প্রতিশোধ

 ১৭৮৩ খৃষ্টাব্দের এক সুন্দর সৌম্য অপরাহ্নে যখন পিতা পুত্রীতে বৈকালিক ভ্রমণে বাহির হইতেছিলেন, সেই সময়ে দুই তিন জন বন্ধু ও ডাক্তার ডাইকাউণ্টের শোণিতাক্ত দেহ বহন করিয়া প্রাসাদে প্রবেশ করিল!

 ডাক্তার বলিলেন, আজ সকালে তাহার সহিত নবীন ব্যারণ ডিরোলেডের দ্বন্দ্ব যুদ্ধ হয়। ব্যারণ ডিরোলেড তরবারি ক্রীড়ায় অত্যন্ত সুকৌশলী। ডাইকাউণ্ট বক্ষে গুরুতর আঘাত পাইয়াছেন। তাঁহারা কোন ক্রমেই শোণিত ক্ষয় নিবারণ করিতে না পারিয়া এবং মৃত্যু নিশ্চয় জানিয়া তাঁহার শেষ মুহূর্ত্ত নিজের গৃহে পিতা ও ভগিনীর স্নেহ হস্তের শুশ্রুষায় একটুখানিও শান্তিপূর্ণ হইতে পারে মনে করিয়া তাঁহাকে এখানে আনিয়াছেন! মৃত্যুর তাঁহার আর অধিক বিলম্ব নাই!

 বিবাদের কারণ তাহারা বলিতে পারিলেন না, হয়ত কোন উজ্জল-নয়না হাস্য রঞ্জিতাধরা রাজ্ঞীর সহচরীই এই উষ্ণ মস্তিষ্ক যুবকদ্বয়ের পরস্পরের প্রতি আক্রমণের হেতু হইতে পারে, হয়ত অপর কোন কিছুও হইতে পারে তবে প্রথমোক্ত কারণটাই এবং প্রায় এরূপস্থলে বর্ত্তমান থাকে দেখিতে পাওয়া যায়।

 যখন মৃত্যু আসিয়া বালকের কালীমা লিপ্ত ললাট শান্তির হস্ত স্পর্শে মর্ম্মর শুভ্র করিয়া দিল, যন্ত্রণার ক্ষীণ রুদ্ধশ্বাস স্থির হইয়া একেবারেই থামিয়া গেল, এবং বন্ধুগণ একে একে ম্লান মুখে মৌন বিষাদে বিদায় লইয়া চলিয়া গেলেন, কেবল গভীর শোকের অনির্ব্বাণ যন্ত্রণানল বক্ষে লইয়া বৃদ্ধ কাউণ্ট মার্ণিক তাহার বালিকা কন্যার সহিত একাকী হইলেন। তখন সহসা নতদৃষ্ট্রি তুলিয়া বৃদ্ধ তাঁহার নির্ব্বক-প্রতিমার মত নিস্তব্ধ কন্যার অবসন্ন একখানা হাত নিজের হাতে তুলিয়া লইয়া ধীরে ধীরে তাহা তাহার মৃত ভ্রাতার বরফের মত শীতল ও শুভ্র ললাটের উপর স্থাপন করিয়া অকম্পিত কঠিন স্বরে কহিলেন, “জুলিয়েট্! আমার দিন একেবারে সন্ধ্যায় আসিয়া পৌঁছিয়াছে, একটু আর অবসর আমার নাই, কিন্তু তোমার সম্মুখে দীর্ঘ —দীর্ঘ অবসর পড়িয়া আছে, আমার কাছে আজ প্রতিজ্ঞা কর, তোমার ভাই এর এই শোচনীয় মৃত্যু যে ঘটাইল সে ইহার প্রতিশোধ পাইবে।”

 জুলিয়েট মন্ত্র বশীভূতের মতই ধীরে ধীরে বলিল, “হ্যাঁ পাইবে।”

 “শপথ করো সেই হত্যাকারীর রক্তধারায় তুমি আমায় স্নান করাইবে, জেনো জুলি জেনো আমার মৃত আত্মা তোমার নিকট তার এ প্রাণের তৃষ্ণা বহন করিয়া আনিতে নিবৃত্ত হবে না। আবার বলো—সে প্রতিশোধ পাইবে, আবার শপথ করো,—তুমি বুদ্ধিমতী তুমি অকৃতকার্য্য হবে না বলে—অঙ্গীকার করো”

 আবার জুলিয়েট তেমনি স্বপ্নাভিভূতের মত পিতার আদেশের পুনরুচ্চারণ করিল। তাহার সংজ্ঞাহীন দেহ অসাড় হস্ত এবং স্পন্দহীন মনে জীবনীশক্তির চিহ্ন বিদ্যমান ছিল না। বৃদ্ধ নিজের দক্ষিণ হস্ত তুলিয়া তাহার মাথার উপর রাখিয়া আশীর্ব্বাদ করিতে গেলেন কিন্তু সে হাত কাঁপিয়া পড়িয়া গেল, ওষ্ঠ একটুও শব্দ উচ্চারণ করিল না।

 ১৭৯৩ খৃষ্টাব্দের সেই ভয়ানক যুদ্ধের পর সহরের কোন রাজপথে ভদ্র মহিলাগণের গমনাগমনের পক্ষে নিরাপদ ছিল না।

 রাস্তার সমুদয় লোক সেই জন্যই সেদিন দ্বিপ্রহরে একটা সুন্দরী যুবতীকে একাকী দক্ষিণ দিক্ হইতে রাজপথের উত্তর দিকে গমন করিতে দেখিয়া আশ্চর্য্যে তাহার দিকে চাহিতেছিল।

 রমণীর শুভ্র পরিচ্ছদের উপরে তিন বর্ণে চিত্রিত রিপবলিক চিহ্ন কোমর দিয়া জড়ান ছিল, সেইটিই যে তাহাকে এতখানি পথ নির্ব্বিঘ্ন রাখিয়াছিল তাহাতে কোনও সন্দেহ ছিল না কিন্তু সেই নির্ব্বোধ বালিকা সহসা একটা কি অদ্ভুত উত্তেজনার বশে সে কথা এক মুহুর্ত্তের মধ্যে ভুলিয়া গিয়া নিজের ধ্বংসের পথ নিজের হাতে প্রস্তুত করিয়া দিল। সে দেশপ্রসিদ্ধ নাগরিক-প্রধান ডিরোলেডের প্রকাণ্ড অট্টালিকার কাছে আসিয়াই সেই রক্ষাকবচ দেহ হইতে খুলিয়া টুকরা টুকরা করিয়া ছিঁড়িয়া ফেলিল এবং সেই ছিন্ন খণ্ডগুলি মাটিতে ফেলিয়া দিয়া আবার অগ্রসর হইল।

 এই অসীম সাহসীকতা এক মুহূর্ত্তের জন্য পথিকদিগকে বিস্মিয় স্তম্ভিত করিয়া তুলিয়াছিল কিন্তু পরক্ষণেই এই স্বদেশদ্রোহিতা প্রত্যেক ব্যক্তিকে অগ্নি প্রদীপ্ত করিয়া তুলিল, এক সঙ্গে বিংশকণ্ঠ চিৎকার করিয়া উঠিল, রিপবলিকের অপমানকারিণীকে অগ্নিতে দগ্ধ করিয়া ফেলিল।

 শীকার সম্মুখে পাইলে ব্যাঘ্র ব্যাঘ্রীর দল যেমন করিয়া গর্জ্জিয়া তাহার রক্তপান করিতে ছুটিয়া আসে, প্যারিসের সর্ব্বাপেক্ষা নিম্নশ্রেণীর পঞ্চাশজন নরনারী —তেমনি হিংস্র—তেমনি শোণিত পিপাসু—তেমনি করিয়াই সেই অসহায় বালিকাকে ঘিরিয়া ফেলিল। প্রত্যেকেই তাহাদের হিংস্র পশুর মত দীর্ঘ নখের দ্বারা কোমল পুষ্প পেলবের মত তাহাকে তেমনি সহজে সহজে তেমনি অকরুণতীত ছিন্ন করিয়া ফেলিতে সক্ষম!

 রমণী নিজের বিপদের কথা নিজের দুর্ব্বুদ্ধি ঘটিত উত্তেজনার পর মুহূর্ত্তেই বুঝিতে পারিয়াছিল। ব্যাকুলভাবে তাই সে সম্মুখের সেই প্রকাণ্ড প্রাসাদ তুল্য অট্টালিকার দ্বারের দিকে ছুটিয়া গেল। কিন্তু এই বিপ্লবের দিনে কি কেহ নিজের গৃহদ্বার বিপদকে বরণ করিবার জন্য খুলিয়া রাখে?

 হতাশ হইয়া নারী তখন দ্বারে পিঠ দিয়া দাঁড়াইল, বিপদকে সম্মুখে করিয়া দাড়ান—তাহার পিছন হইতে আক্রমণের চেয়ে অনেক ভাল।

 কিন্তু সেইটুকু হীনতার মধ্যে ফেলিয়া নিষ্ঠুর প্রতিহিংসা পরায়ণ উন্মত্ত নরনারীগণ তাহাকে মুক্তি দিল না! তাহারা তাহার অনুসরণ করিয়া আসিয়াছিল, তাহার পোষাকের প্রান্ত ধরিয়া তাহাদের নির্দ্দয়ভাবে একজন সজোরে আকর্ষণ করিল।

 শেষ মুহুর্তেও যাহা সে করিবে না স্থির করিয়াছিল, যখন পৈশাচিক বিভীষিকাপূর্ণ মৃত্যু আসিয়া মমতাহীন কঠোর হস্তে তাহার তরুণ সুকোমল অঙ্গ হৃদয়হীন ভাবে স্পর্শ করিল তখনও সে আর সে প্রতিজ্ঞা রক্ষা করিতে পারে এমন সুকুমারী বালিকার পক্ষে সম্ভব নয়। সেও এবার আর আত্মদমন করিতে পারিল না। মৃত্যু! শুধু কি মৃত্যু! পশু পক্ষীর চেয়েও হেয় কীট পতঙ্গের অপেক্ষা ও ঘৃণ্য মৃত্যু! আর্ত্ত ভাবে সে দ্বারে আঘাত করিয়া প্রাণপণ চিৎকার করিয়া ডাকিল “রক্ষা করো সিটিজেন্‌ ডিরোলেড। আমায় আশ্রয় দিয়া এ অপমানিত মরণের হাত হইতে বাঁচাও।”

 পৈশাচিক হাস্যে পিশাচের দল নৃত্য করিয়া উঠিল, সকরুণ প্রার্থনা টুকু তাহাদেরই উচ্চ চিৎকারে আতঙ্কে যেন মরিয়া গেল বলিয়াই বোধ হইয়াছিল; কিন্তু সেই মুহূর্ত্তেই ভিতর হইতে দ্বার খুলিয়া গেল এবং দুইটী সবল বাহ বিনা দ্বিধায় মুহূর্ত্ত মধ্যে তাহার কটি বেষ্টন পূর্ব্বক তাহাকে জোর করিয়া এই মুক্ত দ্বার পথে ভিতরে টানিয়া লইতে বিলম্ব করিল না। তাঁহার সজোর আকর্ষণে আততায়ীর হস্ত বালিকার পোষাকের একটা ছিন্ন অংশ মাত্র ধরিয়া রাখিতে সক্ষম হইল। তাহাকে ধৃত রাখিতে পারিল না।

 কয়েক মিনিট পরে অবসন্নতা হইতে সংজ্ঞা লাভ করিয়া বালিকা দেখিল, সে একটা সুসজ্জিত গৃহের একখানি সুকোমল সোফায় শয়ন করিয়া আছে, এবং তাহার পাশে বসিয়া একজন বর্ষীয়সী রমণী সস্নেহ চক্ষে তাহার ভয় মুর্চ্ছিত মুখের পানে চাহিয়া তাহাকে শান্ত করিবার চেষ্টা করিতেছেন!

