে পারিলেন না। প্রথম দিনটা মনে যে কবিত্বের উচ্ছাস উঠিয়াছিল, আজ তাহা মিলাইয়া আসিয়াছে। বাগ‍্দত্তা স্ত্রীকে কি বলা যাইতে পারে, তাহা ভাবিয়া দেখা হয় নাই। যখন সঙ্কোচ কাটাইয়া তিনি মুখ তুলিলেন, তখন স্কুলগৃহের দ্বারের মধ্যে একখানি শুভ্র হস্তের একটা অংশ ও এক রাশি কাল চুল মাত্র চোখে পড়িল।

 কল্যাণী পরদিনও স্কুলে গেল। হৃদয়নাথ দৃঢ়সঙ্কল্প হইয়া বেলা তিনটার সময় হইতেই বাগানে রৌদ্র মাথায় করিয়া ঘুরিয়া বেড়াইতে লাগিলেন। গোলাপগাছের কলম তৈয়ার করিবার জন্য মালীকেও হঠাৎ তাঁহার খুব দরকার হইয়া দাঁড়াইল, দু একটা গাছের কলম করা সম্বন্ধে পরামর্শ দিয়াই হৃদয়নাথ তাহাকে ফরমাইস্ করিলেন, “খুব ভাল ক’রে একটা গোলাপের তোড়া তৈয়ার কর দেখি।” মালী আজ্ঞা পালন করিল। তোড়াটা হাতে লইয়া কিন্তু, হৃদয়নাথের একটু লজ্জা করিতে লাগিল, মালীটা কিছু বুঝিতে পারে নাই ত?

 সকলেই এতাবৎকাল তাঁহাকে নির্হৃদয় কৌমার্য্যব্রতধারী বলিয়া জানে। সহসা নিজের সেই পরিচয়টুকু নষ্ট করিতে হৃদয়নাথের মনের মধ্যে আনন্দের সঙ্গেও তাই একটা ব্যথাও যেন বাজিতেছিল।

 ঘড়িটা চারিটা বাজাইয়া চুপ হইল! কিন্তু হৃদয়নাথের বুকের মধ্যে ঝিম্ ঝিম্ করিয়া একটা সুর তালে তালে বাজিয়াই চলিল,—বিশেষতঃ যখন স্কুলের আলকাতরা মাখান ছোট দরজাটীর ভিতর দিয়া নিপুণভাবে ঝুলান একটী শুভ্র বস্ত্রের আঁচলখানি দক্ষিণের উদ্দাম বাতাসে চঞ্চল হইয়া দর্শন দিল।

 সেদিন জোর করিয়া সমস্ত সঙ্কোচ ও লজ্জা ত্যাগ করিয়া হৃদয়নাথ দ্বারের কাছে আসিয়া দাঁড়াইলেন। কল্যাণীর এই সময়ের ভিতর উদ্যানের সীমানা ছাড়াইয়া যাওয়া উচিত ছিল। কিন্তু সে তাহার মৃগশিশুর মত অবাধ চঞ্চল গতিকে এমনই অকস্মাৎ গজেন্দ্রগমনে পরিণত করিয়া ফেলিয়াছিল যে, তাহার নাগাল পাইতে হৃদয়নাথকে বাগানের দরজা পার হইতে হইল না। হৃদয়নাথ মৃদুম্বরে ডাকিলেন, “সুমিত্রা!” কল্যাণী ফিরিয়া দাঁড়াইল। হৃদয়নাথ বিস্মিত হইয়া দেখিলেন, সুমিত্রা নয়। কিন্তু রং গঠন অনেকটা একরকম বলিযাই তাঁহার এ সন্দেহ জন্মে নাই। আস্তে আস্তে জিজ্ঞাসা করিলেন “কে?” কল্যাণী তাঁহার চোখের উপর চোখ রাখিয়া উত্তর দিল, “আমি কল্যাণী, সুমিত্রার বোন্।”

 হৃদয়নাথ আরও আশ্চর্য্য বোধ করিলেন। ঐ দরিদ্র-গৃহখানি রত্নের আকর নাকি? তার চেয়ে বিস্মিত হইলেন মেয়েটীর ধরণে লজ্জা নাই, দ্বিধা নাই, অথচ এতটুকু নির্লজ্জতাও নাই। শান্ত নির্ভীক চক্ষু বুদ্ধি ও জ্ঞানের জ্যোতিতে আশ্চর্য্য উজ্জ্বল! বলিলেন, “সুমিত্রা কি আসেনি?”

