নয়

কতকালের ঘর-পালানো ছেলে ঘরে ফিরেছে, তাকে নিমেই সকলে ব্যস্ত, তখন তো আর বিয়ের কথা তোলা যায় না। ছেলে বেঁচে আছে বললে পর্যন্ত রাগ করে, এতকাল নকুল যে ছেলের ওপর বিরাগ দেখিয়ে এসেছে, ছেলেকে দেখেই নকুল যেন সব ভুলে গিয়েছিল! ছেলে যে চোখটা কাণা করেনি। সেই চোখে মুগ্ধ দৃষ্টিতে সে ছেলের দিকে তাকিয়ে छिल, उद्धि कुँ ঋকরে শুনছিল তার কথা।

 আলোচনাটা নাগাকে তাই স্থগিত রাখতে হয়েছে। তবে বিশেষ ভাবুন তারু হয় নি, কদিন পরেই তো সে ফিরে আসবে।

 এবার যাতায়াতে হিসাবের চেয়ে সময় লাগল অনেক বেশী। তাড়াহুড়া করার কিছু ছিল না, জলকন্যা তাই অনেকটা মন্থরগতিতে উত্তরদিকে যাত্রা আরম্ভ করেছিল। নদীর বৈচিত্র্য তো ছিলই, তার ওপরে ছিল বর্ষার সূচনার বৈচিত্র্য। গুমোট করে আকাশের এক প্রান্ত থেকে মেঘ আঁকাশ ছেয়ে ফেলতে ফেলতে জোর বাতাস উঠে মেঘ উড়িয়ে নিয়ে গেল, সকাল থেকে শুরু করে সারাদিন মুষলধারে বর্ষণের পর বৃষ্টি থেমে গিয়ে সারারাত আকাশে চলল। চাঁদ আর টুকরো টুকরো মেঘের আশ্চর্য খেলা। নাগা প্রায় রূপার কথা ভুলে গেল আর যাদববাবু প্রায় ভুলে গেলেন তার জলকন্যা বেআইনী মাল ব্যয়ে চলেছে।

 নিতাই সাহা হিসাবী লোক, ফিরবার সময় জলকন্যা যাতে তার একটা 'আইনসঙ্গত চালান নিয়ে আসে তার ব্যবস্থা, সে করে রেখেছিল। মালের প্রত্যাশাতেই জলকন্যাকে তিনদিন নোঙর ফেলে বসে থাকতে হল, তারপর এক রাশি বস্তা বোঝাই নিয়ে ফিরবার পথে জলকন্যার গতি আপনা থেকেই মন্থর হয়ে গেল। বস্তাগুলি তুলবার সময় থেকেই জলকন্যার জন্য যা দিলবাবু বড়ই মমতা বোধ করেছিলেন, এ যেন অত্যাচার করা হচ্ছে তার লিঞ্চের ওপর আর জীবন্ত প্রাণীর মতইট লঞ্চ যেন সেটা অনুভব করছে। লাগে চুক্তি করা না থাকলে যাদববাবু এত বোঝাই নিতে কখনোই রাজী কতেন না। তার জলকন্যা কি গাধাবোট?

 এবার দেনাপাওনা নিয়ে নিতাই সাত কোনরকম গোলমাল করল না। বরং, ভিমনা থেকে আরম্ভ করে লঞ্চের সমস্ত খালাসী লস্করকে কিছু কিছু অতিরিক্ত টাকা পুরস্কার দিয়ে বসল। নিতাই সাহা টাকা বড় ভালবাসে, চালানী কারবার থেকে প্রচুর আয় হলেও টাকার লোভে সে চোরাই মাল কেনা বেচা করে, কিন্তু যাকে একবার সে পছন্দ ও বিশ্বাস করে তার সঙ্গে আর কোনরকম ব্যবসাদারী প্যাচ কষবার চেষ্টা করে না।

 কথায় কথায় সে বলে, “জানেন যাদববাবু, যাগে লগে কারবার করি, ভদ্রলোক নাই কওন যায়। তাগো লগে ভদ্রতা করুম কি? ফাকি দেওনের চেষ্টা যদি না করি তারা ভাববো। আমি বোকা হাবা মানুষ।”

 বিদায় নেবার সময় সে বলে গেল, “কয়দিন পরে আপনেরে ডাকুম সন্দ করি। বর্ষার আগে কয়টা কাম সাইরা রাখুম ভাবতেছি।”

 কিছুক্ষণ থেকে সাপুড়ের বাঁশীর আওয়াজ কাণে আসছিল, নিতাই চলে গেলে নাগা লঞ্চ থেকে নেমে সাপ খেলানো দেখতে গেল। একটা দোকানের সামনে সাপুড়েকে ঘিরে ভিড় জমেছে আর ভিড়ের ঠিক সামনেই দাড়িয়ে আছে পঞ্চ।

 “কখন আইলা নাগা?”

