একুশ


 শরৎকাল উপস্থিত। রাজপুতানায় এই সময় আরম্ভের সময়, সুতরাং রাজস্থানে অম্বিকার পূজার সহিত খড়্গের পূজা হইয়া থাকে। আশ্বিন মাসে উপর্যুপরি দশ দিন নরেন্দ্রনাথ যেরূপ ঘটা ও সমারোহ দেখিলেন তাহা বর্ণনা করা যায় না। পূর্বপুরুষগণ যে সমস্ত অস্ত্র লইয়া যুদ্ধজয় করিয়াছেন বা যুদ্ধে প্রাণ দিয়াছেন, যোদ্ধৃগণ এখন মহাউৎসাহে সেই সমস্ত অস্ত্র আয়ূধশালা হইতে বাহির করিয়া মহাসমারোহের সহিত তাহার পূজায় রত হইলেন। দেবীর মন্দিরে প্রতিদিন মহিষ ও মেষ বলি হইল, দশম দিবসে মহাসমারোহে দুর্গার পূজা হইল, তাহার পর-দিবসে মহারাণা সমস্ত যোদ্ধৃগণকে আহ্বান করিয়া রণস্থলে উপস্থিত হইলেন। সেদিন সমস্ত উদয়পুর যেন নূতন শোভায় শোভিত হইয়াছে। বাজার, দোকান, পথ-ঘাট পুষ্পমাল্য ও বৃক্ষপত্রে পরিশোভিত হইয়াছে; দ্বারে দ্বারে সুন্দর ও সুশোভিত তোরণ দৃষ্ট হইতেছে; গৃহে গৃহে বিজয়পতাকা উড্ডীন হইতেছে। প্রাতঃকালে জয়ঢাকের শব্দে রাজপুত সৈন্যগণ সজ্জিত হইয়া রঙ্গস্থলে গমন করিতেছে, উদয়পুরের অধীন নানা স্থান হইতে অনেক সেনানী নিজ নিজ সৈন্যসামন্ত লইয়া সমবেত হইয়াছে, নানা স্থানীয় লোকের নানারূপ পরিচ্ছদ, নানারূপ পতাকা ও নানারূপ অস্ত্রশস্ত্র আজি উদয়পুরে সম্মিলিত হইতেছে। পঞ্চদশ সহস্র যোদ্ধা আজি মহারাণাকে বেষ্টন করিয়াছে, তাহাদিগের পদভরে যেন মেদিনী কম্পিত হইতেছে।

 বেলা একপ্রহর হইতে সন্ধ্যা পর্যন্ত রণস্থল সৈন্যে সমাকীর্ণ এবং তাহাদিগের যুদ্ধকৌশল দেখিবার জন্য সমস্ত নগরবাসী ঝাঁপিয়া পড়িয়াছে। রাণার আদেশে সৈন্যগণ তীরনিক্ষেপ বা বর্শাচালনে, খণ্ডযুদ্ধে অথবা অশ্বচালনে নিজ নিজ কৌশল দেখাইতে লাগিল এবং মেওয়ারের নানা স্থান ও নানা দুর্গ হইতে আগত নানা কুলের রাজদূতগণ নিজ নিজ রণনৈপুণ্য দর্শাইতে লাগিল। চন্দাওয়াৎকুল জগাওয়াৎকুল, রাঠোরকুল, প্রমরকুল, ঝালাকুল প্রভৃতি নানা কুলের রাজপুতগণ অদ্য উদয়পুরে মহারাণার নিকট রাজভক্তি ও রণনৈপুণ্য প্রদর্শন করিতে আসিয়াছে এবং তাহাদিগের স্ব-স্ব চারণগণ সেই সেই কুলের গৌরবসূচক গীত গাইতেছে। নরেন্দ্র সমস্ত দিন এইরূপ সমরোৎসব দেখিয়া এবং চারণদিগের গীত শুনিয়া পুলকিত হইলেন। অদ্যাবধি রাজস্থানে শারদীয়া পূজার শেষ দিনে এইরূপ ঘটা হয়, অদ্যাবধি রাজপুত যোদ্ধৃগণ এই সময় নিজ নিজ রাজার নিকট সমবেত হইয়া যুদ্ধকৌশল প্রদর্শন করে, অদ্যাবধি রাজপুত নগরবাসিগণ দেবীপূজার অবসানে রণস্থলে সমবেত হইয়া দেশীয় রাজাকে রাজভক্তি প্রদর্শন করে। বর্তমান লেখক রাজস্থানে ভ্রমণকালীন শারদীয় খড়্গপূজা ও শারদীয়া সমারোহ অবলোকন করিয়াছে সহস্র সহস্র নগরবাসীদিগের সমাগম ও রাজভক্তি দৃষ্টি করিয়াছে, প্রাচীন নিয়ম অনুসারে স্বাধীন রাজপুতদিগের শরৎকালের আনন্দোৎসব দেখিয়া নয়ন তৃপ্ত করিয়াছে।