 কল্যাণী ঈষৎ চোখ নামাইয়া কহিল, “না, কাল থেকে আমিই আস‍্ছি।” তারপর আবার দুই চোখ তুলিয়া হৃদয়নাথের চোখের উপর স্থাপন করিল, বলিল, “কেন? তাতে কি কিছু আপনার আপত্তির কারণ আছে?”

 একটু সঙ্কুচিত হইয়া হৃদয়নাথ কহিলেন, “না তা কেন?”

 “তবে এখন আমি যেতে পারি?”

 “হ্যাঁ, পার—না, একটা কথা আছে, সুমিত্রা কেন আসে না? সে কি কিছু এর কারণ বলেছে?”

 কল্যাণী একবার প্রশ্নকর্ত্তার মুখে চকিত দৃষ্টি নিক্ষেপ করিয়া পরমুহূর্ত্তে অন্যদিকে চাহিয়া অন্যমনস্কতার ভাণ করিয়া আঙ্গুলে নিজের আঁচল জড়াইতে জড়াইতে বলিল, “বলেছে বই কি! আপনি তাকে বিয়ে করবেন বলেছেন না?”

 হৃদয়নাথের মুখ আকর্ণ লাল হইয়া উঠিল, তিনি মাথা একটু নিচু করিলেন, “তা সেজন্য তিনি আর আসেন না কেন?”

 কল্যাণী আঁচলখানা ছাড়িয়া দিয়া হাসিয়া ফেলিল, “বাঃ, বিয়ের কথা হচ্ছে, সে কেমন ক’রে আসবে? তা ছাড়া তার মন আর শরীরও তেমন ভাল নেই।” শেষের কথা কয়টা বলিয়া কল্যাণী গম্ভীর হইয়া পড়িল। এবং যাইবার জন্য উদ্যোগী হইল। ব্যগ্র হইয়া হৃদয়নাথ জিজ্ঞাসা করিলেন, “মন ভাল নেই কেন? না, না, তুমি কথা বদ্‌লাচ্ছ। আমি বেশ বুঝতে পার্‌ছি। কল্যাণী বুঝি তুমি?—না, কল্যাণী আমায় বল, কেন তার মন ভাল নাই?”

 কল্যাণী চুপ করিয়া রহিল। দ্বিধা আসিয়া দুএকবার বাধা না দিতেছিল এমন নহে, কোন্‌টা উচিত, কোন্‌টা শুভ সে সন্দেহও দুই একবার মনে উঠিয়া তাহার স্থির দৃষ্টি চঞ্চল করিয়া তুলিতে লাগিল। সহসা কথা জোগাইল না। হৃদয়নাথ একটু অগ্রসর হইয়া আসিয়া মিনতিপূর্ণ আগ্রহের সহিত আবার বলিলেন, “তুমি আমায় কিছু লুকিও না। বল কল্যাণী, বল, সে কি আমার প্রস্তাবে মনে কোন আঘাত পেয়েছে, আমি কি তার কাছে অযোগ্য আবেদন করেছি?”

 “হ্যাঁ” বলিয়া কল্যাণী তাঁহার পানে স্থির চোখে চাহিয়া রহিল।

 হৃদয়নাথ চমকিয়া উঠিয়া দুই পা পিছাইয়া গেলেন। বিস্ময়ের সহিত বেদনার সুস্পষ্ট চিহ্ন তাঁহার শ্রীহীন মুখে ফুটিয়া উঠিল। একটু নীরবে থাকিয়া আত্মসম্বরণ করিবার চেষ্টা করিতে করিতে অস্ফুট কণ্ঠে তিনি জিজ্ঞাসা করিলেন, “সে কি আমায় বিয়ে ক’রতে ইচ্ছুক নয়?”