 ভোরে আইছি। এখানে কর কি?”

 ‘সাপ খেলান দেখি, আর কি করুম? চা খাইবা?”

 “দেইখা লই কেমন সাপ খেলায়।”

 সাপ খেলানোয় নতুনত্ব কিছু নেই, সেই গেরুয়া আলখাল্লা পরা সাপুড়ে, সেই ঝাঁপি, সেই একটানা সুরের বাঁশী। তবু সাপ খেলানো কখনো পুরানো হয় না, কখনো একঘেয়ে লাগে না। কেবল ঝাঁপির মুখ বন্ধ করে সাপুড়ে যখন বাঁশী বাজাতে বাজাতে চলে যায় তখন মনে হয় জীবনের বড় একটা উত্তেজক ঘটনা যেন শেষ হয়ে গেল। কিছুক্ষণ মনটা অধীর হয়ে থাকে, ফাঁকা ফাঁকা লাগে।

 খেলার শেষে পথুর সঙ্গে নাগ চায়ের দোকানে চ খেতে গেল। চা তার ভাল লাগে না, খাওয়ার পর মুখটা কেমন বিস্বাদ হয়ে থাকে। কিন্তু রূপার দাদা পঞ্চর নিমন্ত্রণ তো রক্ষা-করা চাই। প্যাকিংকেসের কাঠ জোড়া দেওয়া টেবিলে রঙচটা নোঙর কাপে ফুটন্ত চা দিয়ে যায়, নাগা জিজ্ঞাসা করে, “বাড়ীতে গেছিল্লা নাকি আর?”

 ‘গেছিলাম। রূপার বিয়া জান না, তোমাগো পরাশার লগে?”

 “কবে বিয়া?”

 ‘শাওন মাসের সাত তারিখ। দেরি নাই বেশী।”

 গরম চায়ে চুমুক দিতে গিয়ে নাগার মুখ পুড়ে যায়। পঞ্চু হেসে বলে, “আরো মরদ, চা খাওন শেখো নাই?”

 ‘পরশ টাকা দিছে, একশ টাকা?”

 “হ, দিছে। কই যে টাকা পাইল ছোকরা! বড় কর্তা দিছে সন্দ” করি, বড়কর্তার লগে বড় খাতির পরাশার। তোমরা গেছিলা কই?”

 “ঘুইরা বেড়াইতেছিলাম নানান খানে।”

 “হ, ছোট কর্তার বেড়ানের শখ চিরডা কাল। আগে যাইতেন নাও লিয়া, অখন আবার লঞ্চ কিনছেন। কতদূর গেছিলা? সারপুতা? কও কি সারপুতা তো এইখানে না!”

 নাগার কথা বলতে ভাল লাগছিল না, কিন্তু পঞ্চর কথার কামাই নেই। মানুষের সঙ্গে ভাব করার তার আশ্চর্য ক্ষমতা আছে, এক কথা শেষ না করেই আরেক কথা পাড়ে, কথার মাঝখানে চায়ের সঙ্গে খাবার জন্য বিস্কুট কিনে দেয় নাগাকে, নিজে সে যে কত দুঃখী সে কথা বলে আর মাঝে মাঝে দুটি একটি কথা জেনে নেয় লঞ্চে ঘুরে বেড়ানো সম্বন্ধে।

 হঠাৎ সে চিন্তিত মুখে বলে, “কি হইছে তোমার, মুখ খ্যান ভার দেখি? নাগা বলে, “না, কিছু হয় নাই।” চায়ের দোকানের বাইরে এসে পঞ্চ নাগাকে একটি অনুরোধ জানাল। দু'এক দিনের মধ্যে লঞ্চ যদি করমতলায় ফিরে যায় সে যাতে লঞ্চে যেতে পারে সেজন্য নাগা যেন যাদববাবুকে বলে অনুমতি নিয়ে রাখে।

 ‘গরীব মাইনষের বার বার পয়সা দিয়া যাওন-আসন পোষায় না নাগা।'

 তাড়াতাড়ি করমতলায় ফিরে যাবার জন্য নাগার মন ছটফট করছিল এখান থেকে লঞ্চ যদি করমতলায় ফিরেও যায়, মাল খালাস দিয়ে পরশুর আগে যেতে পারবে না। অন্য কাজে যদি আটকে যায়, তা হ’লে করমতলায় ফিরতে আরও কতদিন লাগবে কে জানো! যাদববাবুর ফাছে ছুটি নিয়ে ওবেলা সাতখামারের জাহাজে গেলে হয় না?

