দুই

 নরেন্দ্রনাথের পিতা বীরেন্দ্রনাথ দত্ত ধনাঢ্য ও প্রতাপশালী জমিদার ছিলেন। তিনি নিজ গ্রামে প্রকাণ্ড অট্টালিকা নির্মাণ করাইয়া আপন নামানুসারে গ্রামের নাম বীরনগর রাখিয়াছিলেন। তাঁহার যথার্থ সহৃদয়তার অন্য সকলে তাঁহাকে মান্য করিত, তাঁহার প্রবল প্রতাপের জন্য সকলে তাঁহাকে ভয় করিত, পাঠান-জায়গীরদারগণ ও স্বয়ং সুবাদার তাঁহাকে সম্মান করিতেন।

 বাল্যকালে বীরেন্দ্র নবকুমার মিত্র নামক একটি দরিদ্র-পুত্রের সহিত একত্রে পাঠশালায় পাঠ করিতেন। নবকুমার অতিশয় সুশীল ও নম্র ও সর্বদাই তেজস্বী, বীরেন্দ্রের বশংবদ হইয়া থাকিত, সুতরাং তাহার প্রতি বীরেন্দ্রের স্নেহ জন্মিয়াছিল। যৌবনকালে যখন বীরেন্দ্র জমিদারি স্থাপন করিলেন, নবকুমারকে ডাকাইয়া আপনার অমাত্য ও দেওয়ান-পদে নিযুক্ত করিলেন। নবকুমার অতিশয় বুদ্ধিমান ও সুচতুর, সুশৃঙ্খলরূপে কার্য-নির্বাহ করিতে লাগিলেন। নবকুমার স্বার্থপর হইলেও নিতান্ত মন্দ লোক ছিলেন না, বীরেন্দ্রের নিকট ভিক্ষা করিয়া দুইখানি গ্রাম আপনার নামে করিলেন, কিন্তু ভয়ে হউক, কৃতজ্ঞতাবশতঃ হউক, বীরেন্দ্রের জমিদারির কোনও হানি করেন নাই। বীরেন্দ্রের মৃত্যুর সময়ে নরেন্দ্র অতি শিশু, জমিদারি ও পুত্রের ভার প্রিয় সুহৃদের হস্তে ন্যস্ত করিয়া বীরেন্দ্র মানবলীলা সংবরণ করিলেন।

 ভালবাসা যতদূর নামে ততদূর উঠে না, অপত্যস্নেহের ন্যায় পিতৃস্নেহ বা মাতৃস্নেহ বলবান্ হয় না, দয়া অপেক্ষা কৃতজ্ঞতা দুর্বল ও ক্ষণভঙ্গুর। নবকুমারের কৃতজ্ঞতা শীঘ্র ভাঙিয়া গেল।

 নবকুমার নিতান্ত মন্দ লোক ছিলেন না, কিন্তু নবকুমার দরিদ্র, ঘটনাস্রোতে সমস্ত জমিদারি প্রাপ্তির আশা তাঁহার হৃদয়ে জাগরিত হইল। সে লোভ দরিদ্রের পক্ষে দুর্দমনীয়। বীরেন্দ্রের পুত্র অতি শিশু, বীরেন্দ্রের পূর্বেই মৃত্যুগ্রাসে পতিত হইয়াছিলেন, শিশুর বিষয় রক্ষা করে, এরূপ জ্ঞাতি-কুটুম্ব কেহ ছিল না, দুই-একজন যাঁহারা ছিলেন, তাহারাও নবকুমারের সহিত যোগ দিলেন। সংসারে যাঁহারা বীরেন্দ্রের অভিভাবক ছিলেন, তাঁহারা কিছুই জানিলেন না অথচ জানিয়া কি করিবেন?

 তথাপি নবকুমার সমস্ত জমিদারি একাকী লইবেন, প্রথমে এরূপ উদ্দেশ্য ছিল না, বীরেন্দ্রের জীবদ্দশাতেই দুই-পাঁচখানি গ্রাম আপন নামে করিয়াছিলেন, এখন আরও দুইপাঁচখানি গ্রাম আপন নামে করিতে লাগিলেন। ক্রমে লোভ বাড়িতে লাগিল। ভাবিলেন, আমার একমাত্র কন্যা হেমের সহিত নরেন্দ্রের বিবাহ দিব, অবশেষে বীরেন্দ্রের জমিদারি তাঁহার পুত্রেরই হইবে, এখন নাবালকের নামে জমিদারি থাকিলে গোলমাল হইতে পারে, সম্প্রতি আপন নামে থাকাতে বোধ হয় কোন আপত্তি হইতে পারে না। এই প্রকার চিন্তা করিয়া তদনুসারে কার্য করিতে লাগিলেন।