 বালিকা ক্লান্ত মস্তক উঠাইয়া ধীরে ধীরে একবার ঘরের চারিদিকেই চাহিয়া দেখিল, খোলা জানালার মধ্য দিয়া একটা যে কোলাহল আসিতেছিল কিন্তু সেই শব্দের উপর আরও একটা উচ্চ আদেশের স্বরও সেই সঙ্গে শুনিতে পাওয়া যাইতেছিল! রাজা যে স্বরে তাহার পারিপার্শীগণকে, প্রভু যে কণ্ঠে দুর্ব্বিনীত ভৃত্যকে আদেশ প্রদান করিয়া থাকেন এও সেই প্রকার অলঙ্ঘ্য আদেশের স্বর!

 গৃহকর্ত্তী তাহার কৌতূহল বুঝিয়াই যেন গর্ব্বমিশ্রিত গাম্ভীর্য্যের সহিত কহিলেন, “ও আমার ছেলের গলার শব্দ! যা হোক্ মাদ‍্ময়সেল্! এখানে তোমার কোন ভয় কর্ব্বার দরকার নেই, তুমি বোধ হয় জান —তুমি এখন সিটিজেন ডিরোলেডের গৃহে অতিথি হইয়াছ।

 এক মুহূর্ত্তের জন্য বালিকার মুখ যেন কি এক গভীর বেদনায় কি এক রকম হইয়া গেল! কিন্তু সে তখনি আত্মসংযত হইয়া সেই মুহূর্ত্তেই গৃহ প্রবিষ্ট গৃহস্বামীর প্রতি ফিরিয়া সেই ভয়ানক বিপদের হস্ত হইতে তাহাকে রক্ষা করিবার জন্য তাঁহাকে আন্তরিক ধন্যবাদ প্রদান না করিয়া থাকিতে পারিল না।

 এই রূপবতী বালিকাকে তাহার সেই অসহায় অবস্থায় ছিন্ন বসনে এবং ভয়চকিত অথচ কৃতজ্ঞ দৃষ্টিতে অত্যন্ত সুন্দর দেখাইতেছিল, নাগরিক প্রধান ডিরোলেড তাহার প্রসারিত ক্ষুদ্র হাতখানি গভীর সহানুভূতি ও পূর্ণ প্রশংসার সহিত সসম্রমে তুলিয়া ধরিয়া তাহা চুম্বন করিলেন। তাহাতে আশ্চর্য্যের বিষয় কিছুই ছিল না। কেন না ডিরোলেডও প্যারির ভিতর একজন পরম সুপুরুষ এবং যুবাপুরুষ মাত্র। যদিও ঐ প্রণয় জ্ঞাপক প্রীতি চিহ্নকে এখন তাঁহারা অভিজাতগুণের দুর্ব্বলতার চিহ্ন বলিয়াই উপহাস করিয়া থাকেন, কিন্তু কারণভেদে কার্য্যও সময় সময় যুক্তির বশীভূত থাকে না। তাঁহারই বা ইহাতে এমন বেশী দোষ কি? সবারই এমন হয়।

 এই ঘটনার প্রায় এক সপ্তাহ পরে সিটিজেন ডিরোলেডের সুসজ্জিত পাঠাগারে এক ঈষৎ শীতোষ্ণ সন্ধ্যায় একখানি সবুজ বস্ত্রাবৃত টেবিলের চারিদিকে ঘেরিয়া বসিয়া পাঁচজন ভদ্রলোক তাস খেলিতেছিল। টেবিলের উপর স্বর্ণ ও রৌপ্য পাত্রে পুষ্প ও সিগারেট সাজান আছে, ঘরে অনেক আলো জ্বলিতেছে; তাহাদের প্রত্যেকের হাতে কয়েকখানা তাসও রহিয়াছে এবং মধ্যে মধ্যে টেবিলের উপরে তাহাদের হস্ত হইতে তাহা নামিয়াও আসিতেছিল। কিন্তু তবুও তাহাদের মুখের উৎকণ্ঠিত সাবধান সতর্ক ভাবেই স্পষ্ট বুঝিতে পারা যাইতেছিল যে তাহা ক্রীড়ার উত্তেজনা নয়, কোন গূঢ় রহস্যপূর্ণ মন্ত্রণার সংশয়াচ্ছন্ন উদ্দীপনা। বাতাসে প্রত্যেক কম্পনটি পর্য্যন্ত তাহাদের চকিত করিয়া তুলিয়া তাহাদের সন্দেহপূর্ণ দৃষ্টিকে স্থুল পর্দ্দায় আচ্ছাদিত দ্বার ও রুদ্ধ জানালার দিকে টানিয়া ফিরাইতেছিল।

 গৃহস্বামী উপস্থিত ব্যক্তিগণের মধ্যে সর্ব্বাপেক্ষা অল্পবয়স্ক ও দৈহিক সৌন্দর্য্যে সমধিক সুন্দর কান্তি সতেজ মূর্ত্তি যুবক হইলেও সকলের অপেক্ষা তাহাকেই সাহসী ও উদ্যমশীল বলিয়া বুঝিতে পারা যাইতেছিল। সজোরে তাস ফেলিয়া বিপক্ষের তাস জিতিয়া লইতে লইতে সে বলিল, “নিশ্চয়ই আমরা কৃতকার্য্য হবো। না হবার কি কারণ আছে বলো? আমরা পাঁচজনে মাত্র এই পরামর্শ স্থির করেছি বইত নয়, তা ভিন্ন কেহই একথা জানে না, কেন আমরা অকৃতকার্য্য হবে?”

 এক জন নিমন্ত্রিত উত্তর করিলেন, “যদি আমাদের ভিতরে কেহ বিশ্বাসঘাতক না থাকে তবে কৃতকার্য্য হওয়া অসম্ভব নয়। এই একমাত্র উপায়ে দুর্ভাগিনী রাজ্ঞীকে উদ্ধার কর‍্তে পারা যায় কিন্তু একাজে টাকা অনেক দরকার হবে।”  ভিরোলেড সোৎসাহে কহিয়া উঠিল, “ভাগ্য আমাদের প্রতি এবিষয়ে আশ্চর্য্য সাহায্য কর‍্ছে দেখ। কাল‍্কের পর হতেই আমি কনসারজারির গভর্ণরের কাজ পাবো, যদিও রাণীর সঙ্গে কথা বলা আমার সুবিধা হবে না; কিন্তু সর্ব্বদাই তাঁর হাতে টাকা কড়ি ও চিঠিপত্র দেবার সুযোগও পেতে পার্ব্বোতো, আহা! ঈশ্বর তাঁকে এ বিপদ হতে উদ্ধার করুন।”

 “কিন্তু সে টাকা ও চিঠিপত্র এখানেই কি, খুব নিরাপদে আছে?”

 ডিরোলেড পূর্ব্বাপেক্ষাও উৎসাহের সহিত উত্তর করিল, “নিশ্চয়! আমার মাকে—তোমরা নিশ্চয়ই ভালরূপেই জানো। আমাদেরি মত তিনিও মনে মনে সম্পূর্ণ রূপ অত্যাচারিতেরই পক্ষ। তা এইতো আমরা দুজন, আর আমাদের বহুদিনের পুরাতন ভৃত্য দুইটি। যদিও তারা এসম্বন্ধে কিছুই জানে না কিন্তু জান‍্লেও তারা বরং মৃত্যুকে বরণ করবে তবু আমাদের কোন রহস্য প্রকাশ কর‍্বে না। সে সমস্ত এই ডেক্সটার ভিতর যথেষ্ট সাবধানেই রেখেছি।”

 অন্য সকলেই এই কৈফিয়তে বোধ করি খুসী হইয়াই মৌন সম্মতি লক্ষণের হিসাবে নীরব রহিল কিন্তু তাহাদের মধ্যে সর্ব্বাপেক্ষা বয়োজ্যেষ্ঠ এক ব্যক্তি একটু অসন্তোষের সহিত জিজ্ঞাসা করিলেন, “কিন্তু সিটিজেন ডিরোলেড! তোমার বাড়ীতে আজকাল যে স্ত্রীলোকটি বাস করেন তাঁর কথাতো তুমি কই কিছুই ভাব‍্চোনাতো?”

 রাজতন্ত্রের উপাসিকা যে মুক্ত রাজপথে দাঁড়িয়ে নিজের ভয়ানক বিপদ্ সম্মুখে জেনেও নিজের বিশ্বাস নিজের ধারণাকে ছদ্মবেশের আবরণে ঢেকে রাখা সহ্য করতে পারেনি বলে আজ আমার এ গৃহ পবিত্র কর‍্তে বাধ্য হয়েছে। ডিরোলেড আকোচঞ্চল কণ্ঠে বলিয়া উঠিল, “ঈশ্বরের সৃষ্টির মধ্যে, সে কি একটি আশ্চর্য্যরূপ সুন্দরতম পবিত্রতম হৃদয়, তাকে তোমার এত অবিশ্বাস কেন? এত ভয় কিসের?”

 সমাগত ব্যক্তিগণের অধরপ্রান্ত ঈষৎ হাস্যের আভাষে একসময়েই কুঞ্চিত হইয়া আসিল কিন্তু সেই সকৌতূক ইঙ্গিত অবজ্ঞাতর দৃষ্টি এড়াইল না। ডিরোলেড ইহা দেখিতে পাইয়া ঈষৎ উত্তেজিত হইয়া ভ্রূকুঞ্চিত করিল, “তা ছাড়া সে এর কিছুই জানে না এবং জান‍্তে ইচ্ছা সে কর‍্বেও না। আমি তোমাদের শপথ করে বল‍্ছি বরং তুমি আমি অবিশ্বাসী হতে পারি তথাপি সেই দেবীর মতন পবিত্র মুখ যার, সে অবিশ্বাসী হ’তে পারে না।” না হলেই ভাল ভাই কিন্তু কি জান সাবধানের মার নাই!

