কুড়ি

 মেওয়ার দেশে পূর্বে চিতোর প্রধান নগরী ছিল, এক্ষণে উদয়পুর মাড়ওয়ারের বালুকারাশি ও মরুভূমি হইতে প্রধান-পর্বত মেওয়ার দেশে পুনরায় আসিতে নরেন্দ্রনাথ বড়ই আনন্দানুভব করিলেন। আবার আরাবলীর উচ্চ শিখর উল্লঙ্ঘন করিলেন, আবার পর্বতীয় নদী ও প্রস্রবণের বেগ ও মহিমা সন্দর্শন করিলেন, আবার শান্ত নিস্তব্ধ পর্বত হ্রদের শোভা দেখিয়া নরেন্দ্রের হৃদয়ে অতুল আনন্দোদয় হইল। কিছুদিন এইরূপে ভ্রমণ করিয়া নরেন্দ্রনাথ ও যোধপুরের দূতগণ উদয়পুরে উপস্থিত হইলেন।  নরেন্দ্রনাথের বোধ হইল, সেরূপ সুন্দর স্থানে সেরূপ সুন্দর নগরী পূর্বে তিনি কখনও দেখেন নাই। নীচে সুন্দর শান্ত হ্রদ, নির্মল আকাশ ও চতুর্দিকস্থ পর্বতশ্রেণীর ছায়া সযত্নে বক্ষে ধারণ করিতেছে। চতুর্দিকে সুন্দর পর্বতরাশির পর পর্বতরাশি যেন প্রকৃতি এই মনোহর উচ্চ প্রাচীর দিয়া এই সুখের আবাসস্থানকে রক্ষা করিতেছে। হ্রদের নিকটবর্তী একটি পর্বতশ্রেণীর উপর সুন্দর রাজপ্রাসাদ ও শ্বেতবর্ণ সৌধমালা যেন সহাস্যবদনে নিম্ন দর্পণে আপনার সুন্দর প্রতিরূপ অবলোকন করিতেছে।

 সূর্যদ্বার দিয়া যোধপুরের দূত নগরে প্রবেশ করিলেন: যোধপুর ও উদয়পুরে তখন বন্ধুত্ব ছিল, সুতরাং যোধপুরের দূতগণকে আহ্বান করিবার জন্য নাগরিকগণ জয়ধ্বনি করিতে লাগিল। প্রশস্ত পথ দিয়া নরেন্দ্রনাথ ও তাহার সঙ্গিগণ রাজপ্রাসাদাভিমুখে যাইতে লাগিলেন, চারণগণ “টপ্পা” অর্থাৎ মঙ্গলসূচক গীত গাইতে লাগিলেন, দুই পাশে স্ত্রীলোকগণ কলসকক্ষে দণ্ডায়মান হইয়া “সুহেলিয়া” অর্থাৎ আনন্দগীত গাইয়া যোধপুরের দূতদিগকে আহ্বান করিলেন। দূতগণ সকলেই দুই-এক মুদ্রা পুরস্কার দিয়া পরিতুষ্ট করিলেন।

 অনন্তর সকলে রাজপ্রাসাদে পৌঁছিয়া রাণার অনুমতিক্রমে প্রাসাদের উপর উঠিলেন, শ্বেতপ্রস্তর-নির্মিত সোপান দ্বারা আরোহণ করিয়া সূর্যমহলে প্রবেশ করিলেন। সেই মহলেই রাণা বিদেশীয় দূতদিগকে আহ্বান করিতেন। বংশের আদিপুরুষ সুর্যের একটি প্রতিমূর্তি সেই গৃহের এক দেওয়ালে খোদিত ছিল, সেইজন্য উক্ত মহলের নাম সূর্যমহল।

 বক্তবর্ণ বস্ত্রমণ্ডিত বহুমূল্য রত্ন-বিনির্মিত রাজাসনে বাপ্পারাওয়ের বংশাবতংস মহারাণা রাজসিংহ উপবেশন করিয়া আছেন। চারিদিকে সুবর্ণখচিত রৌপ্যস্তম্ভের উপর একটি চন্দ্রাতপ মণিমুক্তায় ঝলমল্ করিতেছে। কিঞ্চিৎ দূরে পারিষদগণ উপবেশন করিয়া আছেন ও চারণগণ স্তুতিবাক্যে এই অমরাবতী তুল্য রাজসভায় রাণার সাধুবাদ করিতেছেন। এরূপ সময়ে যোধপুরের দূত প্রবেশ করিলেন।

 দূত বিনীতভাবে সমস্ত সমাচার অবগত করালেন। যশোবন্তসিংহের পরাজয় ও দেশে প্রত্যাগমন, মহারাজ্ঞীর ক্রোধ ও রাজার দুর্দশা এই সমস্ত অবগত করাইয়া যোধপুরের মন্ত্রীর পত্র রাণার হস্তে সমর্পণ করিলেন। রাণা রাজসিংহ সমস্ত বিষয় অবগত হইয়া যশোবন্তের জন্য শোক প্রকাশ করিয়া দূতগণকে বিদায় করিলেন ও তাঁহাদের উদয়পুরে থাকিবার জন্য উপযুক্ত স্থান নির্ধারিত করিতে মন্ত্রিবরকে আদেশ করিলেন। অল্পদিন পরেই যোধপুররাজ্ঞীর মাতা উদয়পুর হইতে যোধপুরে গমন করিলেন।

