ময়ূখ/একবিংশ পরিচ্ছেদ
আগ্রা দুর্গের অভ্যন্তরে বাদশাহের অন্তঃপুরে প্রবেশ করিবার দুইটি প্রকাশ্য পথ ছিল, একটি দিল্লী ফটকে ও অপরটি অমরসিংহ ফটকের সম্মুখে। এতদ্ব্যতীত পাণি ফটক দিয়াও অন্তঃপুরে প্রবেশ করা যাইত, কিন্তু সে পথ কেবল বাদশাহের অবরোধবাসিনী রমণীগণের জন্য নির্দিষ্ট ছিল। এই তিনটি প্রকাশ্য পথ ব্যতীত আগ্রা দুর্গের অন্তঃপুর প্রবেশের একটি গুপ্ত পথ ছিল, স্বয়ং বাদশাহ্ ব্যতীত অন্য কৈহ সে পথ জানিতেন না।
অন্তঃপুরে আকবর ও জাহাঙ্গীরের আমলে এক বেগমের মহল হইতে অন্য বেগমের মহলে যাইবার বহু গুপ্ত পথ নির্ম্মিত হইয়াছিল। শাহ্জহানের আমলে আরজ্ মন্দ বাণু বেগম ব্যতীত মহল সরার অন্য কোন অধিবাসিনী না থাকায়, গুপ্তপথ ব্যবহৃত হইত না। যোধবাই মহলের পশ্চাতে বাদশাহ্ বেগমের হামামের নিম্নে একটি গুপ্ত গৃহ আছে। এই গৃহে এখনও একটি বধমঞ্চ দেখিতে পাওয়া যায়। কোনও অন্তঃপুরচারিণী রীতিবিরুদ্ধ আচরণ করিলে, বাদশাহ্ অথবা প্রধানা বেগম এই গৃহে তাহাকে প্রাণদণ্ডে দণ্ডিত করিতেন। মোগল সাম্রাজ্যের যুগের ধ্বংসাবশেষ মধ্যে আগ্রা দুর্গে শ্বেত ও রক্তমর্ম্মরনির্ম্মিত বিশাল প্রাসাদের নিম্নে পথবিচলিতা অন্তঃপুরচারিণীর জীবননাট্যের শেষ অঙ্ক যে রঙ্গমঞ্চে অভিনীত হইত, তাহা এখনও দর্শকের মনে ভীতি সঞ্চার করিয়া থাকে।
বহুদিন এই বধমঞ্চ ব্যবহৃত হয় নাই; বাদশাহের অন্তঃপুরে বহুদিন কোনও অবরোধবাসিনী স্বীয় রক্তস্রোতে স্বেচ্ছাচারের প্রায়শ্চিত্ত করেন নাই; বহু দিন সে কক্ষে কেহ প্রবেশ করে নাই। কক্ষ আবর্জ্জনাময়, গৃহতল ধুলায় আচ্ছন্ন, বহুদিন পরে সহসা সেই অন্ধকার গৃহ বহু মশালের আলোকে উজ্জ্বল হইয়া উঠিল। চারিজন খোজা ময়ূখকে লইয়া সেই কক্ষে প্রবেশ করিল। তাহাদিগের সম্মুখে পাঁচজন ও পশ্চাতে পাঁচজন তাতারী প্রতিহারী মশাল হস্তে প্রবেশ করিল, পরে গুলরুখ্ ও জহানার বেগম আসিলেন। সর্ব্বশেষে কুঠার হস্তে এক জন খোজা ও রজ্জু হস্তে একজন তাতারী কক্ষে প্রবেশ করিয়া দ্বার রুদ্ধ করিল।
খোজাগণ ময়ূখকে নামাইয়া তাঁহার বন্ধন মোচন করিল এবং তাঁহাকে জহানারা বেগমের সম্মুখে রাখিয়া দূরে সরিয়া দাঁড়াইল। মশাল হস্তে তাতারীগণ প্রাচীরের পার্শ্বে সারি দিয়া দাঁড়াইল। যে কুঠারহস্তে আসিয়াছিল, সে বহুদিনের রক্তস্রোতে বিবর্ণ কাষ্ঠখণ্ড টানিয়া লইয়া আঘাতের জন্য প্রস্তুত হইল। তাতারী ফাঁসীকাষ্ঠে রজ্জু লাগাইয়া গৃহতলের মধ্যদেশ হইতে কাষ্ঠখণ্ড সরাইয়া ফেলিল, সঙ্গে সঙ্গে যমুনা-জলের কুলুকুলুধ্বনি শ্রুত হইল।
শাহ্জাদী জিজ্ঞাসা করিলেন, “সর্ওয়ার খাঁ, দেখিতেছ?” ময়ূখ দক্ষিণ হস্তের বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠে উপবীত জড়াইয়া চক্ষু মুদ্রিত করিলেন। শাহ্জাদী কহিলেন, “দেখ এখনও যদি ধর্ম্মপত্নীকে গ্রহণ কর, তাহা হইলে মুক্তি পাইতে পার।”
ময়ূখ মুদ্রিতনয়নে কহিলেন, “শাহ্জাদী, আমি হিন্দু, প্রাণভয়ে মিথ্যা কথা বলিব না। আমি ব্রাহ্মণ, মুসলমান নহি, আমার নাম ময়ূখ, সর্ওয়ার খাঁ নহে, এই রমণীকে আমি চিনি না। আমি মরণের জন্য প্রস্তুত, বিলম্ব করিয়া যন্ত্রণা বাড়াইবেন ন॥”
“তুমি পত্নীগ্রহণ করিবে না?”
