ময়ূখ/বিংশ পরিচ্ছেদ

বিংশ পরিচ্ছেদ
অন্বেষণে

 দ্বিতীয় প্রহরের নৌবৎ বাজিয়া থামিয়া গেল, তখনও ময়ূখ গৃহে ফিরিলেন না দেখিয়া বিনোদিনী বড়ই চিন্তিতা হইয়া পড়িয়াছিল। তর্করত্ন দীর্ঘকাল পরে ময়ূখের সন্ধান পাইয়া দেশে ফিরিবার ব্যবস্থা করিতেছিলেন এবং ললিতার বিবাহ, গৌরীপুরে প্রত্যাগমন, পরগণা বারবক্ সিংহের সনন্দ প্রাপ্তি ইত্যাদি নানা কথায় রাত্রির প্রথম দুই প্রহর কাটিয়া গেল। দিল্লী ফটকে মধ্যরাত্রির নৌবৎ আরম্ভ হইলে, বিনোদিনীর চেতনা হইল। তর্করত্ন তাহাকে চিন্তিতা দেখিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, “মা, কি ভাবিতেছ?” তখন বিনোদিনী কহিল, “বাবা, অনেক রাত্রি হইয়া গেল, বাপ আমার ফিরিল না কেন?”

 “কত রাত্রি হইয়াছে?”

 “দ্বিতীয় প্রহর শেষ হইয়া তৃতীয় প্রহর আরম্ভ হইল।”

 “এত অধিক রাত্রি অবধি বাদশাহত দরবারে থাকেন না। আমি দেখিয়া আসি।”

 তর্করত্ন বিনোদিনীর গৃহ হইতে বাহির হইয়া আগ্রা দুর্গের দিল্লী ফটক পর্য্যন্ত আসিলেন। ময়ূখকে না দেখিতে পাইয় তিনি দিল্লীর ফটক হইতে অমর সিংহ ফটকের সম্মুখ পর্য্যন্ত গেলেন। তখন আগ্রা দুর্গের চতুর্দ্দিক্‌ জনশূন্য; মনসবদারগণের শিবিরে শিবিরে এক একজন প্রহরী ব্যতীত সকলেই সুষুপ্তিমগ্ন, অমরসিংহ ফটক জনশূন্য। তর্করত্ন বিফলমনোরথ হইয়া গৃহে ফিরিলেন। বিনোদিনী ও ললিতা তাঁহার প্রতীক্ষায় বসিয়াছিলেন। তাঁহাকে একাকী ফিরিতে দেখিয়া ললিতার নয়ন দিয়া অশ্রুধারা প্রবাহিত হইল। তর্করত্ন বিনোদিনীকে কহিলেন, “মা, তুমি ব্যস্ত হইও না, আমি এখনই নবাব য়ামিনউদ্দৌলার নিকট যাইতেছি, এখনই সংবাদ লইয়া আসিতেছি। কোতয়াল এখনই খুঁজিয়া বাহির করিবে।”

 বিনোদিনী চক্ষু মুছিতে মুছিতে কহিল, “বাবা, আপনি যাহা ভাল বিবেচনা করেন করুন, রাত্রি অধিক না হইলে আমি বাদশাহ্‌ বেগমের নিকটে গিয়া কাঁদিয়া পড়িতাম।”

 তর্করত্ন তাহাকে আশ্বাস দিয়া য়ামিনউদ্দৌলা আসফ্‌ খাঁর গৃহে চলিলেন। তিনি যখন সপ্তগ্রাম হইতে শাহনওয়াজখাঁর সহিত আগ্রায় আসিয়াছিলেন, তখন তাঁহার সহিত আসফখাঁর পরিচয় হইয়াছিল। বুদ্ধিজীবী আসফ্‌খাঁ বঙ্গবাসী ব্রাহ্মণের তীক্ষ্ণ বুদ্ধির পরিচয় পাইয়া তাঁহাকে রাজকার্য্যে নিযুক্ত করিতে চাহিয়াছিলেন, কিন্তু ময়ূখের সন্ধান না পাইয়া বৃদ্ধ ব্রাহ্মণের মন ভাঙ্গিয়া গিয়াছিল, তিনি কর্ম্মগ্রহণ না করিয়া তীর্থ ভ্রমণের ছলে আগ্রা পরিত্যাগ করিলেন।