 আরও এক ঘণ্টা কাটিয়া গেল, তর্কের শেষ সিদ্ধান্ত সকলকার মনঃপূত হইলে তখন আগন্তুক চারিজন প্রস্থানোদ্যত হইয়া নিজেদের সর্ব্বাঙ্গ কালো চোগায় আবৃত করিয়া মুখের উপর টুপির চওড়া কার্ণিসগুলা টানিয়া দিয়া ডিরোলেডকে বিদায় সম্ভাষণ জানাইলে পরে এক ব্যক্তি এই সময়ে সহসা প্রস্তাব করিল, “এসো আমরা সচক্ষে সেই চিঠিপত্রগুলো কোথায় আছে দেখে নিশ্চিন্ত হয়ে যাই। সিটিজেন্‌ ডিরোলেড! তোমার মতন তরুণ যোদ্ধার হৃদয়েই এত বড় একটা দায়িত্বের সাহস, সঞ্চিত থাকা সম্ভব, যাতে তুমি এখন একটা মস্ত ভার নিজের হাতে স্বেচ্ছায় নিচ্চ।”

 “আমি ভয় জিনিষটাকে কোন দিনই এজীবনে প্রত্যক্ষ করতে পারলাম না।” সগর্ব্বে এই কথা বলিয়া ডিরোলেড ডেক্সের চাবি নিজের বুক পকেট হইতে বাহির করিয়া ডেক্স খুলিয়া তাহার মধ্যের গুপ্ত স্থানে লুক্কায়িত একটি রেশমি আবরণে জড়িত বাক্স বাহির করিয়া বলিল, “এই বাক্সটির ভিতরে আমাদের মাননীয়া রাজ্ঞীকে ঐ সকল রক্তপিপাসু বাঘ গুলার থাবা থেকে মুক্ত কর‍্বার জন্য যা কিছু সঞ্চয় সবই সঞ্চিত আছে।”

 সহসা ডিরোলেডের হাতে বাক্সটি কাঁপিয়া উঠিল, সকলেই ভূতাহতের মত এক সঙ্গেই দ্বারের দিকে ফিরিয়া চাহিল, দ্বার সেই মুহূর্ত্তে নিঃশব্দে ও ধীরে ধীরে খুলিয়া গিয়াছিল। এক হাতে পিছনকার ভারী পর্দ্দাখানাকে ঠেলিয়া রাখিয়া জুলিয়েট দ্বারের উপর দাঁড়াইয়া।

 “মুসো ডিরোলেড! ম্যাডাম ডিরোলেড আপনাকে জিজ্ঞাসা কর‍্তে বল্লেন যে এঁদের জন্য কিছু জলযোগের বন্দোবস্ত করে রেখেছেন, তা কি এখন পাঠাতে পারেন?”

 ডিরোলেড একবার পূর্ণ দৃষ্টিতে কিশোরী তরুণীর মুখের পানে চাহিয়া, দেখিল; সরলতার একখানি চিত্র তাহার সেই দ্বারের উপরে ঘন সবুজ পর্দ্দাটায় কোন সে অপূর্ব্ব শিল্পী আঁকিয়া দিয়া গিয়াছে। আশ্বাসের মৃদু হাসি হাসিয়া অকম্পিত হস্তে যথাস্থানে সেই সাঙ্ঘাতিক বাক্সটি রাখিয়া ডেক্সটা বন্ধ করিয়া উঠিয়া আসিয়া তাহাকে ধন্যবাদের সহিত যাহা বলিবার ছিল বলিয়া অল্প পরেই বিদায় দিল। অন্য কয়জনও তখন একটু যেন প্রকৃতিস্থ হইয়াছেন। একজন ভিন্ন সকলেই তাহাদের নিমন্ত্রকের মতের সহিত সহানুভূতি প্রকাশ করিয়া এই দেবী-মুর্ত্তির সম্বন্ধে নির্ভয় হইতে প্রস্তুত হইলেন এবং কিছুক্ষণ মাত্র পরেই বিদায় লইলেন। আহা এমনি করিয়াই মানুষ নিজের সর্ব্বনাশ নিজে ডাকিয়া আনে গো! তাঁহারা যদি আর একবার ভাল করিয়া সেই সরল স্বচ্ছ চোখের দৃষ্টির মধ্যে একটু অনুসন্ধান করিয়া দেখিতেন। অথবা তাঁহাদের যুবক বন্ধুর চোখের মায়ার বন্ধন খুলিয়া দিয়া তাহার স্বেচ্ছান্ধতা বিদূরিত করিবার জন্য একটু চেষ্টাও পাইতেন! যদিও সেই ফ্রান্সের মধ্যের সেই সর্ব্বোত্তম হস্তের বন্ধন খুলিয়া ফেলা তাঁদের পক্ষেই খুবই সহজ হইত না এবং বন্ধনকারিণীর পদ্ম হন্তের স্পর্শ সৌরভের স্মৃতি দূর করা আরও কঠিন হইত। তবু তোমরা এই সব অসমসাহসিকতার চেষ্টাকারী, তাঁদের এই কঠিন কাজটাতেও একবার বুক দিয়া চেষ্টা করা উচিত ছিল।

 জুলিয়েট্ দ্বারের বাহিরে আসিয়া এক মুহূর্ত্ত স্থির হইয়া দাঁড়াইল। তারপর সবলে দুই হাত দিয়া নিজের বুক খানাকে চাপিয়া ধরিয়া তাহার উদ্দাম চঞ্চলতাকে রোধ করিবার জন্য প্রাণপণে চেষ্টা করিতে লাগিল। বিজয়ের সগর্ব্ব আনন্দের সহিত প্রতিহিংসার কঠোর জ্বালা মিশ্রিত হইয়া তাহার শান্তশ্রীকে এক মুহূর্ত্তের জন্য ভীষণ করিয়াই তুলিয়াছিল। এই মিমাংসা কঠোর মুখেই অন্ধ পতঙ্গকুল মুহূর্ত্তমাত্র পূর্ব্বে সরলতার উজ্জ্বল আলোকে দিব্যকান্তি সন্দর্শন করিতেছিলেন না?

 পর দিন সন্ধ্যার সময় ডিরোলেড তাহার পুত্রবৎসলা জননীও নিরাপদে নিজ গৃহত্যাগ করিয়া সন্দেহ সঙ্কুল, বিপর্যয়পূর্ণ নৃতন কার্য্য-ভার গ্রহণ করিবার জন্য কিছু দিনের মতই বিদায় লইল। কন‍্সারজারির অস্থায়ী গভর্ণরের পদে সে নিযুক্ত হইয়াছিল এবং সর্ব্বদাই মনে করিয়া ছিল যে, যে বিপ্লব তাহার অনেকে মিলিয়া দেশের বুকে টানিয়া আনিয়াছে তাহারই সংঘর্ষে নিদারুণ অত্যাচারে উৎপীড়িতা দুর্ভাগিণী রাণীকে মুক্ত করিবার এই উত্তম অবসর। এ সুযোগ যদি ব্যর্থ হইয়া যায় তবে ফ্রান্সের মাতৃ রক্তে তাহাকে স্নাত হইতেই হইবে। আর কোন উপায় নাই।  ডিরোলেড মায়ের শয়ন গৃহ হইতে তাঁহার অশ্রু হীন আশীর্ব্বাদে ও স্নেহ চুম্বনে ক্লান্তিহীন চিত্তে ফিরিয়া নিজের পাঠাগারে আসিয়া একটুখানি কি ভাবিয়া লইল। যাত্রার সমুদয় উদ্যোগ প্রস্তুত, সেই ভয়ানক বিপদ জনক বাক্স একটি রেশমি ধামে আঁটিয়া নিজের হাতে লইয়া সে একটু সঙ্কুচিত ভাবে ভৃত্যকে ডাকিয়া বলিল, “মাদ‍্ময়সেল জুলিয়েট‍্কে বলো তিনি যদি একবার দয়া করে আমার সঙ্গে বিদায় সাক্ষাৎ কর‍্তে আসেন তা’হলে তাঁর কাছে নিরতিশয় বাধিত হই—” তারপর একটু থামিয়া একটা ক্লান্ত নিশ্বাস ফেলিয়া আদেশ দিল “আধ ঘণ্টার মধ্যে গাড়ী যেন থাকে প্রস্তুত।”

 প্রায় পাঁচ মিনিটের মধ্যেই জুলিয়েট্ ধীরশান্ত গতিতে সেই গৃহে প্রবেশ করিল। দুই চোখে আগ্রহ ভরিয়া ডিরোলেড তাহার দিকে চাহিয়া দেখিল,— সুন্দর উন্নত দেহ, মুখও তেমনি প্রশান্ত। কিন্তু তাহার ক্ষুদ্র ওষ্ঠ এত বিবর্ণ ও কম্পিত হইতেছিল, এবং বিস্ফারিত নেত্রে এমনি একটা অদ্ভুত দৃষ্টি সুস্পষ্ট হইয়া উঠিয়াছে যে ডিরোলেড তাহা দেখিয়া অত্যন্ত আশ্চর্য্যানুভব করিল। তাহার নিকটে আসিয়া ভূতপূর্ব্ব ব্যারণ নম্র ও মৃদুস্বরে কহিল, “আমার অনুরোধ রক্ষা করে আমায় যে দয়া দেখিয়েছ, সেজন্য তোমায় কি বলে ধন্যবাদ দেব স্থির করতে পার‍্চিনে মাদ‍্ময়সেল্।”

 অশাসিত নীচ বিদ্রোহী দলকে উচ্চ গম্ভীর রাজকীয় স্বরে শাসন করা যাহার অভ্যস্ত, অহার কণ্ঠে ততখানি সকরুণ স্বর শুনিলে কেমন যেন বিসদৃশ ও হাস্যকর লাগিতে থাকে। তথাপি বক্তার কণ্ঠে ও ভাবে কোনই অসামঞ্জস্য ছিল না বরং খুব একটা ঐকান্তিকতাই ছিল। একটুখানি নিরব থাকিয়া অল্পপরেই ডিরোলেড বলিল, “ঈশ্বরের নিকট আমার মার জন্য প্রার্থনা করে মাদ‍্ময়সেল, তিনি তোমার প্রার্থনায় তাঁকে শান্ত রাখ‍্বেন, মা আমার তাঁর শেষ পুত্রটি নিয়েই সংসার কর‍্ছিলেন আর—” ডিরোলেড থামিলেন।

 জুলিয়েট্ সহজ ভাব রক্ষা করিবার যথেষ্ট চেষ্টা করিয়া জিজ্ঞাসা করিল—“আপনি বোধ হয় খুব বেশী দিনের জন্য যাচ্ছেন না?”