“আমার পত্নী নাই, কারণ এখনও আমার বিবাহ হয় নাই।”।
“এখনও ভাবিয়া দেখ।”
“শাহ্জাদী, মিথ্যা বলি নাই, যবনী বিবাহ করিব না, ধর্ম্মত্যাগ করিব না, মরণের রাজ্যে আসিয়া মিথ্যা বলি নাই।”
শাহ্জাদী ইঙ্গিত করিলেন, জল্লাদ্ ময়ূখের হস্ত ধরিয়া আকর্ষণ করিল। সহসা সেই ভূগর্ভস্থিত গৃহের ঘন অন্ধকার অপেক্ষা ঘন কৃষ্ণবর্ণ মসীপিণ্ড প্রাচীর হইতে লম্ফ দিয়া গৃহতলে অবতীর্ণ হইল এবং পদাঘাতে রন্ধ্র পদে জল্লাদকে যমুনাতলে প্রেরণ করিয়া পুনরায় প্রাচীরের অন্ধকারে মিশিয়া গেল। ময়ূখ বিস্মিত হইয়া রহিলেন, অস্ফুট শব্দ করিয়া গুলরুখ্ মূর্চ্ছিতা হইল, ভয়ে শাহ্জাদীর দেহ স্বেদাপ্লুত হইল।
অনেকক্ষণ কেহ কথা কহিল না। পরে ময়ূখ কহিলেন, “শাহ্জাদী, বিলম্বে প্রয়োজন নাই, কুঠার গিয়াছে, কিন্তু রজ্জু আছে, আবশ্যক হইলে আমি সহস্তে তাহা কণ্ঠে বেষ্টন করিব।”
শাহ্জাদী নীরব, যে তাতারী রজ্জু ধরিয়াছিল, সে দেখিল যে রজ্জু ধীরে ধীরে উপরে উঠিয়া অন্ধকারে মিশাইয়া গেল! সে “শোভানাল্লা” বলিয়া দূরে সরিয়া দাঁড়াইল। শাহজাদী স্তব্ধ। এই সময়ে সেই মসীপিণ্ড প্রাচীর হইতে একজন খোজার মুখে ভীষণ বেগে পদাঘাত করিল, তাহার হস্ত হইতে তরবারি পড়িয়া গেল। সঙ্গে সঙ্গে সেই মসীবর্ণ পুরুষ এক লম্ফে গৃহতলে অবতরণ করিয়া দ্বিতীয় খোজার মস্তকে অসির আঘাত করিল, খোজার মস্তক স্কন্ধ হইতে বিচ্ছিন্ন হইয়া জহানারা বেগমের দেহে পড়িল। তখন অবশিষ্ট খোজা ও তাতারীগণ তাঁহাকে বেষ্টন করিয়া দাঁড়াইল। সেই মসীপিণ্ড ময়ূখকে কহিল, “মহারাজ, দুই খানা তলোয়ার পড়িয়া আছে, দুয়ার হাব্সীদের পিছনে।”
ময়ূখ চিত্রার্পিতের ন্যায় দাঁড়াইয়াছিলেন, মসীপিণ্ডের কথা শুনিয়া তাঁহার চমক ভাঙ্গিল। তিনি তরবারি গ্রহণ করিলেন। আগন্তুকের কথা শুনিয়া খোজাদিগের ভয় ভাঙ্গিল, একজন কহিল, “ওরে জীন নহে, মানুষ।” দ্বিতীয় ব্যক্তি কহিল, “পাগল আর কি? মানুষ হইলে কখন আসমানে উঠিয়া যাইতে পারে?” তখন সেই মসীপিণ্ড পুনরায় কহিল, “হাঁ, আমি মানুষ।” ময়ূখ এতক্ষণে তাহাকে চিনিলেন এবং জিজ্ঞাসা করিলেন, “ভুবন?”
