স্বর্গচ্যুত

 সে প্রতিদিন বিকেলবেলা একটা পাহাড়ের তলায় সমতল ভূমিতে ঝাউগাছের তলাটীতে চুপ করে দাঁড়িয়ে থাক্‌ত। মুক্ত বাতাস তার চুলগুলি নিয়ে খেলা কর্‌তো। কখন বা একটী দোলা দিয়ে পালিয়ে যেত। আর গোছা গোছে সরু চুলগুলি সরে এসে তার ছোট ফুট্‌ফুটে কচি মুখখানি ঢেকে ফেল্‌ত। বালিকাকে কিন্তু কখনও তাদের বাধা দিতে দেখিনি, তেমনি ভাবে তারা তার মুখে বুকে ছড়িয়ে পড়ে খেলা কর্‌তো। তার পায়ের কাছে সেই গাছটী রোজই কতকগুলি ঝাউ ফল ও পাতার উপহার সাজিয়ে ধ’রত। রাস্তায় চল্‌তে চল্‌তে পথিকেরা একটী বার তার দিকে চেয়ে থম্‌কে না দাঁড়িয়ে, একবার তার মুখখানি অতৃপ্ত দৃষ্টিতে না চেয়ে দেখে, কখনও চলে যেতে পার্‌তো না।

 সে কিন্তু বড় একটা কাকেও লক্ষ্য কর্‌তো না। হয়ত একটা ঝাউ পাতার ঝাড়, না হয় কোন একটী ফুলের গুচ্ছ হাতে করে সুমুখের রাস্তা পানে কালো চোক্ দুটী স্থির রেখে দাড়িয়ে থাক ত। দেখে আচম্‌কা মনে হতো কে যেন লোকের তারিফ্ নেবার জন্য এইখানে তার বড় যত্নে আঁকা ছবিখানি রেখে আড়ালে কাণ খাড়া করে আছে। সেই ছোট মুখখানি আমায় অকৃষ্ট করে ফেলেছিল। কত দিন মনে করেছি কাছে গিয়ে জিজ্ঞাসা করি, রোজই সে এই একটা জায়গায় তার এই বয়সের হাসিখুসী খেলাধুলো ফেলে চুপটী করে দাঁড়িয়ে থাকে কেন? কিন্তু তার কি রকম একটী মৌন গাম্ভীর্য্য তাকে যেন সবার মধ্য থেকে একটু খানি আড়াল করে রেখেছিল, সেই টুকুই আমাকে বাধা দিতে লাগ্‌ল। মনে হ’ত, যদি এই কথার শেষেই তার ঐ আকাশের মত স্বচ্ছ সুনীল চোখ দুটা জলে ভরে ওঠে? কি দিয়ে তবে তাকে থামাব। দু এক পা অগ্রসর হয়েও তাই সঙ্কোচে মরে গিয়ে ফিরে এসেছি। কিন্তু আমার মনটি যে ক্রমেই সেই অজ্ঞাত মেয়েটির দিকে আকৃষ্ট হচ্ছে, সেটুকু নিজে নিজেই বেশ বুঝতে পার্‌ছিলুম।

 একদিন—সেদিন শীতের ঠাণ্ডা হাওয়ার সঙ্গে ভর করে পাতলা কুয়াশার স্তর ক্রমেই জমাট বাঁধা মেঘের গায়ে মিশে গিয়ে দুর্য্যোগের সূচনা করে উঠ্‌লো। পাখীরা সব যে যার বাসায় স্থির হয়ে বসে জিরোচ্ছে, সেদিন রাস্তাতেও দু একটা হতভাগ্য ভিন্ন কেউ আর বার হয়নি। এমন ক্লান্তিজনক নিরানন্দ দিনে আমায় গুরুতর প্রয়োজনে একটি বন্ধুর সঙ্গে দেখা ক’র্‌বার জন্য বাড়ীর সেই গরম ঘরখানি ছেড়ে এই ঠাণ্ডা হাওয়ার পথে বেরোতে হলো। সইস বাড়ী নেই, তাছাড়া ঘোড়াটা— আহা নিরীহ জীব! আমার জন্য সে বেচারী কেন তার তপ্ত কম্বলখানির আলিঙ্গনচ্যুত হ’য়ে এমন আনন্দ-ভোগটুকু হারায়।

মধ্যাহ্নে একেতো গ্রাম্যপথ জনশূন্যই পড়ে থাকে, তাতে আজ দিনটাও সুবিধাজনক নয়, কাজেই কেউ কোথাও নেই। মনে স্ফুর্ত্তি আনবার জন্য শিষ দিতে দিতে একটি পুরনো গানের একটা চরণ গাইছিলুম। হঠাৎ সেই গাছতলাটীতে চোখ পড়ে গেল, কি আশ্চর্য্য মেয়েটী আজও তো দাঁড়িয়ে আছে! আহা! বেচারীর ঠোট দুখানি শীতে নীল হয়ে গেছে, ঠাণ্ডা বাতাসে অল্প পোষাকে তাকে কাঁপিয়ে তুলেছিল, তবু সেই রকম মুখের ভাব। যেন কোন কিছুতেই সে ভাবটুকুর বদল হতে জানে না!

 দ্রুতপদে কাছে গেলুম, কৌতূহল আর চাপা গেল না। আমাকে দেখে তার বড় বড় চোখ দুটীতে একটু খানি যেন বিস্ময়ের ভাব ফুটে উঠ্‌ল; সে বাঁদিকে মুখখানি একটু ফিরিয়ে অপাঙ্গে আমার দিকে একটীবার চেয়ে দেখ্‌লে। কাছে গিয়ে তার একখানি হাত ধরে আদর করে জিজ্ঞেস ক’র্‌লুম “এত শীতে আজও তুমি এখানে দাঁড়িয়ে আছ কেন বাছা?”