 জুলিয়েটের পা কাঁপিতেছিল, এই নিজের করা প্রশ্নটার সঙ্গে সঙ্গেই সে যেন অত্যন্ত বিচলিত হইয়া উঠিয়াছিল। ডিরোলেড তাহাকে হাত বাড়াইয়া তৎক্ষণাৎ ধরিয়া না ফেলিলে সে হয়ত মাটিতে পড়িয়াই যাইত।

 সম্মুখের একখানা সোফায় তাহাকে বসাইয়া ডিরোলেড তাহার পাশে একখানা নীচু চৌকির উপর বসিয়া একটু শুষ্ক ভাবে হাসিয়া উত্তর করিল, “এখনকার দিনে যেকোন বিদায়ই যে চিরবিদায় হ’তে পারে না। মাদ‍্ময়সেল্! কে একথা জোর করে বল‍্তে পারে? তবে আপাততঃ আমি এক মাসের জন্য কনসারজারিতে দূর্ভাগিণী রাজ্ঞীর ভার নেবার জন্যই যাচ্চি, তারপর আবার কি ঘটে!”

 “যে কোন কারণেই হোক্ তা’হলে আজ রাত্রের বিদায় আমাদের বহুদিনের বিদায়ই হবে বোধ হ’চ্ছে—না, সিটিজেন্‌ ডিরোলেড?”

 এই একমাস আমার নিকটে এক শতাব্দীর মতই দীর্ঘ বলে আজ মনে হ’চ্ছে, বিশেষ যখন তোমায় না দেখে আমায় এই এক মাস কাটাতে হবে। কিন্তু যেন অনিচ্ছার সহিত আত্মবিস্মৃত ভাবে এই পর্য্যন্ত বলিয়া ভূতপূর্ব্ব ব্যারণ অনেকক্ষণ পর্য্যন্ত তাহার পার্শ্ববর্ত্তিনীর সেই আশ্চর্য্য দৃষ্টির মধ্যে অনুসন্ধিৎসুনেত্রে চাহিয়া রহিল। তারপর অত্যন্ত মৃদুস্বরে সন্দেহপূর্ণ আশার সহিত ভগ্নকণ্ঠে কহিল, “কিন্তু তোমারও এই একমাস সময়কে দীর্ঘবোধ কর‍্বার কারণও যে আমার সঙ্গে এক, এত বড় আশাটা কর‍্তেও যেন আমি সাহস কর‍্তে পার‍্ছি না মাদ‍‍্ময়সেল্!”

 জুলিয়েট মুহূর্ত্তে বিবর্ণতর হইয়া উঠিয়া তড়িৎবেগে নিজের হাতটা সরাইয়া লইল। ডিরোলেড তাহার হাত খানি নিজের কম্পিত হস্তে ধারণ করিবার চেষ্টা করিতেছিল। একটু সরিয়া বসিয়া সে বলিয়া উঠিল, “আপনি আমায় ঠিক বুঝতে পারেন নি মুসো সিটিজেন্, আমার বলার অর্থ এই যে আমি আর বেশী দিন মাদাম ডিরোলেডের করুণাপূর্ণ আতিথ্য নিতে এখানে থাক‍্তে পার‍্বে না—অনেক দিন থেকেই আমি তাঁর বিশ্বাস ও আদরের মধ্যে অনধিকার দখল নিয়ে রয়েছি এবং—”

 তাহাকে বাধা দিয়া অত্যন্ত বিষাদপূর্ণ কণ্ঠে তিরস্কারের ভাবে ডিরোলেড কহিল, “তুমি আমাদের কাছে থেকে কি তা’হলে সুখী নও মাদ‍্ময়সেল্? তুমি, আমাদের তা’হলে ছেড়ে যেতে চাও—”

 জুলিয়েট্ উচ্চ যন্ত্রণাপরিপূর্ণ কণ্ঠে আর্ত্তনাদের মত করিয়া বলিয়া উঠিল, “ঈশ্বরের দিব্য আপনি আমায় অমন করে ব’ল‍্বেন না। আপনি জানেন না—আপনি বুঝ‍্তে পারছেন না—তা’হলে আপনার—”

 “নিশ্চয়ই আমি বুঝ‍্তে পেরেছি জুলিয়েট্—আমি তোমায় ঠিকই বুঝেছি,—” অদৃষ্ট তাহার জন্য নিজের ভাণ্ডারে কিসের সঞ্চয় রাখিয়াছে,—সে কি? আশা নিরাশা তাহা পরীক্ষার জন্য ডিরোলেড আর বেশীক্ষণ পরীক্ষকের আসনে বসিয়া কালক্ষেপ করিতে পারিল না। পূর্ণ বিশ্বাসেই বলিয়া যাইতে লাগিল— “আমি তোমার সুকোমল হৃদয় চিনেছি। সে যে একেবারে প্রভাত পুষ্পেরমতই শুভ্র সুরভিনিন্দিত। আমি তোমার মনোদর্পণের মত ওই দুটি স্বচ্ছ চোখে তোমার পবিত্র চিত্ততা শতবার সহস্র বারই যে পাঠ করেছি—আমি তোমার অসীম স্নেহ প্রেম করুণা আজও ওই ব্যথিত মুখে মাখান দেখ‍্তে পাচ্ছি যে, এততেও যদি তোমায় না চিন‍্বো তবে এতদিন, তোমার সঙ্গে এক গৃহে বাসই যে আমার পক্ষে ব্যর্থ হলো জুলিয়েট্! শোন জুলিয়েট্! আমায় দোষ দিও না; আমি স্বেচ্ছায় জেনেশুনে তোমায় ভালবাসিনি। জানিনা কবে কোন্ দেবতা আমার নিজেরও অজ্ঞাতসারে আমায় একেবারে তোমার ওই করুণ দৃষ্টির উপরেই সম্পূর্ণরূপে সমর্পণ করে দিয়েছেন। না’হলে দিকে দিকে আজ ওই মৃত্যুর ভেরী বেজে উঠ‍্চে আর আজ আমি একজন যোদ্ধা আমি-দুর্দ্দম নাগরিকদের নেতা, আমি,—আমি কি না একটা অসহায় শিশুর মত তোমার পায়ের তলায় সর্ব্বস্ব অঞ্জলী দিতে এসেছি। শুধু শুধু কি এমন হয় জুলিয়েট? আমি দেবীর নিকট ভিক্ষা চাইতে এসেছিলাম। আমার স্বর্গীয় প্রেম, আমার দেবদত্ত ভালবাসা সে যে পায়ে স্থান দিয়েছে এত বড় সৌভাগ্য আমার, এও আমি বুঝ‍্বো না? আমি বুঝেছি—জুলিয়েট্—সাধনা আমার,—দেবী আমার,—সর্ব্বস্ব আমার—আমি বুঝেছি!

 ডিরোলেড দুই হাতে জোর করিয়া তাহার অনিচ্ছুক হস্ত টানিয়া লইয়া তাহা নিজের আবেগ আনন্দে কম্পিত বক্ষে চাপিয়া ধরিল, তারপর পুনঃ পুনঃ সেই ক্ষুদ্র হাত খানির উপর তৃষিত অধর চাপিয়া তাহাতে অজস্র চুম্বন রেখা আঁকিয়া দিল। সেই সরল চিত্ত বীরের গভীর চিত্তোদ্বেগের সকরুণ সাক্ষ্যম্বরূপ অজস্র অশ্রুবিন্দুও সেই প্রথম প্রণয় নিদর্শন পবিত্র চুম্বনের সঙ্গে সঙ্গে সেই ফুটন্ত ফুলের মত শুভ্র সুকোমল হাত খানার উপরে ঝরিয়া পড়া শিশির বিন্দুর মতই ঝর্ ঝর্ করিয়া ঝরিয়া পড়িতে লাগিল। বীরের অশ্রু! সে অশ্রু কি মহৎ! কি করুণ! কি গভীর!