ভুবন কহিল, “হুজুর, বিলম্ব করিয়া কাজ নাই।”
সেই মুহূর্ত্তে খোজা ও তাতারীগণ তাহাদিগকে আক্রমণ করিল, অনেকগুলি উল্কা নিবিয়া গেল, বধমঞ্চ পুনরায় অন্ধকারপ্রায় হইল, এই সময়ে গুলরুখের চেতনা ফিরিল। সহসা গুলরুখ্ শাহ্জাদীর পদতলে পতিত হইয়া কহিলেন, “শাহ্জাদী মারিও না, আমি আর একবার বুঝাইয়া দেখি।” জহানারা বেগমের মন ভিজিল, তিনি ইঙ্গিত করিলেন, খোজাগণ নিরস্ত হইল। তাহা দেখিয়া ভুবন এক লম্ফে ফাঁসী কাষ্ঠে উঠিয়া অন্ধকারে মিশিয়া গেল।
পুনরার মশাল জ্বলিল। খোজা ও তাতারীগণ সেই ভূগর্ভস্থিত পুরী তন্ন তন্ন করিয়া অনুসন্ধান করিল; কিন্তু ভুবনকে দেখিতে পাওয়া গেল না। তখন গুলরুখের অনুরোধে খোজা ও তাতারীগণ কক্ষ পরিত্যাগ করিল। শাহ্জাদীও কক্ষের বাহিরে আসিলেন। গুলরুখ্ ধীরে ধীরে ময়ূখের দিকে অগ্রসর হইলেন। ময়ূখ তাঁহাকে দেখিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, “বিবি, তুমি কে? তুমি কেন আমায় বৃথা কষ্ট দিতেছ?” গুলরুখ স্থির হইয়া দাঁড়াইলেন, তখন তাঁহার হৃদয় দ্রুতবেগে স্পন্দিত হইতেছিল, জিহ্বা শুষ্ক হইয়া আসিয়াছিল, গুলরুখের মুখে কথা ফুটিল না। তাহা দেখিয়া ময়ূখ মনে করিলেন যে রমণী অস্ত্র দেখিয়া ভয় পাইয়াছে। তিনি তরবারি দূরে নিক্ষেপ করিয়া কহিলেন, “আমি ত আপনাকে চিনি না?”
সহসা গুলরুখের জিহ্বার জড়তা দূর হইল, সে আবেগরুদ্ধ কণ্ঠে বলিয়া উঠিল, “তুমি-আপনি—আমাকে চিনিতে পারিলে না?” ময়ূখ কহিলেন, “না।”
“সপ্তগ্রামের যুদ্ধে আহত হইয়াছিলে স্মরণ আছে?” “আছে” “বজরায় আমি তোমাকে শুশ্রূষা করিয়াছিলাম— স্মরণ আছে?”
“সে কি তুমি?”
“হাঁ।”
“রোগশয্যায় স্বপ্ন দেখিতাম আমার শিয়রে বসিয়া ললিতা সেতার বাজাইতেছে, কিন্তু ললিতা ত সেতার বাজাইতে জানে না?” “সে ললিতা নহে, সে আমি।” “তোমাকে ত আমি পূর্ব্বে দেখি নাই?”
