মহাভারত (উপক্রমণিকাভাগ)/প্রথম অধ্যায়
মহাভারত
আদিপর্ব্ব।
প্রথম অধ্যায়—অনুক্রমণিকা।
নারায়ণ, সর্ব্বনরোত্তম নর,[১] এবং সরস্বতী দেবীকে প্রণাম করিয়া জয়[২] উচ্চারণ করিবেক।
কুলপতি[৩] শৌনক নৈমিষারণ্যে[৪] দ্বাদশ বার্ষিক যজ্ঞের অনুষ্ঠান করিয়াছিলেন। ঐ সময়ে এক দিবস ব্রতপরায়ণ মহর্ষিগণ দৈনন্দিন কর্ম্মাবসানে একত্র সমাগত হইয়া কথাপ্রসঙ্গে
কালযাপন করিতেছেন, এমন সময়ে সূতকুলপ্রসূত[৫] লোমহর্ষণতনয়[৬] পৌরাণিক[৭] উগ্রশ্রবাঃ বিনীত ভাবে তাঁহাদের সম্মুখে উপস্থিত হইলেন। নৈমিষারণ্যবাসী তপস্বিগণ, দর্শনমাত্র অদ্ভুত কথা শ্রবণবাসনাপরবশ হইয়া, তাঁহাকে বেষ্টন করিয়া চতুর্দ্দিকে দণ্ডায়মান হইলেন। উগ্রশ্রবাঃ বিনয়ন ও কৃতাঞ্জলি হইয়া অভিবাদন পূর্ব্বক সেই সমস্ত মুনিদিগকে তপস্যার কুশল জিজ্ঞাসা করিলেন। তাঁহারাও যথোচিত অতিথিসৎকারান্তে বসিতে আসন প্রদান করিলেন। পরে সমুদয় ঋষিগণ স্ব স্ব আসনে উপবিষ্ট হইলে তিনিও নির্দ্দিষ্ট আসনে উপবিষ্ট হইলেন। অনন্তর, তাঁহার শ্রান্তি দূর হইলে, কোন ঋষি কথা প্রসঙ্গ করিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, হে পদ্মপলাশলোচন সূতনন্দন। তুমি এক্ষণে কোথা হইতে আসিতেছ, এবং এত কাল কোথায় কোথায় ভ্রমণ করিলে বল।
এই রূপে জিজ্ঞাসিত হইয়া বাগ্মী উগ্রশ্রবাঃ সেই সভাস্থ প্রশান্তচিত্ত মুনিগণকে সম্ভাষণ করিয়া যথানিয়মে পরিশুদ্ধ বচনে এই উত্তর দিলেন, হে মহর্ষিগণ! প্রথমতঃ মহানুভাব রাজাধিরাজ জনমেজয়ের সর্পস[৮] দর্শনে গমন করিয়াছিলাম। তথায় বৈশম্পায়নমুখে কৃষ্ণদ্বৈপায়নোক্ত[৯] মহাভারতীয় পরমপবিত্র বিবিধ অদ্ভুত কথা শ্রবণ করিলাম। অনন্তর, তথা হইতে প্রস্থান করিয়া, নানা তীর্থ পরিভ্রমণ ও অশেষ আশ্রম দর্শন পূর্ব্বক, বহুব্রাহ্মণসমাকীর্ণ সমন্ত পঞ্চক তীর্থে উপস্থিত হইলাম। ঐ সমন্ত পঞ্চকে পূর্ব্বে পাণ্ডব ও কৌরব এবং উভয়পক্ষীয় নরপতি গণের যুদ্ধ হইয়াছিল। তথা হইতে, মহাশয়দিগের দর্শনাকাঙ্ক্ষী হইয়া, এই পরমপবিত্র আশ্রমে উপনীত হইয়াছি। আপনারা আমাদিগের ব্রহ্মস্বরূপ। হে তেজঃপুঞ্জ মহভাগ ঋষিগণ! আপনারা স্নান অহিক অগ্নিহোত্রাদি দ্বারা পূত হইয়া সুস্থ মনে আসনে উপবিষ্ট হইয়াছেন, আজ্ঞা করুন, ধর্ম্মার্থসম্বদ্ধ পরমপবিত্র পৌরাণিকী কথা, অথবা মহানুভাব নরপতিগণ ও ঋষিগণের ইতিহাস, কি বর্ণনা করিব?
ঋষিগণ কহিলেন, হে সূতনন্দন! ভগবান্ ব্যাসদেব যে ইতিহাস কীর্ত্তন করিয়াছেন, সুরগণ ও ব্রহ্মর্ষিমণ্ডল যাহা শ্রবণ করিয়া প্রীত মনে বহু প্রশংসা করেন, এবং দ্বৈপায়নশিষ মহর্ষি বৈশম্পায়ন তদীয় আদেশানুসারে সর্পসত্রসময়ে রাজা জনামেজয়কে যাহা শ্রবণ করাইয়াছিলেন, আমরা সেই ভারতখ্য পরমপবিত্র বিচিত্র ইতিহাস শ্রবণে বাসনা করি। ভারত বেদচতুষ্টয়ের সার সমাকর্ষণ পূর্বক সঙ্কলিত এবং শাস্ত্রাস্তারের সহিত অবিরুদ্ধ; ভারতে অনির্বচনীয় অতর্কীয় আত্মতাদি বিষয়ের সবিশেষ মীমাংসা আছে; ভাৱত পাঠ ও শ্রবণ করিলে পাপভয় নিবারণ হয়।
ঋষিগণের প্রার্থনা শুনিয়া উগ্রশ্রবাঃ কহিলেন, যিনি নিখিল জগতের আদিভূত, যিনি অখণ্ড ব্রহ্মাণ্ডমণ্ডলের অদ্বিতীয় অধীশ্বর, যিনি স্বীয় অনন্তশক্তিপ্রভাবে স্কুল, সূক্ষম, স্থাবর, জঙ্গম, নিখিল পদার্থ সৃষ্টি করিয়াছেন, যাজ্ঞিক পুরুষেরা যে অনাদি পুরুষের প্রীতি উদ্দেশে হুতাশনমুখে আহুতি প্রদান করেন, শত শত সামগ ব্রাহ্মণ যাহার গুণ গান করিয়া থাকেন, এই প্রত্যক্ষ পরিদৃশ্যমান মায়া প্রপঞ্চরূপ অতাত্ত্বিক বিশ্ব যাঁহার বিরাটমূর্ত্তি, লোকে ভোগাভিলাষে ও পরম পুরুষার্থ মুক্তি পদার্থ প্রার্থনায় যাহার উপাসনা করিয়া থাকে, সেই অনাদি, অনন্ত, অব্যক্ত, কালয়ে অবিকৃত, সকল মঙ্গল নিদানভূত, মঙ্গলমূর্তি, ত্রিলোকপাতা, যজ্ঞফলদাতা, চরাচরগুরু হরির চরণারবিন্দ বন্দনা করিয়া সৰ্বলোকপূজিত মহর্ষি বেদব্যাসের অশেষ মত নিঃশেষে কীর্ত্তন করিব।
অনেকানেক অতীতদশী মহাশয়ের নরলোকে এই বিচিত্র ইতিহাস কীর্ত্তন করিয়া গিয়াছেন, বর্তমান কালে অনেকে কীর্ত্তন করিতেছেন, এবং উত্তর কালেও অনেকে কীর্ত্তন করিবেন। দ্বিজাতিরা দৃঢ়ত হইয়া সংক্ষেপে ও বাহুল্যে যাহা অধ্যয়ন করিয়া থাকেন, সেই সর্ব্বজ্ঞানের অদ্বিতীয় আকর বেদশাস্ত্র এই পরম পবিত্র ইতিহাস রূপে আবির্ভূত। এই বিচিত্র গ্রন্থ অশেষবিধ শাস্ত্রীয় ও লৌকিক সময়ে[১০] বহুতর মনোহর শব্দে ও নানা ছন্দে অলঙ্কত, এই নিমিত্ত পণ্ডিতমণ্ডলীতে সবিশেষ আদরণীয় হইয়াছে।
প্রথমে এই জগৎ ঘোতর অন্ধকারে আবৃত হইয়া একান্ত অলক্ষিত ছিল। অনন্তর সৃষ্টিপ্রারম্ভে সকলব্রহ্মাণ্ডবীজভূত এক অলৌকিক অণ্ড প্রসূত হইল। নিরাকার, নির্বিকার, অচিন্তনীয়, অনির্বচনীয়, সৰ্বত্রসম, সনাতন, জ্যোতির্ময় ব্রহ্ম সেই অণ্ডে প্রবিষ্ট হইলেন। সর্বলোকপিতামহ[১১] দেবগুরু ব্রহ্মা তাহাতে জন্ম গ্রহণ করিলেন।
তদনন্তর রুদ্র, স্বায়ম্ভুব মনু, প্রাচেতস, দক্ষ, দক্ষের সপ্ত পু, ও একবিংশতি প্রজাপতি উৎপন্ন হইলেন। সঁহাকে সমস্ত ঋষিগণ যোগদৃষ্টিতে দর্শন করেন, সেই অপ্রমেয় পুরুষ, বিশ্বদেবগণ, একাদশ আদিত্য, অষ্ট বসু, যমজ, অশ্বিনীকুমারযুগল, যক্ষগণ, সাধ্যগণ, পিশাচগণ, গুহ্যগণ, ও পিতৃগণ জন্মিলেন। তদনন্তর ব্রহ্মপরায়ণ ব্রহ্মর্ষিগণ ও সর্বগুণসম্পন্ন অনেকানেক রাজর্ষিগণ উৎপন্ন হইলেন। আর জল, বায়ু, পৃথিবী, আকাশ, চন্দ্র, সূর্য্য, সংবৎসর, ঋতু, মাস, পক্ষ, দিন, রাত্রি, ও বিশ্বান্তগত অন্যান্য যাবতীয় পদার্থ সৃষ্ট হইল।
এই প্রত্যক্ষ স্থাবরজঙ্গমাত্মক জগৎ প্রলয়কালে পুনর্বার স্বাধিষ্ঠানভূত পরব্রহ্মে লীন হইয়া যায়। যেমন পর্যায়কাল উপস্থিত হইলে ঋতুগণ স্ব স্ব অসাধারণ লক্ষণ সকল প্রাপ্ত হয়, সেইরূপ যুগপ্রান্তে সমুদায় পদার্থ স্ব স্ব নাম, রূপ, ও স্বভাব প্রাপ্ত হইয়া থাকে। অনাদি, অনন্ত, সর্ব্বভূতসংহারকারী সংসারচক্র এই রূপে পরিভ্রমণ করিতেছে।