 মেয়েটী আস্তে আস্তে চোখ দুটী আমার মুখ থেকে নামিয়ে নিলে, হাতখানি কিন্তু সরিয়ে নিলে না, একটুখানি চুপ করে থেকে তারপর আবার আমার পানে চোখ তুলে চেয়ে অত্যন্ত মিষ্টম্বরে উত্তর দিল “আমার ভাই ইস্কুল থেকে আসবে বলে আমি এইখানে দাঁড়িয়ে থাকি। আজ কিনা শনিবার, সেইজন্য আজ এক্ষুনি থেকে এসেছিলুম।”

 কি একটা অনুভূত আনন্দে আমার সমস্ত শরীরটায় যেন কাঁটা দিয়ে উঠলো। কি মধুর ভ্রাতৃস্নেহে এই শিশু হৃদয়টুকু পূর্ণ হয়ে আছে। সুন্দর ফুলটি তেমনি কি সুরভিস্নিগ্ধ! জিজ্ঞাসা কর্‌লেম, তোমার বাড়ী বুঝি কাছেই? তোমার বাড়ীতে আর কে কে আছেন?”

 বালিকা তার হাতের ফলের ঝাড়টা একটু খানি নেড়ে চেড়ে আমার পানে তার— আজকের আকাশের মত নয়—কিন্তু অন্যদিন যে রকম রং আকাশে মেঘের সময় দেখা যায় তেমনি রংঙের— চোক দুটি ফেরালে, কি শান্ত সুন্দর সেই দুটী চোখ!

 নম্রভাবে ধীর কণ্ঠে বলে, “বাড়ীতে আমার মা আছেন, আর কেউ নেই। ঐ যে আমাদের বাড়ী।”

 বালিকার নির্দ্দেশ মতন চেয়ে দেখলুম, নদী তীরের যে ছোট কুটীরগুলি এ যাবৎ লক্ষ্যের বিষয় বলে কখন মনেও করিনি তারি একটি কুটীর সেই চাঁদের মত মেয়েটিকে কোলে নিয়ে পবিত্র হয়ে উঠে এখন আমার দিকে উপহাসের দৃষ্টিতে চেয়ে দেখ্‌ছে। মনে মনে আশ্চর্য্য বোধ কর্‌লুম, এই মধুময়ী বালিকা দরিদ্র গৃহ উজ্জ্বল করেছে! ভাবলুম, চাঁদের জ্যোৎস্না, সূর্য্যের আলো পানা-পুকুরে কি ভাসে না! কি একটা কথা ব’ল্‌তে যাচ্ছিলুম হঠাৎ মেয়েটির মুখখানি এমনি চক্‌চকে হয়ে উঠ্‌ল যে আমি ভাষা হারিয়ে ফেলে সেই দিকে ফিরে চাইলুম। হঠাৎ একটি খসে-পড়া তারার মতন চঞ্চলগতি বালককে আমাদের অদূরে দেখতে পেয়ে বুঝ্‌তে পার্‌লুম, এইটিই মেয়েটির লক্ষ্যকেন্দ্র, এরি একর্ষণ একে এখানে টেনে রেখেছিল, এই তার ভাই।

 এর পর থেকে আমার সঙ্গে তাদের পরিচয় একান্ত ঘনিষ্ঠ হয়ে উঠ্‌ল। আমার জীবনের এই—কটা মাসই যেন সব চেয়ে স্মরণীয় ও সব চেয়ে বরণীয় হয়ে আমার জীবন-ইতিহাসের পৃষ্ঠায় স্বর্ণাক্ষরে জ্বল জ্বল ক’র্‌চে। অল্প বয়সে অল্প কয়টি বৎসরের জন্য আমি আর একবার এই বিশ্বজগতের রহস্যময় আবরণমুক্ত আলোককীর্ণ উজ্জ্বল অংশের পরিচিত হয়েছিলুম বটে; কিন্তু সে আলেয়ার আলো এত শীঘ্র আমার গভীর প্রান্তরের মাঝখানে ফেলে মিলিয়ে গিয়েছিল যে, সে আলোকের জ্যোতি বাস্তবের চেয়ে স্বপ্নের মত অনুভবের জিনিষে দাঁড়িয়েছিল মাত্র, শুধু স্বপ্নে উপভোগ্য বস্তুতে দাহ থাকে না, ঐ বাস্তব বলিয়া বাহ্য শক্তিতে পরিপূর্ণ।

 কাঞ্চী অভিরমা পুরাতন ক্ষত্রিয় কুলের এক দরিদ্র নারী; তাঁহার হাসি মুখখানিতে করুণা ফুটাইয়া বিনীত লজ্জায় আমায় পুরাতন চারপায়া খানি এগিয়ে দিতে গিয়ে অনেক সময় ক্ষমা চেয়ে স্মরণ করিয়ে দিতেন যে, তার একটা পায়া হাল্কা হয়ে পড়েছে, একটু সাবধানে বসা প্রয়োজন। অতি সামান্য যব জনেরার রুটি, একটু খানি নুলিয়া শাক, যৎসামান্য ফলটা মূলটা আমি যখন ছেলেদের সঙ্গে আমোদ করে খেতে বসতুম, তিনি তার অলক্ষিতেও যেন ঈষৎ লাল হয়ে উঠতেন, কিন্তু তাঁর সেই দারিদ্র্য-প্রকাশক আতিথ্যে সাক্ষাৎ সম্বন্ধে কিছুই কুণ্ঠিত ভাব প্রকাশ কর্‌তেন না। দারিদ্র্যে যে একটা উৎকট লজ্জাও গোপন থাকতে পারে, সেটা যেন এই পরিবারের ধারণায় কোনদিন ধরা দেয় নি। নিঃশঙ্ক গরিমায় আপনাতেই তারা সমুন্নত, কোনখান দিয়ে অপরিতৃপ্তির দীনতা তাদের স্পর্শ ক’র‍্তে পারেনি।

