মহাভারত (উপক্রমণিকাভাগ)/অষ্টাদশ অধ্যায়
অষ্টাদশ অধ্যায়— আস্তীকপর্ব্ব।
উগ্রশ্রবাঃ কহিলেন, দেবতারা অমৃতমন্থনের আদেশ পাইয়া মন্দর গিরিকে মন্থনদণ্ড করিবার নিশ্চয় করিলেন। কিন্তু সেই উক্ত শুঙ্গসমূহসুশোভিত, বহুললতাজালসংকীর্ণ, বহুবিধ বিহগম গুলকোলাহলসঙ্কুল, অনেকব্যালকুলসমাকুল, অস্পরকিয়র অমরগণসেবিত, একাদশসহস্র যোজন উন্ন, ও তৎপরিমাণে ভূগর্ভে অবস্থিত গিরিরাজের উদ্ধরণ অসমর্থ হইয়া, তাহারা ব্রহ্মা ও নারায়ণের নিকটে আসিয়া বিনয়বচনে নিবেদন করিলেন, কাপিনারা আমাদিগের হিতার্থে কোনও সদুপায় নির্ধারণ ও গন্দরের উদ্ধ রণে যত্ন করুন।
অপ্রমেয়স্বরূপ নারায়ণ ও ব্রহ্মা তাহাদিগের প্রার্থনায় সম্মত হইয়া ভুজগরাজ অনন্তদেবকে মন্দরেরণের আদেশ প্রদান করিলেন। মহবিল মহাবীর্য অনন্তদেব তাঁহাদিগের নিদেশানুসারে সমস্ত বন ও বনচরগণ সহিত সেই পর্বতরাজের উদ্ধরণ করিলেন। তদনন্তর দেবগণ অনদেৰ সমভিব্যাহারে অর্ণবতীরে উপস্থিত হইলেন, এবং অর্ণবকে সম্বোধিয়া কহিলেন, আমরা অমৃতলাভার্থে তোমার জল মন্থন করিব। সমুদ্র কহিলেন, মন্দরপরিভ্রমণ দ্বারা আমাকে বিস্তর ক্লেশ সহ করিতে হইবেক, অতএব আমিও যেন লাভের অংশভাগী হই। অনন্তর সমুদায় দেবতা ও অসুর মণ্ডলী কূর্ম্মরাজের নিকট প্রার্থনা করিলেন, তুমি এই গিরির অধিষ্ঠান হও। কূর্ম্মরাজ তথাস্তু বলিয়া মরগিরির অধিষ্ঠানার্থে আপন পৃষ্ঠ পাতিয়া দিলেন। দেবরাজ তৎপৃষ্ঠে অধিষ্ঠিত শৈলরাজকে যন্ত্রসহকারে চালিত করিলেন।
এই রূপে অমরগণ মন্দরকে মন্থনদণ্ড ও বাসুকিকে মন্থনচ্ছু করিয়া অমৃতলাভাভিলাষে সলিলনিধি সমুদ্রের মন্থন আরম্ভ করিলেন। মহাবল দানবাহ্রদল রঞ্জু স্থানীয় নাগরাজের মুখদেশ ও দেবগণ তাঁহার পুচ্ছদেশ ধারণ করিলেন। ভগবান্ অনন্তদেব নারায়ণের অপর মূর্তি, এই নিমিত্ত তিনি তাঁহার দুর্বিষহ বিষের প্রভাব সংবরণ করিয়া দিলেন। দেবতারা মন্থনার্থে নাগরাজ বাসুকিকে বল পূর্বক আকর্ষণ করাতে, তাঁহার মুখ হইতে বারংবার ধূম ও অগ্নিশিখ সহিত অতি প্রভূত শ্বাসবায়ু নিঃসৃত হইতে লাগিল। ঐ সমস্ত শ্বাসবায়ু সমবেত হইয়া বিদ্যুৎ সহিত মেঘসমূহরূপে পরিণত হইল এবং শ্রান্ত ও সন্তপ্ত দেবদানবদিগের উপর বারি বর্ষণ করিতে আরম্ভ করিল। আর সেই শৈলের শিখরদেশ হইতে সমস্তুতঃ পুষ্পবৃষ্টি হইতে লাগিল।
এই রূপে মন্দরগিরি দ্বারা সুরাসুরগণ কর্তৃক মথ্যমান সমুদ্র হইতে মেঘরবানুকারী বিশাল শব্দ হইতে লাগিল। নানাবিধ শত শত জলচরগণ মন্দরগিরির মর্দনে নিষ্পিষ্ট হইয়া পঞ্চত্ব প্রাপ্ত হইল। পাতালতলবাসী অন্যান্য বহুবিধ জলীয় প্রাণিগণ মন্দরাঘাতে প্রাণত্যাগ করিল। গিরিরাজ অনবরত ভ্রাম্যমাণ হওয়াতে, তদীয় শিখরদেশস্থিত অতি প্রকাণ্ড মহীরুহ সকল পরস্পর সংঘৃষ্ট হইয়া পতগগণ সহিত নিপতিত হইতে লাগিল। যেমন নীলবর্ণ জলধর সৌদামিনীমণ্ডল দ্বারা সমবৃত হয়, তোপ মন্দর সেই সমস্ত ভূরুহের পরস্পর সংঘর্ষণসস্তৃত অতি প্রভূত হুতাশনের শিখা সমূহ দ্বারা সমাবৃত হইল। ঐ হুতাশন মশঃ প্রবল হইয়া অরণ্যবিনির্গত কুঞ্জর ও কেশৱী সকল দগ্ধ করিল। তদ্ব্যতীত অন্য নানা বনচর ঐ হুতাশনের আহুতি হইল। হুতাশন এই রূপে ইতস্ততঃ দাহ আরম্ভ করাতে, দেবরাজ ইন্দ্র মেঘসম্ভুত সলিলসেক দ্বারা তাহার শান্তি সম্পাদন করিলেন।