ত্রয়স্ত্রিংশৎ সহস্র, ত্রয়স্ত্রিংশৎ শত, ত্রয়স্ত্রিংশৎ দেবতা সংক্ষেপে সৃষ্ট হইলেন[১২]। আর বৃহদ্ভানু, চক্ষু, আত্মা, বিভাবসু, সবিতা, ঋচীক, অর্ক, ভানু, আশাবহ, রবি, ও মহ্য, দিবের[১৩] এই একাদশ পুত্র জন্মিলেন। সর্ব্ববকনিষ্ঠ মহ্যের পুত্র দেবভ্রাজ, তৎপুত্র সুভ্রাজ। সুভ্রাজের দশজ্যোতিঃ, শতজ্যোতিঃ, সহস্রজ্যোতিঃ নামে তিন পুত্র হইলেন। দশজ্যোতির দশ সহস্র পুত্র, শতজ্যোতির লক্ষ পুত্র, ও সহস্র জ্যোতির দশ লক্ষ পুত্র হইল। ইহাদিগের হইতেই কুরুবংশ, যদুবংশ, ভরতবংশ, যযাতিবংশ, ইক্ষাকুবংশ, ও অন্যান্য রাজর্ষি বংশের উদ্ভব হইল।
মহর্ষি বেদব্যাস যোগবলে প্রাণীদিগের অবস্থিতি স্থান[১৪], ত্রিবিধ রহস্য[১৫], বেদ, যোগশাস্ত্র, বিজ্ঞানশাস্ত্র, ধর্ম, অর্থ, কাম, ও তৎপ্রতিপাদক বিবিধ শাস্ত্র, লোকযাত্রাবিপ্নান,[১৬] এতৎ সমুদায় অবগত ছিলেন। এই ভারত গ্রন্থে ব্যাখ্যা সহিত সমস্ত ইতিহাস ও অশেযবিধ বেদার্থ যথাক্রমে কথিত হইয়াছে। লোকে কেহ কেহ সংক্ষেপে কেহ কেহ বা বাহুল্যে জানিতে বাসনা করে, এই নিমিত্ত মহর্ষি এই জ্ঞানশস্ত্রকে সংক্ষেপে ও বাহুল্যে কহিয়াছেন। কোনও কোনও ব্রাহ্মণেরা প্রথম মন্ত্র[১৭] অবধি, কেহ কেহ আস্তীকপ অবধি, কেহ কেহ বা উপরিচর রাজার উপাখ্যান অবধি, এই ভারতের আরও বিবেচনা করিয়া অধ্যয়ন করেন। মনীষিগণ অশেষ প্রকারে এই পবিত্র সংহিতার ভাবার্থ প্রকাশ করিয়া থাকেন। কেহ কেহ হ্রন্থব্যাখ্যা বিষয়ে পটু, কেহ কেহ বা গ্রন্থার্থধারণা বিষয়ে নিপুণ।
ভগবান্ সত্যবতীনন্দন, তপস্যা ও ব্রহ্মচর্য প্রভাবে সনাতন বেদশাস্ত্র বিভাগ করিয়া, তদীয় সরসঙ্কলন পূর্বক মনে মনে এই পরমাদ্ভূত পবিত্র ইতিহাস রচনা করিয়াছিলেন। রচনানন্তর মনে মনে চিন্তা করিতে লাগিলেন, কি রূপে এই গ্রন্থ শিষ্যগণকে অধ্যয়ন করাইব। ভূতভাবন ভগবান্ হিরণ্যগর্ব্ভ, পরাশরতনয়ের উৎকণ্ঠার বিষয় অবগত হইয়া, তাঁহাকে ও নরলোককে চরিতার্থ করিবার অভিপ্রায়ে স্বয়ং তৎসমীপে উপস্থিত হইলেন। ব্যাসদেব দর্শনমাত্র গাত্রোত্থান করিয়া কৃতার্থম্মন্য ও বিস্ময়াবিষ্ট চিত্তে সাষ্টাঙ্গ প্রণিপাত করিলেন, এবং স্বহস্তদত্ত আসনে উপবেশন করাইয়া অঞ্জলিবন্ধ পূর্ব্বক সম্মুখে দণ্ডায়মান রহিলেন। অনন্তর ব্রহ্মা তাঁহাকে অসিনপরিগ্রহের অনুমতি প্রদান করিলে তিনি প্রীতি প্রফুল্ল নয়নে তদীয় আসনসন্নিধানে উপবিষ্ট হইয়া বিনয়বচনে নিবেদন করিলেন, ভগবন্! আমি মনে মনে এক পরম পবিত্র কাব্য রচনা করিয়াছি, তাহাতে বেদ বেদাঙ্গ ও উপনিষদ্ সমুদায়ের ব্যাখ্যা, ইতিহাস ও পুরাণের অর্থ সমর্থন, ভূত ভবিষ্যৎ বর্ত্তমান কালত্রয়ের নির্ণয়, জরা মৃত্যু ভয় ব্যাধি ভাব অভাব নিরূপণ, নানাবিধ ধর্ম্ম ও আশ্রমের লক্ষণ নির্দ্দেশ, চাতুর্ব্বণ্য মীমাংসা, পৃথিবী চন্দ্র সূর্য্য গ্রহ নক্ষত্র ও চতুর্যুগের বিবরণ, নারায়ণ যে যে কারণে যে যে দিব্য ও মানব যোনিতে জন্ম গ্রহণ করিয়াছেন তাহার কীর্ত্তন, এবং অশেষ পবিত্র তীর্থ, নানা দেশ, নদ, নদী, বন, পর্ব্বত, সাগর, গ্রাম, নগর, দুর্গ, সেনা, ব্যুহরচনা, যুদ্ধকৌশল, বক্ত্তৃবিশেষে কথনবৈচিত্র্য, লোকযাত্রা-বিধান, এই সমস্ত ও অপরাপর যাবতীয় বিষয়ের সবিশেষ নিরূপণ করিয়াছি, কিন্তু ভূতলে তদুপযুক্ত লেখক দেখিতেছি না।
ব্রহ্মা কহিলেন, বৎস! এই ভূমণ্ডলে অনেকানেক মহা-প্রভাব ঋষি আছেন, কিন্তু রহস্যজ্ঞানশালিতা প্রযুক্ত তুমি সর্ব্বোৎকৃষ্ট। জন্মাবধি তুমি কখনও বিতথ বাক্য উচ্চারণ কর নাই; এক্ষণে তুমি স্বরচিত গ্রন্থকে কাব্য বলিয়া নির্দ্দেশ করিলে, অতএব তোমার এই গ্রন্থ কাব্য বলিয়া বিখ্যাত হইবেক। যেমন গৃহস্থাশ্রম অন্যান্য সমস্ত আশ্রম অপেক্ষা উৎকৃষ্ট, সেইরূপ তোমার এই কাব্য অন্যান্য যাবতীয় কবির কাব্য অপেক্ষা উৎকৃষ্ট। এক্ষণে তুমি গণেশকে স্মরণ কর, তিনি তোমার কাব্যের লেখক হইবেন।
ইহা বলিয়া ব্রহ্মা স্বস্থানে প্রস্থান করিলে সত্যবতীতনয় গণপতিকে স্মরণ করিলেন। ভক্তবৎসল ভগবান্ গণনায়ক স্মৃতমাত্র ব্যাসদেবসন্নিধানে উপস্থিত হইলেন। অনন্তর তিনি যথোপযুক্ত পূজা প্রাপ্তি পূর্ব্বক আসন পরিগ্রহ করিলে বেদব্যাস নিবেদন করিলেন, হে গণেশ্বর! আমি মনে মনে ভারত নামে এক গ্রন্থ রচনা করিয়াছি, আমি বলিয়া যাই, আপনি লিখিয়া যান। ইহা শুনিয়া বিঘ্নরাজ কহিলেন, হে তপোধন! লিখিতে আরম্ভ করিলে যদি আমার লেখনীকে বিশ্রাম করিতে না হয়, তবে আমি লেখক হইতে পারি। ব্যাসও কহিলেন, কিন্তু আপনিও অর্থগ্রহ না করিয়া লিখিতে পারিবেন না। গণনায়ক তথাস্তু বলিয়া লেখক অঙ্গীকার করিলেন। মহর্ষি দ্বৈপায়ন এই নিমিত্তই কৌতুক করিয়া মধ্যে মধ্যে দুরূহ গ্রন্থগ্রন্থি রচনা করিয়াছেন, এবং প্রতিজ্ঞা করিয়া কহিয়াছেন, এই গ্রন্থে এরূপ অষ্ট সহস্র অষ্ট শত শ্লোক আছে যে, কেবল শুক ও আমি তাহার অর্থ বুঝিতে পারি; অপরের কথা দূরে থাকুক, সঞ্জয় বুঝিতে পারেন কি না সন্দেহ। অস্ফুটার্থতা প্রযুক্ত সেই সকল ব্যাসকূটের অদ্যাপি কেহ ব্যাখ্যা করিতে পারেন না। গণেশ সর্বজ্ঞ হইয়াও সেই সকল স্থলে অর্থবোধানুরোধে মন্থর হইতেন, ব্যাসদেব সেই অবকাশে বহুতর শ্লোক রচনা করিতেন।
জীবলোক অজ্ঞানতিমিরে অভিভূত হইয়া ইতস্ততঃ অনর্থ ভ্রমণ করিতেছিল, এই মহাভারত জ্ঞানাঞ্জনশলাকা দ্বারা মোহাবরণ নিরাকরণ করিয়া তাহাদের নেত্রোন্মীলন করিয়াছেন। এই ভারতরূপ দিবাকর সংক্ষেপে ও বাহুল্যে ধর্ম্ম অর্থ কাম মোক্ষ রূপ বিষয় সকল প্রকাশ ও মানবগণের মোহান্ধকার নিরাস করিয়াছেন। পুরাণরূপ পূর্ণচন্দ্রের উদয় দ্বারা বেদার্থরূপ জ্যোৎস্না প্রকাশিত হইয়াছে, এবং মনুষ্যের বুদ্ধিরূপা কুমুদ্বতী বিকাশ পাইয়াছে। এই ইতিহাসরূপ মহোজ্জ্বল প্রদীপ মোহান্ধকার নিরাকরণ পূর্ব্বক সংসাররূপ মহাগৃহ আলোকময় করিয়াছে। যেমন জলধর সকল জীবের উপজীব্য, সেইরূপ এই অক্ষয় ভারতবৃক্ষ ভবিষ্য কবিদিগের উপজীব্য হইবেক। সংগ্রহাধ্যায় এই মহাদ্রুমের বীজ, পৌলোম ও আস্তীকপর্ব্ব মূল, সম্ভবপর্ব্ব স্কন্ধ[১৮], সভা ও বনপর্ব্ব বিটঙ্ক[১৯], অরণ্যপর্ব্ব পর্ব্ব[২০], বিরাট ও উদ্যোগপর্ব্ব সার, ভীষ্মপর্ব্ব মহাশাখা, দ্রোণপর্ব্ব পত্র, কর্ণপর্ব্ব পুষ্প, শল্যপর্ব্ব সৌরভ, স্ত্রীপর্ব্ব ও ঐষীকপর্ব্ব ছায়া, শান্তিপর্ব্ব মহাফল, অশ্বমেধপর্ব্ব অমৃতরস, আশ্রমবাসিকপর্ব্ব অধারস্থান, আর মৌসলপর্ব্ব অত্যুচ্চ শাখান্তভাগ। এই নিরুক্ত ভারতদ্রুমের পরমপবিত্র সুরস ফল পুষ্প বর্ণনা করিব।
