মহাভারত (উপক্রমণিকাভাগ)/দ্বাচত্বারিংশ অধ্যায়

দ্বাচত্বারিংশ অধ্যায়— আস্তীকপর্ব্ব।

শৃঙ্গী কহিলেন, পিতঃ! শাপ দেওয়াতে যদিও আমার সাহসিকতা অখবা দুষ্কর্ম করা হইয়া থাকে, আর উহা তোমার প্রিয়ই হউক, অপ্রিয়ই হউক, যাহা কহিয়াছি, মিথ্যা হইবার নহে। আমি তোমাকে তত্ত্ব কথা কহিতেছি, উহা কদাচ অন্যথা হইবেক না। আমি পরিহাসকালেও মিথ্যা কহি মা, শাপ দান কালের ত কথাই নাই। শমীক কহিলেন, বৎস! আমি জানি, তুমি অত্যন্ত উগ্রপ্রভাব ও সত্যবাদী, কখনও মিথাকহ নাই, সুতরাং তোমার শাপ মিথ্যা হইবার নহে। পুত্র প্রাপ্তবয়স্ক হইলেও, তাহাকে পিতার শাসন করা কর্ত্তব্য; তাহা হইলে পুত্র উত্তরোত্তর গুণশালী ও যশস্বী হইতে পারে। তুমি ত বালক, তোমাকে অবশ্যই শাসন করিতে পারি। তুমি সর্ব্বদা তপস্যা করিয়া থাক; যাহারা তপস্য। ও যোগানুষ্ঠান দ্বারা প্রভাবসম্পন্ন হয়েন, তাহাদের অতিশয় কোপবৃদ্ধি হয়। তুমি পুত্র, তাহাতে বয়সে বালক, আবার যৎপরোনাস্তি অবিবেচনার কর্ম্ম করিয়াছ, এই সমস্ত আলোচনা করিয়া তোমাকে উপদেশ দেওয়া আবশ্যক বোধ করিতেছি। অতএব কহিতেছি শুন, তুমি শমপথাবলম্বী হইয়া এবং বন্য ফল মূল মাত্র আহার ও ক্রোধের দমন করিয়া তপস্যানুষ্ঠান কর, তাহা হইলে ধর্ম্মপথ হইতে ভ্রষ্ট হইবে না। লোকে পারলৌকিক মঙ্গলকাঙক্ষায় অশেষ ক্লেশে ধর্ম্মসঞ্চয় করে, কিন্তু ক্রোধবশ হইলে এক কালে সমুদায় সঞ্চিত ধর্ম্ম উচ্ছিন্ন হয়। ধর্ম্মহীনদিগের সদ্গতি নাই। ক্ষমাশীল লোকের শমই সিদ্ধির অদ্বিতীয় সাধন, ক্ষমাশীলের ইহলোক পরলোক উভয় জয়। অতএব সতত ক্ষমাশীল ও জিতেন্দ্রিয় হইয়া চলিবে। ক্ষমাশীল হইলে ব্রহ্মলোক প্রাপ্ত হইবে। আমি শমপথাবলম্বী হইয়া যাহা করিতে পারি তাহা করি; রাজাকে এই সংবাদ পাঠাইয়া দি যে, আমার পুত্র নিতান্ত বালক, অদ্যাপি তাহার বুদ্ধির পরিপাক হয় নাই; তুমি আমার যে অবমাননা করিয়া ছিলে, সে তদ্দর্শনে অমর্ষবশ হইয়া তোমাকে শাপ দিয়াছে।