 বাতাসে কতকগুলা চুলের গোছা কল্যাণীর মুখে চোখে উড়িয়া পড়িতেছিল, হাত দিয়া সে গুলাকে সরাইয়া দিতে দিতে সে উত্তর দিল, “কতকটা তাই বটে। প্রভাস বাবুর সঙ্গে দিদির বিয়ের সব ঠিক ছিল, হঠাৎ মাসীমা মারা গেলেন বলেই শুধু হলোনা। সেইজন্য আর কোথাও বিয়ে হয় সেটা আমাদের কারু তেমন ইচ্ছা ছিল না।”

 হৃদয়নাথ উত্তেজিত ভাবে বলিয়া উঠিলেন, “তা হ’লে সে আমাকে কিছু বলিল না কেন? আমার প্রস্তাবে সম্মতি দিল কেন?”

 “কেন? তুমি তার কি জান্‌বে যে কেন? আমাদের মা বাপের অবস্থা খুবই খারাপ, মার জীবনের আশা নাই, চিকিৎসা পথ্যের অভাবে মা মারা যাবেন, ভাই বোনদের একবেলা আহার জোটে তো একবেলা জোটে না। সে সম্মত না হয়ে কি করে? সে তত নভেলের নায়িকা নয়?”

 হৃদয়নাথ আহত হৃদয়ে চৌকাটের উপরে বসিয়া পড়িলেন। হাত হইতে গোলাপ ফুলের তোড়াটা মাটিতে পড়িয়া গেল। জীবনের নবসঞ্চিত কাব্যরস নিম্বপত্রের মত তিক্তাস্বাদ হইয়া উঠিল। কল্যাণী একদৃষ্টে অনেকক্ষণ তাঁহার পানে চাহিয়া দাঁড়াইয়া রহিল। তারপর একটু নিকটে আসিয়া জিজ্ঞাসা করিল, “তাহলে আমি এবার যাই?”

 হৃদয়নাথ চম্‌কাইয়া উঠিয়া চাহিয়া দেখিলেন। কল্যাণী দেখিল, তাঁহার মুখ অত্যধিক ম্লান হইয়া গিয়াছে। তাঁহার জন্য তাহার একটু দুঃখ হইল, একটা সন্দেহও জন্মিল, একটু বিষন্নভাবে জিজ্ঞাসা করিল, “আমি আপনাকে কষ্ট দিলাম—না? হয়ত এ কথা আপনাকে বলা আমার উচিত হয়নি।”

 “না উচিত হয়েছে বইকি? না হ’লে আমার দ্বারা তোমার দিদির কত বড় ক্ষতি হ’ত বল দেখি? আমার কষ্ট, ঈশ্বর জানেন। এখন যেটা আঘাত মনে হচ্চে, পরে সেটাই হয়ত পুরস্কার মনে হবে। কি ভাল, শুধু তিনিই জানেন।”

 একটা অনিবার্য্য কৌতুহলের সহিত কল্যাণী বলিয়া উঠিল, “আপনারা—বড়লোকেরা কি তবে গরীবের মেয়েদের সৌন্দর্য্যের মুল্যেই শুধু তাদের গ্রহণ করিতে চান, না? তাহলে আরও তো অনেক সুন্দর মেয়ে আছে।”

