মহাভারত (উপক্রমণিকাভাগ)/অষ্টচত্বারিংশ অধ্যায়
অষ্টচত্বারিংশ অধ্যায়— আস্তীকপর্ব্ব।
উগ্রশ্রবাঃ কহিলেন, নাগ ভগিনী জরৎকারু অবিলম্বে ভ্রাতৃ সন্নিধানে উপস্থিত হইয়া স্বীয় স্বামীর প্রস্থানবৃত্তান্ত যথাতথ নিবেদন করিলেন। ভুজগরাজ এই অতি মহৎ অপ্রিয় শ্রবণে সাতিশয় বিষন্ন হইয়া ভগিনীকে কহিলেন, ভদ্রে? তুমি জান, যে উদ্দেশে তোমায় আমি জরৎকারুক দান করিয়াছিলাম। তাহা কেবল সর্পকুলের হিতার্থে; যদি তাঁহার ঔরসে তোমার পুত্র জন্মে, সেই পুত্র রাজা জনমেজয়ের সপস হইতে আমাদিগের পরিত্রাণ করিবেক। ভগবান্ সর্ব্বলোকপিতামহ ব্রহ্মা পূর্ব্বে সর্ব্বসুরসমক্ষে ইহাই কহিয়াছিলেন। অতএব জিজ্ঞাসা করি, তৎসহযোগে তোমার গর্ভসম্ভাবনা হইয়াছে কি না? আমার বাসনা এই, জরৎকারুকে যে ভগিনী দান করিয়াছিলাম, তাহা নিষ্ফল না হয়। তোমাকে আমার এরূপ প্রশ্ন করা কোনও ক্রমেই ন্যায্য নহে; কিন্তু গুরুতর কার্যসংক্রান্ত বিষয় বলিয়া অগত্যা এরূপ অনুচিত জিজ্ঞাসা করিতে হইল। আর আমি বিলক্ষণ জানি, তাহার তপস্যায় যেরূপ অনুরাগ, কোনও মতেই প্রত্যাগমনে সম্মত হইবেন না। এই নিমিত্ত আমি তাহাকে নিবৃত্ত করিবার প্রয়াস পাইব না। তিনি যেরূপ উগ্রস্বভাব, আমাকে শাপ দিলেও দিতে পারেন। অতএব মুনি কি বলিলেন, কি করিলেন, আদ্যোপান্ত সমুদায় বর্ণন করিয়া আমার চিরস্থিত ঘোর হৃদয়শল্য উদ্ধৃত কর।
এইরূপ কাতরোক্তি শ্রবণ করিয়া জরৎকারু শোকসন্তপ্ত ভুজগরাজ বাসুকিকে আশ্বাস প্রদান পূর্ব্বক কহিলেন, যৎকালে সেই মহাতপাঃ মহাত্মা গমন করেন, আমি তাহাকে পুত্রের বিষয় জিজ্ঞাসা করিয়াছিলাম। তিনি, অস্তি অর্থাৎ গর্ভসঞ্চার হইয়াছে, এই মাত্র উত্তর প্রদান করিয়া প্রস্থান করিলেন। তিনি পরিহাসকালেও ভুলিয়া কখনও মিথ্যা কথা কহেন নাই, সুতরাং এমন গুরুতর বিষয়ে মিথ্যা কহিবেন কেন? তিনি, হে ভুজঙ্গমে! তুমি পরিতাপ করিও না, তোমার গর্ভে প্রদীপ্ত দিবাকর ও প্রজ্বলিত অনলতুল্য তেজস্বী এক পুত্র জন্মিবেক, এই কথা বলিয়া গিয়াছেন। অতএব ভ্রাতঃ! তোমার মনে যে বিষম দুঃখ আছে, তাহা দূর কর।
নাগরাজ বাকি এই বাক্য শ্রবণ করিয়া তথাস্তু বলিলেন, এবং আহ্লাদসাগরে মগ্ন হইয়া ভগিনীর যথোচিত সম্মান ও সমাদর করিলেন। যেমন শুক্লপক্ষের শশাঙ্ক অন্তরীক্ষে দিন দিন বৃদ্ধি প্রাপ্ত হইতে থাকে, তদ্রপ তাহার গর্ভ দিন দিন বৃদ্ধি পাইতে লাগিল। পূর্ণ কাল উপস্থিত হইলে, নাগভগিনী জরৎকারু পিতৃ মাতৃ উভয় কুলের ভয়হারক দেবকুমারতুল্য এক কুমার প্রসব করিলেন। নাগভাগিনেয় মাতুলালয়েই প্রতিপালিত হইতে লাগিলেন। অসাধারণ বুদ্ধিশক্তি ও জ্ঞানবৈরাগ্যদিগুণসম্পন্ন বালক বাল্যকালেই ব্রহ্মচর্য অবলম্বন করিয়া ভৃগুকুলোদ্ভব চ্যবন মুনির নিকট যাবতীয় বেদ ও বেদাঙ্গ অধ্যয়ন করিলেন। যৎকালে তিনি গর্ভস্থ ছিলেন, তাঁহার পিতা, অস্তি, বলিয়া বনপ্রস্থান করেন, এই নিমিত্ত তিনি লোকে আস্তীক নামে প্রসিদ্ধ হইলেন। ভুজগরাজ পরম ধতে সেই অপ্রমিতবুদ্ধিশালী বালকের লালন পালন করিতে লাগিলেন। তিনিও দিন দিন বৃদ্ধি প্রাপ্ত হইয়া নাগকুলের আনন্দ বর্দ্ধন করিতে লাগিলেন।