মহাভারত (উপক্রমণিকাভাগ)/ষট্চত্বারিংশ অধ্যায়
ষট্চত্বারিংশ অধ্যায়— আস্তীকপর্ব্ব।
উগ্রশ্রবাঃ কহিলেন, জরৎকারু, পিতৃগণের এই প্রকার কাতবোক্তি শ্রবণে একান্ত শোকাভিভূত হইয়া, অশ্রুজলপূর্ণ লোচনে অর্দ্ধস্ফুট বচনে তাহাদিগকে সম্বোধন করিয়া কহিলেন, হে ঋষিগণ! আপনারা আমার পূর্ব্ব পুরুষ, আমারই নাম জরৎকারু, আমি আপনাদিগের অপরাধী সন্তান, অতি পাপাত্মা ও অক্বভাত্মা, অতএব আপনারা আমার যথোচিত দণ্ডবিধান করুন এবং আজ্ঞা করুন, আপনাদিগের মঙ্গলের নিমিত্ত আমাকে কি করিতে হইবেক? পিতৃগণ কহিলেন, বৎস! তুমি আমাদিগের ভাগ্যবশতঃ যদৃচ্ছাক্রমে এই স্থানে উপস্থিত হইয়াছ। তোমাকে জিজ্ঞাসা করি, তুমি কি নিমিত্ত এ পর্যন্ত দারপরিগ্রহ কর নাই? জরৎকারু কহিলেন, হে পিতামহগণ? আমার বাসনা এই, আমি উৰ্দ্ধরেতাঃ হইয়া দেহ পরিত্যাগ করিব! আমি দারপরিগ্রহ করি না, এই আমার একান্ত ইচ্ছা এক্ষণে, আপনাদিগকে এই গর্তে পক্ষীর ন্যায় লম্বমান দেখিয়া, ব্রহ্মচর্য হইতে নিবৃত্ত হইলাম। আমি আপনাদিগের অভিপ্রেত সম্পাদনার্থে নিঃসন্দেই দারপরিগ্রহ করিব। যদি কখনও সনাম্নী কন্যা প্রাপ্ত হই, যদি সেই কন্যা বিনা প্রার্থনায় স্বয়ং উপস্থিত হয়, আর যদি তাহার ভরণ পোষণ করিতে না হয়, তবে তাহার পাণিগ্রহণ করিব। হে পিতামহগণ! আমি যথার্থ কহিতেছি, আপনাদিগের অনুরোধে আমি এই নিয়মে দারপরি গ্রহে সম্মত আছি, প্রকারান্তরে তদ্বিষয়ে প্রবৃত্ত হইব না। এই প্রকারে পরিণীতা ভার্যার গর্ভে আপনাদিগের উদ্ধারক সন্তান উৎপন্ন হইবেক, এবং আপনারাও অক্ষয় স্বর্গ লাভ করিবেন।
উগ্রশ্রবাঃ কহিলেন, হে শৌনক। জরৎকারু পিতৃগণকে এইরূপ কহিয়া ভূমণ্ডলে ভ্রমণ করিতে লাগিলেন; কিন্তু বৃদ্ধ বলিয়া ভার্যালাভে কৃতকার্য হইতে পারিলেন না। তখন তিনি নির্বিণ্ন মনে অরণ্যে প্রবেশ করিলেন, এবং পিতৃগণের হিসাধন মানসে কালভার্থে উচ্চৈঃস্বরে তিন বার এই বাক্য উচ্চারণ করিলেন, এই স্থলে যে সমস্ত স্থাবর জঙ্গম অথবা অদৃষ্ট প্রাণী আছে, তাহারা আমার বাক্য শ্রবণ করুক; আমি অতি কঠোর তপস্যায় কালযাপন করিতেছিলাম, কিন্তু আমার পূর্ব্ব পুরুষের অতিশয় কাতর হইয়া বংশরক্ষার্থে আমারে দারপরি গ্রহের আদেশ প্রদান করিয়াছেন, তদনুসারে আমি দারপরি গ্রহে কৃতসংকল্প হইয়া কন্যালভার্ধে সমস্ত ভূমণ্ডল ভ্রমণ করিয়াছি, আমি দরিদ্র ও দুঃখশীল, আমার উল্লিখিত প্রাণিসমুহের মধ্যে যদি কাহারও কন্যা থাকে, তিনি আমাকে প্রদান করুন, কিন্তু যে কন্যা সনাম্নী ও ভিক্ষা স্বরূপে উপনীত হইবেক, এবং আমাকে যাহার ভরণ পোষণের ভার গ্রহণ করিতে হইবেক না, আমাকে তোমরা এরূপ কন্যা প্রদান কর। বাসুকি যে সকল নাগকে জরৎকারুর অম্বেষণে নিযোজিত করিয়াছিলেন, তাঁহারা তাহার নিকটে গিয়া এই সংবাদ প্রদান করিল। নাগরাজ বাকি শ্রবণমাত্র আপন ভগিনীকে বস্ত্রালঙ্কারে ভূষিত করিয়া, অরণ্য প্রবেশ পূর্বক জরৎকারুসমীপে উপস্থিত হইয়া, তাঁহাকে ভিক্ষা স্বরূপে প্রদান করিলেন। কিন্তু সেই কন্যা সনাম্নী কি না ও তাহার ভরণ পোষণের ভার লইতে হইবেক কি না, এই সংশয়ে তৎপরিগ্রহে বিমুখ হইয়া তাহার নাম জিজ্ঞাসা করিলেন, এবং বাসুকিকে কহিলেন, যদি এই কন্যার পাণিগ্রহণ করি, আমি ভরণ পোষণ করিতে পারি না।