॥এক॥

 ভাগীরথীর পশ্চিম তীরে বীরনগর গ্রামে গ্রীষ্মঋতুর একদিন সায়ংকালে গঙ্গাসৈকতে দুইটি বালক ও একটি বালিকা ক্রীড়া করিতেছে। সন্ধ্যার ছায়া ক্রমে গাঢ়তর হইয়া গঙ্গানদী আচ্ছাদন করিতেছে। জলের উপর কয়েকখানি পোত ভাসিতেছে, দিনের পরিশ্রমের পর নাবিকেরা ব্যস্ত রহিয়াছে, পোত হইতে দীপালোক নদীর চঞ্চল বক্ষে বড় সুন্দর নৃত্য করিতেছে। বীরনগরের নদীকূলস্থ আম্রকানন অন্ধকার হইয়া ক্রমে নিস্তব্ধ ভাব ধারণ করিতেছে। কেবল বৃক্ষের মধ্য হইতে স্থানে স্থানে এক-একটি দীপশিখা দেখা যাইতেছে, আর সময়ে সময়ে পর্ণকুটীরাবলী হইতে রন্ধনাদি সংসারকার্য সম্বন্ধীয় কৃষক-পত্নীদিগের করব শুনা যাইতেছে, কৃষকগণ লাঙ্গল লইয়া ও গরুর পাল হাম্বারব করিতে করিতে স্ব স্ব স্থানে প্রত্যাবর্তন করিতেছে। ঘাট হইতে স্ত্রীলোকেরা একে একে সকলেই কলস লইয়া চলিয়া গিয়াছে নিস্তব্ধ অন্ধকারে বিশাল শান্ত-প্রবাহিনী ভাগীরথী সমুদ্রের দিকে বহিয়া যাইতেছে। অপর পাশ্বে প্রশস্ত বালুকাট ও অসীম কান্তার অন্ধকারে ঈষৎ দৃষ্ট হইতেছে। গ্রীষ্ম-পীড়িত ক্লান্ত জগৎ সুস্নিগ্ধ সায়ংকালে নিস্তব্ধ ও শান্ত।

 তিনটি বালক-বালিকায় ক্রীড়া করিতেছে, বালিকার বয়ঃক্রম নয় বৎসর হইবে। ললাট, বদনমণ্ডল ও গণ্ডস্থল বড় উজ্জ্বল, তাহার উপর নিবিড় কৃষ্ণ কেশগুচ্ছ পড়িয়া বড় সুন্দর দেখাইতেছে। হেমলতার নয়নের তারা দু’টি অতিশয় কৃষ্ণ, অতিশয় উজ্জ্বল, সুন্দরী চঞ্চলা বালিকা পরীকন্যার মত সেই নৈশ গঙ্গাতীরে খেলা করিতেছে।

 কনিষ্ঠ বালকটির রংক্রম একাদশ বৎসর হইবে, দেখিলেই যেন হেমলতার ভ্রাতা বলিয়া বোধ হয়। মুখমণ্ডল সেইরূপ উজ্জ্বল, প্রকৃতি সেইরূপ চঞ্চল। কেবল উজ্জ্বল নয়ন দুইটিতে পুরুষোচিত তেজোরাশি লক্ষিত হইত ও উন্নত প্রশস্ত ললাটের শিরা এই বয়সেই কখন কখন ক্রোধে স্ফীত হইত। নরেন্দ্রকে দেখিলে তেজস্বী ক্রোধপরবশ বালক বলিয়া বোধ হয়।

 শীশচন্দ্র ত্রয়োদশবর্ষীয় বালক, কিন্তু মনুষ্যের গম্ভীর ভাব ও অবিচলিত স্থিরবুদ্ধির চিহ্ন বালকের মুখমণ্ডলে বিরাজ করিত। শীশচন্দ্র বুদ্ধিমান, শান্ত, গম্ভীর-প্রকৃতির বালক।

 দুইটি বালক বালুকায় গৃহ নির্মাণ করিতেছিল, কাহার ভাল হয়, হেমলতা দেখিবে। নরেন্দ্র গৃহনির্মাণে অধিকতর চর কিন্তু চঞ্চল, হেম যখন নিকটে দাঁড়ায়, নরেন্দ্রের ঘর ভাল হয়, আবার হেম শ্রীশের ঘর দেখিতে গেলেই নরেন্দ্র রাগ করে, বালুকাগৃহ পড়িয়া যায়। মহাবিপদ, দুই-তিনবার উৎকৃষ্ট ঘর পড়িয়া গেল।

 হেম এবার আর শ্রীশের নিকট যাবে না, সত্য যাবে না, যথার্থ যাবে না; নরেন্দ্র, আর একবার ঘর কর। নরেন্দ্র মহা-আহ্লাদে চক্ষুর জল মুছিয়া ঘর আরম্ভ করিল।

