মাধবীকঙ্কণ/তিন
আমরা পূর্বেই বলিয়াছি, শৈবলিনী সন্ধ্যার সময় ঘাট হইতে ফিরিয়া আসিলেন। ধর্মপরায়ণ শান্তচিন্তা বিধবা সন্ধ্যায় পূজা সমাপ্ত করিয়া বালক-বালিকাগুলিকে লইয়া গল্প করিতে বসিলেন। শৈবলিনী মাসে কি দুই মাসে বীরনগরে আসিতেন। শৈবলিনী বড় গল্প করিতে পারিতেন। শৈবলিনীর সন্তানাদি নাই, সকল শিশুকেই আপনার বলিয়া মনে করিতেন। এই সমস্ত কারণে শৈবলিনী বালক-বালিকাদিগের বড় প্রিয়পাত্রী। শৈব আসিয়াছেন, গল্প করিতে বসিয়াছেন, শুনিয়া এই প্রকাণ্ড অট্টালিকার সমস্ত বালকবালিকা একত্র হইল, কেহই শৈবলিনীর অনাদরের পাত্র ছিল না। কাহাকেও ক্রোড়ে, কাহাকেও পার্শ্বে, কাহাকেও সম্মুখে বসাইয়া শৈবলিনী মহাভারতের অমৃতমাখা গল্প করিতে লাগিলেন। আমরা এই অবসরে শৈবলিনীর বিষয়ে দুই-একটি কথা বলিব।
শৈবলিনীয় পিতা সামান্য সঙ্গতিপন্ন ও অতিশয় ভদ্রলোক ছিলেন। শ্রীশচন্দ্র ও শৈবলিনী পিতার গুণগ্রাম ও মাতার ধীরস্বভাব ও নম্রতা পাইয়াছিলেন, অতি অল্প বয়সে শৈবলিনী বিধবা হইয়াছিলেন, স্বামীর কথা মনে ছিল না, সংসারে সুখ-দুঃখ প্রায় জানিতেন না, এ জন্মে চির-কুমারী বা চির-বিধবা হইয়া কেবল মাতার সেবা ও ছোট ভাইটির যত্ন ভিন্ন আর কোন ধর্ম জানিতেন না।
শৈবলিনীর পিতার মৃত্যুর পর তাঁহাদের অবস্থা ক্রমশ মন্দ হইতে লাগিল, এমন কি, অন্নের কষ্ট কাহাকে বলে, অভাগিনী শৈবলিনী ও তাঁহার মাতা জানিতে পারিলেন; কিন্তু সেই শান্ত নস্ত্র বিধবা একবারও ধৈর্যহীন হন নাই, অতি প্রত্যুষে উঠিয়া আান ও পূজাদি সমাপন কবিয়া কায়িক পরিশ্রমের দ্বারা বৃদ্ধা মা ও শিশুর জন্য বন্ধনাদি করিতেন। প্রত্যুষে প্রফুল্ল পুষ্পের ন্যায় শৈবলিনী নিজ কার্য আরম্ভ করিতেন, শান্ত-নিস্তব্ধ সন্ধ্যাকালে শান্তচিত্ত বিধবা কার্য সমাপন করিয়া মাতার সেবায় ও শিশুভ্রাতার লালনপালনে রত হইতেন। সেই কৃষ্ণকেশমণ্ডিত, শ্যামবর্ণ, বাকশূন্য মুখখানি ও আয়ত শাস্তরশ্মি নয়ন দুইটি দেখিলে যথার্থ সদয় স্নেহে আপ্লুত হয়। যথার্থই বোধ হয় যেন সায়ংকালের শাস্তি ও নিস্তব্ধতা শৈবালে আবৃত মুদিতপ্রায় শৈবলিনী মুখখানি নত করিয়া রহিয়াছে।
এ জগতে শৈবলিনী কিছুরই আকাঙ্খিনী নহে। বিধবা শৈবলিনী সহচর চাহে না, যে আম্রবৃক্ষ ও বংশবৃক্ষ শৈবলিনীর নম্র কুটীর চারিদিকে সস্নেহে মণ্ডিত করিয়া মধ্যাহ্ন ছায়া বর্ষণ ও সায়ংকালে মৃদুস্বরে গান করিত, তাহারই শৈবলিনীর সহচর। তাহারাও যেমন প্রকৃতি সন্তান, শৈবলিনীও সেইরূপ প্রকৃতির সন্তান; জগদীশ্বর তাহাদের ভরণপোষণ করিতেন, অনাথিনী শৈবলিনীকেও ভরণপোষণ করিতেন। শৈবলিনী শৈশবে বিধবা, কিন্তু প্রেমের আকাজিনী নহে, কেন না সমগ্র জগৎ শৈবের প্রেমের জিনিস। বৃক্ষে বসিয়া যে কপোত-কপোতী গান করিত, তাহারাও শৈবের প্রেমের পাত্র, তাহাদের সঙ্গে শৈব একত্র গান গাইত, তাহাদেব প্রত্যহ তণ্ডল দিয়া পালন করিত। শৈব যখন বৃদ্ধা মাতাকে সেবা দ্বারা সন্তুষ্ট করিতে পারিত, তখনই শৈবলিনীর হৃদয় প্রেমরসে অগ্নিত হইত,মাতাকে সুখী দেখিলে শৈবের নয়ন আনন্দাশ্রুতে পরিপূর্ণ হইত। যখন শিশু শ্রীশচন্দ্রকে ক্রোডে লইয়া মুখচুম্বন করিত, যখন শিশু আহলাদিত হইয়া দিদি বলিয়া শৈবকে চুম্বন করিত, তখন যথার্থই শৈবের হৃদয় নাচিয়া উঠিত, অশ্রুতে বসন ভিজিয়া যাইত। আর যখন সায়ংকালে শান্ত নিস্তব্ধ নদীর প্রশান্ত বক্ষে চার বিভুধিত স্বর্গের প্রতিবিম্ব দেখিয়া ভগবানের কথা মনে পড়িত, যিনি চন্দ্র, তারা ও নদী সৃষ্টি করিয়াছেন, যিনি পক্ষীকে শাবক দিয়াছেন ও শৈবকে শ্রীশ দিয়াছেন, সেই ভগবানের কথা মনে পড়িত। তখনই শৈবলিনী হৃদয় অনন্ত প্রেমে সিক্ত হইত। শৈবলিনীর স্বামী বা পুৱ নাই, শৈবলিনীর প্রেমের একমাত্র ভাগী কেহ ছিল না, সুতরাং বর্ষাকালের নদীস্রোতের ন্যায় প্রেমিক আর কে আছে? জগৎ যেরূপ বিস্তারিত, সমুদ্র যেরূপ গভী, আকাশ যেরূপ অনন্ত, শৈবলিনীর প্রেম সেইরূপ বিস্তারিত গভীর অনন্ত।
এইরূপে কিছুকাল অতীত হইলে শৈবলিনীর মাতার কাল লইল, ধীর-ভাব, রূপবান, ভদ্রবংশজাত শ্রীশচন্দ্রকে নবকুমার আপন কন্যার সহিত বিবাহ দিবার ইচ্ছায় বীরনগরে লইয়া গেলেন। যাদের জন্য শৈবলিনী পশুরগৃহ ত্যাগ করিয়াছিলেন, তাহারা না থাকায় শৈবলিনী পুনরায় শ্বশুরালয়ে গেলেন ও তথায় বাস করিতে লাগিলেন।