 তর্করত্ন যখন আসফখাঁর গৃহে প্রবেশ করিলেন, বৃদ্ধ নবাব তখনও অন্তঃপুরে যান নাই। অনেক কর্ম্মচারী ও খোজাকে পরিচয় দিয়া বৃদ্ধ ব্রাহ্মণ বাদশাহের শ্বশুরের সাক্ষাৎ পাইলেন। একজন খোজা তাঁহাকে চিনিত; সে দয়াপরবশ হইয়া বিদেশীয় বৃদ্ধকে নবাবের নিকট লইয়া গেল। আসফ্‌ খাঁ যমুনাতীরে বার দুয়ারীতে বসিয়াছিলেন। সুন্দরী ইরাণী ক্রীতদাসীগণ তাঁহার সম্মুখে নৃত্য করিতেছিল, বহু সভাসদ্‌ আমীর ওমরাহ মজলিসে উপস্থিত ছিলেন। আসফ্‌ খাঁ তর্করত্নকে দূর হইতে দেখিয়াই চিনিয়াছিলেন। বৃদ্ধ তাহার সম্মুখে উপস্থিত হইবামাত্র তিনি তাঁহাকে অভ্যর্থনা করিয়া উপবেশন করিতে অনুরোধ করিলেন। তৃতীয় প্রহর রাত্রিতে বৃদ্ধের আগমনের কারণ শুনিয়াই আসফ্‌ খাঁ মজলিস্‌ ত্যাগ করিয়া উঠিলেন; নৃত্য থামিল, মজলিস্ ভাঙ্গিয়া গেল। কক্ষান্তরে আসিয়া নবাব বৃদ্ধকে জিজ্ঞাসা করিলেন, “কি হইয়াছে?”

 বৃদ্ধ ময়ূখের দিল্লী আগমন, বিনোদিনীর বাদ্‌শাহ বেগমের সহিত পরিচয় এবং ময়ূখের দেওয়ান-ই-খাসে আগমন প্রভৃতি সমস্ত ঘটনা বিবৃত করিয়া কহিলেন, “নবাব সাহেব, আমি যখন নানা দেশে ময়ূখের সন্ধান করিয়া বেড়াইতে ছিলাম, তখন সে এই নগরেই ছিল। আমি যখন হতাশ হইয়া আগ্রা ত্যাগ করি, তখনও সে আগ্রায় ছিল। এতদিন পরে তাহার সন্ধান পাইলাম বটে, কিন্তু দর্শন পাইলাম না।”

 উজীর তাঁহাকে আশ্বাস দিয়া কহিলেন, “আপনি ব্যস্ত হইবেন না, আমি যখন তাহাকে দেখিয়াছি তখন আপনিও তাহাকে দেখিতে পাইবেন।”

 “তাহার জন্য তাহার পুরজন বড় ব্যস্ত হইয়া উঠিয়াছেন।”

 “আপনি তাঁহাদিগকে শান্ত করুন, ব্যস্ত হইলে চলিবে না; আমি তাঁহার উপর নজর রাখিয়াছি।”

 “সে কবে ফিরিবে? কবে তাঁহার সাক্ষাং পাইব?”

 “তাহা বলিতে পারি না, তবে শীঘ্রই ফিরিবেন, শীঘ্রই তাঁহার সাক্ষাৎ পাইবেন। আপনার সহিত যে ফকীর সপ্তগ্রাম হইতে আগ্রা আসিয়াছিল সে এখন কোথায় আছে?”

 “কাহার কথা বলিতেছেন, চৈতন্যদাস?”

 “নাম স্মরণ নাই, হুগলীতে পর্ত্তুগীজ পাদ্রী যাহার অস্থি চুর্ণ করিয়াছিল তাহারই সন্ধান করিতেছি।”

 “সে বৃন্দাবনেই আছে।”

 “কোথায় আছে?”

 “শচীনন্দন গোস্বামীর আশ্রয়ে আছে, ভিক্ষা করিয়া দিনপাত করে।”

 “তাহাকে আগ্রায় আনিতে হইবে।”

 “সে বোধ হয় আসিতে চাহিবে না।”

 “বাদশাহের আদেশ, তাহাকে শাহ্‌নশাহের সম্মুখে উপস্থিত করিতে হইবে।”

 “মথুরার ফৌজদারকে আদেশ করুন, তাহাকে যেন পাল্কীতে পাঠাইয়া দেয়, পর্ত্তুগীজ পাদ্রীর অনুগ্রহে চৈতন্যদাস চলচ্ছক্তিরহিত।”