 ঘর প্রায় সমাধা হইল হেম ভাবিল, নরেন্দ্রের ত জয় হইবে, কিন্তু শ্রীশ একাকী আছে, একবার উহার নিকট না যাইলে কি মনে করিবে? কেশগুচ্ছগুলি নাচাইতে নাচাইতে উজ্জ্বল জলহিল্লোলেব ন্যায় একবার শ্রশের নিকটে গেল। শ্রীশ ক্ষিপ্রহস্ত নহে, বালুকা-গৃহনির্মাণে চতুর নহে, কিন্তু ধৈর্য ও বুদ্ধিবলে একপ্রকার গৃহ করিয়াছে, বড় ভাল হয় নাই।

 নরেন্দ্র একবার গৃহ করে, একবার হেমের দিকে চাহে। রাগ হইল, হাত কঁপিয়া গেল, উত্তম গৃহ পড়িয়া যাইল। নরেন্দ্র ক্রুদ্ধ হইয়া বালুকা লইয়া হেম ও শ্রীশের গায়ে ছড়াইয়া দিল। শ্রীশের জিত, ঘর হইল না।

 নরেন্দ্রনাথ, সাবধান। আজ বালুকাগৃহ নির্মাণ করিতে পারিলে না, দেখো, যেন সংসার-গৃহ এরূপে ছারখার হয় না। দেখো, যেন জীবন-খেলায় শ্রীশচন্দ্র তোমাকে হারাইয়া বিষয় ও হেমলতাকে জিতিয়া লয় না।

 নরেস্থের ক্রোধধ্বনি শুনিয়া ঘাট হইতে একটি সপ্তদশবর্ষীয় বিধবা স্ত্রীলোক উঠিয়া আসিলেন। তিনি শ্রীশের জ্যেষ্ঠা ভগিনী; নাম শৈবলিনী।

 শৈবলিনী আসিয়া আপন ভ্রাতাকে তিরস্কার করিল। শ্রীশ ধীরে ধীরে বলিল, ‘না দিদি, আমি কিছুই করি নাই, নরেন্দ্র ঘর করিতে পারে না, সেইজন্য কাঁদিতেছে, হেমকে জিজ্ঞাসা কর।” “তা না পারুক, আমি নরেন্দ্রের ঘর করিয়া দিব।” এইরূপ সানা করিয়া শৈবলিনী চলিয়া গেলেন। শ্রীশ দিদির সঙ্গে চলিয়া গেল।

 হেম ও নরেন্দ্রের কলহ শীত্র শেষ হইল। হেম নরেন্দ্রের ক্রন্দন দেখিয়া সজলনয়নে বলিল, “ভাই, তুমি কাঁদ কেন? আমি একটিবার ঘর দেখিতে গিয়াছিলাম, তোমারই ঘর ভাল হইয়াছিল, তুমি ভাঙিলে কেন? তোমার কাছে অনেকক্ষণ ছিলাম, শ্রীশের কাছে একবার গিয়াছিলাম বৈ ত নয়? তুমি ভাই, রাগ করিও না। তুমি ভাই, কাঁদ কেন?” নরেন্দ্র কি আর রাগ করিতে পারে? নরেন্দ্র কি কখন হেমের উপর রাগ করিয়া থাকিতে পারে?

 তাহার পর বালক-বালিকার কি কথা? আকাশে কেমন তা ফুটিয়াছে। ওগুলা কি ফুল, না মানিক? নরেন্দ্র যদি একটি কুড়াইয়া পায়, তাহা হইলে কি করে?

তাহা হইলে গাঁথাইয়া হেমের গলায় পরায়। ঐ দেখ, চাঁদ উঠিবার আগে কেমন রাঙা হইয়াছে। ও আলো কোথা হইতে আসিতেছে। বোধ হয়, নদী পার হইয়া খানিক যাইলে ঐ আলো ধরা যায়। না, তাহা হইলে ওপারের লোক ধরিত। বোধ হয়, নৌকা করিয়া অনেক দূর যাইতে যাইতে চাঁদ যে দেশে উঠে, তথায় যাওয়া যায়; সে দেশে কি রকম লোক, দেখিতে ইচ্ছা করে। নরেন্দ্র বড় হইলে একবার যাবে, হেম, তুমি সঙ্গে যেও।

 বালক-বালিকা কথা কহিতে থাকুক, আমরা এই অবসরে তাহাদের পরিচয় দিব। এই সংসারে বয়োবৃদ্ধ বালক-বালিকারা গঙ্গার বালুকার ন্যায় ছার বিষয় লইয়া কিরূপ কলহ করে, চন্দ্রালোকের ন্যায় বৃথা আশার অনুগমন করিয়া কোথায় যাইয়া পড়ে, তাহারই পরিচয় দিব। পরিচয়ে আবশ্যক কি? পাঠক, চারিদিকে চাহিয়া দেখ, জগতের বৃহৎ নাট্যশালায় কেমন লোক-সমারোহ, সকলেই কেমন নিজ নিজ উদ্দেশ্যে ধাবমান হইতেছে। কে বলিবে কি জন্য?