 কাঞ্চী—সেই ছোট্ট পরিকন্যাটির মতনই চমৎকার মেয়েটি—তার মার গৃহকর্ম্মেও বড় অল্প সাহায্য কর‍্ত না। নদী থেকে জল এনে সে যখন তার ছোট্ট কচি হাতে স্বল্প বাসন ক’খানি নতমুখে বসে পরিষ্কার করিত, নিকষ কালো চুলের দু-একটি গোছা সে সময় তার পিছন হতে কখন চুপিচুপি এসে জ্যোৎস্না-মাখা মুখখানির দুদিক থেকে উঁকি দিয়ে চেয়ে দেখ‍্ত; নিবিষ্টতার একটি ভাব মসৃণ ললাটখানির উপরে ফুটে উঠে তখন তাকে যেন কর্ম্মের একটি ছোট্ট জীবন্ত ছবির মতন দেখাতে থাক‍্ত। বড় ঘরের হলেও সে আজ নেপালের গরীবের মেয়ে,— গ্রামে অবৈতনিক পাঠশালা নেই। ঘরেই সে মার কাছে, দাদার কাছে পড়া জেনে নেয়। আমি খুব একটি সুযোগ পেলুম। বলে বসলুম, আমি তোমায় রোজ পড়াব।”

 কৃতজ্ঞ দৃষ্টিতে সে এমন করে আমার পানে চেয়ে দেখলে যে, সামান্য কাজের বদলে ততখানি মূল্য আমি সইতে না পেরে হঠাৎ চোক ফিরিয়ে নিলুম।

 নেপালী মেয়েরা প্রায় খুব বুদ্ধিমতী হয়। এরও বেশ বুদ্ধি শুদ্ধি, খুব মনোযোগী। যখন সে দাদার জন্য ঝাউতলাটীতে দাঁড়িয়ে থাকে, সেইটি তার পড়া তৈরি করবার একটা সময়। জামার তলায় বইখানি লুকনো থাকে, মধ্যে মধ্যে দেখে নেয়, আর মনে মনে মুখস্থ করে যায়। ভাল ভাল অনেকগুলি কবিতা তার দাদার পাঠ্য পুস্তক থেকেও এমনি করে সে মুখস্থ করেছে, শেখান পাখীর মতন বেশ সুন্দর রকমে সেগুলি আবৃত্তি করতে পারে।

 আমার ঘরে কোন কাজ নেই। উদ্ভিদতত্ত্ব সংগ্রহ ও সংকলন করেই দিনগুলোকে এক রকম করে কাটিয়ে দিয়ে কোন রকমে এক বার পার হয়ে যাওয়া; কিন্তু এবার শুষ্ক আগ্রহহীন দিনগুলাকে আমি জয় করেছি। যেখানে কখন জল ছিল না, একদিন সেখানকার মাটিকে বিদীর্ণ করে শীতল জলের নির্ঝর হঠাৎ ছুটে বেরিয়েছে। সন্ধ্যাবেলা নদীর তীরে আমাদের দেখা হত। ক্ষেতগুলিতে জল দিয়ে, বাগানটীর বেড়া বাঁধায় তাদের সাহায্য করে তাদের সঙ্গে সবুজ ঘাসের উপর বসে পড়ে দেশ বিদেশের নানারকম গল্প ক’র‍্তে ক’র‍্তে আমার মনে হত, স্বর্গ কোথায়? আমার দেওয়া জলছবির খাতা, কিছু খাবার ও খেলনা হাতে করে তুলে নেবার সময় দুটি শিশুরই আনন্দ-উজ্জ্বল দুখানি মুখে হঠাৎ একটী কুণ্ঠার দ্বিধা এত ধীরে ঈষৎ রক্তিমার সঞ্চার ক’র‍্ত যে, আমি দুঃখিত না হয়ে তাদের নির্লোভ মর্য্যাদাজ্ঞানের পরিচয়ে আনন্দই অনুভব কর‍্তুম। স্বাধীন পার্ব্বত্য প্রদেশীয়ের সন্তানজ্ঞানে তাদেব ছোট বুকদুটিও ভরা। তা থাক, ছোটই তো বড় হয়।

 অভিজিৎ বল‍্তো তার বড় যোদ্ধা হবার সাধ। তাদের পিতামহ এবং পিতা নাকি নেপালে যুদ্ধের সময় সম‍্সের জঙ্গের পক্ষে থাকিয়া দেশের জন্য প্রাণ দিয়াছিলেন। তাই দাদার কথা শুনে কাঞ্চীর ফোটা ফুলের মত মুখখানি ভয়ে যেন এতটুকু হয়ে যেত। সে ছোট দুটী হাতে তার গলাটি জড়িয়ে ধরে ভাঙ্গা ভাঙ্গা করুণ স্বরে আস্তে আস্তে বল‍্ত “না ভাই যুদ্ধ ক’র‍্তে যেও না, যদি তুমিও মরে যাও।”

 খুব বড় একজন সাহসী সেনাপতির মতন বালক ঈষৎ অবজ্ঞার হাসি হাসিত “বীরের মৃত্যু কি মরণ রে? বীর মরে অক্ষয়স্বর্গ লাভ করে। বোকা মেয়ে, তাও জানোনা?”

 সুখের দিন; এ দিন গুলার চেয়ে দ্রুতগামী বিশ্ব সংসারে আর কিছুই আমি খুঁজে পাইনে। এই হৃদয়টাতো শ্মশানের মত ভয়ানক হয়ে গেছলো, আজ আবার হঠাৎ এই শিশুটি তাদের দুঃখনাশী সঙ্গদানে সেইটেকেই যেন বসন্তের চিহ্ন-ভরা মনোরম বাগানে পরিবর্ত্তিত করে ফেলেছিল। কেন্দ্রচ্যুত গ্রহ একটা—যে অনন্ত আকাশের চারিদিকে তার নিজের ব্যর্থতা বুকে করে চারিদিকের আলোর পানে চেয়ে কেবলি লক্ষ্যশূন্য ভাবে ঘুরে বেড়াচ্ছিল, হঠাৎ যেন আবার তাকে একটি কেন্দ্রের সঙ্গে বেঁধে দেওয়া হয়েছে। বুঝেছিলুম শিশুবুভুক্ষিতের পক্ষে বড় কম পুরস্কার নয়। এমন সময় হঠাৎ একদিন পাহাড় থেকে নেমে কলকাতার আদালতে সাক্ষ্য দিতে যেতে হল। মনের ভিতরে সংসার থেকে বিদায় নিয়েছি অনেক দিন, কিন্তু সংসার তা বল্লেতো বোঝে না, সে আবদারে শিশুর মতন আঁচল নিয়ে টানাটানি ক’রে তার পাওনা আদায় করতে চায়। যাবার সময় অভিজিতের সঙ্গে আর দেখা হ’ল না, তাদের পাঠশালে পরীক্ষা আরম্ভ হয়ে গিয়েছে। সে ক’দিন ভারী ব্যস্ত। গাড়ীখানাকে এগিয়ে দিয়ে নিজে হেঁটেই বেরিয়ে প’ড়লুম। আহা এমন শান্ত সৌন্দর্য্যের মর্য্যাদা নষ্ট করে ফেলে কর্ক্কশ চক্রধ্বনি তুলে কেন প্রকৃতির নির্ব্বোধ শান্তিতে ব্যাঘাত দেওয়া? এটা শুধু নিষ্ঠুরতা নয়, . অপরাধও!

