মহাভারত (উপক্রমণিকাভাগ)/ত্রয়োদশ অধ্যায়

ত্রয়োদশ অধ্যায়—আস্তীকপর্ব্ব।

শৌনক কহিলেন, হে সূতনন্দন! রাজাধিরাজ জনমেজয় কি নিমিত্ত সর্পসত্রানুষ্ঠান দ্বারা সর্পকুল সংহার করিয়াছিলেন, কি নিমিত্তই বা জিতেন্দ্রিয়াগ্রগণ্য দ্বিজশ্রেষ্ঠ আস্তীক মহাশয় প্রদীপ্ত হুতাশন হইতে ভুজগগণের পরিত্রাণ করেন, তাহা সবিশেষ সমস্ত বর্ণন কর। আর যে রাজা সর্পসত্র অনুষ্ঠান করিয়াছিলেন, তিনি কাহার পুত্র, এবং ঐ মহাত্মা ব্রাহ্মণই বা কাহার তনয়, তাহাও তুমি আমার নিকট কীর্ত্তন কর। উগ্রশ্রবাঃ কহিলেন, হে দ্বিজবর! আমি আপনার নিকট মহাফলপ্রদ আস্তীকোপাখ্যান আদ্যোপান্ত বর্ণন করিতেছি, শ্রবণ করুন। শৌনক কহিলেন, হে সূতকুলতিলক! যশস্বী পুরাণ ঋষি আস্তীক মহাশয়ের মনোরম আখ্যান সবিস্তর শুনিবার নিমিত্ত আমার নিতান্ত বাসনা জন্মিয়াছে। উগ্রশ্রবাঃ কহিলেন, হে ঋষিবর! আমার পিতা ব্যাসশিষ্য মেধাবী লোমহর্ষণ নৈমিষারণ্যবাসী ব্রাহ্মণগণ কর্ত্তৃক অভ্যর্থিত হইয়া, তাঁহাদিগকে কৃষ্ণদ্বৈপায়নপ্রোক্ত সর্ব্বপাপক্ষয়কারী এই ইতিহাস শ্রবণ করাইয়াছিলেন। আমি তাঁহার নিকট যেরূপ শুনিয়াছি, অবিকল সেইরূপ বর্ণন করিতেছি, শ্রবণ করুন।

 মহর্ষি আস্তীকের পিতা জরৎকারু সাক্ষাৎ প্রজাপতিতুল্য ব্রহ্মচারী বিষয়বাসনাশূন্য কঠোরতপস্যারত উৰ্দ্ধরেতাঃ যাযাবরাগ্রগণ্য[] ধর্ম্মজ্ঞ ও ব্রতপরায়ণ ছিলেন। সেই তপঃপ্রভাবসম্পন্ন মহাত্মা যত্রসায়ংগৃহ[] হইয়া তীর্থ পর্য্যটন ও তীর্থস্নান করত পৃথিবীমণ্ডল ভ্রমণ করিতেন। এই রূপে বহু কাল বায়ুভক্ষ, নিরাহার, শুদ্ধকলেবর, ও বীতনিদ্র হইয়া ইতস্ততঃ ভ্রমণ পূর্ব্বক দুঃসাধ্য ব্রতানুষ্ঠান করেন।