 যাদববাবু বললেন, “বাড়ীতে যাবি? সে” আমিও যাই-বইসা বইসা ছাল নামান দেইখা করুম কি?”

 করমতল পৌছিতে রাত হয়ে গেল। রূপা কি এখন জেগে আছে? বাড়ীর কেউ কি জেগে আছে? কি করে এখন একবার রূপাকে দেখে আসা যায়? চলতে চলতে একটা কথা নাগার মনে পড়ে গেল। পথের মোড়ে পৌছে ‘আসতেছি কর্তা” বলে সে নকুলের বাড়ীর রাস্তা ধরল॥

 নকুল সবে দরজা বন্ধ করেছিল, নাগার ডাক শুনে বেরিয়ে এল।

 “কিরে নাগা?”

 “পঞ্চুর লগে দেখা হইছিল।”

 “কি কইছে পঞ্চু?”

 নাগা হাঁ করে দরজার দিকে তাকিয়ে ছিল। রূপা কি ঘুমিয়ে পড়েছে? রূপা জেগে থাকলেও তার সঙ্গে চুপিচুপি দু’চারটা দরকারী কথা বলার সুযোগ যে আজ জুটবে না। তাতে কোন সন্দেহ নেই। তবু রূপাকে অন্ততঃ একবার না দেখে ফিরে গেলে চলবে কেন?: রূপার ওপর নাগার রাগ হতে থাকে। সন্ধ্যা হতে না হতে এমন নিশ্চিন্ত মনে ঘুম। আর তার এদিকে ভাবনায় চিন্তায় মাথা খারাপ হয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়েছে। রূপা কি—”।

 “আঁ? পঞ্চ কি কইছে? কইছে আজ কাইলের মধ্যে আসবো।”

 “পঞ্চর দোকান দেখছস নাগা?”  'না, দেখি নাই।”

 প্রথমদিন পঞ্চ বলেছিল সদরে সে নাকি একটি ছোটখাট দোকান দিয়েছে। কিন্তু কোথায় দোকান কিসের দোকান জািনবার কৌতুহল নাগার হয় নি। এবার নকুলকে কি বলা যায় নাগা তাই ভাবছে, দরজার কাছে রূপাকে দেখা গেল। রূপার মুখখান হাসি-হাসি অথবা কাঁদ-কাঁদ পিছনের ডিবারির আলোতে কিছুই বুঝা গেল না। এদিকে দরজা বন্ধ করে শুয়ে পড়বার জন্য নকুল ছটফট উসখুসি করছে, এতরাত্রে এখানে দাঁড়িয়ে থাকবার কোন ছুতাও তার নেই।

 তখন নাগার মনে জাগল এক বুদ্ধি—কুবুদ্ধিই বলা যায়।

 “আ কৃপাল, আসল কথাই ভুইলা গেছি। কর্তা তোমারে ডাকছেন— কর্তা আছেন। লঞ্চে।”

 “আমারে ডাকছেন? অখন?”

 “হা, চট কইরা যাও। মেজাজ ভাল না। কর্তার।’ নকুল আর কি করে, কোমরে ভাল করে কাপড় জড়িয়ে বলল, “নে, যাই’।

 নাগা বলল, “আমি বাড়ীত গিয়া ঘুমামু, দুই রাইত ঘুমাই নাই।” নকুল অগত্যা একাই নদীতীরে লঞ্চের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে গেল। সারাদিন চিড়ে কুটে রূপার মা অঘোরে ঘুমোচ্ছিল, কমপক্ষে আধুঘণ্টা রূপার সঙ্গে কথা বলার। আর কোন বাধাই রইল না। প্রথমে রূপাই কথা বলল।

 “হইছে তো আক্কল? ঘুমাও গিয়া ঘরে-সাত তারিখ তাক ঘুমাইও *&न भज॥”

 “আমার দোষ কি?” ‘দোষ না তোমার? কইলাম। মতলব করতেছে লোকটা, চইলা গেলা কোন হিসাবে? দেৱী করলা ক্যান?

 হ, নাগা দোষ করেছে বটে, চেষ্টা করে দেখার বদলে স্রোতে গা ভাসিয়ে দিয়েছে। কিন্তু সে কি ভাবতে পেরেছিল। পরেশ এর মধ্যে টাকা যোগাড় করে দিনক্ষণ সব ঠিক করে ফেলবে।  “অখন কি করন যায় ক” দেখি রূপা?”

 “আমি কি কমু? কারনের কি আছে অখন!”