পূর্ব্ব কালে ভগবান্ কৃষ্ণদ্বৈপায়ন, স্বীয় জননী সত্যবতী ও পরমধার্ম্মিক ধীরবুদ্ধি ভীষ্মদেবের নিয়োগানুসারে, বিচিত্রবীর্যের ক্ষেত্রে অগ্নিত্রয়তুল্য[২১] তেজস্বী পুত্রত্রয় উৎপাদন করিয়াছিলেন। মহর্ষি ধৃতরাষ্ট্র, পাণ্ডু, ও বিদুরকে জন্ম দিয়া তপস্যানুরোধে পুনর্ব্বার আশ্রমপ্রবেশ করিলেন। অনন্তর তাঁহারা বৃদ্ধ হইয়া পরম গতি প্রাপ্ত হইলে তিনি নরলোকে ভারত প্রচার করিলেন। পরে সর্পসত্রকালে স্বয়ং রাজা জনমেজয় ও সহস্র সহস্র ব্রাহ্মণ ভারতশ্রবণার্থে ঔৎসুক্য ও আগ্রহাতিশয় প্রকাশ করাতে, সশিষ্য বৈশম্পায়নকে ভারত কীর্ত্তনের আদেশ প্রদান করিলেন। বৈশম্পায়ন সদস্যমণ্ডলমধ্যবর্ত্তী হইয়া দৈনন্দিন কর্ম্মাবসানে ভারত শ্রবণ করাইতে আরম্ভ করিলেন।
মহর্সি বেদব্যাস ভারতে কুরুবংশের বৃত্তান্ত, গান্ধারীর ধর্ম্মশীলতা, বিদুরের প্রজ্ঞা, কুন্তীর ধৈর্য্য, বাসুদেবের মাহাত্ম্য, পাণ্ডবদিগের সাধুতা, ধার্ত্তরাষ্ট্রদিগের দুর্ব্বৃত্ততা, এই সকল বিষয় বর্ণন করিয়াছেন। প্রথমতঃ তিনি ভারতসংহিতাকে চতুর্বিংশতিসহস্ৰশ্লোকময়ী রচনা করিয়াছিলেন। উপাখ্যানভাগ পরিত্যাগ করিলে ভারতের সংখ্যা ঐরূপ হয়। অনন্তর সংক্ষেপে সর্ব্বার্থসঙ্কলন পূর্ব্বক সার্দ্ধশত শ্লোক দ্বারা অনুক্রমণিকা রচনা করিলেন।
ব্যাসদেব ভারত রচনা করিয়া সর্ব্বাগ্রে আপন পুত্র শুকদেবকে, তৎপরে শুশ্রূষাপরায়ণ অন্যান্য বুদ্ধিজীবী শিষ্যদিগকে, অধ্যয়ন করাইলেন। অনন্তর ষষ্টিলক্ষশ্লোকময়ী ভারতসংহিতা রচনা করিলেন। তন্মধ্যে দেবলোকে ত্রিংশৎ, পিতৃলোকে পঞ্চদশ, গন্ধর্ব্বলোকে চতুর্দ্দশ, আর নরলোকে এক লক্ষ শ্লোক প্রতিষ্ঠিত আছে। নারদ দেবতাদিগকে, অসিত দেবল পিতৃগণকে, শুকদেব গন্ধর্ব্ব, যক্ষ, ও রাক্ষসদিগকে শ্রবণ করান, আর ব্যাসশিষ্য বৈশম্পায়ন নরলোকে প্রচার করেন। তিনিই পরীক্ষিৎপুত্র রাজাধিরাজ জনমেজয়কে শ্রবণ করান। ইঁহারা সকলেই পৃথক্ পৃথক্ সংহিতা কীর্ত্তন করিয়াছিলেন। আমি এক্ষণে নরলোক-প্রতিষ্ঠিত শতসহস্ৰশ্লোকময়ী সংহিতা কীর্ত্তন আরম্ভ করিতেছি, আপনারা শ্রবণ করুন। দুর্য্যোধন অধর্ম্মময় মহাবৃক্ষ, কর্ণ তাহার স্কন্ধ, শকুনি শাখা, দুঃশাসন পুষ্প ও ফল, রাজা ধৃতরাষ্ট্র তাহার মূল। যুধিষ্ঠির ধর্ম্মময় মহাবৃক্ষ, অর্জ্জুন তাহার স্কন্ধ, ভীমসেন শাখা, মাদ্রীপুত্র নকুল সহদেব পুষ্প ও ফল, কৃষ্ণ বেদ ও ব্রাহ্মণগণ তাহার মূল। যুধিষ্ঠিরের চরিতকীর্ত্তনে ধর্ম্মবৃদ্ধি, ভীমসেনের চরিতকীর্ত্তনে পাপপ্রণাশ, ও অর্জ্জুনের চরিত্রকীর্ত্তনে শৌর্য্যবৃদ্ধি হয়, আর নকুল সহদেবের চরিত্রকীর্ত্তনে রোগের সম্ভাবনা থাকে না।
রাজা পাণ্ডু, বুদ্ধিবলে ও বিক্রমপ্রভাবে নানা দেশ জয় করিয়া, পরিশেষে মৃগয়ানুরাগপরবশ হইয়া ঋষিগণের সহিত অরণ্যে বাস করিতে লাগিলেন। তিনি দৈবদুর্বিপাকবশতঃ সম্ভোগাসক্ত মৃগ বধ করিয়া ঘোরতর আপদে[২২] পতিত হইয়াছিলেন। তথাপি শাস্ত্রবিধানানুসারে ধর্ম্ম, বায়ু, ইন্দ্র, ও অশ্বিনীকুমারযুগলের সমাগম দ্বারা পাণ্ডবদিগের জন্মলাভ ও সদাচরাভ্যাসাদি যাবতীয় ব্যাপার সম্পন্ন হইল। কুন্তী ও মাদ্রী পরম পবিত্র অরণ্যে ঋষিদিগের আশ্রমে তাহাদিগের লালন পালন করিতে লাগিলেন।
কিছু কাল পরে, ঋষিগণ সেই ব্রহ্মচারিবেশ, অশেষশাস্ত্রজ্ঞ, সর্ব্বগুসম্পন্ন রাজকুমারদিগকে রাজধানীতে ধৃতরাষ্ট্রাদ্রির নিকট আনয়ন করিলেন, এবং, ইঁহারা পাণ্ডুর পুত্র, তোমাদিগের পুত্র, ভ্রাতা, শিষ্য, ও সুহৃদ, এই বলিয়া পরিচয় দিয়া প্রস্থান করিলেন। ইহা শুনিয়া সমুদায় কৌরব ও সুশীল ধর্ম্মপরায়ণ পুরবাসিগণ কোলাহল করিতে লাগিলেন। কেহ কেহ কহিল, ইহারা তাঁহার পুত্র নহে, কেহ কেহ বলিল, তাঁহারই বটে; কেহ কেহ কহিল, বহু কাল হইল পাণ্ডুর মৃত্যু হইয়াছে, তাঁহার কি রূপে সম্ভতি হইতে পারে। অনন্তর সর্ব্বত্র এই বাক্য শ্রুত হইতে লাগিল, অদ্য আমরা ভাগ্যক্রমে পাণ্ডুর সস্ততি দেখিলাম; হে পাণ্ডবগণ! তোমরা কুশলে আসিয়াছ? তাঁহারা কহিলেন, আমরা কুশলে আসিয়াছি। অনন্তর কোলাহল নিবৃত্ত হইলে, মহাশব্দে আকাশবাণী হইল, এবং পুষ্পবৃষ্টি, সৌরভসঞ্চার, ও শঙ্খদুন্দুভিধ্বনি হইতে লাগিল। পাণ্ডুপুত্রেরা নগর প্রবেশ করিলে এই সকল অদ্ভুত ব্যাপার ঘটিয়াছিল। উক্ত সমস্ত ব্যাপার দর্শনে হর্ষ প্রাপ্ত হইয়া পৌরগণ আহ্লাদে কোলাহল করিতে লাগিল।
পাণ্ডবেরা নিখিল বেদ ও বিবিধ শাস্ত্র অধ্যয়ন করিয়া পরমাদরে ও অকুতোভয়ে বাস করিতে লাগিলেন। সমুদায় লোক যুধিষ্ঠিরের সদাচার, ভীমের ধৈর্য্য, অর্জ্জুনের বিক্রম, এবং নকুল সহদেবের গুরুভক্তি, ক্ষমা, ও বিনয় দর্শনে পরম পরিতোষ প্রাপ্ত হইয়াছিল। অনন্তর অর্জ্জুন সমাগত রাজগণ সমক্ষে দুরূহ কর্ম্ম সম্পন্ন করিয়া স্বয়ংবরা কন্যা আনয়ন করিলেন। তদবধি তিনি ভূমণ্ডলে সকল শস্ত্রবেত্তার পূজ্য হইলেন, এবং সমরকালে প্রদীপ্ত দিবাকরের ন্যায় দুর্নিরীক্ষ্য হইয়া উঠিলেন। তিনি পৃথক পৃথক ও সমবেত সমুদায় নৃপতিদিগকে পরাজিত করিয়া রাজা যুধিষ্ঠিরের রাজসূয় মহাযজ্ঞ আহরণ করেন। যুধিষ্ঠির, বাসুদেবের পরামর্শে এবং ভীম ও অর্জ্জুনের বাহুবলে, বলগর্ব্বিত জরাসন্ধ ও শিশুপালের বধ সাধন করিয়া, অন্নদান দক্ষিণাপ্রদানাদি সর্বাঙ্গসম্পন্ন রাজসূয় মহাযজ্ঞ নির্ব্বিঘ্নে সমাপন করিলেন। নানা প্রদেশ হইতে পাণ্ডবদিগের নিকট মণি, কাঞ্চন, রত্ন, গো, হস্তী, অশ্ব, বিচিত্র বস্ত্র, শিবির, কম্বল, অজিন, জবনিকা, রঙ্কিব আস্তরণ[২৩], এই সমস্ত উপঢৌকন উপস্থিত