 তৎকালে সুবাদারের সভাতে প্রধান প্রধান জমিদার ও জায়গীরদারদিগের এক একজন উকীল থাকিত। তাহারা নিজ নিজ মনিবেব পক্ষ হইতে মধ্যে মধ্যে নজর দিয়া সুবাদারের মন তুষ্ট রাখিত ও মনিবের পক্ষ হইতে আবেদন আদি সমস্ত কার্য নির্বাহ করিত। সদরে এইরূপে একটি একটি উকীল না থাকিলে জমিদারির বিশেষ অনিষ্ট হইবার সম্ভাবনা ছিল।

 বীরনগর জমিদারির উকীল এক্ষণে নবকুমারের বেতনভোগী। তিনি বঙ্গদেশের কানঙ্গু মহাশয়ের নিকট আবেদন করিলেন যে, বীরেন্দ্রের মৃত্যু হইতে জমিদারির খাজনা নিয়মিতরূপে আসিতেছে না, তবে নবকুমার নামে একজন কার্যদক্ষ লোক সেই জমিদারির ভার লইয়া আপন ঘর হইতে যথাসময়ে খাজনা দিতেছে। নবকুমার বীরেন্দ্রের বিশেষ আত্মীয় ও বীরেন্দ্রের পরিবারকে প্রতিপালন করিতেছে। আবেদনসহ পঞ্চ সহস্র মুদ্রা কানঙ্গু মহাশয়ের নিকট উপঢৌকন গেল। আবেদনের বিরুদ্ধে কেহ দণ্ডায়মান ছিল না, তৎক্ষণাৎ বীরেন্দ্রের নাম খারিজ হইয়া নবকুমারের নাম লিখিত হইল। অদ্য নবকুমার মিত্র বীরনগরের জমিদার।

 জমিদারের হৃদয়ে নূতন নূতন ভাবের আবির্ভাব হইতে লাগিল। যে নরেন্দ্রের পিতাকে পূর্বে পূজা করিতেন, যে নরেন্দ্রকে এতদিন অতিযত্নে পালন করিয়াছেন, অদ্য সেই নরেন্দ্র তাঁহার চক্ষুর শূল হইল। নবকুমারের সাক্ষাতে না হউক, অসাক্ষাতে সকলেই বলিত নরেন্দ্রের বাপের জমিদারি, নবকুমারের জমিদারি' কেহ বলিত না। গ্রামের প্রজারাও নরেন্দ্রকে দেখিয়া জমিদারপুত্র বলিত। প্রকৃত জমিদার নবকুমার কি এ সমস্ত সহ্য করিতে পারেন? তিনি চিন্তা করিলেন, আমি কি অপবাদ বহন করিবার জন্যই এই জমিদার্নি করিলাম? পুনরায় নরেন্দ্রের সহিত হেমের বিবাহ হইলে কে না বলিবে, পিতার জমিদারি পুত্র পাইল, আমার নাম কোথায় থাকিবে? এতটা করিয়া কি পরিণামে এই ঘটিবে? আমি কি জমিদার হইয়াও বালকের দেওয়ান বলিয়া পরিগণিত হইব? কার্যেও কি তাহাই করিব, সযত্নে জমিদারি রক্ষা করিয়া পরে নরেন্দ্রকে ফিরাইয়া দিব? বিচক্ষণ প্রগাঢ়মতি নবকুমার এইরূপ চিন্তা করিয়া স্থির করিলেন যে, আপন নাম চিরস্মরণীয় করা আবশ্যক। তিনি পোষ্যপুত্র লইবেন অথবা কোন দরিদ্রের সহিত আপন কন্যা হেমলতার বিবাহ দিবেন।

 পণ্ডিতবর নবকুমার এইরূপ সুন্দর সিদ্ধান্ত করিয়া কার্যসাধনে যত্নবান হইলেন। নিকটস্থ একটি গ্রামে গোকুলচন্দ্র দাস নামক একজন ভদ্রলোক একটি পুত্র ও একটি বিধবা কন্যা ও অল্প সম্পত্তি বাখিয়া কাল গ্রাসে পতিত হন। পুত্রটির নাম শ্রীশচন্দ্র দাস, কন্যার নাম শৈবলিনী। নবকুমার শ্রীশচন্দ্রকে বীরনগরে আনাইয়া লালনপালন করিতে লাগিলেন। শৈবলিনী শশুরালয়ে থাকিত, কখন কখন ভ্রাতাকে দেখিবার জন্য বীরনগরে আসিয়া দুই-একদিন বাস করিত। ভ্রাতা ভিন্ন বিধবার আর কেহই এ জগতে ছিল না।