তদনন্তর মহাদ্রুমগণের নির্যাস ও অশেষবিধ ওষধিরস সাগরসলিলে গলিয়া পড়িতে লাগিল। সেই সমস্ত অমৃতগুণসম্পন্ন রসের ও কাঞ্চননিবের প্রভাবে সুরগণ অমরত্ব প্রাপ্ত হইলেন। অর্ণবারি উক্তৰিধ রস, কাঞ্চননি, ও অন্যান্য বহুবিধ উৎকৃষ্ট রসে মিশ্রিত হইয়া ক্ষীররূপে পরিণত হইল। সেই ক্ষীর হইতে ঘৃত উৎপন্ন হইল।
অনন্তর দেবতারা পদ্মাসনে আসীন বরদ ব্রহ্মার নিকটে আসিয়া নিবেদন করিলেন, ভগবন্! দেবাদিদেব নারায়ণ ব্যতিরেকে আমরা সমুদায় দেব দানব একান্ত ক্লান্ত হইয়াছি। কোন্ কালে মস্থন আরম্ভ করা গিয়াছে, এখন পর্যন্তও অমৃত উদ্ভূত হয় নাই। তখন ব্রহ্মা নারায়ণকে কহিলেন, তুমি ইহাদিগের বলাধান কর; তোমা ব্যতিরেকে এ বিষয়ে আর গতি নাই। নারায়ণ কহিলেন, যাহারা এই ব্যাপারে নিযুক্ত আছে, তাহাদিগের সকলকেই আমি বল প্রদান করিতেছি। সকলে মিলিত হইয়া মন্দর পরিভ্রমণ দ্বারা সরিৎপতিকে আলোড়িত করুক।
সমুদায় দেব ও দানৰ নারায়ণের বচন শ্রৰণ মাত্র বল প্রাপ্ত ও একবাক্য হইয়া পুনর্বার প্রবল রূপে জলধিমন্থন আরম্ভ করিলেন। তদনন্তর মধ্যমান অন্ত্যেধির গর্ভ হইতে শীতলময়ুখসম্পন্ন সৌম্য ও প্রসন্নমূর্ত্তি চন্দ্র উৎপন্ন হইলেন। শ্বেতসয়োজসমাসীনা লক্ষী, সুরাদেবী, ও শ্বেতবর্ণ অশ্বরত্ন উচ্চৈঃশ্রবাঃ স্মৃত হইতে আবির্ভূত হইলেন। তৎপরে কৌস্তুভনামা শ্রীমন্ মহোজ্জল দিব্য মণি ঘূত হইতে সমুদ্ভূত হইয়া নারায়ণের বক্ষঃস্থলে লম্বমান হইল। লক্ষী, সুৱা, শশধর, ও মনোজব অশ্বরাজ আদিত্যপথানুসারী হইয়া দেবপক্ষে গমন করিলেন। অনন্তর মুর্তিমান্ ধরিদেব অমৃতপূর্ণ শ্বেত কমণ্ডলু হস্তে করিয়া আবির্ভূত হইলেন। এই পরমাদ্ভুত ব্যাপার অবলোকন করিয়া দানবগণ, এই অমৃত আমার আমার বলিয়া, কোলাহল করিতে লাগিল। তদনন্তর ধলকান্তি, দশনচতুষ্টয়সম্পন্ন, মহাকায় ঐরাবতনামা মাতঙ্গরাজ উৎপন্ন হইল। বজ্রধারী দেবরাজ ঐ গজরাজ অধিকার করিলেন।
দেবাসুরগণ ইহাতেও ক্ষান্ত না হইয়া সাতিশয় মন্থন করাতে, কালকূট উৎপন্ন হইয়া ধূমবহুল প্রজ্বলিত অনলের যায় সহসা জগম্মল আকুল করিল। ঐ অতি বিষম বিষের গন্ধ আম্রাণ করিয়া ত্রৈলোক্য বিচেতন ও মুচ্ছিত হইল! ব্রহ্মা তদ্দর্শনে সাতিশয় শঙ্কিত হইয়া অনুরোধ করাতে, ভগবান্ মন্ত্রমূর্তি মহেশ্বর লোকরক্ষার্থে তৎক্ষণাৎ তাহা পান করিয়া কণ্ঠদেশে ধারণ করিলেন। তদবধি তিনি ত্রিলোকে নীলকণ্ঠ নামে বিখ্যাত হইলেন।
দানবেরা এই অদ্ভুত ঘটনা দর্শনে নিতান্ত নিরাশ হইয়া অমৃত 'ও লক্ষী লাভার্থে ঘোরতর বিরোধ উপস্থিত করিল। তখন নারায়ণ, মোহিনী মায়া অবলম্বন করিয়া স্ত্রীরূপ পরিগ্রহ পূৰ্বক, দানবদলের নিকট উপস্থিত হইলেন। মুঢ়মতি দৈত্য দানবগণ তাঁহার পরমাদ্ভুত রূপলাবণ্য অবলোকনে মোহিত ও তগতচিত্ত হইয়া তাঁহাকে অমৃত প্রদান করিল।