 হৃদয়নাথ ক্রুদ্ধ ভ্রূকুটী করিলেন। কল্যাণী ঈষৎ লজ্জার সহিত মাথা নীচু করিল। তখন হৃদয়নাথ উঠিয়া দাঁড়াইলেন। কণ্ঠ পরিষ্কার করিয়া লইয়া বলিলেন, “তোমার দিদিকে গিয়ে বল কল্যাণী, আমি তাকে মুক্তি দিলুম, তার মহৎ হৃদয় বিক্রী করবার জিনিষ নয়। এর দাম দেবার সাধ্য আমার নাই, যে ভাগ্যবান্ তা জয় করেছেন তিনি ইহা লাভ করুন। তোমাদের দারিদ্র্য আর থাক্‌বে না। আমার যথাসাধ্য তোমাদের জন্য আমি কর্‌বো। সেজন্য আজ হ’তে তোমরা নিশ্চিন্ত থাক। আর আমার জন্যে—ভগবান্ যা ভাগ্যে লেখেন নি, তার জন্যে দুঃখ ক’রে কি হবে? আমার এই নিঃসঙ্গ নিষ্ফল জীবন এমনই কেটে যাক। এ একটা আমার শিক্ষা হলো।”

 লজ্জায় অনুতাপে মরিয়া গিয়া কল্যাণী ভাবিল, সে ইহার প্রতি বড় অবিচারই করিতেছিল। তাঁহার রুদ্ধ স্বরের ভিতর যে অশ্রুজল পুঞ্জীভূত হইয়া উঠিয়াছিল, সহসা তাহা কল্যাণীর চক্ষুকে বশীভূত করিল না কি? তাহার চোখও সমবেদনার অশ্রুতে ভরিয়া উঠিয়া টল টল করিতে লাগিল। কি বলা উচিত ভাবিয়া না পাইয়া সে নতমুখে চুপ করিয়া দাঁড়াইয়া রহিল। হৃদয়নাথ ক্ষণকাল নীরবে মুখ ফিরাইয়া দাঁড়াইয়া রহিলেন, তারপর ত্বরিত হস্তে ফুলের তােড়াটা মাটী হইতে কুড়াইয়া লইয়া কহিলেন, “যা তাকে দেবার জন্য রেখেছিলুম তা আবার ফিরিয়ে রাখ্‌লুম। পূর্ব্বেই আমার প্রতিজ্ঞা ছিল যে, যদি কখনও কেউ যেচে নেয়, তবেই তাকে এ হৃদয় মন দান কর্ব্বো, তা’ না হ’লে অযােগ্যের দান দীনের উপহার চিরদিনের মত নিজের কাছে থেকেই শুকিয়ে যাবে—সে প্রতিজ্ঞা ভেঙ্গেচে, হাতে হাতেই তার ফলও ফলেচে। যাক্—এবার যেতে পার কল্যাণী, আর কিছু বলবার নাই। বলো, আমি মনের সঙ্গে তাকে আশীর্বাদ কর্‌চি, তারা দুজনে চিরসুখী হােক। আমি তাদের সুখের জন্য যেটুকু সাধ্য তা চেষ্টা কর্‌বো—কুণ্ঠিত হবো না— যাও।”

 কল্যাণী শক্ত করিয়া পা দিয়া মাটী চাপিয়া দাঁড়াইল, নিম্নদৃষ্টি জোর করিয়া উন্নমিত করিয়া তাঁহার চোখের উপর চোখের দৃষ্টি স্থাপন করিয়া ম্লান হাসির সহিত কহিল, “ব্যস্ত হবেন না, যাচ্ছি, কিন্তু কিছু যদি মনে না করেন তো বলি—আপনার অনাদৃত ফুলের তোড়াটা দয়া ক’রে আমায় দেবেন কি? অমন ভাল ফুল আমি আর কখনো দেখিনি।”

 “নেবে তুমি? যথার্থই সাধ ক’রে আদর ক’রে নিতে পারবে? না এ শুধু করুণা চিত্তের করুণার ক্ষণিক ইচ্ছা মাত্র কল্যাণি?”

 কল্যাণী নতমুখে কহিল “আমার চিত্ত খুব যে করুণ নয়—তারও প্রমাণ আপনি পেয়েছেন, আর আমি যা একবার স্থির করি—তার কখন বদল হয় না। এখন আপনার তোড়া দেওয়া না দেওয়া সে আপনার ইচ্ছা।”