 সেই ঝাউতলায় আমি যে কাঠের ছোট বেঞ্চ খানি রেখেছি, কাঞ্চী তার উপরে বসে আপনার মনে পা দুখানি দোলাতে দোলাতে কি একটা আবৃত্তি কর‍্ছিল। বোধ হয় তার পাঠ্য পুস্তকের সর্ব্বশক্তিমান্ ঈশ্বরের বিষয়ক কবিতাটি। কাল আমি তাকে ওইখানটা পড়। দিয়েছিলুম কিনা তাই এইটেই সন্দেহ হলো। ফুর ফুরে একটুখানি হাওয়া ছিল। খুনসুটে ভাইয়ের মতন সে তার সরু সরু চুলের গোছাগুলো নিয়ে ক্রমাগত তার চোখে মুখে ছড়িয়ে দিয়ে তাকে বড় জ্বালাতন করে তুলেছিল। আমি চুপি চুপি তার পিছন দিক্ থেকে কাছে গিয়ে বড় একটা গোলাপ ফুল তার মাথার উপরে রাখতেই সে এমনি দ্বিধাহীন ভাবে হেসে ফিরে চাইলে যে, আমি ভিন্ন তার সঙ্গে কোন রকম কৌতুক কর‍্বার আর কারু যে— অভিজিৎ সিং যখন স্কুলে আছে—সাহস থাকা সম্ভবই নয়, এই ভাবই তাতে প্রকাশ পেলে। হঠাৎ সে মুখ ফেরানয় ফুলটি তার মাথা থেকে ভূঁয়ে পড়ে গেল, আমি হেঁট হয়ে সেটা কুড়িয়ে নিয়ে ধূলো ঝেড়ে তার হাতে দিলুম। আগ্রহ করে সে ফুলটি নিয়ে সেটি আঘ্রাণ করে একটু খানি হেসে বল্লে, “দাদাকে রাত্রিতে অনেকক্ষণ পড়তে হয়, ফুলটী ঘরে থাক‍্লে এর গন্ধে তার অনেকটা ক্লান্তি দূর হ’বে।”

 আমি বিস্ময়ে নির্ব্বাক্ হয়ে তার ঈষৎ আনন্দিত মুখখানির দিকে চেয়ে দেখলাম। কতখানি ভালবাসা এদের মনের মধ্যে সকল সময়ে পরস্পরের প্রতি অচঞ্চল ধ্রুব তারকার মত নির্নিমেষে জাগ্রত হয়ে আছে? প্রশংসাপূর্ণ আদরে তাকে চুম্বন করে বল্লেম, “তোমার দাদার জন্য তুমি যত ইচ্ছে আমার বাগান থেকে ফুল কেন নিয়ে এসোনা কাঞ্চী! আমি তো কদিন থাক‍্বো না, তুমি নিজে গিয়েই অনেক করে ফুল এনো। আমি সইসকে বলে দেব এখন।”

 কাঞ্চী আমার কথা শেষ না হতেই চকিত হয়ে আমার পানে চাইলে, “থাক‍্বেন না, কোথা যাবেন?”

 “বাংলায়, আবার শীঘ্র আসবো।”

 কিন্তু আমার সান্ত্বনায় কাঞ্চী যেন তেমন খুশী হল না, সে ঈষৎ একটা নিশ্বাস ফেলে হঠাৎ মুখ নীচু করে নিলে, স্পষ্ট দেখতে পেলুম তার স্বচ্ছ চোখ দুটিতে জল টলটলিয়ে এসেছে।

 ক’দিন কাজকর্ম্ম ও বন্ধু বান্ধবের আদর আপ্যায়িতের ভেতরও তাদের কথা মন থেকে একবার মিলিয়ে যায়নি। সেই দুফোঁটা অশ্রুজল যেন আমার বুকে সুখের বেদনায় সকল সময়েই নিদাঘের বারিবিন্দুটুকুর মতন টলটল কর‍্ছিল। সেই দুটি অশ্রুবিন্দু, যে জাহবীবারির মতই পবিত্র!

 সারাদিন সময় ছিল না, কিন্তু রাত্রে স্তিমিকালোক নির্জ্জন শয়নকক্ষে তপ্ত শয্যার মধ্যে প্রবেশ কর‍্লেই আমার স্মৃতির বাঁধন খসে পড়তো। মনে হতো আমার বিহনে তাদের না জানি কতই কষ্ট হ’চ্ছে! আহা কচি কচি ফুলের মতন যে দুখানি নরম হাত একটুতেই যেন তাতে রক্ত ফুটে ওঠে। ঘুমিয়ে ও নিস্তার ছিল না, স্বপন দেশের পরীরাণী কাঞ্চীর মুখের মতন মুখোস পরে মাথার শিওর ঘেঁসে নিত্য নিত্যই আনাগোনা আর করে দিয়েছে; আশ্চর্য্য হচ্ছি এইটিতেই তারা অনেক দূরের প্রবাসী, কেমন করে এই শুখ‍্নো প্রাণের দুর্ব্বলতা এরি মধ্যে টের পেয়ে গেল! এদের চরগুলোতে দেখচি আমাদের কল‍্কাতা সহরের গুপ্তচরের চেয়েও সজাগ থেকে টাট‍্কা খপর সব রপ্তানি করে থাকে।

