মহাভারত (উপক্রমণিকাভাগ)/সপ্তত্রিংশ অধ্যায়
সপ্তত্রিংশ অধ্যায়— আস্তীকপর্ব্ব।
উগ্রশ্রবাঃ কহিলেন, নাকুলশ্রেষ্ঠ বাসুকি মাতৃদত্ত শাপ শ্রবণনন্তর সেই শাপমোচনের উপায় চিন্তা করিতে লাগিলেন। তৎপরে তিনি ঐরাবত প্রভৃতি ধর্ম্মপরায়ণ সমস্ত ভ্রাতৃগণের সহিত মন্ত্রণা আরম্ভ করিলেন। বাসুকি কহিলেন, হে ভ্রাতৃগণ! জননী আমাদিগকে যে শাপ দিয়াছেন, তাহা তোমরা সকলেই বিদিত অছি। আইস, সকলে মিলিয়া সেই শাপমোচনের উপায় চিন্তা করি। সর্বপ্রকার শাপেরই অন্যথা হইবার উপায় আছে; কিন্তু মাতৃদত্ত শাপ হইতে পরিত্রাণের কোনও পথ নাই। বিশেষত, জননী অবিনাশী, অপ্রমেয়স্বরূপ, সত্যলোকাধিপতি ব্রহ্মার সমক্ষে আমাদিগকে শপ দিয়াছেন, ইহাতেই আমার হৃৎকম্প হইতেছে। নিশ্চিত বুঝিলাম, আমাদের সমূলে বিনাশ উপস্থিত; নতুবা কি নিমিত্ত অবিনাশী ভগবান শাপদানকালে জননীকে নিবারণ করিলেন না? অতএব, যাহাতে সমস্ত নাগকুলের ভাবী বিপন্ হইতে পরিত্রাণ হয়, আইস, সকলে একত্র হইয়া তাহার উপায় চিন্তা করি; কোনও ক্রমেই কালাতিপাত করা উচিত নহে। আমরা সকলেই বুদ্ধিমান্ ও বিচক্ষণ; মন্ত্রণা করিয়া অবশ্যই শাপমোক্ষের কোনও উপায় উদ্ভাবিত করিতে পারি। দেখ! পূর্ব্ব কালে ভগবান্ অগ্নি অন্তর্হিত হইয়াছিলেন, কিন্তু দেবতারা মন্ত্রণাৰলে ভঁহার উদ্ভাবন করেন। এক্ষণে যাহাতে জনমেজয়ের সর্পস না হইতে পায়, অথবা বিফল হইয়া যায়, এমন উপায় করিতে হইবেক।
এইরূপ বাসুকিবাক্য শ্রবণ করিয়া, নীতিবিশারদ সমবেত কনন্দনের। তথাস্তু বলিয়া উপস্থিত কার্য্য সাধন বিষয়ে প্রতিজ্ঞা করিল। তন্মধ্যে কোনও কোনও নাগ কহিল, আমরা ব্রাহ্মণের স্বরূপ পরিগ্রহ করিয়া জনমেজয়ের নিকট এই ভিক্ষা চাহিব যে, তুমি যজ্ঞ করিও না। কতকগুলি পণ্ডিভিমানী নাগ কহিল, চল, সকলে গিয়া তাহার মন্ত্রী হই, তাহা হইলে তিনি সকল বিষয়েই কার্যাকার্য নিরূপণের নিমিত্ত অম!দিগকে জিজ্ঞাসা করিবেন;, তখন আমরা যাহাতে যজ্ঞ না হইতে পায়, এরূপ পরামর্শ দিব। সেই অসাধারণ বুদ্ধিমান রাজা আমাদিগকে নীতিবিদ্যাবিশারদ দেখিয়া অবশ্যই যজ্ঞ। বিষয়ে মত জিজ্ঞাসা করিবেন। আমরা ঐহিক ও পারলৌকিক অশেষ বিষম দোষ দৰ্শাইয় ও অপরাপর ভূরি ভূরি কারণ নির্দেশ করিয়া, এ রূপে নিষেধপক্ষে মত দিব যে, আর সে মত্ত হইতে পাইবেক না। অথবা যে সৰ্পৰ্ষত্রবিধান রাজকার্যতৎপর ব্যক্তি সেই যজ্ঞের উপাধ্যায় হইবেন, আমাদের মধ্যে কোনও নাগ গিয়া তাঁহাকে দংশন করুক, তাহা হইলেই