দশ

পরদিন বিকালে ভিমন্যা লঞ্চ নিয়ে এল। তার কাছে শোনা গেল, ডেনিস খবর পাঠিয়েছে কিছু দিনের মধ্যে হয়তো লঞ্চটি তলার দরকার হতে পারে, তবে এখনো কিছু ঠিক নেই। লঞ্চে পঞ্চও এসেছে। তার সম্বন্ধে ভিমনা একটু গম্ভীর ভাবেই মত প্রকাশ করল—“গায়ে পইড়া খাতির জমাইতে চায়, কেমন যান সনদ লাগে ছোকরারে।”

 যাদববাবু হেসে বললেন, “আমাগো নকুইলার পোলা। জন্মাবধি দেইখা আসতেছি।”

 একটি দু’টি করে ভোঁতা। দিনগুলি কাটতে লাগল। দু’টি একটি ছোট ছোট কাজের আহবান এল কিন্তু যাদববাবু সেগুলি বাতিল করে দিলেন। নাগার মনমরা ভাব দেখে সকলেই অবাক হয়ে ভোবল, ছেলেটার হল কি? ছোটমা কয়েকবার তাকে ডেকে জিজ্ঞাসা করলেন, তার অসুখ করেছে কিনা। একদিন জোর করে ধমক দিয়ে তাকে তিনি খানিকটা পাচন গিলিয়ে দিলেন। নিজে থেকে নাগা কিছুতেই ভাব করতে আসছে না। দেখে কণিকা অগত্যা দু’একবার তার সঙ্গে ভাব করতে গেল। কিন্তু একেবারেই আমল পেল না। খোকার গ্রীষ্মের ছুটি আগেই শেষ হয়ে গিয়েছিল, একদিন সকালে গুরুজনকে প্রণাম করে সে কলকাতায় বিদ্যা অর্জন করতে চলে গেল।

 একদিন সকালে এল নিতাই সাহা। পরেশ তখন দু’দিনের ছুটি নিয়ে বাড়ী যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হচ্ছে। এ ক’দিনে পরেশের উপর নাগার বিরাগ অনেকটা কমে গিয়েছিল। কদিন পরেই তার এত সাধের বিয়ে কিন্তু নাগার মতই তার যেন আনন্দ নেই, উৎসাহ নেই। তার মুখখানাও সর্বদা শুকনো দেখায়, কেমন একটা ভীরু স্তিমিত দৃষ্টিতে সে মানুষের দিকে তাকায়। নাগা কিছু বুঝতে পারে না বটে। কিন্তু পরেশের ওপর মনটা তার নরম হয়ে আসে। এরকম মানুষের ওপর কি রাগ পুষে রাখা যায়?

 নিতাই সাহা চৌকীতে পা তুলে জাকিয়ে বসল। আজ তার মুখের ভাব অন্যদিনের চেয়ে বেশী ভারিকি। ভাল করে বসে সে বলল, ‘ম-ঠাকরুণগোর গয়না পত্তর কিছু চুরি গেছে নাকি যাদববাবু?”

 যাদববাবু আশ্চর্য হয়ে বলেন, “কই না?”

 জবাব শুনে নিতাই যেন আরও বেশী আশ্চর্য হয়ে গেল। চুরি যায় নাই? হারায় নি কিছু?  যাদববাবু মাথা নেড়ে হেসে বললেন, ‘ব্যাপার কি সা’মশায়।”

 নিতাই চিন্তিত মুখে বলল, “একবার জিগাইয়া আসেন দেখি? তোরঙ্গ খুইলা গয়না পত্তিরগুলি একবার মিলাইয়া নিবেন।”

 যাদববাবু হাসিমুখে বাড়ীর মধ্যে চলে গেলেন, মিনিট দশেক পরে যখন ফিরে এলেন, মুখ তার গম্ভীর হয়ে গেছে।

 ‘বৌঠানের কয়টা গয়না মেলে না। সা”মশায়।”

 বড় একটা ট্রাঙ্কের মধ্যে ছোট একটি টিনের বাক্সে কতকগুলি গয়না ছিল, তার মধ্যে কয়েকটা গয়না উধাও হয়ে গেছে, ট্রাঙ্কে যেমন তালাচাবি লাগানো ছিল তেমনি আছে। চাবির গোছাও মাধববাবুর স্ত্রীর আঁচলে বাধা আছে।

 “আপনে জানলেন কি কইরা সা’মশায়?”

 নিতাই সাহা গর্বের হাসি হাসল। বলল, “আমার আজানা কি আছে যাদববাবু। অখন আমার কথা শোনেন, গয়না আপনারে আমি পাওয়াইয়া দিমু, তবে চোরেরে পুলিশে দেওন চলব না, পিটানি দেওনও চলাব না।”

 “যাদববাবু বললেন, “বেশী।”

 নিতাই মুখ গম্ভীর করে বলল, “কি জানেন যাদববাবু, অন্য মাইনষের ব্যাপার হইলে চুপ মাইরা যাইতাম, আমার কিসের মাথা ব্যথা?, পয়সা দিয়া সোনা কিনছি, পয়সা নিয়া বেইচা দিমু, কার কি চুরি গেছে না গেছে আমার কি। তবে আপনে হইলেন ভদ্রলোক, আপনে আমারে বিশ্বাস করেন আপনারে আমি বিশ্বাস করি, জাইনা শুইনা। আপুনের ক্ষতি করি কেমনে? আবার যে আমারে বিশ্বাস কইরা গয়না বেচছে, তারেই বা পুলিশে”দিমুনে কেমনে? বুঝলেন না?”