 জুলিয়েট্ সেই গভীর শ্রদ্ধাপূর্ণ ঐকান্তিকতার মহাপূজা সহ্য করতে না পারিয়া উঠিবার চেষ্টা করিল। গভীর যন্ত্রণায় আকুল হইয়া উঠিয়া সে ডিরোলেডের হস্ত হইতে আপনাকে ছিন্ন করিয়া লইতে গেল, কিন্তু পারিল না। নিদারুণ মানসিক বেদনায় মর্ম্মের মধ্যে মরিয়া গিয়া, সে তাহার স্রোতস্বিনীর মতই বেগবান ভালবাসার আবেগ ভরা আশা আনন্দের কল্পনা কথা হইতে নিজের কর্ণরুদ্ধ করিতে গেল—কার সুগভীর এই ভালবাসা? যাহার বিশ্বস্ত আতিথেয়তা ভঙ্গ করিয়া সে যাহার পশ্চাতে গুপ্তচরের ন্যায় ছায়ার ন্যায় অনুসরণ করিয়া নিজের প্রতিহিংসা বৃত্তি চরিতার্থ করিবার জন্য অনাহারে অনিদ্রায় দিবারাত্র ফিরিয়াছে। এ সেই তাহার তাঁহাদের পরম শত্রু যাহার জন্য সম্রান্ত বংশের উত্তরাধিকারিণী আজ এই ভিখারিণী বেশে পথে পথে ঘুরিয়া বেড়াইতেও দ্বিধা করেন নাই। এ সেই তাহার হিংসা বৃত্তির একমাত্র লক্ষ, তাহার শত্রু, তাহার পিতার, ভ্রাতার পিতৃবংশের মহাশত্রু! সে তাহাকে গভীর ঘৃণার সহিত কেবলমাত্র তাহার ভাতার হত্যাকারী বলিয়া মনে করিতে গেল। তাহার পিতার অকাল মৃত্যুর হেতু তাহার অদৃষ্টাকার করাল ধূমকেতুমাত্র! আর কেহ না! আর কিছু না! প্রাণপণে সে তাহার ভ্রাতার জীবন শূন্য সেই শোণিতাক্ত হিমশিলা শীতল দেহ মনে করিবার চেষ্টা করিল। পিতার দুর্ব্বল কণ্ঠে কঠিন শেষ আদেশ স্মরণ করিল, “জুলিয়েট্! আমাদের এই শোচনীয় মৃত্যুর প্রতিশোধ লইবার জন্যই শুধু বাঁচিবার চেষ্টা করো।”—সেই কণ্ঠকে কানের মধ্যে জোর করিয়া ধরিয়া রাখিবার জন্য সে প্রাণপণে নিজের সহিত যুদ্ধ করিতে লাগিল। কিন্তু হায় একি! সেই সমস্ত জীবন্ত ছবি আজ, ছায়াবাজির মতই তাহার দৃষ্টিহীন প্রায় চোখের সম্মুখ হইতে মুহূর্ত্তে মুহূর্ত্তে অপসৃত হইয়া যাইতে লাগিল এবং তাহার পরিবর্ত্তে সেই স্থানে এই সুদীর্ঘাকৃতি সুন্দর যুবকের তরুণ বীরমূর্ত্তি স্পষ্ট হইয়া ফুটিয়া উঠিতে লাগিল। তাহার পদ প্রান্তে সেই মূর্ত্তি দীনদরিদ্রের ন্যায় ভূমিতলে নতজানু হইয়া বসিয়া তাহারই হস্তের উপর নিজের উচ্চ পূজ্য সম্মানিত মস্তক রক্ষা করিয়া অশ্রুশিক্ত করিতে করিতে রুদ্ধ কণ্ঠে সকাতরে বলিতেছিল, “আমি তোমায় ভালবাসি জুলিয়েট্! দেবি আমার! স্বর্গ আমার! আমি তোমায় ভালবাসি।” আর তাহার সেই সাধের স্বর্গ সেই কল্পনার দেবী তাহার সঙ্গে ব্যবহার কি করিয়াছে? সে নিজের জীবনকে ঘোর বিপদাপন্ন করিয়াও ছলে কৌশলে তাহার এই নিরুপদ্রুত শান্তিময় গৃহে প্রবেশ করিয়াছিল —কেন? না, তাহার প্রত্যেক চাল চলনটি অবধি পর্যবেক্ষণ করিতে পাইবে বলিয়া। তার পর, উঃ কি ভয়ানক! তার পরের কথা আর বলিবার কহিবারই নয়। কি হৃদয়হীন সম্প্রদায়ের হস্তেই সে তাহার ভাগ্যফল সঁপিয়া দিয়াছে! যাহারা দয়া কাহাকে বলে তাহার নামও কখন জানে না, সে সমুদয় সে কেন করিয়াছে? শুধু প্রতিহিংসা, শুধু প্রতিহিংসা লইবার জন্য। এই প্রতিহিংসা গ্রহণই কিছুক্ষণ মাত্র পূর্ব্বেও তাহার জীবনের একমাত্র চরম উদ্দেশ্য ও সর্ব্বাপেক্ষা পবিত্রতম কার্য্য ছিল। কিন্তু আজ যখন ডিরোলেড তাহাকে ডাকিয়া পাঠাইয়া বিদায় চাহিলেন, সেই মুহূর্ত্তেই সমুদয় ঘৃণা বিদ্বেষ যেন দূরে সরাইয়া ফেলিয়া গভীর করুণারাশি কোথা হইতে যে উথলিয়া উঠিতে লাগিল এবং তাহার মধ্য হইতে কতদিনকার সুপ্ত বেদনা সহসা জাগিয়া উঠিয়া নারী হৃদয়ের অজস্র ভালবাসার অমৃত অভিষেকে ব্যাকুল উর্দ্ধস্বরে হাহা করিয়া কাঁদিয়া উঠিল। দয়ার যমজ সহোদরা প্রেম সেই শুষ্ক রুদ্ধ কোমলতার বাঁধ ভাঙ্গিয়া আবার তাহার ঘুমন্ত নারী প্রকৃতিকে জাগাইয়া তুলিয়াছিল বুঝি? হায়রে মানবী! কেমন করিয়া তুই নিজের মানবত্বকে চির বিস্মৃত হইয়া রাক্ষসী হইয়াই থাক‍্বি তবে এখন সে কি করিবে? হয় যদি সে সব কথা ভুলিয়া যাইতে পারিত! যদি সে নিজেকে নীরব নিবেদনে এই সাহসী, উদার, উচ্চহৃদয়, পূর্ণ বিশ্বাসী প্রেমিকের হস্তে সর্ব্বান্তঃকরণে সমর্পণ করিয়া দিতে পারিত! হায়! তা হইলেই তাহার এ ব্যর্থ জীবন বুঝি শুধু সার্থক হইতে পারিত। এখন সে কি করিতে পারে? তাহার এই অবশ হাত দুটি সে কেমন করিয়াই তাঁহার সবল হস্ত হইতে মুক্ত করিয়া লইবে? কাজে কাজেই কানেও ঐ যে অজস্র প্রণয়স্তুতি প্রবেশ করিতেছে তাহার ঐ ভালবাসার কথা শ্রবণ করা ভিন্ন আরত তার কোনই উপায়ও নাই।

“রিপবলিকের নামে শপথ শীঘ্র দ্বার খোল?”

 ডিরোলেড মুহূর্ত্ত মধ্যে জুলিয়েটের হাত ছাড়িয়া লাফাইয়া উঠিয়া দাঁড়াইল। এ শব্দ—ইহার অর্থ তাহার ভাল রকমই জানা আছে।

 সেই হুমূর্তেই পাশের বারান্দা দিয়া পুরাতন ভৃত্য দ্বার মুক্ত করিবার জন্য দ্রুতপদে বাহিরের দিকে চলিয়া যাইতেছে শব্দ পাওয়া গেল। তাহাকে আর সেই অচলতা হইতে চলিবার তৎক্ষণাৎ আবশ্যক হইল না।

 জুলিয়েট ও শিহরিয়া উঠিয়া বিভীষিকাপূর্ণ আতঙ্কে তাহার পদানত প্রেমপত্রের বিবর্ণ মুখের দিকে চাহিয়া তৎপরে দ্বারের দিকেও চাহিয়া দেখিল। আর এক মুহূর্ত্তপরেই ‘সাধারণের রক্ষাসমিতি’র কর্ম্মচারীগণ এই ঘরে প্রবেশ করিবে, এই সময়ে—এই অমরাবতীসুখস্বপ্ন ভঙ্গ করিতে তাহার নিজের হাতই যে আজ তাহাদের এইখানে ডাকিয়া আনিয়াছে।

 ডিরোলেড অত্যন্ত বিবর্ণ হইয়া গিয়াছিল, জালে পতিত সিংহ যেমন অবরুদ্ধ আক্রোশে গুমরিয়া তাহার সঙ্কীর্ণ স্থানের মধ্যেই ঘুরিয়া বেড়ায়, তেমনি করিয়া সে একবার কক্ষ ও কক্ষ-প্রাচীরের চারিদিকে চাহিয়া তারপর উর্দ্ধ আকাশে, কিম্বা নিম্নে নরকে—যেখানে হোক, —যেখানেই হোক, কোথায়ও একটা স্থান অনুসন্ধান করিল যেখানে সে তাহার এই রেশম মণ্ডিত এই মৃত্যুবাণটি সমেত অদৃশ্য হইয়া যাইতে পারে। কিন্তু সেরূপ কোন উপায়ই গৃহনির্ম্মাতা রাখে নাই। তাই হতাশ চিত্তে সেই নিজের হাতে লেখা নিজের মৃত্যুর পরওয়ানাটা মুঠা দিয়া চাপিয়া ধরিল।—

 এই সময়টুকুর ভিতরে বহিদ্বারের প্রকাণ্ড কপাট ঠেলিয়া খুলিবার সংঘর্ষ শব্দ এবং তাহার পরমুহুর্ত্তেই একসঙ্গে অনেক লোকের পদধ্বনি ও গলার সাড়া বারান্দা দিয়া ক্রমশঃ নিকটবর্ত্তী হইতেছিল। গভীর নিস্তব্ধ গৃহে সেই ভীষণ চিৎকার ও বিদ্রুপের কঠোর কর্কশ উচ্চ হাস্য ভৌতিক শব্দের মতই নির্দ্দয়তার সহিত পুনঃপুনঃ সজোরে আঘাত করিয়া উঠিতে লাগিল। আর সেই সঙ্গে সে গৃহের দুইটি ভয়বিহ্বল চিত্তকে মুহুর্মুহু বেত্রাঘাতে যেন তাহারা সচেতন করিয়া তুলিল। ডিরোলেডের মুখের দিকে একমাত্র সুগভীর দৃষ্টিপাত করিয়াই জুলিয়েট্ সহসা তাহার হস্ত হইতে তাহার সেই মৃত্যুবাণটাকে টানিয়া লইয়া সোফার উপরে নিক্ষেপ করিয়া নিজে তাহার উপরে চাপিয়া বসিয়া পড়িল।  এক মুহূর্ত্ত পরেই যখন সশব্দে দ্বার খুলিয়া গেল এবং তাহার ভিতর দিয়া মুক্ত জলস্রোতের মত লালটুপি ও ত্রিবর্ণের চিহ্নধারী সশস্ত্র সৈনিকদলের সহিত মারাট সদর্প পদবিক্ষেপে গৃহে প্রবেশ করিলেন তখন, সে মহিমময়ী রাজ্ঞীর মত স্থির অথচ সগর্ব্ব ভঙ্গীতে তাহাদের পানে চাহিয়া কহিল, “সিটিজেন ডিরোলেড! ১৭৯৩ সাল হইতে কি এদেশের ভদ্র লোকেরা নারীর সম্মান শুদ্ধ ভুলিয়া গিয়াছেন না কি? অনায়াসেই তাঁহারা এখন এমন একটা বিশ্রদ্ধালাপ ভঙ্গ করিতে ৭ সাহস করেন। এ বড়ই আশ্চর্য্য!”

 রিপব‍্লিকদিগের তীক্ষ সুচতুর দৃষ্টি প্রথমে তাহাদের, তার পর সেই ঘরের ছাদ দেওয়াল ও সমুদায় আসবাব পত্রের উপরে নিক্ষিপ্ত হইতেছিল। একটু উপহাসের তীক্ষ্ণ হাসিখানি ক্ষুরধারের মতই মারাটের নিশাচর জাতীয় জীব বিশেষের ন্যায় পরম গম্ভীর মুখে চকিত হইয়া উঠিল। ডিরোলেড তাহার স্বাভাবিক স্থৈর্য্যাবলম্বনের চেষ্টা করিতে করিতে গম্ভীর স্বরে জিজ্ঞাসা করিলেন, “এরকম আশ্চর্য্য আগমনের অর্থ কি সিটিজেন মারাট?”  মারাট একটুখানি মাথা নোয়াইয়া বিদ্রুপের ছলে উভয়কেই অভিবাদন করিয়া কহিলেন, “আপনার বিরুদ্ধে একটা ভয়ানক অভিযোগ আছে, জানিলেন সিটিজেন ডেপুটী! আজ আমাদের সমিতির কাছে এক বেনামী চিঠি পৌঁছেচে যে, আপনি না কি ‘বিধবা ক্যারেটে’র সাহায্য করছেন। আর তারি প্রমাণ পত্র সমস্ত আপনার এই ডেক‍্সেইই না কি পাওয়া যাবে।—কি করি বলুন, সমিতি আমাকেই এই অপ্রিয় অনুসন্ধানের ভারটা চাপিয়ে দিয়াছেন।”

 ডিরোলেড, ভ্রূকুঞ্চিত করিলেন,—আশ্চর্য্য! রিপবলিকের একজন বিশ্বস্ত কর্ম্মচারী ও তার একটা নামহীন শত্রুর চাতুরীতে এতবড় একটা অপমানের হস্ত হ’তে মুক্ত হ’তে পারে না,—এতই অবিশ্বাস!”