“না। জীবনসর্ব্বস্ব, ত্রিবেণীর ঘাটে দূর হইতে তোমাকে দেখিয়া তোমার চরণে আত্মসমর্পণ করিয়াছি।”
গুলরুখ্ এই বলিয়া ময়ূখের পদযুগল ধারণ করিলেন। ময়ূখ স্তম্ভিত হইয়া দাঁড়াইয়া রহিলেন। তখন গুলরুখ্ পুনর্ব্বার বলিতে আরম্ভ করিল, “তোমাকে পাইব বলিয়া লজ্জা সরম বিসর্জ্জন দিয়াছি, আসদ্ খাঁ ও শাহ্নওয়াজ খাঁর নিকট পরিচয় দিয়াছি যে আমি তোমার ধর্ম্মপত্নী। তুমি সপ্তগ্রামের যুদ্ধে আহত হইয়া পথে পড়িয়াছিলে, আমি তখন শাহ্নওয়াজ খাঁর সহিত বজরায় যাইতেছিলাম, আমরা তোমাকে পথ হইতে বজরায় উঠাইয়া আনিয়াছিলাম। বজরায় তুমি দুই তিন দিন অজ্ঞান হইয়াছিলে, আমাকে ললিতা বলিয়া ডাকিতে, আমি ভাবিতাম তুমি আমাকে আদর করিতেছ। হুগলীর ফিরিঙ্গিরা যখন আমাদের বজরা ডুবাইয়া দেয় তখন হইতে তোমাকে আর খুঁজিয়া পাই নাই। তাহার পর সে দিন দেখিলাম, তুমি পাণিফটকের নিকট দাঁড়াইয়া আছ। আমি তোমাকে এইখানে আনাইয়াছি, শাহ্জাদীর নিকটও পরিচয় দিয়াছি যে তুমি আমার স্বামী। তোমাকে দেখিবার আশায়, তোমাকে পাইবার আশায়, তোমাকে অনেক কষ্ট দিয়াছি, তুমি কি আমার হইবে না? দেখ, আমি রমণী, লজ্জা সরম বিসর্জ্জন দিয়া তোমার নিকট ভিক্ষা চাহিতেছি।”
ময়ূখ কিয়ৎক্ষণ নীরব থাকিয়া কহিলেন, “বিবি, আমি হিন্দু ব্রাহ্মণ, আপনি অনুগ্রহ করিয়া আমাকে ক্ষমা করুন।”
“দেখ তুমি আমার দেবতা, যাহার বাহির এত সুন্দর, তাহার ভিতর কখন মলিন হইতে পারে না; যাহার এত রূপ সে কখন নিগুর্ণ হইতে পারে না। আমি রমণী, মুগ্ধা, স্বেচ্ছায় নারীধর্ম্ম বিস্মৃত হইয়া তোমার চরণে আশ্রয় লইতে আসিয়াছি। মুসল্মান হিন্দু হইতে পারে, হিন্দুও মুসলমান হইতে পারে, হিন্দু ও মুসলমানের একাধিক পত্নী হইতে পারে। অন্দর মহলে আমার প্রতিপত্তি আছে, আমি বাদশাহ বেগমের অনুগ্রহের পাত্রী, শাহ্নশাহ্ বাদসা আমাকে স্নেহ করেন। তুমি যদি আমাকে চরণে আশ্রয় দাও, তাহা হইলে আমি তোমার জন্য অসাধ্য সাধন করিতে পারি। মন্সব, খিলাত, ইনাম, তালুক, মদদ্ যাহা চাহিবে তাহাই পাইবে—”
ময়ূখ তাহাকে বাধা দিয়া বলিয়া উঠিলেন, “বিবি সাহেব, আপনার বহুৎ মেহেরবাণী, কিন্তু আমি ত মুসলমান হইতে পারিব না?”
“আমি হিন্দু হইব।”
“মুসলমান কখনও হিন্দু হইতে পারে না।”
“কেন, বৈষ্ণব ত হইতে পারে?”
“আমি ব্রাহ্মণ, বৈষ্ণব হইলে জাতিচ্যুত হইব।”
“দেখ, আমি শাহ্জাদীকে বলিয়াছি যে তুমি সরওয়ার খাঁ, আমার স্বামী, এক কাফের রমণীর রূপে মোহিত হইয়া হিন্দু হইয়া গিয়াছ। তুমি জান যে মুসলমানের রাজ্যে হিন্দু মুসলমান হইলে ক্ষতি নাই, কিন্তু মুসলমান হিন্দু হইলে তাহার শাস্তি প্রাণদণ্ড। তুমি এখন সম্মত না হইলে শাহ্জাদী তোমাকে কতলের হুকুম দিবেন।”
“বিবি, আমি মরিতে কাতর নহি।”
“এখন সম্মত হও, পরে না হয় আমাকে ভুলিয়া যাইও “
“অসম্ভব, একবার সম্মত হইলে আবার কেমন করিয়া মিথ্যা কথা বলিব?”
“তবে আমাকে চরণে স্থান দিবে না?”