 অনেকদিন প্রকৃতি দেবীর বিশ্রামকুঞ্জ নেপালের পার্ব্বত্য প্রদেশে বাস করে, এখন এই সহরের লোকগুলোকে তাদের অফিসের কাপড় পরা ধূলা, ধোঁয়া ও জনতা ভেদ করে কর্ম্ম ত্রস্ত ব্যস্তভাবে যাওয়া আসা কর‍্তে দেখতুম, আর তাদের জন্য মনের ভেতরে করুনার রাশি পুঞ্জীভূত হয়ে উঠতে থাক‍্ত। মুখে সর্ব্বদা সতর্ক উত্তেজনা, গতি যেন ঝড়ের হাওয়ার মতন চঞ্চল, বিশ্রাম বলে একটা জিনিষের সঙ্গে এর যেন পরিচিত হবার সুযোগই পায়নি। হয়ত এরা কল্পনা কর‍্তে পারে না যে, এই সংঘর্ষময় বিচিত্র কর্ম্মক্ষেত্রের বাইরে এমন একটি শ্যামল শৈল প্রান্তর তার প্রান্তভাগকে ফুলে ফলে পাখীর গানে, মায়ের বুকের মতন স্নেহভরা উচ্ছ্বাসে পূর্ণ করে রেখে এমন হেসে আহ্বান কর‍্তে পারে যে, তাতে সকল ক্লান্তি, সমস্ত অবসাদ মায়ের হাতের স্পর্শের মতনই নিঃশেষে মুছিয়ে দিয়ে মানুষকে স্বর্গের শান্তি দান করতে সক্ষম হয়। কি উদারতা তার আকাশে! তার বাতাসে মেশানো কি পুঞ্জ পুঞ্জ সহানুভূতি!

 ফেরবার সময় এলো, আমি যেন বাঁচলুম। বড় বড় ভোজ, থিয়েটার সমিতি, নাচ, মানবচিত্তের লঘুতার শত পরিচয়, উঃ! প্রাণটাকে যেন পাথরের জাঁতায় পিষে রেখেছিল। বন্দীর কাছে যেন জেল দারোগা তার মুক্তির পরওয়ানা পাঠ করে গ্যাছে—এমনিতরো আনন্দে শিশুর মতন উচ্ছ্বসিত হয়ে ভাবলুম আবার আমার সেই স্বর্গোদ্যানে ফিরে যেতে পাবো যেখানে আমার তারা আছে। নিশ্চয়ই আমার পথ চেয়ে আছে।

 কত ছবির বই, কত সুন্দর সুন্দর খেলনা রংচংয়ে বিচিত্র সাজে সেজে রাস্তার দুধারের দোকানগুলো থেকে আমায় হেসে আহ্বান করলে। আরও তো কত বারই এদের মাঝখানকার এই সব রাস্তা দিয়ে আনাগোনা করেছি কিন্তু ‘ছেলেদের আমোদের জিনিষ’ আমার এই প্রৌঢ় সীমানার শেষ প্রান্তবর্ত্তী চিত্তকে এমন করে তো কই প্রলুব্ধ করেনি! আদর করে তাদের বুকের কাছে ধরে একটুখানি স্নেহ মিশিয়ে দিয়ে বাক্সর ভেতরে রেখে দিলুম, যাদের এসব দেব স্নেহটুকু তাদেরি যে প্রধান পাওনা! তারাই যে এটাকে এর অসাড় নিদ্রা থেকে জাগিয়ে তুলেছে। দুর্গম পথে পাহাড় বন পেরিয়ে ফিরে এলুম; ঝাউতলা শূন্য —কাঞ্চী সেখানে নেই। আনন্দের প্রথম মুহূর্ত্তে সন্দেহ যেন একটা নিষ্ঠুর আঘাতের বেদনা জাগিয়ে দিলে। কটা দিনেই সে কি আমায় ভুলে গেল!

 রাস্তা দিয়ে তাদের একটি প্রতিবেশী যাচ্ছিল, অত্যন্ত ত্রস্ত ভাব, তাকে ডেকে তাদের খপর জিজ্ঞেস কর‍্লুম। নিশ্চয়ই তারা আমায় ভোলনি, হয়ত অভির পাঠশালার পরীক্ষা হয়ে যাওয়াতে আর কোথাও তারা বেড়াতে গেছে। সেই লোকটি নেপালি ক্ষত্রিয় নয়, গুর্খা। নাম বজীর সিং; সে গুন্ গুন্ করে কি বলে ব্যস্ত হয়ে চলে গেল, ঠিক বুঝ‍্তে পারলুম না, তবে এইটুকু মনে হলো যে, সে বল্লে অভিজিতের অসুখ, সে ওষুধ আন‍্তে চলেছে।

 মুহূর্ত্তে আমার সোনার স্বপ্ন ভেঙ্গে নিদাঘের তপ্ত রৌদ্রে পৃথিবী দীপ্ত হয়ে উঠ‍্ল, হায়রে সংসারের অনিত্য সুখ!

 অবস্থা খুব খারাপ! হ্যাঁ খুবই খারাপ অবস্থা। আমি প্রথমে গিয়েই তার নাম ধরে ডেকেছিলুম, মনটাও খুব উৎকণ্ঠিত ছিল, আর তা ছাড়া জানিনা তো যে এতদূর হয়েছে। তার মা খুব ব্যস্ত হয়ে হাত নেড়ে ইঙ্গিতে আমায় নিষেধ করে চুপি চুপি বলে উঠলেন “ওকে ডেকোনা, বাছা আমার পরীক্ষার জন্য পরিশ্রম করে বড় শ্রান্ত হয়ে একটু ঘুমুচ্ছে!”