হইতে লাগিল। পাণ্ডবদিগের তাদৃশ ঐশ্বর্য্য দর্শনে দুর্যোধনের অন্তঃকরণে অত্যন্ত ঈর্ষ্যা ও দ্বেষ উপস্থিত হইল। তিনি ময়দানবনির্ম্মিত পরমাশ্চর্য্য সভা দর্শন করিয়া অত্যন্ত পরিতাপ পাইলেন। সেই সভায় তিনি ভ্রমবশে[২৪] স্খলিতগতি হওয়াতে, ভীম কৃষ্ণের সমক্ষে তাঁহাকে গ্রাম্য লোকের ন্যায় উপহাস করিয়াছিলেন। দুর্য্যোধন অশেষবিধ ভোগসুখ ও নানারত্ন সম্পন্ন হইয়াও মনের অসুখে দিনে দিনে বিবর্ণ ও কৃশ হইতে লাগিলেন। পুত্রবৎসল ধৃতরাষ্ট্র পুত্রের মনঃপীড়ার বিষয় অবগত হইয়া দ্যূতক্রীড়ার অনুজ্ঞা দিলেন। তৎশ্রবণে কৃষ্ণ অত্যন্ত রুষ্ট ও অসন্তুষ্ট হইলেন, বিবাদভঞ্জনের চেষ্টা না পাইয়া বরং তদ্বিষয়ে অনুমোদন প্রদর্শন করিলেন, দ্যূত প্রভৃতি অশেষবিধ কুনীতিও সহ্য করিলেন। কারণ বিদুর, ভীষ্ম, দ্রোণ, ও কৃপাচার্য্যের অনভিমতে আরব্ধ সেই তুমুল যুদ্ধে ক্ষত্রিয়কুলধ্বংস হওয়া তাঁহার অভিপ্রেত ছিল।
ধৃতরাষ্ট্র পাণ্ডবদিগের জয়রূপ অপ্রিয় সংবাদ শ্রবণ এবং দুর্য্যোধন, কর্ণ, ও শকুনির প্রতিজ্ঞা[২৫] স্মরণ করিয়া বহু ক্ষণ চিন্তা পূর্ব্বক সঞ্জয়কে কহিলেন, সঞ্জয়! আমি তোমায় সমুদায় কহিতেছি, শ্রবণ কর; কিন্তু শুনিয়া আমারে অপ্রাজ্ঞ বিবেচনা করিও না। তুমি শাস্ত্রজ্ঞ, মেধাবী, বুদ্ধিমান, ও পরম প্রাজ্ঞ। আমি বিবাদেও সম্মত ছিলাম না, এবং কুলক্ষয়দর্শনেও প্রীত হই নাই। আমার স্বপুত্র ও পাণ্ডুপুত্রে বিশেষ ছিল না। পুত্রেরা সদা ক্রোধপরায়ণ, আমারে বৃদ্ধ বলিয়া অবজ্ঞা করিত; আমি অন্ধ, লঘুচিত্ততা প্রযুক্ত পুত্রস্নেহে সকলই সহ্য করিতাম; অচেতন দুর্য্যোধন মোহাভিভূত হইলে আমিও মোহাভিভূত হইতাম। সে রাজসূয় যজ্ঞে মহানুভাব যুধিষ্ঠিরের সমৃদ্ধি দেখিয়া, এবং সভাপ্রবেশকালে সেই রূপে উপহসিত হইয়া, অবমানিত বোধে ক্রোধে অন্ধ হইল; এবং ক্ষত্রিয়কুলে জন্ম গ্রহণ করিয়াও, যুদ্ধে পাণ্ডবদিগকে জয় করিতে অশক্ত ও রাজলক্ষ্মী আত্মসাৎ করিবার বিষয়ে হতোৎসাহ হইয়া, গান্ধাররাজের সহিত পরামর্শ করিয়া কপট দ্যুতক্রীড়ার মন্ত্রণা করিল। এই সকল বিষয়ে আমি আদ্যোপান্ত যাহা অবগত আছি, কহিতেছি শুন। তুমি আমার বুদ্ধিযুক্ত বাক্য সকল শ্রবণ করিয়া আমারে প্রজ্ঞাবান্ বলিয়া জানিতে পারিবে।
যখন শুনিলাম, অর্জ্জুন বিচিত্র শরাসন সমাকর্ষণ পূর্ব্বক লক্ষ্য বিদ্ধ ও ভূতলে পাতিত করিয়া, সমবেত রাজগণ সমক্ষে দ্রৌপদীরে হরণ করিয়া আনিয়াছে, তখন আর আমি জয়ের আশা করি নাই। যখন শুনিলাম, অর্জ্জুন দ্বারকাতে সুভদ্রারে বল পূর্ব্বক হরণ করিয়া বিবাহ করিয়াছে, অথচ বৃষ্ণিকুলাবতংস কৃষ্ণ বলরাম মিত্রভাবে ইন্দ্রপ্রস্থে আগমন করিয়াছেন, তখন আর আমি জয়ের আশা করি নাই। যখন শুনিলাম, দেবরাজ ভূরি পরিমাণে বারিবর্ষণ করিতে লাগিলেন, কিন্তু অর্জ্জুন দিব্য শরজাল দ্বারা সেই বারিবর্ষণ নিবারণ করিয়া খাণ্ডবদাহে অগ্নিকে পরিতৃপ্ত করিয়াছে, তখন আর আমি জয়ের আশা করি নাই। যখন শুনিলাম, পঞ্চ পাণ্ডব কুন্তীসহিত জতুগৃহ হইতে পরিত্রাণ পাইয়াছে, এবং মহাপ্রাজ্ঞ বিদুর তাহাদের ইষ্টসাধনে যত্নবান হইয়াছে, তখন আর আমি জয়ের আশা করি নাই। যখন শুনিলাম, অর্জুন রঙ্গক্ষেত্রে লক্ষ্য ভেদ করিয়া দ্রৌপদী লাভ করিয়াছে, এবং মহাপরাক্রান্ত পাঞ্চাল পাণ্ডব উভয় কুল একত্র হইয়াছে, তখন আর আমি জয়ের আশা করি নাই। যখন শুনিলাম, ভীমসেন বাহুবলে অতি তেজস্বী মগধেশ্বর জরাসন্ধের প্রাণবধ করিয়াছে, তখন আর আমি জয়ের আশা করি নাই। যখন শুনিলাম, পাণ্ডুতনয়েরা দিগ্বিজয়ে বিনির্গত হইয়া পরাক্রমপ্রভাবে সমস্ত ভূপতিদিগকে বশীভূত করিয়া রাজসূয় মহাযজ্ঞ সম্পন্ন করিয়াছে, তখন আর আমি জয়ের আশা করি নাই। যখন শুনিলাম, অশ্রুমুখী, অতিদুঃখিতা, একবস্ত্রা, রজস্বলা, সনাথা দ্রৌপদীকে অনাথার ন্যায় সভায় লইয়া গিয়াছে, তখন আর আমি জয়ের আশা করি নাই। যখন শুনিলাম, ধুর্ত্ত মন্দবুদ্ধি দুঃশাসন সভামধ্যে দ্রৌপদীর বস্ত্র আকর্ষণ করিয়াছে, অথচ বিনাশ প্রাপ্ত হয় নাই, তখন আর আমি জয়ের আশা করি নাই। যখন শুনিলাম, শকুনি পাশক্রীড়াতে যুধিষ্ঠিরকে পরাজিত করিয়া তাহার রাজ্যহরণ করিয়াছে, অথচ তাহার অপ্রমেয়প্রভাবশালী সহোদরেরা অনুগত আছে, তখন আর আমি জয়ের আশা করি নাই। যখন জ্যেষ্ঠভক্তিপরতন্ত্র প্রযুক্ত অশেষ ক্লেশসহিষ্ণু ধর্ম্মশীল পাণ্ডবদিগের বনপ্রস্থানকালে নানা চেষ্টা শ্রবণ করিলাম, তখন আর আমি জয়ের আশা করি নাই। যখন শুনিলাম, সহস্র সহস্র ভিক্ষাজীবী মহানুভাব স্নাতক ব্রাহ্মণ[২৬] বনবাসী যুধিষ্ঠিরের অনুগত হইয়াছেন, তখন আর আমি জয়ের আশা করি নাই। যখন শুনিলাম, অর্জ্জুন দেবাদিদেব কিরাতরূপী মহাদেবকে যুদ্ধে প্রসন্ন করিয়া পাশুপত মহাস্ত্র লাভ করিয়াছে, তখন আর আমি জয়ের আশা করি নাই। যখন শুনিলাম, সত্যসন্ধ ধনঞ্জয় স্বর্গে গিয়া দেবরাজের নিকট যথাবিধানে অস্ত্রশিক্ষা করিতেছে, তখন আর আমি জয়ের আশা করি নাই। যখন শুনিলাম, অর্জ্জুন বরদানগর্ব্বিত দেবতাদিগের অজেয় পুলোমপুত্র কালকেয়দিগকে[২৭] পরাজিত করিয়াছে, তখন আর আমি জয়ের আশা করি নাই। যখন শুনিলাম, শত্রুঘাতী অর্জ্জুন অসুরবধার্থে ইন্দ্রলোক গমন করিয়া কৃতকার্য্য হইয়া প্রত্যাগমন করিয়াছে, তখন আর আমি জয়ের আশা করি নাই। যখন শুনিলাম, ভীম ও অন্যান্য পাণ্ডবেরা সেই মানুষের অগম্য দেশে কুবেরের সহিত সমাগত হইয়াছে, তখন আর আমি জয়ের আশা করি নাই। যখন শুনিলাম, কর্ণমতানুযায়ী ঘোষষাত্রাপ্রস্থিত মৎপুত্রদিগকে গন্ধর্ব্বেরা বদ্ধ করিয়াছিল, অর্জ্জুন তাহাদিগের উদ্ধার সাধন করিয়াছে, তখন আর আমি জয়ের আশা করি নাই। যখন শুনিলাম, ধর্ম্ম যক্ষরূপ পরিগ্রহ পূর্ব্বক যুধিষ্ঠিরের নিকটে আসিয়া কয়েকটি প্রশ্ন করিয়াছেন, তখন আর আমি জয়ের আশা করি নাই। যখন শুনিলাম, আমার পুত্রেরা, বিরাটরাজ্যে দ্রৌপদীসহিত অজ্ঞাতবাসকালে, পাণ্ডবদিগের অনুসন্ধান করিতে পারে নাই, তখন আর আমি জয়ের