 দুঃখে অভিমানে রূপা মুখ ভার করে বসে থাকে। আজ না বললেই নয় এমন কত কথা রূপাকে বলার আছে মনে হয়েছিল নাগার, এখন আর বলার কথা সে খুজে পাচ্ছে না। নাগা উসখুসি করে, তারপর তাকিয়ে দ্যাখে কি, রূপার চোখ দিয়ে। টস টস করে জল পড়ছে।

 নকুলের ফিরে আসতে অনেক দেরি ছিল, কিন্তু নাগা উঠে পালিয়ে গেল।

 বাড়ী ফিরে কাউকে কিছু না জানিয়ে ঘরে গিয়ে শুয়ে পড়ল বিছানায়। নিজের বিছানায় বসে পরেশ বিড়ি টানছিল, জিজ্ঞাসা করুল, “কই গেছিলি?”

 নাগা ধীরে ধীরে বলল, “আমার ঘুম পাইছে। পরেশ।”

 পরেশ তাড়াতাড়ি বলল, “য়ুম না, ঘুমা। কই কি, রূপার লাগে আমার বিয়া ঠিক হইয়া গেছে জানস? খানিকক্ষণ অপেক্ষা করে নাগার সাড়া না পেয়ে পরেশ ক্ষুন্ন হয়ে বলল, “তরে আমি বন্ধু মনে করে –’।

 “আমি অখন ঘুমামু পরেশ।”

 পরদিন যাদববাবু বললেন, “নকুইলার লগে ফাজলামি ক্যান রে নাগা?

 নাগা চুপ॥

 ‘কাল হইতে খাস নাই ক্যান?”

 নাগা চুপ॥

 “মুখ শুকনা ক্যান রে ওর?”

 ‘নাগা চুপ॥

 তখন যাদববাবু চুপ করে খানিকক্ষণ নাগার মুখেৰ দিকে চেয়ে রইলেন। তারপর মৃদুস্বরে বললেন, “কি হইছে রে?”

 “কিছু না কর্তা।”

 বেলা বাড়লে নকুল মাঝি এসে তাকে পাকড়াও করল, চীৎকার করে বলতে লাগল, “আমার লগে ইয়াকি। তাঁর বাপ আমারে মান্য কইরা কথা কাইত, আমার লগে তুই ইয়ার্কি দেস।”  ঘরের দাওয়া থেকে যাদববাবু, ধমক দিলেন। তখন গলা নামিয়ে নকুল বলতে লাগল, “তর মতলব বুঝি নাই আমি ভাবছস, মাইয়ার মন ভাঙাইতে গেছিলি তুই! পরাশারে বিয়া করব না। কয়,—ক্যান বিয়া করব না। পরশারে? আমি যার লগে বিয়া দিমু তারেই বিয়া করব—একশ’ বার করব।”

 নাগা মাথা নীচু করে বলল, “তুমি গুরুজন, কাইল তোমারে কষ্ট দিয়া দোষ করছি মামু, আমারে মাপ কইরো। আরেক কথা কই শোন, আমি তোমারে একশ’ বিশ টাকা পণ দিমু, পরশার লগে বিয়া দি ও না রূপার।’

 নকুল ফোস করে উঠল। ‘পরশার লগে দিমু না, তার লগে দিমু? চাল চুলা নাই তর, বিয়া কইরা বেী নিয়া যাবি কই?”

 একথা মিথ্যা নয়। গরীব হলেও পরেশের বাপ . ভাই আছে, ঘুরবাড়ী আছে, তার কিছুই নেই। নাগা চুপ করে রইল।

 নকুল চোখ পাকিয়ে বলল, “তরে কষ্টয়া দিতেছি শোন” নাগা, আবার যদি পা দিবি আমার বাড়ীতে, ঠ্যাং তার খোড়া কইরা দিমু আমি।”

 নকুল, চলে গেলে পরেশ নাগাকে জিজ্ঞাসা করল, “বুড়া চটছে ক্যান তর উপর?”

 একটা কড়া জবাব দিতে গিয়ে নাগা প্রাণপণে আত্মসংবরণ করল, কারণ, পরেশ আতি নম্রভাবে আশ্চর্য বিনয়ের সঙ্গে কথাটা জিজ্ঞাসা করেছে—বদমেজাজী গুরুজনকে ছোট ছেলে যেভাবে প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করে।

 “চটব ক্যান, চটে নাই।” বলে নাগা সেখান থেকে সরে গেল। পরেশ যেন হঠাৎ বড় বেশী ভদ্র আর বিনয়ী হয়ে গেছে। পরেশের সঙ্গে হাতাহাতি মারামারি বরং করা চলে, বন্ধুর মত মিষ্টি মিষ্টি কথা বলে আলাপ করবার মত ধৈর্য নাগার নেই।