 “সমিতি সাধারণের মতের সঙ্গে সম্পূর্ণ আবদ্ধ, আমরা তাই নিরুপায়।”

 মারাট তীক্ষ্ণ অনুসন্ধিৎসু শ্যেনদৃষ্টিতে ডিরোলেডের মুখের উপরে সোজা চাহিয়া কহিতে লাগিল, “কিন্তু সিটিজেন ডেপুটি! আপনার এই সব চাবিবদ্ধ আসবাবের ভিতরে এমন কিছু গোপন রহস্য নাই, যার জন্য আমাদের কর্ত্তব্য সাধনে বাধা দেবার চেষ্টা আপনি করতে পারেন? কি বলেন?”

 ডিরোলেড নীরবে এক তোড়া চাবি আনিয়া মারাটের সহকারীর হস্তে প্রদান করিলেন। অনুসন্ধান আরম্ভ হইল।

 জুলিয়েটের কি অবস্থা হইয়াছে জানিবার কৌতূহল অদম্য হইয়া উঠিলেও ডিরোলেড এ পর্য্যন্ত একবার তাহার দিকে চাহিয়া দেখে নাই। বিপ্লববাদীগণের মমতাহীন তীব্র দৃষ্টি তাহার মুখের উপরে সমস্তক্ষণ অপলকেই স্থাপিত রহিয়াছে, তাহার নেত্রতারকার এতটুকু স্পন্দনটির উপরে এখন তাঁহার সহিত তাহাকেও, —যাহাকে একদিন এমনি একটা নৃশংস মৃত্যুর হস্ত তাহার পাশে দেবতার নির্ম্মল আশীর্ব্বাদটুকুর মতই আনিয়া দিয়া গিয়াছে—এই মুহূর্ত্তে একই নিষ্ঠুর মরণ পথের সহযাত্রিণী করিয়া দিবে। ডিরোলেডের বক্ষ একটা অব্যক্ত যন্ত্রণার ভীষণ আনন্দে সঘনে নাচিতে লাগিল। যে মিলন ঈশ্বরের দান, জীবনে কিম্বা মরণেও তা ছিন্ন হইবার নয়। আজ যদি মরিতেই হয় তবে তাহার ওই জীবনের শ্রেষ্ঠতপঃফল হইতে বিচ্যুত হইয়া মরিতে হইবে না। দুই জনেই দুজনের বাহুলগ্ন, বক্ষঃলগ্ন হইয়া পরস্পরের অসীম ভালবাসার অতলে তলাইয়া থাকিয়া একসঙ্গে এক নিমিষে আজ মারতে পারিবেন। সেও কি কম সুখ!

 জুলিয়েট্ কিন্তু নিজেকে আশ্চর্য্য স্থির রাখিয়াছিল। তাহার রেশমী পোষাকের কুঞ্চিত প্রান্ত স্তরে স্তরে সোফার চারিদিকে ছড়াইয়া পড়িয়াছে। হাতে হাত বদ্ধ করিয়া জগতের সমুদয় ক্ষুদ্র প্রাণী ও তাহাদের সমস্ত ক্ষুদ্র কার্য্যকে উদাস দৃষ্টি দ্বারা সম্পূর্ণরূপে অবজ্ঞা করিয়া সে মুকুটপরিত্যক্তা রাজ্ঞীর মত অবিচল মহিমায় নিজ স্থানেই বসিয়াছিল। তাহার সেই সমুদয় কৃত্রিমতা আজ কিসের জন্য? না যে একটিমাত্র চিহ্ন এই মুহূর্ত্তেই তাহার তীব্র ঘৃণার পাত্রকে, তাহার চিরদিনের পরম শত্রুকে গিলোটিনের তলায় টানিয়া লইয়া যাইতে সক্ষম, সেইটিকে লুকাইয়া রাখিবার জন্য সেই শত্রুর হস্ত তাহার প্রাণাধিক ভ্রাতার বক্ষ বিদীর্ণ করিয়াছে, পিতাকে অকালে ইহলোক হইতে বিদায় লইতে বাধ্য করিয়াছে; কিন্তু কি অসাধারণ শক্তি সেই সজল কণ্ঠের প্রগাঢ় স্বরে; যে তাহারই একটি কথাতেই চিরদিনের সব সঙ্কল্প কোন্ অতলে তলাইয়া ভাসিয়া গেল!

 একি ভুজঙ্গিনীকে বশীভূত করিবার—সিংহীকে জালবদ্ধ করিবার-যাদুকরের অব্যর্থ মন্ত্রশক্তির প্রয়োগ নাকি?

 অনুসন্ধানকারীগণ ডেক্সের প্রত্যেক কাগজখানি পর্য্যন্ত নামাইয়া দেখিল। তারপর ঘরের সমুদয় দ্রব্য তন্ন তন্ন করিয়া খুঁজিয়া দেখিয়া তাহারা হতাশ হইল। তখন অন্যত্র অনুসন্ধান করিতে যাইবার উদ্যোগ করিয়া মারাট ডিরোলেডের পানে ফিরিয়া বিদ্রূপপূর্ণ শ্রদ্ধার ছল করিয়া বলিল, “সিটিজেন গবর্ণর! আমার অনুরোধ, আপনি আমাদের এই দুঃখজনক কর্ত্তব্য সম্পাদনের সময়টা বরাবর আমাদের সঙ্গে সঙ্গেই থাকেন। তারপর আমি শপথ ক’রে বলচি, খুব শীঘ্রই আপনাদের ‘বিশ্রাব্ধলাপ’ করবার নিরুপদ্রব অবসর দিয়ে আমরা বিদায় নেবো —ঐ বিশ্রাব্ধলাপটা ভঙ্গ করায় সিটিজেনেস্ আমাদের পরে বড়ই ক্রুদ্ধ হয়েছিলেন।”

 যাহাকে ‘অনুরোধ’ বলা হইল কার্যতঃ তাহা অলত আদেশ! বন্দী যেমন করিয়া প্রহরীগণের সহিত কারাগারের দ্বারের দিকে অগ্রসর হয়, তেমনি অনিচ্ছুক পদে ডিরোলেড মারাটের সহিত সে গৃহ পরিত্যাগ করিয়া চলিয়া গেল। মারাট অন্যান্য স্থানে হতাশ হইয়া ফিরিয়া আসিয়া এবার নিশ্চয়ই জুলিয়েট‍্কে উঠিতে আদেশ করিবে। তারপর? ডিরোলেডের নির্ভীক চিত্ত কম্পিত হইতে লাগিল। দুর্ভাগিনী রাণী ও ষড়যন্ত্রকারীগণকে রক্ষা করার পরিবর্ত্তে তাহাদের সহিত এই দেবী প্রতিমাকেও পিশাচের হস্তে চূর্ণ-বিচূর্ণ হইতে হইবে যে!

 তাহাদের পদশব্দগুলা একেবারে মিলাইয়া গেলে গভীর নিশ্বাস ফেলিয়া বাক্সটাকে খুব সাবধানেই কাপড়ে ঢাকিয়া লইয়া জুলিয়েট্ আসন ছাড়িয়া উঠিয়া জানালার নিকট আসিয়া বাহিরের দিকে চাহিয়া দেখিল। হায় কোথায় মুক্তি! ঊর্ণনাভ নিজের জালে নিজেই বিজড়িত! চারিদিকেই অসংখ্য সশস্ত্র প্রহরী।

 সশঙ্কচিত্তে ধীরে ধীরে ঘর হইতে বাহির হইল।

 মাদাম ডিরোলেড তাঁহার ঘরে একখানা সোফার উপরে নিঃসহায়ভাবে নিজেকে নিক্ষেপ করিয়া হতাশাস্ফীত সভয় দৃষ্টিতে দ্বারের নিকটবর্ত্তী প্রহরী দুইটীর পানে চাহিতেছিলেন। জুলিয়েট্ কক্ষে প্রবেশ করিবামাত্র একটুখানি উৎসাহিত হইয়া মনের উচ্ছ্বাস ব্যক্ত করিয়া উঠিলেন, “দেখ দেখি জুল্, এ কি রকম অন্যায়! ফ্রাঙ্কের এতটা উন্নতি অনেক লোকেরই চক্ষুশূল হয়েছে কিনা, তাতেই কেউ তাকে অপদস্থ কর্ব্বার জন্যে এই রকমটা করেছে, আর কি? তা হোক্ ঈশ্বরতো এখনও আছেন, নিশ্চয়ই শেষটায় সব মিটে যাবে। দেখো তুমি, নির্দ্দোষী নিরপরাধী যে, সে কেন কষ্ট পাবে, আহা তুমিও বাছা যেন শুকিয়ে উঠেছ। বসো মা বসো।” জুলিয়েট্ কি একটা বলিতে গেল, কিন্তু তাহার দারুণ মনোদ্বেগে কম্পিত ওষ্ঠ শব্দ উচ্চারণ করিতে সক্ষম হইল না, একটু খানি নড়িল মাত্র।

 এমন সময় ডিরোলেড সেই গৃহে প্রবেশ করিয়া মাতাকে উদ্দেশ করিয়া সোৎসাহে কহিয়া উঠিলেন, “সিটিজেন, মারাট এইবার সদলবলে ফিরে যাবার বন্দোবস্ত কর‍্চেন, আমার জন্যে আর তোমার ভয় করার কোন কারণ নেই মা। কে, জুলি-মাদ‍্ময়সেল, ক্ষমা করো—আমি তোমায় দেখতে পাইনি। উ: তোমাকেও আমাদের সঙ্গে থেকে এই অপমানটার অংশ নিতে হওয়ায়, কি রকমই ক্লান্ত ক’রে ফেলেছে। যাহোক এখনি বিশ্রাম করতে পাওয়া যাবে—এই যা সুখের বিষয়!”