আশা করি নাই। যখন শুনিলাম, উত্তর গোগ্রহে অর্জ্জুন একাকী অস্মৎপক্ষীয় অতি প্রধান বীরদিগকে পরাজিত করিয়াছে, তখন আর আমি জয়ের আশা করি নাই। যখন শুনিলাম, বিরাট রাজা আপন কন্যা উত্তরআকে বস্ত্রালঙ্কারে ভূষিতা করিয়া অর্জ্জুনকে সম্প্রদান করিয়াছেন, এবং অর্জ্জুন তাহাকে আপন পুত্রের নিমিত্ত প্রতিগ্রহ করিয়াছে, তখন আর আমি জয়ের আশা করি নাই। যখন শুনিলাম, যুধিষ্ঠির নিৰ্জ্জিত, নির্ধন, নির্ব্বাসিত, ও স্বজনবিয়োজিত হইয়াও সাত অক্ষৌহিণী সৈন্য সংগ্রহ করিয়াছে, তখন আর আমি জয়ের আশা করি। নাই। যখন শুনিলাম, যিনি এই পৃথিবীকে এক পদক্ষেপে অধিকৃত করিয়াছিলেন, সেই ভগবান বাসুদেব পাণ্ডবদিগের পক্ষ হইয়াছেন, তখন আর আমি জয়ের আশা করি নাই। নারদমুখে শুনিলাম, কৃষ্ণ ও অর্জ্জুন নরনারায়ণাবতার, তিনি ব্রহ্মলোকে তাঁহাদের দর্শন করেন, তখন আর আমি জয়ের আশা করি নাই। যখন শুনিলাম, কৃষ্ণ লোকহিতার্থে কুরুদিগের বিরোধ ভঞ্জন করিতে আসিয়া অকৃতকার্য্য প্রতিগমন করিয়াছেন, তখন আর আমি জয়ের আশা করি নাই। যখন শুনিলাম, কর্ণ ও দুর্য্যোধন কৃষ্ণের নিগ্রহ চেষ্টা করিয়াছিল, কিন্তু তিনি বিশ্বরূপ প্রদর্শন পূর্ব্বক তাহাদিগকে হতদৃষ্টি করিয়াছেন, তখন আর আমি জয়ের আশা করি নাই। যখন শুনিলাম, কৃষ্ণের প্রস্থানকালে কুন্তী নিতান্ত কাতরা হইয়া একাকিনী রথের অগ্রে দণ্ডায়মান হইলে, তিনি তাহাকে আশ্বাস প্রদান করিয়াছেন, তখন আর আমি জয়ের আশা করি নাই। যখন শুনিলাম, বাসুদেব ও ভীম উভয়ে পাণ্ডবদিগের মন্ত্রী হইয়াছেন, এবং দ্রোণাচার্য্য তাহাদের মঙ্গল আকাঙক্ষা করিতেছেন, তখন আর আমি জয়ের আশা করি নাই। যখন শুনিলাম, তুমি যুদ্ধ করিলে আমি যুদ্ধ করিব না, কর্ণ ভীষ্মকে এই কথা কহিয়া সেনা পরিত্যাগ করিয়া গিয়াছে, তখন আর আমি জয়ের আশা করি নাই। যখন শুনিলাম, বাসুদেব, অর্জ্জুন, ও অপ্রমেয় গাণ্ডীব ধনু, এই তিন মহাবীর্য্য একত্র হইয়াছে, তখন আর আমি জয়ের আশা করি নাই। যখন শুনিলাম, অর্জ্জুন রথোপরি মোহাভিভূত ও বিষন্ন হইলে, কৃষ্ণ তাহাকে স্বশরীরে চতুর্দ্দশ ভুবন দর্শন করাইয়াছেন, তখন আর আমি জয়ের আশা করি নাই। যখন শুনিলাম, শত্রুমর্দ্দন ভীষ্ম, সংগ্রামে প্রতিদিন অযুতঘাতী হইয়াও, পাণ্ডবপক্ষীয় প্রধান এক ব্যক্তিকেও বিনষ্ট করিতে পারেন নাই, তখন আর আমি জয়ের আশা করি নাই। যখন শুনিলাম, ধর্ম্মপরায়ণ ভীষ্ম পাণ্ডবদিগের নিকট আপন বধোপায় প্রকাশ করিয়াছেন, এবং তাহারাও হৃষ্ট চিত্তে সেই উপায় সাধন করিয়াছে, তখন আর আমি জয়ের আশা করি নাই। যখন শুনিলাম, অর্জ্জুন শিখণ্ডীকে সম্মুখে স্থাপিত করিয়া অতি দুর্দ্ধৰ্ষ মহাপরাক্রান্ত ভীষ্মকে হতবীর্য্য করিয়াছে, তখন আর আমি জয়ের আশা করি নাই। যখন শুনিলাম, ভীষ্ম কেবল মৎপক্ষীয়দিগকেই অল্পাবশিষ্ট করিয়া শরজালে ক্ষতকলেবর হইয়া শরশয্যায় শয়ন করিয়াছেন, তখন আর আমি জয়ের আশা করি নাই। যখন শুনিলাম, ভীষ্ম শরশয্যাশয়ান হইয়া পানীয় আহরণার্থে আদেশ করিলে, অর্জ্জুন ভূভেদ করিয়া তাঁহাকে তৃপ্ত করিয়াছে, তখন আর আমি জয়ের আশা করি নাই। যখন শুনিলাম, বায়ু, ইন্দ্র, ও সূর্য্য পাণ্ডবদিগের অনুকূল হইয়াছেন, এবং হিংস্র জন্তুগণ নিরন্তর আমাদিগকে ভয় প্রদর্শন করিতেছে, তখন আর আমি জয়ের আশা করি নাই। যখন শুনিলাম, অদ্ভুত যোদ্ধা দ্রোণাচার্য্য সমরে নানাবিধ অস্ত্রকৌশল প্রদর্শন করিয়াও পাণ্ডবপক্ষীয় প্রধানদিগকে নষ্ট করিতে পারিতেছেন না, তখন আর আমি জয়ের আশা করি নাই। যখন শুনিলাম, আমরা, অৰ্জ্জুনবধার্থে যে মহারথ[২৮] সংসপ্তকগণ নিযুক্ত করিয়াছিলাম, অর্জ্জুন তাহাদিগের বিনাশ করিয়াছে, তখন আর আমি জয়ের আশা করি নাই। যখন শুনিলাম, মহাবীর অভিমন্যু দ্রোণাচার্য্যরক্ষিত অন্যের অভেদ্য ব্যুহ ভেদ করিয়া তন্মধ্যে একাকী প্রবেশ করিয়াছে, তখন আর আমি জয়ের আশা করি নাই। যখন শুনিলাম, অস্মৎপক্ষীয় মহারথেরা অর্জ্জুনবধে অসমর্থ হইয়া সকলে মিলিয়া শিশু প্রায় অভিমন্যুকে বধ করিয়া হৃষ্টচিত্ত হইয়াছে, তখন আর আমি জয়ের আশা করি নাই। যখন শুনিলাম, অস্মৎপক্ষীয়েরা অভিমন্যুকে বধ করিয়া হর্ষে মহাকোলাহল করিতেছে, কিন্তু অর্জ্জুন ক্রুদ্ধ হইয়া জয়দ্রথবধ প্রতিজ্ঞা করিয়াছে, তখন আর আমি জয়ের আশা করি নাই। যখন শুনিলাম, অর্জ্জুন জয়দ্রথবধার্থে যে প্রতিজ্ঞা করিয়াছিল, শত্রুমণ্ডলীমধ্যে সেই প্রতিজ্ঞা পরিপূর্ণ করিয়াছে, তখন আর আমি জয়ের আশা করি নাই। যখন শুনিলাম, অর্জ্জুনের অশ্ব সকল একান্ত ক্লান্ত হইলে, বাসুদেব বন্ধনমোচন ও জলোপসেবন পূর্ব্বক তাহাদিগকে যুদ্ধ ক্ষেত্রে আনিয়া পুনর্ব্বার যোজিত করিয়াছেন, তখন আর আমি জয়ের আশা করি নাই। যখন শুনিলাম, বাহনগণ অক্ষম হইলে, অর্জ্জুন রথোপরি অবস্থিত হইয়া সমুদায় যোদ্ধাদিগকে পরাভূত করিয়াছে, তখন আর আমি জয়ের আশা করি নাই। যখন শুনিলাম, সাত্যকি অতি দুর্দ্ধর্ষ যুদ্ধাসক্ত দ্রোণসৈন্য পরাভূত করিয়া কৃষ্ণ ও অর্জ্জুনের নিকট উপস্থিত হইয়াছে, তখন আর আমি জয়ের আশা করি নাই। যখন শুনিলাম, কর্ণ কোদণ্ডের অগ্রভাগ দ্বারা আকর্ষণ করিয়া অশেষ ক্লেশ প্রদান পূর্ব্বক ভীমকে ধরিয়া অনিয়। যথোচিত তিরস্কার করিয়াছিল, কিন্তু সে কর্ণহস্তে পতিত হইয়াও মৃত্যু গ্রাস হইতে মুক্ত হইয়াছে, তখন আর আমি জয়ের আশা করি নাই। যখন শুনিলাম, দ্রোণ, কৃতবর্ম্মা, কৃপ, কর্ণ, অশ্বত্থামা, ও শল্য প্রতিবিধানে অসমর্থ হইয়া জয়দ্রথবধ সহ্য করিয়াছে, তখন আর আমি জয়ের আশা করি নাই। যখন শুনিলাম, কর্ণ অর্জ্জুনবধার্থ স্থাপিত দিব্য শক্তি ঘটোৎকচের উপর নিক্ষেপ করিয়াছে, তখন আর আমি জয়ের আশা করি নাই। যখন শুনিলাম, দ্রোণ মরণার্থে কৃতনিশ্চয় ও নিশ্চেষ্ট হইয়া রথোপরি অবস্থিত হইলে, ধৃষ্টদ্যুমু ধর্ম্মমার্গ অতিক্রম করিয়া তাঁহার মস্তক ছেদন করিয়াছে, তখন আর আমি জয়ের আশা করি নাই। যখন শুনিলাম, নকুল