 এইরূপ কহিয়া সুব্রত তপঃপরায়ণ শমীকমুনি গৌরমুখনামক সুশীল সমাহিত স্বীয় শিষ্যকে রাজ। পরীক্ষিতের নিকট পাঠাইলেন, এবং কহিয়া দিলেন, অর্থে কুশল জিজ্ঞাসা করিয়া পরে এই সংবাদ নিবেদন করিবে। গৌরমুখ, গুরুর আদেশানুসারে জরায় হস্তিনাপুরে উপস্থিত হইয়া, দ্বারপাল দ্বারা সংবাদ দিয়া রাজভবনে প্রবেশ করিলেন, এবং রাজকৃত অভ্যাগতসৎকার স্বীকার ও শ্রান্তি পরিহার করিয়া আদ্যোপান্ত শমীকৰাক্য নরপতিগোচরে নিবেদন করিতে লাগিলেন, মহারাজ! শান্ত, দান্ত, হাতপাঃ পরমধর্মাত্মা, মৌনব্রতপরায়ণ শমীকঋষি আপনকার রাজ্যে বাস করেন। আপনি অনী দ্বারা তাঁহার দেশে মৃত সর্প ক্ষেপণ করিয়া আসিয়াছেন। তিনি ক্ষমা করিয়াছিলেন, কিন্তু তাহার পুল ক্ষমা না করিয়া পিতার অজ্ঞাতসারে আপনাকে এই শাপ দিয়াছেন, তক্ষক সপ্তরাত্রমধ্যে আপনকার প্রাণসংহার করিবেক। শমীকমুনি পুলকে শাপনিবারণের নিমিত্ত বারংবার কহিয়াছিলেন, কিন্তু কাহারও সাধ্য নাই যে, সে শাপ অন্যথা করে। মহর্ষি কুপিত পুত্রকে কোনও ক্রমেই শান্ত করিতে না পারিয়া, পরিশেষে আপনকার হিতার্থে আমাকে সংবাদ দিতে িপাঠাইয়াছেন।  রাজা পরীক্ষিৎ গৌৱমুখের এই ভয়ঙ্কর বাক্য শ্রবণ ও স্বকৃত গর্হিত কর্ম্ম স্মরণ করিয়া সাতিশয় বিষ হইলেন। শমীকমুনি মৌনব্রত, এই নিমিত্তই উত্তর দেন নাই, ইহা শুনিয়া তাঁহার হৃদয় শোকানলে দগ্ধ হইতে লাগিল। যে মহাত্মা সেই প্রকার অবমানিত হইয়াও এরূপ দয়া প্রদর্শন করিলেন, তাহার উপরেও আমি তাদৃশ অত্যাচার করিয়াছি, মনোমধ্যে এই আলোচনা করিয়া তাহার পরিতাপের আর সীমা রহিল। বিনা দোষে ঋষির অবমাননা করিয়াছি, ইহা ভাবিয়া তিনি যেরূপ দুঃখিত হইলেন, নিজ মৃত্যুর কথা শুনিয়া তপ হইলেন না। অনন্তর গৌরমুখকে এই বলিয়া বিদায় করিলেন, আপনি মহর্ষিকে বলুন, যেন তিনি আমার প্রতি প্রসন্ন হন।

 গৌরমুখ প্রস্থান করিবামাত্র, রাজা একান্ত উদ্বিগ্নচিত্ত হইয়া, মন্ত্রিগণ সমভিব্যাহারে মন্ত্রণা করিয়া, এক সর্ব্বতঃসুরক্ষিত প্রাসাদ নির্মাণ করাইলেন, তথায় বহু চিকিৎসক, নানা ঔষধ ও মন্ত্রসিদ্ধ ব্রাহ্মণগণকে নিষোজিত করিলেন, এবং সেই প্রাসাদে থাকিয়া সর্ব প্রকারে রক্ষিত হইয়া রাজকার্য পর্যালোচনা করিতে লাগিলেন। কোনও ব্যক্তিই তাঁহার নিকটে যাইতে পায় না, সর্বত্রগামী বায়ুও সেই প্রাসাদে প্রবেশ করিতে পারে না।

 ব্রাহ্মণশ্রেষ্ঠ বিদ্বান্ মহর্ষি কাশ্যপ শুনিয়াছিলেন যে, পন্নগপ্রধান তক্ষক দংশন করিয়া রাজাকে যমালয়ে প্রেরণ করিবেক। অতএব তিনি মনে করিয়াছিলেন, তক্ষক দংশন করিলে আমি চিকিৎসা দ্বারা বাজাকে বিষমুক্ত করিব, তাহাতে আমার ধর্ম্ম ও অর্থ উভয় লাভ হইবেক। নির্ধারিত সপ্তম দিবস উপস্থিত হইলে, কাশ্যপ একাগ্র মনে গমন করিতেছেন, এমন সময়ে নাগেন্দ্র তক্ষক, বৃদ্ধ ব্রাহ্মণের আকার পরিগ্রহ পূর্ব্বক, পথিমধ্যে তাঁহার সহিত সাক্ষাৎ করিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, হে মুনীশ্বর!” তুমি সত্বর হইয়া কি অভিপ্রায়ে কোথায় যাইতেছ? কাশ্যপ. কহিলেন, অঙ্গ সর্পরাজ তক্ষক কুরুকুলোদ্ভব শত্রুবিনাশন রাজা পরীক্ষিৎকে স্বীয় তেজঃ দ্বারা ভস্মাবশেষ করিবেক, আমি চিকিৎসা দ্বারা তাহার প্রাণরক্ষা করিতে যাইতেছি। ভক্ষক কহিলেন, হে মহর্ষে! আমিই সেই তক্ষক, আমিই রাজাকে দগ্ধ করিব। আমি দংশন, করিলে তুমি চিকিৎসা করিয়া কৃতকার্য হইতে পারিবে না, অতএব নিবৃত্ত হও। কাশ্যপ কহিলেন, তুমি দংশন করিলে আমি বিদ্যাবলে রাজাকে বিষমুক্ত করিতে পারি, তাহাতে আমার সন্দেহ নাই।