 দুইজন প্রহরীর সহিত তাহাদের নায়ক মারাট গৃহে প্রবেশ করিয়া সসম্ভ্রমে বৃদ্ধা ব্যারনেসকে অভিবাদন করিয়া বিনীতভাবে কহিলেন, “আপনাদের অনর্থক কষ্ট দিতে বাধ্য হওয়ায় বড়ই দুঃখিত হচ্চি সিটিজেনেস্! কি করি বলুন, এখনকার সময়ে সামান্য কারণেও একটু বেশি বিচলিত হ’তে হয়।”

 ডিরোলেডের দিকে ফিরিয়া কহিলেন,—“তবে এখন বিদায় সিটিজেন ডেপুটি! আপনি নির্ব্বিঘ্নে আপনার সম্মানিত নূতন পদ গ্রহণ করিতে যান্। বোধ হয় আপনার কোন গুপ্তশত্রুই আমাদের কাছে এই চিঠি পাঠিয়েছিল। এই দেখুন না, হয়ত এ লেখা আপনার অচেনা না-ওতো হ’তে পারে। গুপ্তশত্রুকে চিনে রাখা ভাল। জ্যাক্ কস্তেঁগো—চলো আমরা আর বিলম্ব ক’রে এই লেডির নিকটে নিজেদের অভিশপ্ত কর্ব্বো না।”—এই বলিয়া তিনি ডিরোলেডের সাগ্রহ প্রসারিত হস্তে একখানি পত্র দিতে গেলেন; এই সময় অকস্মাৎ মর্ম্মবিদারক আর্ত্তনাদের সহিত নিস্পন্দপ্রায় জুলিয়েট্ ছুটিয়া আসিয়া বিদ্যুতের মতই ক্ষিপ্রহস্তে সেই চিঠিখানা কাড়িয়া লইয়া আর্ত্তকণ্ঠে বলিয়া উঠিল,—“না না ডিরোলেড্ ডিরোলেড, —না না ও চিঠি তুমি দেখো —দেখো না।”

 মুহূর্ত্তের মধ্যে শতখণ্ডে পত্রখানা সে ছিঁড়িয়া ছিঁড়িয়া পায়ের তলায় ফেলিয়া তাহা চরণ-মর্দ্দিত করিতে লাগিল। তাহার যেন তখন খুন চাপিয়াছিল এমনি উন্মাদিনীরই মত মুখ চখের ধরণ।

 এই আকস্মিক উল্কাপাতের পর সে ঘরের লোকেদের ভিতর অনেকক্ষণ পর্য্যন্ত কেহ একটি শব্দও উচ্চারণ করিতে পারিল না। সহসা নির্মেঘ আকাশ হইতে বিচিত্রবর্ণে-রঞ্জিত ওই ছাদটা ফুটা করিয়া যদি শতবজ্র এক সঙ্গে সেই ঘরের মধ্যে নামিয়া আসিত, তাহা হইলেও বোধ করি সে ঘরের লোকেরা ইহাপেক্ষা অধিকতর স্তম্ভিত হইত না। কেহ কাহারও মুখের দিকে চাহিয়া দেখিতেও পারিতেছিল না, কেবল মারাট একবার তীক্ষ্ণ বিদ্রূপের ক্রুহাস্যে নবীন গভর্ণরের সর্পদষ্টবৎনীলিমালিপ্ত বিকৃত মুখের দিকে চাহিয়া দেখিলেন। সে মুখে গভীর হতাশাপেক্ষাও বিস্ময়ের বিমুঢ়ভাব অতি সুস্পষ্ট অক্ষরে প্রশস্ত উদার ললাটে রেখায় রেখায় ফুটিয়া উঠিয়াছিল।

 মারাট বিজয়ের উৎসাহানন্দপরিপূর্ণ স্বরে জিজ্ঞাসা করিলেন, “এ পত্র তবে আপনিই লিখেছেন ব’লে স্বীকার কর‍্চেন?”

 জুলিয়েট কাতরনেত্রে ডিরোলেডের পাষাণ মূর্ত্তির প্রতি একবার মাত্রই ফিরিয়া দেখিল, তারপর আর্তকণ্ঠে কহিল, “হ্যাঁ আমিই লিখেছি।”

 বাধা দিয়া উচ্চ কণ্ঠে তিরস্কারপূর্ণ কাতরস্বরে বৃদ্ধা ব্যারনেস মাদাম ডিরোলেড কহিয়া উঠিলেন, “নির্ব্বোধ মেয়ে! কি তুমি অবুঝের মত কথাবার্ত্তা কইচো! তুমি কিসের জন্য এই ভয়ানক চিঠি লিখ‍্তে যাবে? মহাশয়! আমার ছেলের বিপদ আশঙ্কায় ওর সব বুদ্ধি শুদ্ধিই লোপ পেয়ে গ্যাছে। দেখছেন না এরকম কখনও কি হ’তে পারে, আপনিই বলুন না-পারে কি? মারাট নীরবে ডিরোলেডের মুখের দিকে চাহিলেন। সেই পাষাণমুর্ত্তি প্রাণহীনের মতই স্তব্ধ, তেমনি অবিচল। তখন তিনি অপরাধনীর দিকে ফিরিয়া সেই মর্দ্দিত পত্রখানার একটি টুক‍রা কুড়াইয়া লইয়া তাহা দেখাইয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, “এ লেখা আপনার?” জুলিয়েট্ মৃদুস্বরে উত্তর করিল, “হাঁ। আমারই।”

 “এ রকম লেখবার কিছু যথার্থ কারণ আছে?”

 “আছে।”

 মারাট সাগ্রহে জিজ্ঞাসা করিলেন “কি?”

 এবার জুলিয়েট তাহার সুনীল স্বচ্ছ নেত্রদ্বয় মারাটের মুখের উপরে নির্ভীকভাবে স্থাপন করিয়া অকম্পিতম্বরে উত্তর করিল, “এখন বলবো না, বিচারালয়েই সমস্ত বল‍্বো।”

 “বেশ সেই ভাল। এই ভদ্রলোক তবে সম্পূর্ণ নিরপরাধী?

 মৃদু হাসিয়া জুলিয়েট্ কহিল “স্বচক্ষে দেখতেই তো পেলেন।”

 মারাট খুসী হইয়া ডিরোলেডের নিকটে আসিয়া কহিলেন, “আপনাকে অনর্থক এমন ভীষণ সন্দেহ করবার জন্য আমাদের ক্ষমা করবেন সিটিজেন্ গবর্ণর! কিন্তু আপনি একবার সিটিজেন্ মিরাবোঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ ক’রে, তবে কারজারিতে নিশ্চিন্তচিত্তে যাত্রা কর‍্বেন!—এ কি লেডি! এতক্ষণতো আপনাকে বেশ সহসীর মতই দেখাচ্ছিল, এখন এত কাঁপছেন কেন? দুর্ভাগ্যক্রমে আপনিই আপনার সেই ঈপ্সিত বিশ্রদ্ধালাপের অবসরটুকু নষ্ট ক’রে ফেলেন। আমার এতে কোন দোষ নেই!—ও কি, ওই না সেই খাম; যা খুঁজতে আমি এতদূরে এসেছিলুম,—বাঃ বাঃ রহস্যটা ক্রমেই যে রীতিমত বৃদ্ধি পাচ্ছে দেখ‍্চি।”

 জুলিয়েটের কম্পিত শিথিল বাম হস্ত কোন্ সময় এই ভীষণ বিশ্বাসঘাতকতা করিয়াছিল, সে তাহা জানিতেও পারে নাই। মারাট মুহূর্ত্তে সেই সংহারাস্ত্র,অভাগিনী রাজ্ঞীর ভাগ্যলিপি উঠাইয়া লইয়া উচ্চৈঃস্বরে হর্ষধ্বনি করিয়া উঠিলেন, কহিলেন—“এই রকম একটা ষড়যন্ত্রের অস্পষ্ট গুজব আমরাও শুনেছিলুম, কিছুতেই কিন্তু এর কোন কিনারা পাইনি। বড় উপকৃত হলেম,—ম্যাদ‍্ময়সেল্। আপনার নিকট আমরা বড়ই উপকৃত হলেম। বলুন দেখি, এখন এটি কোথায় আপনি পেলেন? আপনাকে সত্যবাদী বলেই আমার খুব বিশ্বাস হ’চ্চে।”

 বৃদ্ধা বিদ্যুৎচমকে চমকিয়া উঠিয়া বিস্ফারিত নেত্রে তাহার মুখের দিকে চাহিলেন। তাঁহার, পাণ্ডু মুখে আশাহীন ঘোর যন্ত্রণার চিহ্ন সুস্পষ্টতর হইয়া উঠিল। জুলিয়েট্ কোনই উত্তর না দিয়া নত মুখে যেমন তেমনই দাঁড়াইয়া, রহিল।

 সমস্ত বিশ্বজগৎ তখন ডিরোলেডের নিকটে ধূমায়মান হইয়া গিয়াছে, জীবন অথবা সম্মান কিছুই যে আর তাঁহার এ পৃথিবীতে আবশ্যক আছে কিম্বা ইহাদের কোন মূল্যই আছে, একথা পর্য্যন্ত তাঁহার মনেও ছিল না। তাঁহার উপাস্য দেবতা যে আজ বড় সহসাই পিশাচে পরিণত হইয়া গিয়াছে! দেবীর মণ্ডপে তাই আজ হু হু শব্দে নরকাগ্নি জ্বলিয়া উঠিয়াছে। মারাট পুনশ্চ জিজ্ঞাসা করিলেন,—“কে এই জিনিষটার প্রকৃত অধিকারী? শীঘ্র বলে।”

জুলিয়েট্ এইবার চেষ্টা যত্নে যতদূর সম্ভব নিজেকে সাম‍্লাইয়া লইয়াছিল। সে গ্রীবা উন্নত করিয়া সগর্বে উত্তর করিল, “চাক্ষুষের চেয়ে কোন বড় প্রমাণ আছে? আমিই ইহার অধিকারী।”

 “আর কেউ এ বিষয় জানে?”

 “এখানের কেউ না, যারা জানে তাদের নাম আমি বলবো না।”

 “উত্তম! সিটিজেন্ ডেপুটি! আপনার অনর্থক বিলম্ব হয়ে যাচ্ছে। প্রহরী! তোমরা উঁহার সঙ্গে যাও। আমিও আর বিলম্ব করতে পারি না।”

 সঙ্কেত বুঝিয়া ডিরোলেড, একবার মাতার দিকে চাহিয়া দেখিলেন। বৃদ্ধা উন্মাদিনীর মত আসন হইতে উঠিয়া ছুটিয়া আসিয়া পুত্রকে জড়াইয়া ধরিলেন, “ফ্র্যাঙ্ক, ফ্র্যাঙ্ক! বাবা আমার। আমার সর্ব্বস্বধন! ঘরের মধ্যে কালসাপিনীকে আমাদের দুজনকার বুকের রক্ত দিয়ে আমরা যে পুষ‍্ছিলুম—ওরে বাছা সে কি তোকেই দংশন কর্ব্বে ব’লে রে!”

 ডিরোলেড মাতার স্নেহবাহুপাশ হইতে ধীরে ধীরে নিজেকে মুক্ত করিয়া লইয়া তাঁহাকে নীরবে চুম্বন করিয়া প্রহরীদ্বয়ের সহিত নিঃশব্দে গৃহ পরিত্যাগ করিয়া চলিয়া গেল। যাইবার সময় একবার জুলিয়েটের দিকে সে অপাঙ্গেও চাহিল না। তাহার জীবনের গ্রন্থিবন্ধন পর্য্যন্ত যে শিথিল হইয়া পড়িয়াছে!