 যাদববাবু সায় দিয়ে জানালেন, তিনি বুঝতে পেরেছেন।

 তখন নিতাই বলল, “আপনার পরেশ মাঝিরে ডাকেন। আমি কি জানি ব্যাটা আপনের চাকর, কাইল মোটে জানিছি।”

 পকেট থেকে সোনার গয়না বার করে সে যাদববাবুর হাতে দিল। বাড়ীর ভিতর থেকে সকলের কলরব কানে আসছিল, মাধববাবুর গলার আওয়াজটাই সব চেয়ে বেশী স্পষ্ট। যাদববাবু ভেতর গিয়ে হৈ-চৈ থামিয়ে দিয়ে এলেন। গয়না ফিরে পাওয়া যাবে শুনে হৈ-চৈ কমল বটে, কিন্তু এমন একটা রহস্যময় ব্যাপার নিয়ে মেয়েদের উত্তেজিত আলোচনা কে থামাবে?

 যাদববাবু নাগাকে বললেন, ‘পরশারে ডাইকা আন নাগা।”

 নাগা হাতজোড় করে বলল, “আমি না কর্তা।”

 কিন্তু পরেশকে ডেকে আনবার দরকার হল না। “বাড়ী যাওয়ার জন্য রওনা হয়ে সে বৈঠকখানার সামনে দিয়ে যাচ্ছে দেখা গেল। যাদববাবু ডাক দিতে সে তাড়াতাড়ি ঘরে এসে ঢুকল এবং নিতাই সাহাকে দেখে মুখখানা তার হয়ে গেল বিবর্ণ।

 নিতাই বলল, “ডর নাই পরশা। কর্তা কিছু করবেন না কইছেন। টাকাটা শুধু ফেরত দিয়া তুই যেখানে খুশী যা গিয়া।”

 পরেশ ঘাড়া-হেঁট করে দাড়িয়ে থাকে।

 যাদববাবু বললেন, “চুপ কইরা থাকাস যে?

 “আমার কাছে নাই।”

 “কি করছস টাকা?”

 “নকুইলারে দিছি।”

 যাদববাবু ভুরু কুঁচকে বললেন, “নকুইলারে দিছস? নকুইলাও আছে নাকি তার লগে?”

 “না, বিয়ার পণ দিছি।”

 “ও, তার বিয়ার পণ দিছস। একশ টাকা পণ। তুই দেখি নবাব হইছস পরেশ??

 “তার কমে নকুইলা রাজী না কর্তা।”

 যাদববাবু মোটা চুরুট ধরালেন। পরেশের কাঁদ-কাঁদ মুখের দিকে তাকাতে তাকাতে বললেন, “নকুইলারে ডাইকা আন নাগা ’।

 নাগা এবারেও হাতজোড় করে বলল, “আমি না কর্তা।”

 বার বার নাগার অবাধ্যতায় ক্রুদ্ধ হয়ে তাকে ধমক দিতে গিয়ে যাদববাবু থেমে গেলেন। বোধ হয় তার মনে পড়ে গেল, কদিন আগে রাত্রি বেলা। তিনি ডাকছেন বলে মিছামিছি হয়রান করায় নাগার সঙ্গে নকুলের ঝগড়া হয়েছে। ঘর থেকে বেরিয়ে গিয়ে নকুলকে ডেকে আনতে অন্য লোক পাঠিয়ে দিলেন।

 আধঘণ্টা পরে নকুল এল।

 যাদববাবু তাকে ব্যাপারটা বুঝিয়ে দিয়ে বললেন, “সব জাইনা অখন তুমি যদি পরাশার লগে মাইয়ার বিয়া দিতে রাজী থাক নকুইলা, টাকা আমি ফিরত নিমু না?

 'চোরের লগে মাষ্টয়ার বিয়া দিমু কর্তা?

 ‘চোর? চোর কিনা জানি না, নকুল। আমার কিছু কওনের নাই, তোমার যা খুশী করব।” যাদববাবুর মুখ বড় স্নান দেখাচ্ছিল। নাগার মনে হল যেন তার মনের ভাব কিছু কিছু অনুমান করতে পারছে। হয়ত যাদববাবু ভাবছেন, তিনিও তো প্রায় চোর ডাকাতের দলেই ভিড়ে পড়েছেন, চোরের বিচার করবার অধিকার তার কোথায়!

 নকুল তার একটিমাত্র চোখ মিটমিট করতে করতে বলল, “না কর্তা, চোরের হাতে মাইয়া দিমু না।”

 “আধঘণ্টার মধ্যে নিজের জিনিসপত্র নিয়ে পরেশ চিরদিনের জন্য এ বাড়ী থেকে বিদায় হয়ে গেল। এত লোকের মধ্যে কেবল নাগাই বোধ হয় তার জন্যে রীতিমত কষ্ট বোধ করতে লাগল। এতকাল চুরি না করলেও লোকটাকে নাগা অশ্রদ্ধা করে এসেছিল। আজ চোর বলে ধরা পড়ার পর তার সম্বন্ধে সে অশ্রদ্ধার ভাব কেটে গেছে। এমন বোকা তো পরেশ নয় যে তার খেয়াল ছিল না বাড়ীতে বাক্স থেকে গয়না। হারিয়েছে আর সে নকুলকে অতগুলি টাকা দিয়েছে জেনেও কেউ তাকে সন্দেহ করবে না।” আর কোন উপায় খুঁজে না পেয়ে মরিয়া হয়ে সে ধরা পড়ার যথেষ্ট সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও রূপার জন্য গয়না চুরি করেছিল। কাজটা ভাল হোক, মন্দ হোক, চেষ্টা তো সে করেছে, নাগার মত বাধা পাওয়া মাত্র হাল ছেড়ে দেয় নি।