মহাভারত (উপক্রমণিকাভাগ)/পঞ্চাশ অধ্যায়

পঞ্চাশ অধ্যায়— আস্তীকপর্ব্ব।

মন্ত্রিগণ কহিলেন, হে রাজেন্দ্র! রাজা পরীক্ষিৎ এই রূপে মুনির দেশে মৃত সর্প নিক্ষেপ করিয়া নিজরাজধানী প্রস্থান করিলেন। সেই ঋষির গোগর্ভে সমুৎপন্ন মহাতেজাঃ মহাবীর্য্য অতি কোপনস্বভাব শৃঙ্গী নামে এক মহাযশস্বী পুত্র ছিলেন। এই মুনিকুমার সর্ববলোকপিতামহ ব্রহ্মার উপাসনার্থে ব্রহ্মালোকে গমন করিয়াছিলেন। উপাসনান্তে ব্রহ্মার অনুমতি লইয়া পৃথিবীতে প্রত্যাগমন পূর্বক স্বীয় সখার মুখে পিতার অবমাননাবৃত্তান্ত শ্রবণ করিলেন। তাহার সখা কহিলেন, বয়স্য? তোমার পিতা মৌনপরায়ণ হইয়া সমাধি করিতেছিলেন, রাজা পরীক্ষিৎ আসিয়া তাঁহার স্কন্ধে মৃত সর্প ক্ষেপণ করিয়া গিয়াছেন। মহারাজ! মহাতেজাঃ শৃঙ্গী বয়সে বালক হইয়াও তপস্থা ও জ্ঞানে বৃদ্ধ হইয়াছিলেন; এক্ষণে শ্রবণমাত্র কোপানলে প্রজ্বলিত হইয়া, উদক স্পর্শ পূর্বক, স্বীয় সখাকে সম্বোধন করিয়া, তোমার পিতাকে এই শাপ দিলেন, বয়স্য! আমার তপস্যার বল দেখ, যে দুরাত্মা বিনা অপরাধে আমার পিতার স্কন্ধে মৃত সর্প ক্ষেপণ করিয়াছে, তীক্ষ্ণবিষ তীক্ষ্ণবীর্য নাগরাজ তক্ষক আমার বাক্যানুসারে সপ্তম দিবসে তাহার প্রাণসংহার করিবেক। ইহা কহিয়া শৃঙ্গী পিতার সমাধিস্থানে উপস্থিত হইলেন, এবং পিতাকে তদবস্থ দেখিয়া শাপপ্রদান বৃত্তান্ত নিবেদন করিলেন। তখন সেই সাধু সদাশয় মুনিশ্রেষ্ঠ, সুশীল গুণবান্ গৌরমুখমক শিষ্যকে, ইহা কহিবার নিমিত্ত, আপনার পিতার নিকট পাঠাইয়া দিলেন যে, আমার পুত্র তোমাকে শাপ দিয়াছে, তুমি সাবধান হও, তক্ষক তোমাকে স্বীয় তেজঃ দ্বারা দগ্ধ করিবেক। গৌরমুখ আপনার পিতার নিকট আসিয়া বিশ্রামান্তে আদ্যোপান্ত সমস্ত বৃত্তান্ত নিবেদন করিলেন। আপনার পিতা এই ভয়ঙ্কর বাক্য শ্রবণ করিয়া তক্ষকের ভয়ে অত্যন্ত সাবধান ও সতর্ক হইয়া রহিলেন।

 সপ্তম দিবস উপস্থিত হইলে, ব্রহ্মর্ষি কাশ্যপ সত্বর গমনে আপনকার পিতার নিকট আসিতেছিলেন। তক্ষক তাহাকে দেখিতে পাইয়া জিজ্ঞাসা করিল, হে মহর্ষে। তুমি কোথায় ও কি প্রয়োজনসাধনার্থ এত সত্বর গমন করিতেছ? তিনি কহিলেন, অদ্য তক্ষক রাজা পরীক্ষিৎকে ভস্মাবশেষ করিবেক, আমি তাহার প্রতিকারার্থে যাইতেছি, আমি সমীপে থাকিলে, তক্ষক রাজার প্রাণ বিনাশ করিতে পারিবে না।” তক্ষক কহিল, হে ঋষে! আমি সেই তক্ষক, আমি তাহাকে দংশন করিব। তুমি কি নিমিত্ত তাহাকে বাঁচাইতে বৃথা চেষটা পাইবে? আমি দংশন করিলে তুমি কোনও ক্রমেই রাজাকে বাঁচাইতে পারবে না, তুমি আমার অদ্ভুত বীর্য দেখ। এই বলিয়া তক্ষক এক বৃক্ষকে দংশন করিল। বৃক্ষ তৎক্ষণাৎ ভস্মীভূত হইল। কাশ্যপও তৎক্ষণাৎ সেই বৃক্ষকে পুনর্জীবিত করিলেন। তখন তক্ষক, তুমি কি অভিলাষে যাইতেছ বল, এই বলিয়া তাঁহাকে লোভপ্রদর্শন করিল। কাশ্যপ কহিলেন, আমি ধনলাভপ্রত্যাশায় যাইতেছি। তক্ষক কহিল, তুমি রাজার নিকট যত ধনের প্রত্যাশা কর, আমি তদপেক্ষা অধিক দিতেছি, লইয়া নিবৃত্ত হও। কাশ্যপ তক্ষকের এই বাক্য শ্রবণ করিয়া অভিলানুরূপ অর্থ গ্রহণ পূর্ব্বক স্বস্থানে প্রস্থান করিলেন। এই রূপে সেই ব্রাহ্মণ নিবৃত্ত হইলে, তক্ষক ছদ্ম বেশে আপনকার পিতার নিকট আসিয়া স্বীয় দুর্বিষহ বিষছুি দ্বারা তাঁহাকে ভস্মসাৎ করিল। তদনন্তর আপনি রাজ্যে অভিষিক্ত হইয়াছেন। মহারাজ! এই ভয়ঙ্কর ব্যাপার আমরা যেরূপ দেখিয়াছিলাম ও শুনিয়াছিলাম, অবিকল বর্ণন করিলাম, এক্ষণে নিজ পিতার ও মহর্ষি উতঙ্কের পরাভব বিবেচনা করিয়া যাহা কর্ত্তব্য হয়, করুন।