 নরেন্দ্রনাথ উদয়পুরে কয়েক মাস বাস করিয়া প্রীতিলাভ করিলেন। হেমের প্রতিমূর্তি তাঁহার হৃদয়ে অনপনেয় অঙ্কে অঙ্কিত হইয়াছিল, হেমের চিন্তা তিরোহিত হইবার নহে, তথাপি সেই সুন্দর উপত্যকায় বাসকালীন সে চিন্তাও কিঞ্চিৎ পরিমাণে লাঘব হইল, উদয়পুর হইতে অদূরে অনেক যুদ্ধস্থান, অনেক কীর্তিস্তম্ভ, অনেক পূজ্যস্থান আছে, নরেন্দ্র একে একে সমুদয় সন্দর্শন করিতে লাগিলেন। কখন একাকী, কখন দেওয়ানা তাতারবালককে সঙ্গে লইয়া নরেন্দ্র নানা পর্বত উল্লঙ্ঘন করিতেন, হ্রদের এক অংশ হইতে অন্য অংশে এক পর্বত হইতে অন্য পর্বতে, এক যুদ্ধক্ষেত্র হইতে অন্য যুদ্ধক্ষেত্রে বিচরণ করিতেন কখন কখন প্রাতঃকাল হইতে দ্বিপ্রহর পর্যন্ত, দ্বিপ্রহর হইতে সন্ধ্যা পর্যন্ত পর্বত ও উপত্যকায় বিচরণ করিতেন। প্রাতঃকালে ক্রীড়াসক্ত রাজপুত বালকগণ অঙ্গুলি নির্দেশপূর্বক সেই অপরিচিত ভ্রমণকারীকে দেখাইত, সায়ংকালে রাজপুত মহিলাগণ কলসকক্ষে হ্রদ হইতে প্রত্যাবর্তনের সময় সেই বিদেশীকে চারণ বিবেচনায় প্রণাম করিয়া চলিয়া যাইত।

 দেওয়ানাও নিস্তব্ধ প্রভুর সঙ্গে সঙ্গে বিচরণ করিত, নিকটস্থ বৃক্ষ হইতে ফল আহরণ করিয়া আনিয়া দিত ও সায়ংকালে নৌকা আনিয়া আপনি দাঁড় ধরিয়া প্রভুকে উদয়পুরে পুনরায় লইয়া যাইত। নিস্তব্ধ শান্ত হ্রদের উপর দিয়া ধীরে ধীরে নৌকা ভাসিয়া যাইত। সে শান্ত সায়ংকালীন আকাশ নিস্তব্ধ পর্বতরাশি ও নির্মল শব্দশূন্য হ্রদ দেখিয়া নরেন্দ্রনাথের হৃদয় শান্তিরসে পরিপূর্ণ হইত। কখনও বা দেওয়ানা সপ্তস্বরে গীত আরম্ভ করিত, সে বালককণ্ঠ-বিনিঃসৃত সুবিমল স্বরে সেই নৈশ হ্রদ, পর্বতরাশি ও আকাশমণ্ডল ভাসিয়া যাইত। তাতার-ভাষায় গীত, সে গান নরেন্দ্র বুঝিতে পারিতেন না। তথাপি দুই-একটি কথা শুনিয়া বোধ হইত যেন তাহা প্রেমের গান। অভাগা উন্মত্ত বালক। তুই এই বয়সে কি প্রেমে উন্মত্ত হইয়াছিল? না হইলে সে দেওয়ানা হইবে কেন তাহার চক্ষু এরূপ অস্বাভাবিক জ্যোতিতে দীপ্ত কেন সে দেশ গৃহ পরিত্যাগ করিয়া, উন্মত্ত হইয়া দেশে দেশে বিচরণ করে কেন? দেওয়ানা নরেন্দ্রনাথের উপযুক্ত ভৃত্য।

 রজনীর চন্দ্রালোকে সেই হ্রদের নির্মল জল বড় সুন্দর শোভা পাইত। জলহিল্লোলে চন্দ্রের আলোক বড় সুন্দর নৃত্য করিত, বায়ু বহিয়া বহিয়া সেই সুন্দর উর্মিমালাকে চুম্বন করিয়া যাইত। নরেন্দ্রনাথ নৌকার উপর শায়িত হইয়া চারিদিকে সেই অনন্ত পর্বতরাশি দেখিতেন, অনন্ত আকাশে নির্মল নীল আভা দেখিতেন, দুই-একখানি দুগ্ধফেননিভ শুভ্র মেঘ দেখিতেন। এই সমস্ত দেখিলে তার বাল্যকালের কথা স্মরণ হইত, হেমলতার কথা স্মরণ হইত, অলক্ষিত অশ্রুবিন্দুতে যোদ্ধার বদন সিক্ত হইয়া যাইত।

 এইরূপ কয়েক মাস অতিবাহিত হইল। ক্রমে আশ্বিন মাসে অম্বিকাপূজার সময় সমাগত হইল।