 এক দিবস জরৎকারু পর্যটনক্রমে কোনও স্থানে উপস্থিত হইয়া স্বীয় পূর্বপুরুষদিগকে উর্দ্ধপাদ অধঃশিরাঃ মহাগর্ত্তে লম্বমান অবলোকন করিলেন। তদ্দর্শনে অনুকম্পাপরবশ হইয়া তাঁহাদিগকে জিজ্ঞাসা করিলেন, আপনারা কে, কি নিমিত্ত উশীরস্তম্বমাত্র অবলম্বন করিয়া অবাম্মুখে লম্বমান আছেন? এই গর্ত্তে গূঢ়বাসী এক মুষিক আপনাদিগের অবলম্বিত উর্শীরস্তম্বের মূল প্রায় সমুদায় ভক্ষণ করিয়াছে। পিতৃগণ কহিলেন, আমরা যাযাবর নামে ঋষি, বংশলোপের উপক্রম হওয়াতে অধোগতি প্রাপ্ত হইতেছি। আমরা অতি হতভাগ্য, আমাদিগের জরৎকারু নামে এক সন্তান আছে, সেই মুঢ়মতি হতভাগ্য সংসারাশ্রমবিমুখ হইয়া কেবল তপস্যায় মনোনিবেশ করিয়াছে, পুত্রোৎপাদনার্থে দারপরিগ্রহ করিতেছে না। সুতরাং বংশলোপ উপস্থিত হওয়াতে মহাগর্ত্তে লম্বমান হইয়া আছি। আমরা জরৎকারুরূপ নাথ সত্ত্বেও অনাথ ও পাপাত্মার ন্যায় হইয়াছি। যাহা হউক, তুমি কে, কি নিমিত্ত আমাদের এই শোচনীয় অবস্থা অবলোকন করিয়া অনুশোচন ও অনুকম্পা প্রদর্শন করিতেছ?

 জরৎকারু পূর্বপুরুষদিগের এইরূপ কাতরবাক্য শ্রবণ করিয়া নিবেদন করিলেন, হে ঋষিগণ! আপনারা আমার পূর্বপুরুষ, আমারই নাম জরৎকারু, এক্ষণে আজ্ঞা করুন, আমাকে কি করিতে হইবেক। পিতৃগণ কহিলেন, বৎস! বংশরক্ষণে এবং তোমার ও আমাদিগের পারলৌকিক মঙ্গল সাধনে যত্নবান্ হও। পুত্রবান্ লোকদিগের যেরূপ সদগতি লাভ হয়, ধর্ম্মফল ও চিরসঞ্চিত তপোবল দ্বারা তাদৃশ হয় না। অতএব তুমি অমাদিগের নিয়োগানুসারে দারপরিগ্রহে ও পুত্রোৎপাদনে যত্নবান্ ও মনোযোগী হও, তাহা হইলেই আমাদিগের পরম মঙ্গল। জরৎকারু কহিলেন, আমি কদাপি ভোগাভিলাষে দারপরিগ্রহ ও ধনোপাৰ্জ্জন করিব না, কেবল আপনাদিগের হিতার্থে দারপরিগ্রহে সম্মত হইলাম। কিন্তু তদ্বিষয়ে আমি এই প্রতিজ্ঞা করিতেছি, যদি কন্যা আমার সনাম্নী হয় ও তাহার বন্ধুগণ স্বেচ্ছাপূর্ব্বক ভিক্ষাস্বরূপ দান করিতে চাহেন, তবেই আমি যথাবিধানে তাহার পাণিগ্রহণ করিব। কিন্তু আমি দরিদ্র, কোন্ ব্যক্তি দেখিয়া শুনিয়া আমাকে কন্যাদান করিবেক। তবে ভিক্ষাস্বরূপ যদি কেহ দান করিতে চাহে, আমি প্রতিগ্রহ করিতে অসম্মত নহি। হে পিতামহগণ! এই নিয়মে আমি দারপরিগ্রহে যত্নবান্ হইব, প্রকারান্তরে তদ্বিষয়ে প্রবৃত্ত হইব না। এই রূপে পরিণীতা ভার্য্যার গর্ভে আপনাদিগের উদ্ধারকর্ত্তা পুত্র উৎপন্ন হইবেক, তখন আপনারা অক্ষয় স্বর্গ লোক প্রাপ্ত হইয়া পরম প্রমোদে কালযাপন করিবেন।

  1. যে তপস্বীদিগের নিয়মিত বাসস্থান নাই, নিয়ত স্থানে স্থানে পরিভ্রমণ করেন, তাঁহাদের নাম যাযাবর।
  2. যত্রসায়ংগৃহ, যে স্থানে সায়ংকাল উপস্থিত হয়, সেই গৃহ অর্থাৎ তথায় অবস্থিতি করে।