 মা বল্লেন “বটে যে—অভি ঘুমুচ্চে—কিন্তু আসলে তা নয় অবস্থা দেখেই বুঝ‍্লুম প্রবল জ্বরে সে সংজ্ঞা হীন, ঘুম কোথায়! সকাল বেলার শুকতারাটি যেমন ম্লান হতে হতে একেবারে আকাশের মধ্যে মিলিয়ে যায়, তার ন্যাতান দেহটুকুও যেন তেমনি করে মহাঘুমে ঢুলে পড়ছে, দুটি চোখে নিদ্রা যেন জড়িয়ে আছে, স্বাধীনচিত্ত সরল শিশুটি, আহা! সে যে তার পিতৃপিতামহের রাজদরবারের প্রতিপত্তিটুকু ফিরে পাবার জন্য প্রাণপাত করে পরিশ্রম কর‍্ছিল। এই কি তার পুরস্কার হলো!

 কাঞ্চী দাদার তপ্ত ললাটে নীরবে বসে হাত বুলিয়ে দিচ্ছিল, তার দুটি চোখের তারা নিমেষশূন্য হয়ে যেন তার দাদার শুক‍্নো ফুলের মতন ম্লানমুখের উপরেই মিশে গ্যাছে? আমার সাড়া পেয়ে সে এক বারটি কেবল চোখ তুলে আমার পানে দেখলে, কি গভীর হতাশা—সেই ভাসা চোখের কাতর চাউনিতে! সে দিকে যেন চাওয়া যায় না।

 সহরের মধ্যে যিনি সবার চেয়ে ভাল চিকিৎসক, তাকেই আনালুম। তিনি রোগী দেখে মুখ অপ্রসন্ন কর‍্লেন। রোগীর মার দিকে চেয়ে ইংরেজিতে আমায় বল্লেন, “অবস্থা এখন ভারী মন্দ হয়ে দাঁড়িয়েছে, আশা ভারী কম।”

 তাঁকে মিনতি করে বল্লুম, “চেষ্টা করুন হয়ত ভাল হবে, নৈলে মেয়েটি বাঁচবে না, তার যে ভাই অন্ত প্রাণ।”

 ডাক্তার ঈষৎ বিস্ময়ের সঙ্গে আমার যন্ত্রণাকাতর মুখের দিকে চেয়ে দেখলেন। প্রিয়তম পুত্রের মৃত্যুশয্যা পার্শ্বে ভাগ্যহীন জনক জননীর আর্ত্ত বেদনা যাহারা প্রতিদিনই প্রত্যক্ষ করিতে অভ্যস্ত তাদের এতে আর বিস্ময় কোথায়? তিনি মৃদু ভাবে বল্লেন, “হ্যাঁ তাতো করাই চাই, আহা দিব্য ছেলেটি!”

 আমাদের যথাসাধ্য চেষ্টা কর‍্লুম, কিন্তু কি হবে সে চেষ্টায়, যার প্রথমে অতটা অগ্রাহ্য করা হয়ে গ্যাছে? রাত যখন এগারটা তখন হঠাৎ খুব ঘাম হতে লাগলো, আমার দিকে চেয়ে অস্ফুট বিদেশী ভাষায় আমার দেশেরই ডাক্তার বল্লেন “শেষ অবস্থা!” বলবার কিছুই দরকার ছিল না, অবস্থা নিজেই তা স্পষ্ট করে বলে দিচ্ছিল।

 দূরে ধর্ম্মশালার ঘড়িতে দ্বিপ্রহরের ঘোষণায় ঘুমন্ত স্তব্ধ রাত্রি যে সময় চকিত হয়ে উঠ‍্লো, ঠিক সেই সময়েই বালকের শেষ নিশ্বাস টুকু তার ক্ষুদ্র দেহপিঞ্জর ছেড়ে অনন্ত বায়ুর সঙ্গে মিশে গিয়ে কোন্ সেই অজানা শান্তির দেশের উদ্দেশে চলে গেল, যেখানকার কোন খবরই এপর্য্যন্ত কেউ পায়নি, চিরকাল ধরে শুধু একটা অনুমান ও কল্পনা চল‍্ছে।

 তার নিস্পন্দ দেহ নিয়ে যখন আমার বৃথা আশার কুহকে পড়ে পরীক্ষা কর‍্চি, তখনও তার গভীর বিশ্বাসী মার মনে একটুখানিও সন্দেহ আসেনি যে, তাঁর স্নেহের ধন তাঁকে কত বড় ফাঁকি দিয়েছে। ব্যস্তহয়ে আমাদের হাত ঠেলে দিয়ে চুপি চুপি বল্লেন, “আহ কি করচেন ডাক্তাই মশাই! ওকে ঘুমুতে দিন, ক’দিন যে ছেলে ঘুমুতে পায়নি তাই অমন হয়ে পড়েছে। বাছারে আমার ঘুমা ঘুমা!”

 না না, তোমার স্নেহের প্রসূন আজ যে শান্তিময় নিদ্রা লাভ করেছে। দুর্ব্বল মানবকণ্ঠের সহস্র আহ্বানও আর তাকে সে বিশ্রামের আনন্দ থেকে বঞ্চিত করে জাগাতে পারবে না। অনেক কষ্টে ভগিনীর দৃঢ় আলিঙ্গন থেকে ভাইকে ছাড়িয়ে নিয়ে নদী-তীরের শীতল মৃত্তিকানয়নে তার জ্বরতপ্ত দেহ খানিকে উত্তাপে শুষ্ক করিয়া আসা হ’লো। সন্ধ্যার স্থলপদ্মের মত মূখখানিও তখন কি সুন্দর! মার্ব্বেলের মতন সাদা কপাল থেকে তখনও প্রতিভার দীপ্তি যেন একেবারে নিঃশেষ হয়ে মুছে যায়নি। সে যে রাজার সৈন্যদলের জেনারেল হবে বেদনায় বুক ফেটে যেতে লাগলো। ওরে নিষ্ঠুর নিয়তি! বোঁটা-খসা এত ফুল গাছতলায় বিছানো থাকতে জোর করে অফুটন্ত কুঁড়িগুলিকে ছিঁড়ে নিয়ে একি তোর উদ্দাম চয়ন-সুখ।