উভয়পক্ষীয় সৈন্য সমক্ষে সমকক্ষ হইয়া অশ্বথামার সহিত যুদ্ধ করিতেছে, তখন আর আমি জয়ের আশা করি নাই। যখন শুনিলাম, দ্রোণবধানন্তর অশ্বত্থামা নারায়ণাস্ত্র প্রয়োগ করিয়াও পাণ্ডবদিগের প্রাণবধ করিতে পারেন নাই, তখন আর আমি জয়ের আশা করি নাই। যখন শুনিলাম, ভীমসেন যুদ্ধে দুঃশাসনের শোণিত পান করিয়াছে, দুর্য্যোধন প্রভৃতি কেহ তাহার নিবারণ করিতে পারে নাই, তখন আর আমি জয়ের আশা করি নাই। যখন শুনিলাম, অর্জ্জুন অতি দুর্দ্ধর্ষ পরাক্রান্ত কর্ণের প্রাণসংহার করিয়াছে, তখন আর আমি জয়ের আশা করি নাই। যখন শুনিলাম, যুধিষ্ঠির পরাক্রান্ত অশ্বত্থামা, দুঃশাসন, ও কৃতবর্মাকে পরাজিত করিয়াছে, তখন আর আমি জয়ের আশা করি নাই। যখন শুনিলাম, যে শল্য সংগ্রামে কৃষ্ণকে পরাজিত করিব বলিয়া স্পর্ধা করিত, যুধিষ্ঠির সেই পরাক্রান্ত পুরুষের প্রাণসংহার করিয়াছে, তখন আর আমি জয়ের আশা করি নাই। যখন শুনিলাম, সহদেব বিবাদ ও দ্যূতক্রীড়ার মূল মায়াবী পাপিষ্ঠ শকুনির প্রাণবধ করিয়াছে, তখন আর আমি জয়ের আশা করি নাই। যখন শুনিলাম, দুর্য্যোধন হতসৈন্য ও নিঃসহায় হইয়া জলস্তম্ভ করিয়া একাকী হ্রদপ্রবেশ করিয়াছে, তখন আর আমি জয়ের আশা করি নাই। যখন শুনিলাম, পাণ্ডবেরা বাসুদেব সমভিব্যাহারে সেই হ্রদের তীরে দণ্ডায়মান হইয়া অসহন দুর্য্যোধনের তিরস্কার করিতেছে, তখন আর আমি জয়ের আশা করি নাই। শুনিলাম, দুর্য্যোধন গদাযুদ্ধে অশেষ কৌশল প্রদর্শন পূর্ব্বক পরিভ্রমণ করিতেছিল, ভীম কৃষ্ণের পরামর্শে কপট প্রহার দ্বারা তাহার ঊরুভঙ্গ করিয়াছে, তখন আর আমি জয়ের আশা করি নাই। যখন শুনিলাম, অশ্বথামা প্রভৃতি সকলে পরামর্শ করিয়া দ্রৌপদীর নিদ্রিত পুত্রপঞ্চকের বধরূপ অতি ঘৃণিত কলঙ্ককর কর্ম্ম করিয়াছে, তখন আর আমি জয়ের আশা করি নাই। যখন শুনিলাম, ভীম প্রতিফল প্রদানার্থে অশ্বথামার পশ্চাৎ ধাবমান হইলে, তিনি ক্রোধান্ধ হইয়া মহাস্ত্র প্রয়োগ পূর্ব্বক সুভদ্রার গর্ভ বিনাশ করিয়াছেন, তখন আর আমি জয়ের আশা করি নাই। যখন শুনিলাম, অর্জ্জুন স্বস্তি বলিয়া স্বীয় অস্ত্র দ্বারা ব্রহ্মশিরঃ[২৯] অস্ত্র নিবারণ করিয়াছে, এবং অশ্বত্থামা মণিরত্ন প্রদান করিয়াছেন,[৩০] তখন আর অমি জয়ের আশা করি নাই। যখন শুনিলাম, অশ্বত্থামা মহাস্ত্র দ্বারা উত্তরার গর্ভ নাশ করিলে, দ্বৈপায়ন ও বাসুদেব উভয়ে অশ্বত্থামাকে অভিশাপ প্রদান করিয়াছেন, তখন আর আমি জয়ের আশা করি নাই। গান্ধারীর পুত্র, পৌত্র, বন্ধু, পিতৃ, ভ্রাতৃ প্রভৃতি সমুদায় নিধন প্রাপ্ত হইয়াছে; তাহার অতি শোচনীয় অবস্থা উপস্থিত। পাণ্ডবেরা অতি দুষ্কর কার্য্য করিয়াছে ও পুনর্ব্বার অকণ্টক রাজ্য প্রাপ্ত হইয়াছে। কি কষ্ট! শুনিলাম, আমাদের তিন জন ও পাণ্ডবদিগের সাত জন, সমুদায়ে দশ জন মাত্র অবশিষ্ট আছে। এই ভয়ঙ্কর সমরে অষ্টাদশ অক্ষৌহিণী নিধন প্রাপ্ত হইয়াছে। সঞ্জয়! আমি চারি দিক অন্ধকারময় দেখিতেছি, মোহে অভিভূত হইতেছি, আমার চেতনা লোপ হইতেছে, মন বিহ্বল হইতেছে।
উগ্রশ্রবাঃ কহিলেন, ধৃতরাষ্ট্র এইরূপ কহিয়া বহুতর বিলাপ ও পরিতাপ করিয়া নিতান্ত দুঃখিত ও মূর্চ্ছিত হইলেন। পরে অশ্বিাসিত ও চেতনা প্রাপ্ত হইয়া সঞ্জয়কে কহিলেন, সঞ্জয়! যখন আমার ভাগ্যে এরূপ ঘটিল, অবিলম্বে প্রাণত্যাগ করাই শ্রেয়ঃ, আর অমি জীবনধারণের কিছুমাত্র ফল দেখিতেছি না। রাজা ধৃতরাষ্ট্র এইরূপ কহিয়া বিলাপ, দীর্ঘ নিশ্বাস ত্যাগ, ও পুনঃ পুনঃ মোহাবেশ প্রকাশ করিতে লাগিলেন। তখন ধীমান্ সঞ্জয় প্রবোধদানার্থে কহিলেন, মহারাজ! দ্বৈপায়ন ও নারদ মুখে শ্রবণ করিয়াছ, শৈব, সৃঞ্জয়, সুহোত্র, রন্তিদেব, কাক্ষীবান্, ঔশিজ, বাহ্লীক, দমন, শর্যাতি, অজিত, নল, বিশ্বামিত্র, অম্বরীষ, মরুত্ত, মনু, ইক্ষ্বাকু, গয়, ভরত, দাশরথি রাম, শশবিন্দু, ভগীরথ, কৃতবীর্য্য, জনমেজয়, শুভকর্ম্মা বহুযজ্ঞানুষ্ঠাতা যযাতি, এই সকল মহোৎসাহ মহাবল দিব্যাত্মবেত্তা শক্রতুল্যতেজস্বী রাজারা সর্ব্বগুণসম্পন্ন প্রধান প্রধান রাজবংশে জন্ম গ্রহণ করিয়াছিলেন, এবং ধর্ম্মতঃ পৃথিবী জয়, নানা যজ্ঞানুষ্ঠান, ও যশোলাভ করিয়া পরিশেষে কাল গ্রাসে পতিত হইয়াছেন। পূর্ব্ব কালে চৈদ্যরাজ পুত্রশোকে সন্তপ্ত হইলে, দেবর্ষি নারদ তাঁহাকে এই চতুর্বিংশতি রাজার উপাখ্যান শ্রবণ করাইয়াছিলেন। এতদ্ভিন্ন পুরু, কুরু, যদু, বিশ্বগশ্ব, অনূহ, যুবনাশ, ককুৎস্থ, রঘু, বিজয়, বীতিহোত্র, অঙ্গ, ভব, শ্বেত, বৃহদ্গুরু, উশীনর, শতরথ, কঙ্ক, দুলিদুহ, দ্রুম, পর, বেণ, সগর, সঙ্কৃতি, নিমি, অজেয়, পরশু, পুণ্ড, শম্ভু, দেবাবৃধ, দেবাহ্বয়, সুপ্রতিম, সুপ্রতীক, বৃহদ্রথ, সুক্রতু, নল, সত্যব্রত, শান্তভয়, সুমিত্র, সুবল, জানুজঙ্ঘ, অনরণ্য, অর্ক, বলবন্ধু, নিরামর্দ্দ, কেতুশৃঙ্গ, বৃহদ্বল, ধৃষ্টকেতু, বৃহৎকেতু, দীপ্তকেতু, অবিক্ষিৎ, চপল, ধূর্ত্ত, কৃতবন্ধু, দৃঢ়েষুধি, মহাপুরাণসম্ভাব্য, প্রত্যঙ্গ, পরহা, শ্রুতি, এই সমস্ত ও অন্যান্য শত শত সহস্র সহস্র ও পদ্মসংখ্য নরপতিগণ প্রসিদ্ধ আছেন; ইঁহারা মহাবল পরাক্রান্ত ও বুদ্ধিশালী ছিলেন, এবং অশেষ ঐশ্বর্য্য ভোগ করিয়া পরিশেষে তোমার পুত্রগণের ন্যায় নিধন প্রাপ্ত হইয়াছেন; বিদ্যাবান্ সৎকবিগণ পুরাণে তাঁহাদিগের অলৌকিক কর্ম্ম, বিক্রম, দান, মাহাত্ম্য, আস্তিক্য, সত্য, শৌচ, দয়া, আর্জব, কীর্ত্তন করিয়া গিয়াছেন। তাঁহারা সর্ব্বপ্রকারসমৃদ্ধিসম্পন্ন ও নানাগুণে অলঙ্কৃত হইয়াও নিধন প্রাপ্ত হইয়াছেন; তোমার পুত্রেরা দুরাত্মা, ক্রোধান্ধ, লুব্ধ, অতি দুর্বৃত্ত ছিল, তাহাদিগের নিমিত্ত তোমার শোকাকুল হওয়া উচিত নহে। তুমি শাস্ত্রজ্ঞ, মেধাবী, বুদ্ধিমান্, ও পরম প্রাজ্ঞ। যাঁহাদিগের বুদ্ধিবৃত্তি শাস্ত্রানুগামিনী হয়, তাঁহারা মোহাভিভূত হয়েন না। দৈব নিগ্রহ ও দৈব অনুগ্রহ তোমার অবিদিত নহে। অতএব, পুত্রগণের নিমিত্ত তোমার এতবর্তী মমতা উচিত হয় না। যাহা ভবিতব্য