মহাভারত (উপক্রমণিকাভাগ)/ত্রয়োবিংশ অধ্যায়

ত্রয়োবিংশ অধ্যায় অধ্যায়— আস্তীকপর্ব্ব।

উগ্রশ্রবাঃ কহিলেন, কদ্রু ও বিনতা সমুদ্র অতিক্রম করিয়া অনতিবিলম্বে অশ্বসমীপে উপস্থিত হইয়া দেখিলেন, অশ্ব শশাঙ্ককিরণের ন্যায় শুভ্রাকার, কেবল পুচ্ছদেশের কেশগুলি কৃষ্ণবর্ণ। বিনতা তদ্দর্শনে বিষাদসাগরে মগ্ন। হইলেন, কৃঞ্জ জয়লাভে প্রফুল্লা হইয়া তাঁহাকে দাসীকর্মে নিযোজিতা করিলেন। বিনতাও পণেতে পরাজিত হইয়াছেন, সুতরাং দুঃসহ দুঃখদাবদহনে দগ্ধ হইয়া দাসীভাব অবলম্বন করিলেন।

 এই সময়ে গরুড়ও, সময় উপস্থিত হওয়াতে, মাতৃসাহায্যনিরপেক্ষ হইয়া, স্বয়ং অণ্ড বিদারণ পূর্ব্বক জন্ম গ্রহণ করিলেন। মহাবল, মহাকায়, প্রলয়কালীন তানতুল্য দুর্নিরীক্ষা, বিদ্যুৎসম সমুজ্জ্বলনেত্র, কামরূপ, কামবীর্য, কামগম[] বিহঙ্গমরাজ, অতিপ্রদীপ্ত হুতাশন রাশির ন্যায় অভািসমান হইয়া নভোমণ্ডলে অরোহণ ও ঘোরতর নিনাদ পরিত্যাগ পূর্বক, সহসা অতিপ্রকাণ্ড কলেবর ধারণ করিলেন। তদ্দর্শনে দেবতারা ব্যাকুল হইয়া বিশ্বরূপী আসনোপবিষ্ট অগ্নিদেবতার শরণাগত হইলেন এবং প্রণিপাত করিয়া অতি বিনয়ে নিবেদন করিলেন, হে অগ্নে! আর শরীর বৃদ্ধি করিও না, তুমি কি আমাদিগকে দগ্ধ করিবার মানস করিয়াছ? ঐ দেখ, তোমার প্রদীপ্ত রাশি সর্বতঃ প্রসৃত হইতেছে। অগ্নি কহিলেন, হে দেবগণ! তোমরা যাহা বোধ করিতেছ, বাস্তবিক তাহা নহে; আমার তুল্য তেজস্বী বলবান্ বিনতানন্দন গরুড় জন্মগ্রহণ করিয়া কলেবর বৃদ্ধি করিতেছেন; সেই তেজোরাশি দর্শনে তোমরা মোহাবিষ্ট হইয়ছি। এই সর্পকুলসংহারকারী মহাবল কশপসূনু সদা তোমাদিগের হিতৈষী ও দৈত্য রাক্ষস প্রভৃতির অহিতকারী হইবেন। অতএব তোমাদের ভয়ের বিষয় নাই; তথাপি আইস, সকলে মিলিয়া গরুড়ের নিকটে যাই।

 এইরূপ নিশ্চয় করিয়া দেবাগণ, ঋষিগণ সমভিব্যাহারে গরুড়সমীপে গমন পূর্বক, তদীয় স্তুতিবাদ আরম্ভ করিলেন, হে মহাভাগ পতগেশ্বর! তুমি ঋষি, তুমি দেব, তুমি প্রভু, তুমি সূর্য্য, তুমি প্রজাপতি, তুমি ইন্দ্র, তুমি হয় গ্রীব, তুমি শর, তুমি জগৎপতি, তুমি সুখ, তুমি পদ্মযোনি, তুমি অগ্নি, তুমি পবন, তুমি ধা ও বিধাতা, তুমি সুরশ্রেষ্ঠ বিষ্ণু, তুমি মহান, তুমি সকাল সৰ্বব্যাপী, তুমি অমৃত, তুমি মহৎ যশঃ, তুমি প্রভা, তুমি অভিপ্রেত, তুমি আমাদিগের পরম রক্ষাস্থান, তুমি মহাবল, তুমি সাধু, তুমি মহাত্মা, তুমি সমৃদ্ধিশালী, তুমি দুঃসহ, হে মহকীর্ষে গরুড়! ভবিষ্যৎ ও বর্তমান সকল গোমা হইতে নিঃসৃত হইয়াছে, তুমি সর্বোত্তম, তুমি চরাচরমূর্ত্তি, তুমি স্বীয় কিরণমণ্ডল দ্বারা দিবাকরের ন্যায় অবভাসমান হইতেছ, তুমি স্বীয় তেজোপাশি দ্বারা সূর্যের প্রভামণ্ডল নকৃত করিতেছ, তুমি অন্তক, তুমি স্থাবর জঙ্গম সমস্ত পদার্থস্বরূপ, হে হুতাশনপ্রভ! তুমি পরিকুপিত দিবাকরের ন্যায় প্রজা সকলকে দগ্ধ করিতেছ, তুমি লোকসংহারে উদ্যত প্রলয়কালীন অনলের ন্যায় ভয়ঙ্কর রূপে উত্থিত হইয়াছ। আমরা মহাবল, মহাতেজাঃ, অগ্নিসমপ্রত, বিদ্যুৎসমানকান্তি, তিমিরনিবারক, নভোমণ্ডলমধ্যবর্তী, পরাবরস্বরূপ, বরদ, দুর্ধর্ষবিক্রম, বিহঙ্গমরাজ গরুড়ের শরণ লইলাম। হে জগন্নাথ! তোমার তপ্তসুবর্ণমানকান্তি তেজোৱাশি দ্বারা জগন্মণ্ডল সন্তপ্ত হইয়াছে; অতএব তুমি মহাত্মা দেবতাদিগকে রক্ষা কর; দেবতারা ভয়ে অভিভূত হইয়া আকাশপথে ইতস্ততঃ পলায়ন করিতেছেন। হে বিহগবর? তুমি দয়ালু মহাত্মা কশ্যপ ঋষির সন্তান, বোষ পরিহার করু, জগৎকে দয়া কর, শান্তি অবলম্বন কর, আমাদিগের রক্ষা কর। তোমার মহাবজ্রসদৃশ ভয়ঙ্কর রবে দিঙ্গুল, নভঃস্থল, স্বর্গলোক, ভূলোক, ও আমাদিগের হৃদয়. নিরন্তর কম্পিত হইতেছে। অতএব তুমি অনলতুল কলেবর সংহার কর। তোমার কুর্পিতকৃতান্ততুল্য আকার দর্শনে আমাদের মন একান্ত অস্থির হইয়াছে। হে ভগবন্ পগপতে! আমরা প্রার্থনা করিতেছি, প্রসন্ন, শুভদ, ও সুখাবহ হও। গরুড় দেবতাদিগের ও দেবর্ষিগণের এইরূপ স্তুতিবাদ শ্রবণ করিয়া আত্মতেজঃ সংহার করিলেন।

  1. ইচ্ছা অনুসারে শীঘ্র ও সর্ব্বত্র গমনক্ষম।