 ডিরোলেডের পশ্চাতে দ্বার রুদ্ধ হইয়া গেল, বৃদ্ধা নিজের আসনে আবার বসিয়া পড়িয়া দুই করে মুখ ঢাকিলেন। নিস্তব্ধ গৃহে তাঁহার ঘন ঘন নিশ্বাসের মর্ম্মভেদী শব্দ মর্ম্মভেদী বিলাপধ্বনির মতই শুনাইতে লাগিল। মারাট জুলিয়েট‍্কে কহিলেন, “আমিআর বিলম্ব কর‍্তে পারব না?”

 হাতে হাত সংবদ্ধ করিয়া সেই যুক্ত কর দ্বারা নিজের ঝটিকাক্ষুব্ধ সমুদ্রবৎ উদ্বেল বক্ষকে চাপিয়া ধরিয়া সে দাঁড়াইয়াছিল, নতনেত্র তুলিয়া মৃদু হাসিল,—“না আর বিলম্ব কি? কেবল একটা অনুরোধ”—মারাটের কঠোর দৃষ্টি সহসা ঈষৎ স্নেহপূর্ণ হইয়া আসিল—“কি?”

 মৃদুস্বরে জুলিয়েট্ কহিল, “দু একটি কথা আমি গোপনে মাদাম ডিরোলেডকে ব’লে যেতে চাই,—পারি কি সিটিজেন্ মারাট?”

 ইচ্ছা সত্ত্বেও কঠিন চিত্ত মারাট, ইহাকে ‘না’ বলিতে পারিল না। জুলিয়েট তখন ধীরে ধীরে মাদাম ডিরোলেডের নিকটে গিয়া দাঁড়াইল। কিন্তু মাদাম ডিরোলেড তাহা জানিতে পারিয়াও তাহার দিকে চাহিয়া দেখিলেন না। ধ্যানমগ্নের ন্যায় নিঃস্তব্ধ হইয়া তিনি অন্যদিকেই চাহিয়া রহিলেন। জুলিয়েট্ তাঁহার পায়ের কাছে জানু নত করিয়া ভূমে বসিয়া পড়িল, তাঁহার শোক ও বিরক্তিপূর্ণ দৃষ্টির সম্মুখে নিজের স্থিরদৃষ্টি নিবদ্ধ করিয়া অন্যের অশ্রাব্য মৃদুস্বরে কহিল, “আমায় আপনারা ঘৃণা কর‍্তে পারেন মাদাম! আপনার এ গৃহ আমার দ্বারা কলুষিত হচ্চে তাও আমি জানি, আমি আর বেশীক্ষণ দেরী ক’রে এ পাপের ভার বাড়াবো না। —তবে একটি অনুরোধ আমার আছে, তাই বলতেই এসেছি,—শেষ অনুরোধ শুন‍্বেন না কি?”

 মাদাম ডিরোলেড নিস্পন্দ বসিয়া রহিলেন, ফিরিলেনও না। অব্যক্ত যন্ত্রণাপরিপূর্ণ দীর্ঘশ্বাসে জুলিয়েটের বক্ষ তরঙ্গবিক্ষুব্ধ সমুদ্রেরই ন্যায় উদ্বেলিত হইয়া উঠিল। একটুখানি নীরবে থাকিয়া উত্তর পাইবে না বুঝিয়া সে তখন আবার কহিল, “আমার এই শেষ অনুরোধ— যখন সংবাদ পাবেন যে, বিশ্বাসঘাতিনীর পাপ দেহ তপ্ত শোণিতধারায় ধুয়ে গিয়ে তার নিদারুণ রক্তপিপাসা মিটিয়ে দিয়েছে, তখন শুধু কৃপা ক’রে এই কথাগুলি তাঁকে বল‍্বেন—এই আমার একমাত্র শেষ প্রার্থনা!—বল‍্বেন আমি তাঁর ঘরের এই বিশ্বাসহন্ত্রী অতিথি, জুলিয়েট্ মাণি, ৺কাঁউণ্ট্ মার্ণির কন্যা। তিনি বোধ হয় ভুলে যান নি, তিনি আমার ভ্রাতৃহন্তা! ভাইয়ের মৃত্যুশয্যায় পিতার কাছে প্রতিজ্ঞা করেছিলেম—মৃত ভাইকে ছুঁয়ে শপথ করেছিলেম,—তাঁর পুত্রহন্তা এর প্রতিফল পাবে! তাই নিজের জীবন বিপন্ন ক’রে এখানে স্বেচ্ছায় এসে ঢুকেছিলেম—অকস্মাৎ নয়। প্রতিহিংসা চরিতার্থ করবার জন্যই আপনাদের আমার প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করিয়েছিলুম।

 জুলিয়েট্ একটু থামিল, তারপর রুদ্ধপ্রায় কণ্ঠ পরিস্কার করিয়া লইয়া পুনশ্চ কহিল, “তারপর আরো বল‍্বেন যে, প্রতিহিংসা ভিন্ন ইহলোকে পরলোকে আর কোন ধর্ম্ম, কোন কার্য্য জীবনের উদ্দেশ্যই ছিল না; হাতে পেয়ে তা কেন আমি পূর্ণ করিনি? এর উত্তর দেওয়া ভাইকাউণ্ট রাল‍্ফের ভগ্নী ও কাউণ্ট মার্ণির মেয়ের পক্ষে অপমানজনক হলেও, কোন রমণীর পক্ষে এতে অপমান নাই! আজ সন্ধ্যাবেলা তাঁরই মুখের শুধু দুটি কথায় আমার সকল সঙ্কল্প, সব চেষ্টা ভেসে গিয়েছে! তিনি বলেছিলেন ‘জুলিয়েট্ আমি তোমায় ভালবাসি!’ সেই শব্দটুকু আমার কর্ত্তব্য, প্রতিজ্ঞা সবই আমায় ভুলিয়ে দিয়েছে! স্বর্গীয় সঙ্গীতের মত সেই কথাদুটি মৃত্যুর বিভীষিকাকেও মুক্তির আনন্দরূপে আমায় প্রলোভিত করচে। আজ শুধু সেই-ই আমাকে তাঁর যায়গায় দাঁড়িয়ে তাঁর বিপদকে নিজের মাথায় তুলে নিতে অলঙ্ঘ্য আদেশ দিয়েছিল। তাঁকে আড়াল ক’রে এই যে অগ্নিকুণ্ডে ঝাঁপিয়ে পড়তে পার‍্লেন এ শুধু তাঁরই সেই মন্মোহনমন্ত্রের গুণ; আমার নয়! সেই সময়েই আমিও বুঝিতে পেরেছিলেম, আমিও তাঁকে ভালবাসি। আমার এই প্রতিশোধ স্পৃহার চেয়েও অধিকতর ভালবাসি।”—

 জুলিয়েট্ উঠিয়া দাঁড়াইল, মুহুর্ত্তে মাদাম ডিরোলেড দুই বাহু তাহার দিকে প্রসারিত করিয়া দিয়া রুদ্ধকণ্ঠে কাঁদিয়া উঠিয়া কহিলেন, “জুলি! জুলি! বাছা আমার, কোথা যাস্? আমার যে বড় সাধ ছিল।”—

 জুলিয়েট্ তাঁহার স্পর্শ হইতে সরিয়া দাঁড়াইয়া দৃঢ়স্বরে কহিল, “আমায় স্পর্শ করবেন না মা,—আমি আপনার স্নেহের যোগ্যা নই। তবে যদি নিতান্তই দয়া করেন, তো আমার মৃত্যুর পর তাঁর মন থেকে আমার প্রতি—পারেন তো এ নিদারুণ ঘৃণা মুছে দেবার একটু চেষ্টাও কর‍্বেন। বল‍্বেন “জুলিয়েট্ তার প্রাণাধিক প্রিয় ভাই এর, তার পরমপূজ্য বাপের কাছে মহাপরাধে অপরাধিনী; কিন্তু তাঁর কাছে নয়।—যাই মা, এইবার আমার সকলকার কাছের সকল পাপেরই প্রায়শ্চিত্ত কর‍্তে চল্লেম্। বিদায়!”

 সুদৃঢ় পদক্ষেপে মারটের নিকটে আসিয়া বলিল, “আপনাকে, অনেকক্ষণ আটক ক’রে, রেখেছি ব’লে, দুঃখিত হচ্চি, মুসো মারাট! চলুন, এইবার আমায় কোথায় নিয়ে যাবেন চলুন!”

 মারাট এতক্ষণ নীরবে তাহারই ভাব পর্য্যবেক্ষণ করিতেছিলেন। তাহার সুন্দর সমুন্নত দেহ, সম্রাজ্ঞীর মত নির্ভীক চালচলন ও আত্মগরিমা দেখিয়া তিনি মনে মনে বিস্ময় অনুভব করিতে লাগিলেন। নিষ্ঠুর-প্রকৃতি রিপব‍্লিক-কর্ম্মচারীর পাষাণ চিত্তও ইহাতে যেন দ্রব হইয়া আসিয়াছিল। মনে মনে তারিফ্ করিয়া বলিলেন, “অনেক তীক্ষ্ণবুদ্ধি বিজ্ঞ ও নিরীহ লোকের শোণিত ধারায় রঞ্জিত হ“লেও গিলোটিনের ভাগ্যে এমন একটী মন্তক ইহার পূর্ব্বে জুটে নাই। আমি তাকে ফ্রান্সের একটি অমূল্য দ্রব্য এবার উপহার দিতে পারব।”

 জুলিয়েটের আবাহনে মারাট সচকিতে চাহিয়া দেখিয়া, উঠিয়া দাড়াইলেন—“প্রস্তুত?”

 “সম্পূর্ণ। আসুন!”

 অকম্পিত দৃঢ়পদে জুলিয়েট্ অগ্রবর্ত্তিনী হইয়া দ্বার সমীপস্থ প্রহরীর দিকে নিজের সুকোমল শুভ্র হাত দুখানি বাড়াইয়া দিয়া নম্রস্বরে জিজ্ঞাসা করিল, “হাতকড়ি কার কাছে?

 মারাট্ প্রশংসমান নেত্রে তাহার দিকে চাহিয়া সম্ভ্রমের সহিত কহিল, “কোন প্রয়োজন নাই, আপনি আসুন।”

 বহির্দ্বারের প্রকাণ্ড লৌহ কবাট ঝন্‌ ঝন্ ধ্বনি সহকারে সজোরে রুদ্ধ হইবার শব্দ প্রকাণ্ড জনহীন পুরীর মধ্যে বহুক্ষণ ধরিয়া প্রতিধ্বনি জাগাইয়া রাখিল। তারপর—তারপর মৃত্যু-গভীর নিঃস্তব্ধতায় সে ধ্বনি মিলাইয়া গিয়া প্রেত-পুরীর ন্যায় সব নীরব হইয়া গেল।