ছিল ঘটিয়াছে, তাহার অনুশোচনা করা অবিধেয়। কোন ব্যক্তি প্রজ্ঞাবলে দৈবকার্য্য অন্যথা করিতে পারে? বিধাতার নিয়ম অতিক্রম করা কাহার সাধ্য? ভাব, অভাব, সুখ, অসুখ, সমুদায় কালমূলক। কাল সর্ব্ব জীবের সৃষ্টি করেন, কাল সর্ব্ব জীবের সংহার করেন, কাল সর্ব্ব জীবের দাহ করেন, কাল সর্ব্ব জীবের শান্তি করেন। ইহলোকে যে সকল শুভাশুভ ঘটনা হয়, সে সমুদায় কালকৃত। কাল সর্ব্বজীবসংহারকারী, কালই পুনর্ব্বার সব জীব সৃষ্টি করেন। সর্ব্ব জগৎ সুপ্ত হইলেও কাল জাগরিত থাকেন। অতএব কাল দুরতিক্রম। কাল অপ্রতিহত প্রভাবে সমভাবে সর্ব্বভূত শাসন করেন। অতীত, অনাগত, সাম্প্রতিক, সমুদায় পদার্থ কালকৃত বোধ করিয়া তোমার ধৈর্য্যাবলম্বন করা উচিত। সঞ্জয় পুত্রশোকার্ত রাজা ধৃতরাষ্ট্রকে এইরূপ প্রবোধ দিয়া সুস্থচিত্ত করিলেন। পরমকারুণিক ভগবান্ কৃষ্ণদ্বৈপায়ন লোকহিতার্থে এই বিষয়ে পবিত্র উপনিষৎ কীর্ত্তন করিয়াছেন, এবং বিদ্বান্ সৎকবিগণ পুরাণে সেই উপনিষৎ কীর্ত্তন করিয়া থাকেন।
ভারত অধ্যয়নে পুণ্য জন্মে। অধিক কি কহিব, শ্রদ্ধা পূর্ব্বক শ্লোকের এক চরণ মাত্র পাঠ করিলেও সকল পাপ নষ্ট হয়। এই গ্রন্থে দেব, দেবর্ষি, ব্রহ্মর্ষি, যক্ষ, উরগ প্রভৃতির ও সনাতন ভগবান্ বাসুদেবের কীর্ত্তন আছে। তিনি সত্য, পবিত্র, মঙ্গলপ্রদ, পরিচ্ছেদাতীত, কালত্রয়ে অবিকৃত, জ্যোতির্ম্ময়, ও সনাতল; পণ্ডিতেরা তাঁহার অলৌকিক কর্ম্ম সকল কীর্ত্তন করিয়া থাকেন, তিনি এই কার্য্য কারণ রূপ বিশ্বের সৃষ্টিকর্ত্তা, তিনি ব্রহ্মাদি দেবতার ও যজ্ঞাদি কার্য্যের সৃষ্টি করেন, তিনি জন্ম মৃত্যু ও পুনর্জন্মের কারণ, তিনি পাঞ্চভৌতিক দেহের অধিষ্ঠাতা জীব ও নির্বিশেষ পরব্রহ্ম স্বরূপ। যতিগণ সমাহিত হইয়া ধ্যান ও যোগবলে দর্পণতলগত প্রতিবিম্বের ন্যায় তাঁহাকে হৃদয়ে দর্শন করেন।
ধর্মপরায়ণ নর শ্রদ্ধা ও নিয়ম পূর্ব্বক এই অধ্যায় পাঠ করিয়া পাপ হইতে মুক্ত হয়। আস্তিক ব্যক্তি ভারতের এই অনুক্রমণিকাধ্যায় প্রথমাবধি সর্ব্বদা শ্রবণ করিলে বিপদে পতিত হয় না। দুই সন্ধ্যা অনুক্রমণিকার কিঞ্চিৎ কিঞ্চিৎ পাঠ করিলে, তৎক্ষণাৎ অহোরাত্র সঞ্চিত সমুদায় পাপ হইতে মুক্ত হয়। এই অধ্যায় ভারতের শরীর স্বরূপ, ইহাতে সত্য ও অমৃত উভয় আছে। যেমন গব্যের মধ্যে নবনীত, দ্বিপদের মধ্যে ব্রাহ্মণ, বেদের মধ্যে আরণ্যক, ওষধির মধ্যে অমৃত, জলাশয়ের মধ্যে সমুদ্র, চতুষ্পদের মধ্যে ধেনু, সেইরূপ মহাভারত সমস্ত ইতিহাসের মধ্যে শ্রেষ্ঠ। যে ব্যক্তি শ্রাদ্ধকালে ব্রাহ্মণদিগকে অন্ততঃ ভারতীয় শ্লোকের এক চরণ শ্রবণ করায়, তাহার পিতৃলোকের অক্ষয় তৃপ্তি হয়। ইতিহাস ও পুরাণ দ্বারা বেদের অর্থ সমর্থন করিবেক। বেদ অল্পজ্ঞের নিকট এই ভয় করেন যে, এ আমাকে প্রহার করিবেক। বিদ্বান ব্যক্তি কৃষ্ণদ্বৈপায়নপ্রোক্ত এই বেদ শ্রবণ করাইয়া অর্থলাভ করেন, এবং নিঃসন্দেহ ভ্রূণহত্যাদি পাপ হইতে মুক্ত হন। যে ব্যক্তি শুচি ও সংযত হইয়া পর্ব্বে পর্ব্বে এই পরমপবিত্র অধ্যায় পাঠ করে, আমার মতে, তাহার সমুদায় ভারত অধ্যয়ন করা হয়। যে নর প্রতিদিন শ্রদ্ধাবান্ হইয়া এই ঋষিপ্রণীত শাস্ত্র শ্রবণ করে, তাহার দীর্ঘ আয়ুঃ, কীর্ত্তি, ও স্বর্গ লাভ হয়।
পূর্ব্ব কালে সমুদয় দেবত। একত্র হইয়া তুলাযন্ত্রের এক দিকে চারি বেদ ও অপর দিকে এই ভারত স্থাপন করিয়াছিলেন। ভারত সরহস্য বেদচতুষ্টয় অপেক্ষা ভারে অধিক হয়, এজন্য তদবধি ইহ লোকে ভারত মহাভারত বলিয়া প্রসিদ্ধ হইয়াছে। পরিমাণকালে ইহার মহত্ত্ব ও ভারবত্ত্ব উভয়ই অধিক হইল, সেই নিমিত্ত ইহার নাম মহাভারত। যে ব্যক্তি মহাভারত শব্দের ব্যুৎপত্তি জানে, সে সর্ব্বপাপ হইতে মুক্ত হয়।
তপস্যা পাপজনক নহে, বেদাধ্যয়ন পাপজনক নহে, বর্ণাশ্রমাদিনিয়মিত বেদবিহিত কর্ম্মানুষ্ঠান পাপজনক নহে, অশেষ ক্লেশ স্বীকার পূর্ব্বক জীবিকা নির্ব্বাহ করা পাপজনক নহে; এই সমস্ত অসদভিপ্রায়দূষিত হইলেই পাপজনক হয়।
- ↑ বিষ্ণুর অবতার ঋষিবিশেষ। বিষ্ণু ধর্ম্মের ঔরসে দক্ষকন্যা মূর্ত্তির গর্ভে নর ও নারায়ণ এই মূর্ত্তিদ্বয়ে অবতীর্ণ হইয়াছিলেন। ইঁহারা উভয়েই ঋষিরূপে ঘোরতর তপস্যা করিয়াছিলেন। যথা
ধর্ম্মস্য দক্ষদুহিতর্য্যজনিষ্ট মূর্ত্ত্যাং নারায়ণো নর ইতি স্বতপঃপ্রভাবঃ॥ ভাগবত ২।৭।৭।
তুর্য্যে ধর্ম্মকলাসর্গে নরনারায়ণাবৃষী।
ভূত্বাত্মোপশমোপেতমকরোদ্দুশ্চরং তপঃ॥ ভাগ ১।৩।৭।যয়োঃ প্রভাবো দুর্দ্ধর্ষঃ শাস্ত্রে বেদে তপঃসু চ॥ কালিকাপুরাণ।ততো দেহপরিত্যাগং কর্ত্তুং সমভবদ্যদা।
তদা দংষ্ট্রাগ্রভাগেন নরসিংহং মহাবলম্।সরভো ভগবান্ ভর্গো দ্বিধা মধ্যে চকার হ॥
নরসিংহে দ্বিধাভূতে নরভাগেন তস্য তু।
নর এব সমুৎপন্নো দিব্যরূপী মহানৃষিঃ॥
তস্য পঞ্চাস্যভাগেন নারায়ণ ইতি শ্রুতঃ।
অভবৎ স মহাতেজা মুনিরূপী জনার্দ্দনঃ॥
নরো নারায়ণশ্চোভৌ সৃষ্টিহেতু মহামতী।
যয়োঃ প্রভাবো দুর্দ্ধর্ষঃ শাস্ত্রে বেদে তপঃসু চ॥ কালিকাপুরাণ। - ↑ রামায়ণ মহাভারতাদি ইতিহাস ও অষ্টাদশ পুরাণ ইত্যাদি শাস্ত্র অধ্যয়ন করিলে সংসার জয় হয়, অর্থাৎ জীব জন্মমৃত্যুপরম্পরারূপ সংসারশৃঙ্খলা হইতে মুক্ত হয়, এই নিমিত্ত তত্তৎ শাস্ত্রের নাম জয়। যথা
অষ্টাদশ পুরাণানি রামস্য চরিতং তথা।
কার্ষ্ণং বেদং পঞ্চমঞ্চ ষন্মহাভারতং বিদুঃ॥
তথৈব শিবধর্ম্মাশ্চ বিষ্ণুধর্ম্মাশ্চ শাশ্বতাঃ।
জয়েতি নাম তেষাঞ্চ প্রবদন্তি মনীষিণঃ॥
সংসারজয়নং গ্রন্থং জয়নামানমীরয়েৎ॥ ভবিষ্যপুরাণ। - ↑ আশ্রমের মধ্যে সর্ব্বপ্রধান মুনি।
- ↑ ভগবান্ গৌরমুখ ঋষিকে কহিয়াছিলেন যে আমি এই অরণ্যে এক নিমিষে দুর্জয় দানবসৈন্য ধ্বংস করিলাম, এই নিমিত্ত ইহা নৈমিষ নামে প্রসিদ্ধ হইবেক। যথা
এবং কৃত্বা ততো দেবো মুনিং গৌরমুখং তদা।
উবাচ নিমিষেণেদং নিহতং দানবং বলম্।
অরণ্যেঽস্মিংস্ততস্ত্বেতন্নৈমিষারণ্যসংজ্ঞিতম্॥ - ↑ ব্রাহ্মণীর গর্ভে ক্ষত্রিয়ের ঔরসে উৎপন্ন প্রতিলোমজ সঙ্কীর্ণ জাতি। যথা