 সেই যে কাঞ্চী ভাইকে ছেড়ে তারই পরিত্যক্ত স্থানটি অধিকার কর‍্লে। আর সে সেখান থেকে উঠে বসলো না। ভূঁয়ের উপরে ম্লন জ্যোৎস্না রেখাটির মতনই সে নিঃশব্দে লুটিয়ে পড়লো। আমি সেইখানে তার মাথার কাছে বসে তার অশ্রুহীন মুখের দিকে চেয়ে কত রকমে তাকে একটি কথা কওয়াবার চেষ্টা কর‍্তে লাগলুম, কিন্তু আমার সকল চেষ্টাই বৃথা হয়ে গেল, তার চোখ দিয়ে একটি ফোঁটা জলও পড়লো না।

 তাদের মা তো বদ্ধ পাগল হয়ে গেছেন। নইলে কি আর তক্ষুনি উঠে দিব্য প্রসন্নমুখে তার জিনিষ পত্রগুলি গুছিয়ে গুছিয়ে রাখ‍্তে রাখ‍্তে আপনার মনে একটু একটু হাসছিলেন, আর মধ্যে মধ্যে গুন্ গুন্ করে যোদ্ধার বিদায় অভিনন্দনের গানটি গাইতে গাইতে বলছিলেন, “ছেলে মানুষ এরি মধ্যে কেমন করে রাজার প্রধান সেনাপতি অতগুলো সৈন্যের নেতা হয়ে দাঁড়ালো। উঃ কি বীরত্ব!” মনে এইটে খেয়াল উঠেছে যে তাঁর বীরবংশের সন্তান অভি দেশের জন্যে যুদ্ধযাত্রা করেছে।

 সেই রাত্রেই কাঞ্চীর জ্বর হলো। মনটা বড় খারাপ হয়ে গেল, রাত পোহাতেই ডাক্তারকে আনলুম। ডাক্তারটি বড় ভদ্রলোক। খুব যত্ন করে দেখ‍্তে লাগলেন! বল্লেন, “ভয় কি, এবার প্রথম থেকে যত্ন হ’চ্চে, চিকিৎসা হ’চ্ছে, নিশ্চয়ই সেরে যাবে?” আমিও তাই ভাবছিলুম।

 প্রথমটা সে ওষুধ খেতে একটু আপত্তি করেছিল, শেষটায় আমার আগ্রহ-ব্যাকুল অনুরোধে সে আর কিছুতেই আপত্তি করতো না।

 তিন দিনের দিন সে আর চোখ মেল‍্লে না। ডাক্তার মুখভার করে বল্লেন, ‘সেই অবস্থা!’ আমার মাথা থেকে পা পর্যন্ত একটা তাড়িতের স্রোত ছুটে গিয়ে সর্ব্বশরীরের স্বচ্ছন্দ রক্তস্রোতকে হঠাৎ যেন জমিয়ে বরফ করে দিলে। ব্যাকুল হয়ে তাঁর হাত দুখানা চেপে ধরলুম, কি বল‍্চি কি কর‍্চি না জেনেই বলে উঠ‍্লুম বাঁচাও, আমার কাঞ্চী মায়ীকে বাঁচাও, সর্ব্বস্ব তোমায় দেব।

 ডাক্তার মুখ আরও গম্ভীর করে বল্লেন, “ও দুটি আপনার তো কেউই হয় না, নেপালী ক্ষত্রিয়ের ছেলে, অত কাতর হ’চ্চেন কেন? আশা নেই— একেবারে নেই।”

 আছে বই কি, নিশ্চয়ই আশা আছে, এমন কিছু অবস্থা কঠিন হয়নি, ডাক্তারেরই ভুল! চেষ্টা —শুধু চেষ্টা, শুধু যত্ন চাই! যেন আগুনের কুণ্ডব ভেতর দিয়ে ছুটে এসে ঘরে ঢুক‍্লুম। সেই একই ভাব! একি অবস্থা। আছে বসে উন্মাদিনী মা এদিকে চেয়ে আপনার মনে বিড় বিড় করে কি বকূচেন। তাড়াতাড়ি নতুন ওষুধই খানিক গ্লাসে ঢেলে নিয়ে তাকে খাইয়ে দিলুম। একবার চোখ চেয়ে আমার উৎকণ্ঠা-শঙ্কিত মুখের পানে তাকিয়ে একটু যেন করুণার মৃদুহাসি হেসে আবার সে চোখ বুজ‍্লে। আমার বুকের ভেতরে আশায় নিরাশায় জোয়ারের জলের ঢেউয়ের মতন রক্তের স্রোত ছলাৎ ছলাৎ করে আছড়াপাছড়ি কর‍্ছিল।

 রাজার ডাক্তার এলেন। যন্ত্র দিয়ে, হাত দিয়ে, কান দিয়ে রোগীকে বিশেষ রকমে পরীক্ষা করে পকেটে হাত পূরে গম্ভীর হয়ে বাইরে এসে সুগন্ধি চুরোটে একটা টান্ দিয়ে বল্লেন, “আশা নেই।”

 কি নির্ঘাত সে শব্দ! আর্ত্তভাবে দুই হাতে মুখখানা ঢাকা দিলুম, হা’রে আমার আশাহীন চিত্তের আশা! হা আমার স্বর্গ!