“বিবি সাহেব, মেহেরবাণী করিয়া আমাকে মাফ্ করুন, আপনি বাদশাহের পালিতা কন্যা, কত সম্ভ্রান্ত আমীর ওমরাহ্ আপনার পাণিগ্রহণের জন্য লালায়িত, আমি সামান্য ব্যক্তি, আমাকে অপরাধী করিবেন না।”
“জানি। আমি অনেক চেষ্টা করিয়াছি, কিন্তু তোমাকে ত ভুলিতে পারি নাই? তোমার মুখ বিস্মৃত হওয়া আমার পক্ষে অসম্ভব। তুমি আমার জান, আমার কলিজা। আমার জন্য তোমাকে অনেক কষ্ট দিয়াছি, তাহার জন্য আমাকে মাফ্ করিও। যদি পারি তাহা হইলে তোমাকে মুক্তি দিতেছি, কিন্তু যদি না পারি তাহা হইলে তোমার সঙ্গেই মরিব। অনেক দূর অগ্রসর হইয়াছি।”
গুলরুখ ধূলা ঝাড়িয়া উঠিয়া দ্বারে করাঘাত করিলেন, একজন খোজা দ্বার মুক্ত করিল, শাহ্জাদী জিজ্ঞাসা করিলেন, “গুলরুখ্, তোমার খসম্ পোষ মানিয়াছে?”
গুলরুখ্ অশ্রুরুদ্ধকণ্ঠে মিনতি করিয়া কহিলেন, “শাহজাদী, তুমি আজিকার মত উহাকে মাফ্ কর।”
“তবে পোষ মানে নাই?”
“মানিবে, সময় লাগিবে।”
“সে হইবে না, তোর খসম্ বলিয়া যে আমার হুকুম তামিল করিবে না আমি তাহা সহ্য করিব না। আমি এখনই তাহাকে কতল করিয়া কালি তোর নিকা দিব।”
শাহ্জাদী কক্ষে প্রবেশ করিয়া ময়ূখকে জিজ্ঞাসা করিলেন, “সরওয়ার্ খাঁ, তোমার বিবিকে লইয়া যাইবে?”
“আমার ত বিবি নহে শাহ্জাদী?”
“আবার মিথ্যা কথা?”
মিথ্যা বলি নাই।”
“জল্লাদ্!” এইবার বিংশতি খোজা ময়ূখকে বেষ্টন করিল, দ্বাদশজন তাতারী মুক্ত তরবারি হস্তে প্রাচীরের চারি দিকে দাঁড়াইল। জল্লাদ ময়ূখের হস্ত ধরিয়া আকর্ষণ করিল। তখন উপায়ান্তর না দেখিয়া ভুবন আত্মসমর্পণ করিল এবং শাহ্জাদীর পদযুগল ধারণ করিয়া কহিল, “শাহ্জাদী, উহার জন্ম অবধি উহাকে লালন পালন করিয়াছি, আমার সম্মুখে উহাকে মারিও না। দয়া করিয়া, মেহেরবাণী করিয়া আগে আমাকে কতল্ কর, পরে যাহা ইচ্ছা হয় করিও।” বৃদ্ধের কণ্ঠ রুদ্ধ হইল, কিন্তু তাহার কাতর আবেদন গ্রাহ্য হইল না।
দুইজন খোজা ময়ূখের মস্তক কাষ্ঠ খণ্ডের উপর স্থাপন করল, জল্লাদ কুঠার উঠাইল। সহসা তীব্র উজ্জ্বল সূর্য্যালোকে কক্ষ উদ্ভাসিত হইয়া উঠিল, মুহূর্ত্তের জন্য সকলে দৃষ্টি শক্তি হারাইল। পরক্ষণেই খোজাগণ অস্ত্র ত্যাগ করিয়া ভূমি চুম্বন করিল। শাহ্জাদীর মুখ শুখাইয়া গেল, গুলরুখ্ শিহরিয়া উঠিলেন। ময়ূখ দেখিতে পাইলেন যে, অন্ধকারময় কক্ষের একদিকের প্রাচীর সরিয়া গিয়াছে, সেই স্থানে প্রশান্তমূর্ত্তি অপরূপ সুন্দরী একজন রমণী দাঁড়াইয়া আছেন। সহসা তাহার মনে আশার সঞ্চার হইল। খোজা তাহাকে পরিত্যাগ করিয়াছিল, ময়ূখ একলম্ফে সেই মাতৃমূর্ত্তির সমীপবর্ত্তী হইলেন এবং তাঁহার পদযুগল ধারণ করিয়া কহিলেন, “মা!”
মাতৃমূর্ত্তি তাঁহার মস্তকে হস্তাপর্ণ করিয়া কহিল, “বেটা, ডর্ নেহি।”