ব্রাহ্মণ্যাং ক্ষত্রিয়াং সূতঃ। যাজ্ঞবল্ক্য ১ অধ্যায়।
- ↑ লোমর্ষণ ব্যাসদেবের বিখ্যাত শিষ্য ছিলেন। মহর্ষি প্রসন্ন হইয়া তাঁহাকে প্রণীত সমস্ত পুরাণ সংহিতা সমর্পণ করেন। এই নিমিত্ত তিনি পুরাণবক্তা। লোমহর্ষণ সর্ব্বত্র সূত নামে প্রসিদ্ধ, কিন্তু ইহা তাঁহার কূলানুযায়ী নাম, প্রকৃত নাম নহে, যে হেতু কল্কিপুরাণে সূতপুত্র বলিয়া লোমহর্ষণের বিশেষণ আছে; এবং লোমহর্ষণ নামও তাঁহার আদি নাম নহে, তাঁহার নিকট পৌরাণিক কথা শ্রবণ করিয়া শ্রোতৃবর্গের লোমহর্ষ অর্থাৎ লোমাঞ্চ হইত, এই নিমিত্ত তাহার লোমহর্ষণ নাম হয়। যথা
প্রখ্যাত ব্যাসশিষ্যোঽভূৎ সূতা বৈ লোমহর্ষণঃ।
পুরাণসংহিতাস্তস্মৈ দদৌ ব্যাসো মহামুনিঃ॥ বিষ্ণু ৩।৬।১৮।
তথা ক্ষেত্রে সূতপুত্র নিহতো লোমহর্ষণঃ।
বলরামাস্ত্রযুক্তাত্মা নৈমিষেঽভূৎ স্ববাঞ্ছয়া॥ কল্কি ২৭ অ।
লোমানি হর্যয়াঞ্চক্রে শ্রোতৄণাং যঃ স্বভাসিতৈঃ।
কর্ম্মণা প্রথিতস্তেন লোমহর্ষণসংজ্ঞয়া॥ কূর্ম্মপুরাণ। - ↑ উগ্রশ্রবার পিতা লোমহর্ষণ ব্যাসাসনে আসীন হইয়া নৈমিষারণ্যবাসী ঋষিদিগকে পুরাণ শ্রবণ করাইতেছেন, এমন সময়ে বলদেব তীর্থযাত্রাপ্রসঙ্গে তথায় উপস্থিত হইলে ঋষিগণ গাত্রোখান পূর্ব্বক তাঁহার সংবর্দ্ধনা ও সৎকার করিলেন, কিন্তু লোমহর্ষণ গাত্রোত্থানাদি করিলেন না। বলদেব তদ্দর্শনে তাঁহাকে গর্ব্বিত বোধ করিয়া ক্রোধে অধীর হইয়া করস্থ কুশাগ্রপ্রহার দ্বারা তাঁহার প্রাণদণ্ড করিলেন। পরে ঋষিদিগের অনুরোধপরতন্ত্র হইয়া কহিলেন, ইহার আর পুনর্জীবন হইবেক না, ইহার পুত্র উগ্রশ্রবাঃ আপনাদিগকে পুরাণ শ্রবণ করাইবেন। তদবধি উগ্রশ্রবাঃ পুরাণবক্তা হইলেন। যথা
তমাগমতভিপ্রেত্য মুনয়ো দীর্ঘজীবিনঃ।
অভিনন্দ্য যথান্যায়ং প্রণমমাত্থায় চার্চ্চয়ন॥ ১৩॥
অনভ্যুত্থায়িনং সূতমকৃতপ্রহ্বনাঞ্জলিম্।
অধ্যাসীনঞ্চ তান্ বিপ্রান চুকোপোদ্বীক্ষ্য মাধবঃ॥ ১৫॥
এতাবদুক্ত্বা ভগবান্ নিবৃত্তোঽসদ্বধাদপি।
ভাবিত্বাত্তং কুশাগ্রেণ করন্থেনাহনৎ প্রভুঃ॥ ১৯॥
আত্মা বৈ পুত্র উৎপন্ন ইতি বেদানুশাসনম্।
তস্মাদস্য ভবেদ্বক্তা আয়ুরিন্দ্রিয়স্তত্ববান॥ ২৭॥ ভাগ ১০। ৭৮। - ↑ সর্পষজ্ঞ। সর্পকুশধ্বংসের নিমিত্ত ঐ যজ্ঞ অনুষ্ঠিত হয়। ইহার সবিশেষ বিবরণ কিঞ্চিৎ পরে মুলেই প্রাপ্ত হইবেক।
- ↑ বেদব্যাসের প্রকৃত নাম কৃষ্ণদ্বৈপায়ন, পরে বেদ বিভাগ করিয়া ব্যাস, বেদব্যাস, ইত্যাদি নাম প্রাপ্ত হন। কৃষ্ণবর্ণ ছিলেন এই নিমিত্ত কৃষ্ণ, আর যমুনার দ্বীপে জন্মিয়াছিলেন এই নিমিত্ত দ্বৈপায়ন। এই দুই শব্দ সমষ্টি, ব্যষ্টি, উভয়থাই ব্যাসবোধক হয়।
- ↑ নীলকমতে সময় শব্দের অর্থ সক্ষেত, অর্জুনমিমতে আচার।
- ↑ স্বায়ম্ভুব মনু ব্রহ্মার আদেশানুসারে মনুষ ও অন্যান্য জীব জন্তু প্রভৃতি সমুদায় সৃষ্টি করিয়াছিলেন, এই নিমিত্ত তিনি 'সর্ব্ব লোকের পিতৃম্বরূপে পরিগণিত। ব্রহ্মা সেই আদিপিতা স্বায়ম্ভুব মনুর পিতা, এই নিমিত্ত তিনি সর্ব্বলোকপিতামহ।
- ↑
ত্রয়স্ত্রিংশৎসহস্রাণি ত্রয়স্ত্রিংশচ্ছতানি চ।
ত্রয়স্ত্রিংশচ্চ দেবানাং সৃষ্টিঃ সংক্ষেপলক্ষণ॥এই মূলের যথাশ্রুত অর্থ লিখিত হইল। শতসহস্রাদি সংখ্যা পরস্পর বিরুদ্ধ বোধ হইতেছে। এই পরম্পরবিরুদ্ধ ত্রিবিধ সংখ্যার টীকাকার নীলকণ্ঠ এই সমন্বয় করিয়াছেন যে, অষ্ট বসু, একাদশ রুদ্র, দ্বাদশ আদিত্য, ইন্দ্র, ও প্রজাপতি এই ত্রয়স্ত্রিংশৎ দেবতা। ত্রয়স্ত্রিংশৎ শত অথবা ত্রয়স্ত্রিংশৎ সহস্র সংখ্যা তাহাদিগের পরিবারাদি সহ গণনাভিপ্রায়ে নির্দ্দিষ্ট হইয়াছে। এই বাহুল্য সংখ্যাও সংক্ষেপসৃষ্টি অভিপ্রায়ে উল্লিখিত। বিস্তারিত সৃষ্টি অভিপ্রায়ে পুরাণান্তরে ত্রয়স্ত্রিংশৎ কোটি সংখ্যার উল্লেখ আছে। অর্জ্জুনমিশ্র প্রথমতঃ এইরূপ ব্যাখ্যা লিখিয়া পরিশেষে যথাশ্রুত গ্রন্থার্থ সামঞ্জস্য সংস্থাপনে ব্যগ্র হইয়া ত্রয়স্ত্রিংশং সহস্র ত্রয়স্ত্রিংশৎ শত ও ত্রয়স্ত্রিংশৎ এই তিনের সমষ্টি করিয়াছেন, অর্থাৎ ৩৩৩৩৩৩ দেবতাদিগের সংক্ষেপ সৃষ্টি।
- ↑ অর্জ্জুনমিশ্রমতে দিব্ শব্দের অর্থ স্বর্গাধিষ্ঠাত্রী দেবতা অথবা অদিতি।
- ↑ গ্রাম, নগর, দুর্গ, তীর্থ, আশ্রম প্রভৃতি।
- ↑ ধর্ম্মরহস্য, অর্থরহস্য, কামরহস্য। রহস্য শব্দের অর্থ গূঢ়তত্ত্ব, অর্থাৎ যাহার মর্ম্ম বুঝিতে পারা যায় না।
- ↑ সংসারযাত্রা নির্বাহের বিধিদর্শক নীতিশাস্ত্র বিশেষ।
- ↑
নারায়ণং নমস্কৃত্য নরঞ্চৈব নরোম।
দেবী সরস্বতীঞ্চৈব ততো জয়মুদীরয়েৎ - ↑ মুল অবধি শাখানিৰ্গম স্থান পর্যন্ত বৃক্ষভাগ, গুঁড়ি।
- ↑ পক্ষীর উপবেশনযোগ্য স্থান।
- ↑ গ্রন্থি, গাঁটি।
- ↑ দক্ষিণাগ্নি, গার্হপত্য, আহবনীয়। কোনও যক্ষ্মীয় অগ্নি অথবা গার্হপত্য অগ্নি হইতে উদ্ধৃত করিয়া যাহা দক্ষিণ ভাগে স্থাপিত করা যায়, তাহার নাম দক্ষিণাগ্নি। গৃহস্থ ব্যক্তি চির কাল অবিচ্ছেদে যে অগ্নি গৃহে রাখে, তাহার নাম গার্হপত্য। গার্হপত্য হইতে উদ্ধৃত করিয়া হোমার্থ যে অগ্নির সংস্কার করা যায়, তাহার নাম আহবনীয়।
- ↑ অপুত্রত্বরূপ আপদ্। মৃগয়াকালে পাণ্ডু মৃগরূপধারী ঋষির সম্ভোগসময়ে প্রাণবধ করিয়াছিলেন। ঋষি তাঁহাকে এই শাপ দেন যে, তোমারও সম্ভোগ কালে মৃত্যু হইবেক, তাহাতেই পাণ্ডুর পুত্রোৎপাদনের ব্যাঘাত জন্মে।
- ↑ রঙ্কুরোম নির্ম্মিত। রঙ্কু মৃগবিশেষ।
- ↑ জলে স্থলভ্রম, স্থলে জলভ্রম, অদ্বারে দ্বারভ্রম, দ্বারে অদ্বারভ্রম ইত্যাদি।
- ↑ জয়ই হউক অথবা মৃত্যুই হউক, পাণ্ডবদিগকে রাজ্যার্দ্ধপ্রদান করিব না!
- ↑ ব্রহ্মচর্য্য সমাধান পূর্ব্বক গৃহস্থাশ্রমে প্রবিষ্ট।
- ↑ অতিদুর্দ্দান্ত মহাপরাক্রান্ত ষষ্টি সহস্র অসুর।
- ↑ যে ব্যক্তি অস্ত্রবিদ্যা নিপুণ ও একাকী দশ সহস্র ধনুর্দ্ধারী সৈন্যের সহিত যুদ্ধ করিতে সমর্থ, তাহাকে মহারথ বলে।
- ↑ ব্রহ্মতেজোময় মহাপ্রভাব অস্ত্রবিশেষ। অশ্বত্থামা অৰ্জ্জুনবধার্থে ঐ অমোঘ অস্ত্র প্রয়োগ করেন।
- ↑ ভীমকে আক্রোধ ও প্রসন্ন করিবার নিমিত্ত।