উহার মৃত্যু হইবেক। এই রূপে উপাধ্যায় মরিলে আর সে যজ্ঞ হইবেক না। তদ্ভিন্ন সর্পসত্রজ্ঞ আর আর যে সকল ব্যক্তি যজ্ঞের ঋত্বিক হইবেন, তাহাদিগকেও দংশন করিব; তাহা হইলেই কার্য্য সিদ্ধ হইবেক। ইহা শুনিয়া অন্যান্স ধর্মাত্মা দয়ালু নাগ কহিল, এ তোমাদের অতি অসৎ পরামর্শ, ব্রহ্মহত্যা কোনও ক্রমেই বিধেয় নহে, বিপৎকালে নির্ম্মলধর্ম্মমূলক প্রতীকার চিন্তা করাই প্রশস্ত কল্প, অধর্ম্মপরায়ণতা সমস্ত জগৎ উচ্ছিন্ন করে। আর আর নাগেরা কহিল, আমরা জলধরকলের পরিগ্রহ করিয়া বারিবর্ষণ দ্বারা যজ্ঞীয় প্রদীপ্ত হুতাশন নিব্বার্ণ করিব; আর ঋত্বিকগণ রজনীযোগে যখন অনবহিত থাকিবেন, কোনও কোনও না সেই সময়ে যজ্ঞপাত্র সকল হরণ করিয়া আনিবে, তাহা হইলেই ধারে বিঘ্ন ঘটিৰেক। অথবা, শত সহস্র নাগগণ সকলকেই এক কালে দংশন করুক, এরূপ করিলে অবশ্যই তাহাদের ত্রাস জম্মিবেক। কিংবা ভুজগের অতি অপবিত্র স্বীয় মূত্র পুরীষ দ্বারা সংস্কৃত ভোজ্য বস্তু সকল দুষিত করুক। আর আর নাগেরা কহিল, আমরাই সেই, যজ্ঞের ঋত্বিক হইব, এবং অগ্রেই দক্ষিণা দাও বলিয়া যজ্ঞ ভঙ্গ করিব। এইরূপ করিলে রাজা জনমেজয় তামাদিগের বশীভূত হইয়া আমাদিগেরই ইচ্ছানুরূপ কর্ম্ম করিবেন। কেহ কেহ কহিল, রাজা যৎকালে জলক্রীড়া করিবেন, তখন তাহাকে রুদ্ধ করিয়া গৃহে আনিয়া বন্ধন করিয়া রাখিব, তাহা হইলেই যজ্ঞ রহিত হইবে। আর কতকগুলি পণ্ডিতম্মন্য মূখ নাগ কহিল, অন্য চেষ্টা পরিত্যাগ করিয়া রাজাকেই দংশন করা ভাল, তাহা হইলেই সকল সম্পন্ন হইল; রাজা মরিলেই সকল অনর্থের মূলোচ্ছেদন হইবেক। মহারাজ! আমাদিগের যেরূপ বুদ্ধি তদনুরূপ কহিলাম; এক্ষণে তোমার যেরূপ অভিমত হয়, কর।
নাগরাজ বাকিকে ইহা কহিয়া নাগগণ তদীয় মুখ নিরীক্ষণ করিতে লাগিল। বাসুকি কিয়ৎ ক্ষণ চিন্তা করিয়া কহিলেন, হে ভুজঙ্গমগণ! তোমরা সকলে যে পরামর্শ স্থির করিলে তাই আমার মতে কর্তব্য বোধ হইতেছে না। তোমরা যাহা বাহা কহিলে, তাহার কিছুই আমার অভিমত নহে। কিন্তু যাহাতে তোমাদের হিত হয়, এমন কোনও উপায় দেখিতে হইবেক। আপনার ও জ্ঞাতিবর্গের হিতার্থে, আমার মতে মহাত্মা কশ্যপকে প্রসন্ন করাই সর্ব্বোৎকৃষ্ট উপায়! তোমাদিগের বচনানুসারে কার্য্য করিতে আমার প্রবৃত্তি হইতেছে না। যাহাতে তোমাদের মঙ্গল হয়, তাহা জামিই বিবেচনা করিয়া স্থির করিব। এক্ষণে আমি কুলজ্যেষ্ঠ, সুতরাং যাবতীয় দোষ গুণ আমার উপরেই পড়িবেক; এই নিমিত্তই আমি বিশেষ দুঃখিত হইতেছি।