 রাজা জনমেজয়, পিতৃপরাভববৃত্তান্ত শ্রবণ করিয়া অমাত্যদিগকে জিজ্ঞাসা করিলেন, তক্ষক যে বৃক্ষকে ভস্মসাৎ করিয়াছিল, এবং কাশ্যপ যে সেই ভস্মীভূত বৃক্ষকে পুনর্জীবিত করিয়াছিলেন, এই অদ্ভুত বৃত্তান্ত তোমরা কাহার নিকট শুনিয়াছিলে? বোধ করি, সর্পকুলাধম তক্ষক এই বিবেচনা করিয়াছিল, কাশ্যপ মন্ত্রবলে রাজার প্রাণরক্ষা করিবেক, সন্দেহ। নাই। আমি দংশন করিলে যদি এ ব্রাহ্মণ রাজাকে বাঁচায়, তাহা হইলে আমাকে লোকে উপহাস্পদ হইতে হইবে। এই ভাবিয়াই সে ব্রাহ্মণকে তুষ্ট করিয়া বিদায় করিয়াছিল।সে যাহা হউক, আমি এক্ষণে তাহাকে সমুচিত প্রতিফল দিব। কিন্তু একটি কথা জিজ্ঞাসা করি, তক্ষক ও কাশ্যপের বৃত্তান্ত নির্জন বনে ঘটিয়াছিল, তাহা কে বা দেখিল, কে বা শুনিল, তোমরাই বা কি রূপে অবগত হইলে বল, সবিশেষ শুনিয়া সর্পকুলনিপাতের উপায় বিধান করিব। মন্ত্রিগণ কহিলেন, মহারাজ! তক্ষক ও কাশ্যপের বৃত্তান্ত যে রূপে যে ব্যক্তি আমাদিগকে কহিয়াছিল, তাহা শ্রবণ করুন। কোনও ব্যক্তি কাষ্ঠ অহরণ নিমিত্ত পূর্ব্বেই সেই বৃক্ষে আরোহণ করিয়াছিল। তক্ষক ও কাশ্যপ উভয়েই তাহা জানিতে পারেন নাই। ঐ ব্যক্তি সেই বৃক্ষের সহিতই ভস্মীভূত হয়, ও সেই বৃক্ষের সহিতই পুনর্জীবিত হয়। সেই আসিয়া আমাদিগকে এই অদ্ভুত বিষয়ের সংবাদ দেয়। মহারাজ! যথাদৃষ্ট যপাত সমুদায় নিবেদন করিলাম, এক্ষণে সাহা বিহিত হয়, করুন।

 এইরূপ মন্ত্রিবাক্য শ্রবণে কাজ। জনমেজয়, রোষরসে কলুষিত হইয়া, করে করে পরিপেষণ এবং মুহুর্মুহুঃ দীর্ঘ নিশ্বাস ও অশ্রুধাৱা পরিত্যাগ করিতে লাগিলেন। পরে অশ্রু নিবারণ ও যথাবিধি উদক স্পর্শ করিয়া তামর্ষভারে কিয়ৎ ক্ষণ মৌনভাবে চিন্তা করিলেন, অনন্তর মনে মনে, কর্ত্তব্য নির্ধারণ করিয়া মন্ত্রিগণকে কহিলেন, আমি তোমাদিগের নিকট পিতার পরলোক প্রাপ্তি বৃত্তান্ত শ্রবণ করিয়া যে কর্ত্তব্য স্থির করিয়াছি, তাহা শ্রবণ কর। আমার মত এই, যে দুরাত্মা তক্ষক শৃঙ্গীকে হেতুমাত্র করিয়া পিতার প্রাণহিংসা করিয়াছে, তাহাকে সমুচিত প্রতিফল দেওয়া কর্তব্য। যদি কাশ্যপ অসিতেন, পিতা অবশ্যই জীবন পাইতেন; কিন্তু তক্ষকের এমনই দুরাত্মতা যে, তাহাকে অর্থ দিয়া নিবৃত্ত করিল। যদিই পিতা কাশ্যপের প্রসাদে ও মন্ত্রিগণের মন্ত্রণাবলে জীবন পাইতেন, তাহাতে তাহার কি হানি হইত? কিন্তু কাশ্যপ আসিয়া পাছে রাজাকে জীবন দেন, এই আশঙ্কায় সেই দুরাত্মা অর্থদান দ্বারা বশীভূত করিয়া তাহাকে নিবৃত্ত করিয়াছে। এ অত্যন্ত অসহ্য অত্যাচার। অতএব আমি, আমার নিজের, উতঙ্কের ও তোমাদের সকলের মনোরথ সম্পাদনের নিমিত্ত পিতার বৈরনির্যাতন করিব।