 বুদ্ধিমান নবকুমার দায়শূন্য ছিলেন না, বীরেন্দ্র জ্ঞাতি-কুটুম্বকে বাটী হইতে তাড়াইয়া দেন নাই; পরিচারিকারূপে তাঁহারা সকলেই আহারাদি কার্য করিত ও দিবানিশি প্রকাশ্যে নবকুমারের গৃহিণীর সাধুবাদ ও খোসামোদ করিত, গোপনে বিধাতাকে নিন্দা করিত। নবকুমার নরেন্দ্রকে এখনও লালনপালন করিলে, আপন অমাত্যবর্গের নিকট সর্বদাই ঈষৎ হাস্য করিয়া বলিতেন, “কি করি! বীরেন্দ্র জমিদারি বুঝিতেন না, সমস্ত বিষয়টি খোয়াইয়াছিলেন। পরের হাতে গেলে বীবেন্দ্রের পরিবার ও পুত্রের কষ্ট হয়, সেইজন্য আমিই ক্রয় করিলাম, নচেৎ জমিদারিতে বিশেষ লাভ নাই। এখন অনাথ নরেন্দ্রকে আমি লালনপালন করিতেছি। বীরেন্দ্রের অনেকগুলি পরিবার, আমি খাইতে পরিতে দিতেছি। কি করি, মানুষে কষ্ট পায়, এ তো আর চক্ষে দেখা যায় না! আর ভাবিয়া দেখ, ভগবান টাকা দিয়াছেন কি জন্য? পাঁচজনকে দিয়ে সুখ, রাখিতে সুখ না, পরকে দিব, তাহাতে যদি আমার কিছু না-ও থাকে সে-ও ভাল।”

 অমাত্যে বলিত, “অবশ্য, অবশ্য, আপনি মহাশয় শোক, আপনার দেয়ার শরীর, সেইজন্যই এমন আচরণ করিতেছেন, অন্যে কি এমন কয়ে? এই তো এত জমিদার আছে,

আপনি যতটা বীরেন্দ্রের পরিবারের জন্য করেন, এমন আর কে কাহার জন্য করে? আহা, আপনি না থাকিলে নরেন্দ্রকেই বা কে খাইতে দিত, অন্য লোকেরই বা কে ভরণপোষণ করিত? তাহারা যে দুইবেলা পেট ভরিয়া খাইতে পায়, সে কেবল আপনার অনুগ্রহে। আপনার মত পুণ্যবান লোক কি আর আছে?”

 হর্ষ-গদগদ-স্বরে ঈষৎ-বিস্ফারিত লোচনে নবকুমার উত্তর করিতেন, “না বাপু, আমি পুণ্য জানি না, চিরকালই আমার এই স্বভাব। আজ বীরেন্দ্রের পরিবার বলিয়া কিছু নূতন নহে, ইহাতে দোষ হয়, আমি দোষী, পুণ্য হয়, তাহাই” ইত্যাদি ইত্যাদি।

 আমরা পূর্বেই বলিয়াছি, নবকুমার নিতান্ত মন্দ লোক ছিলেন না। চাহিয়া দেখ, সকলেই নবকুমারকে বিচক্ষণ বুদ্ধিমান লোক বলিয়া সমাদর করিতেছে। শুন, সকলেই তাঁহাকে দয়াশীল, ব্রাহ্মণভক্ত লোক বলিয়া খ্যাতি করিতেছে। অদ্যাপি নবকুমারের ন্যায় লোক লইয়া আমাদের সমাজ গর্বিত রহিয়াছে, তাঁহাদের সর্বস্থানে সমাদর, সর্বস্থানে প্রশংসা, সর্বস্থানে প্রভুত্ব। মানী জ্ঞানী বিষয়বুদ্ধিসম্পন্ন নবকুমার মরিলে সমাজ শিরোমণি হারাইবে, সমাজে হুলস্থূল পড়িয়া যাইবে। যিনি সর্বস্থানে আদৃত, সকলের মান্য, তোমার আমার কি অধিকার আছে তাহার নিন্দা করি?