 উজীর করতালিধ্বনি করিলেন, একজন খোজা আসিয়া অভিবাদন করিল, আসফ্‌ খাঁ খাসনবীশকে ডাকিয়া দিতে আদেশ করিলেন। অবিলম্বে খাসনবীশ আসিল, উজীর চৈতন্যদাসকে আগ্রায় পাঠাইবার জন্য পত্র লিখিলেন। তৃতীয় প্রহর অতীত হইল, দিল্লী ফটকে নৌবৎ বাজিয়া উঠিল। রাত্রি শেষ হইয়া আসিয়াছে দেখিয়া তর্করত্ন বিদায় চাহিলেন। বিদায় দিবার সময়ে উজীর তাঁহাকে পরদিন আমদরবারে ও গোসলখানায় উপস্থিত থাকিতে অনুরোধ করিয়া, খাস চৌকীর মনসবদার স্বীয় পুত্র শায়েস্তা খাঁর নামে পত্র দিলেন। তর্করত্ন ময়ূখের গৃহে ফিরিলেন।

 তিনি বিদায় হইলে আসফ খাঁ পুনরায় করতালিধ্বনি করিলেন, একজন খোজা কক্ষে প্রবেশ করিয়া অভিবাদন করিল। উজীর তাহাকে জিজ্ঞাসা করিলেন, “খাওয়াস্‌ আমানৎ খাঁ ফিরিয়াছে?” খোজা কহিল, “জনাব, হাঁ।”

 “তাঁহাকে ডাকিয়া আন।”

 খোজা অভিবাদন করিয়া নিষ্ক্রাস্ত হইল। কিয়ৎক্ষণ পরে তাহার সহিত অতি কুৎসিত কুজপৃষ্ঠ একজন হাব্‌সী কক্ষে প্রবেশ করিয়া অভিবাদন করিল। আসফ্‌ খাঁ তখন অবনত বদনে চিন্তা করিতেছিলেন। খোজাদ্বয় কৃষ্ণমর্ম্মরে খোদিত পাষাণমূর্ত্তির ন্যায় স্থির হইয়া দাঁড়াইয়া রহিল। অর্দ্ধদণ্ড পরে উজীর মুখ তুলিলেন, তখন কুব্জপৃষ্ঠ খোজা পুনরায় অভিবাদন করিল। আসফ্‌ খাঁ জিজ্ঞাসা করিলেন, “আমানৎ খাঁ?” খোজা কহিল, “জনাব!”

 “সমস্ত কার্য্য শেষ করিয়াছ?”

 “জনাব, সমস্ত শেষ।”

 “বাঙ্গালী কোথায় গেল?”

 “জনাব, সে সাঁতার দিয়া পাণিফটক পার হইয়া রঙ্গমহলে প্রবেশ করিয়াছে।”

 “কেহ দেখিতে পায় নাই ত?” “আলম্‌পনা, বুড়া বাঙ্গালী জলের ভিতর ডুবিয়া সাঁতার দিয়া ত্রিশ গজ পরিখা ও পাঁচ গজ লহর পার হইয়া রঙ্গমহলে প্রবেশ করিয়াছে।”

 “সাবাস, তাহার কথা অন্দরে বলিয়া আসিয়াছ?” “সরদারণী মেহেদী বিবিকে বলিয়া আসিয়াছি, হিলাল খাঁর মুখে রঙ্গমহলের বখ্‌শী হিম্মত খাঁ য়াকুৎকে খবর দিয়াছি।” “বাঙ্গালী রাজাকে কয়েদ করিল কে? সে খবর লইয়াছ?”

 “সমস্ত খবর পাই নাই তবে সন্ধ্যার পরে য়াকুৎ বাঁদী গুলজার আর কালমক্‌ ইরাদৎ খাঁ নৌকায় করিয়া পাণি ফটকে আসিয়াছিল, ইরাদৎ খাঁ সেখানে নামিয়া গিয়াছিল, গুলজার বাঁদী নৌকা লইয়া রঙ্গমহলে প্রবেশ করিয়াছে। বুড়া বাঙ্গালী বলিয়াছিল যে, তাহার রাজাকে একজন মরদ্‌ ও একজন আওরৎ নৌকায় করিয়া ধরিয়া লইয়া গিয়াছে। গুলজার বিবিই যে বাঙ্গালী রাজাকে কয়েদ করিয়াছে সে বিষয়ে কোন সন্দেহ নাই।”

 “উত্তম, তুমি যাও।”

 খোজাদ্বয় অভিবাদন করিয়া প্রস্থান করিল, আসফ্‌ খাঁ অন্তঃপুরে প্রবেশ করিলেন। সার্দ্ধ তৃতীয় প্রহরে বিস্তৃত মোগল সাম্রাজ্যের প্রধান অমাত্যের বিশ্রামের অবসর হইল।