 না। কে বলে আশা? নেই ভ্রান্তি! ভ্রান্তি! আছে বই কি আশা! ডাক্তার-ওরা কি জানে? কতটুকু শক্তি ওদের? আমি—ওকে বাঁচাবো। হ্যাঁ এই দৃঢ় চিত্তের সবটুকু বল দিয়ে, এই একান্ত হৃদয়ের নির্ম্মল নিঃস্বার্থ স্নেহধারা ঢেলে সেই, সঞ্জীবনী সুধায় ওই শুষ্ক লতা গাছটিকে—এই আমিই সঞ্জীবিত করে তুল‍্বো—পার‍্বো না? ইচ্ছাশক্তির চেয়ে বড় জগতে কোন্ শক্তি আছে? এই প্রবল ইচ্ছাশক্তির জোরে এসংসারে কি না বিপ্লব এই ক্ষুদ্র মানবশক্তির দ্বারায় সংঘটিত হয়েছে! এই শক্তির পূর্ণ প্রয়োগে মানুষ সর্ব্বক্ষম ঈশ্বরে পরিণত হতে কেন না পার‍্বে? দেখি কে কেড়ে নিতে পারে ওই কচি প্রাণটিকে, এই বিশাল প্রাণের ভেতর থেকে! স্বয়ং বিধাতা আজ এসে দাঁড়ালেও তাঁকে ব্যর্থ হয়ে ফিরতে হবে। পক্ষীমাতা যেমন করে তার ছোট বাচ্ছাটিকে ঝড়ের হাত থেকে বাঁচাবার জন্যে বুকের কাছে চেপে ধরে তেমনি করে তাকে দৃঢ় হস্তে নিজের কোলের কাছে টেনে নিলুম। আমার কুড়িয়ে পাওয়া পথের নিধি! বিধাতা আমায় দেননি, তিনি নেবেন কি অধিকারে।

 ডাক্তারের ওষুধটার বুঝি ফল ফল্লাে? না আমারি এই প্রবল ইচ্ছার বল মৃত্যুকেও আজ পরাস্ত কর‍্লে? ধন্য ঈশ্বর! ওই তো সে চেয়ে দেখ‍্ছে। একটুখানি ক্ষীণ নক্ষত্রালোকের মত ম্লান হাসি হেসে আমার কাঞ্চী মায়ী আমার হাতের মধ্যে তার ছোট হাতখানি স্থাপন করে আজ চার দিন পরে কথা কইলে, ঈষৎ যেন চম্‌কে উঠে বল্লে, “ঐ শুনুন!”

 আনন্দে অধীর হয়ে তার শান্ত—তত রোগ যন্ত্রণাতেও শান্ত—ললাটে চুম্বন কর‍্লুম, “কি শুনবোইবা!”

 অন্যমনস্ক ভাবে যেন কোন একটা দূরস্থ ধ্বনি বা এমনি কিছু একটা শুনতে চেষ্টা কর‍্ছিল, আবার দুটিও আমারি মতন তাদের স্বর্গের মতন পবিত্র প্রাণ দুটি আমার সঙ্গে বদল করেছে। এ ত আমার মতন একটু হেসে উত্তর করলে, “শুন‍্তে পাচ্চেন না, ঐ যে অভি আমায় ডাকচে!”

 একটু সুখের হাসি হেসে হঠাৎ ঈষৎ উচ্চকণ্ঠে গভীর রজনীর স্তব্ধতাকে যেন চকিত করে তুলে বলে উঠলো, “যাই অভি যাই, দাঁড়াও তুমি!”

 তার ক্ষীণ কণ্ঠ ঘরের মধ্যে ব্যগ্র আকুলতায় প্রতিধ্বনিত হয়ে উঠে আমায় লৌহদণ্ডের মতন আঘাত কর‍্লে, আর্ত্তনাদের সঙ্গে তাকে বুকে চেপে ধর‍্লুম— কোথা যাবি মা আমার আমি তোকে যেতে দেব না!”

 আমার আহ্বানে বারেক সে যেন একটু বিচলিত হয়ে উঠেছিল। কিন্তু পরমুহূর্ত্তেই তার রোগশোককাতর মুখের সমস্ত শ্রান্তি ও অবসাদকে নিঃশেষ করে মুছে দিয়ে গভীর শান্তির ছায়া বিজয়ের হাসিটুকুর সঙ্গে ফুটে উঠে আমায় যেন ধিক্কার দিয়ে ভর্ৎসনা করে বলতে লাগল—কি আছে এই পৃথিবীতে যার জন্যে এই আনন্দ আর এই অফুরন্ত শান্তি থেকে বঞ্চিত করে এখানে ধরে রাখতে এত চেষ্টা? যে শান্তির চিহ্ণ ইতিমধ্যে তার এই পরিত্যক্ত ক্লান্ত দেহে পরিস্ফুট হয়ে উঠেছিল।

 কি স্নেহঋণ শোধ কর‍্তে কোন্ আলোকের রাজ্য থেকে তারা দুটিতে এক সঙ্গে নেমে এসেছিল? অন্ধকে তারা যে দৃষ্টিদান করেছিল তা’ কি কেবল সেই আলোটুকু ধ্যান কর‍্বার জন্য—যা বিদ্যুতের মতনই চঞ্চল কিন্তু শারদ জ্যোৎস্নারই মতন স্নিগ্ধ!

 সোনা দিয়ে মাজা তার রুক্ষ চুলগুলি সাদা গোলাপের মতন মুখখানিকে ঢেকে ফেলেছিল, আমি সাবধানে সরিয়ে দিতে গেলুম, কি ঠাণ্ডা সে মুখ!!


 শক্তি গর্ব্বে অন্ধ হয়ে তুমি মনে করে থাক তোমার ইচ্ছা তোমার শক্তি বিধাতার বিধানকেও বুঝি বদল করতে সক্ষম! তাই তাঁর দেওয়া দণ্ড পুরস্কারের নীচে মাথা পেতে না দিয়ে তাঁকে রুদ্ধ তাপে পা দিয়ে ছুঁড়ে ফেল‍্তে সকল সময় সংগ্রামে প্রবৃত্ত হও। এতবড় স্পর্ধা তুমি কোথা থেকে পেলে মানব? অসীম সাগরের সুক্ষ্মতম বালুকণা! তুমি যে কতটুকু তোমার সুখ-দুঃখ লাভ লোকসান তোমার চেষ্টা সাধনায় এই বিশ্বনিয়মের নিয়মতন্ত্রের অপরিবর্ত্তনীয় বিধানের নিকট যে কতখানি তুচ্ছ এখন কি তা বুঝতে পেরেছ গর্ব্বান্ধ মানব-অণু?