 সমস্ত দিন এইরূপ উৎসব দেখিয়া নরেন্দ্রনাথ সন্ধ্যার সময় একটি বৃক্ষতলে যাইয়া কিছু ফলমূল আহারের আয়োজন করিলেন এবং নিকটস্থ একটি কূপ হইতে জল আনিতে গেলেন। কূপের নিকট গোস্বামীবেশে এক ব্যক্তি দণ্ডায়মান ছিলেন, তিনিও জল আনিতে গিয়াছিলেন। তিনি নরেন্দ্রকে কিঞ্চিৎ পুরুষ ভাবে ঠেলিয়া দিয়া আগে নিজে জল তুলিতে লাগিলেন।

 গোস্বামীর এই অভদ্রাচরণ দেখিয়া নরেন্দ্র ক্রুদ্ধ হইলেন এবং তিরস্কার করিলেন। গোস্বামী দ্বিগুণ কটূভাষায় তিরস্কার করিয়া বলিলেন,—“তুমি বিদেশীয়, রাজস্থানে আসিয়া রাজপুতদিগের সহিত কলহ করিতে তোমার ভয় বোধ হয় না?”

 নরেন্দ্র। আমি বিদেশীয় বটে, কিন্তু বহুকাল অবধি রাজপুতদিগের সহিত বসবাস করিয়াছি; তোমার ন্যায় অভদ্র রাজপুত দেখি নাই।

 গোস্বামী। যদি রাজপুতদিগের সহিত সহবাস করিয়া থাক তাহা হইলে বোধ হয় জান যে রাজপুতমাত্রেই অসি ও ঢাল চালাইতে জানে; অতএব চুপ করিয়া থাক।

 নরেন্দ্র। গর্বিত রাজপুত, আমিও অসি ও ঢাল চালনা কিছু শিক্ষা করিয়াছি, আমার নিকট গর্ব করিও না। তুমি গোস্বামী বলিয়া এবার ক্ষমা করিলাম।

 কথায় কথায় বিবাদ বাড়িতে লাগিল, গোস্বামী অতিশয় ক্রুদ্ধ হইয়া নরেন্দ্রকে প্রহার করিলেন, নরেন্দ্রও প্রহার করিলেন, অল্পক্ষণে উভয়েই জ্ঞানশূন্য হইয়া অসি ঢাল বাহির করিলেন। তখন অন্ধকার হইয়াছে, সেস্থান নির্জন আর সকলে চলিয়া গিয়াছে।

 দুইজনে একেবারে বেগে যুদ্ধ আরম্ভ করিলেন, ক্ষণকাল তাঁহাদের কাহাকেও ভাল করিয়া দেখা গেল না। মুহূর্তমধ্যে নরেন্দ্র পরাজিত হইলেন। সেই অপূর্ব বলবান গোস্বামীর প্রচণ্ড আঘাতে নরেন্দ্রের ঢাল চূর্ণ হইয়া গেল, নরেন্দ্রের অসি হস্ত হইতে পড়িয়া গেল, নরেন্দ্র স্বয়ং ভূমিতে নিপতিত হইলেন। তীব্রস্বরে গোস্বামী বলিলেন,—“বিদেশীয় যোদ্ধা! তুমি বালক, তোমার অপরাধ ক্ষমা করিলাম। পুনরায় রাজপুত গোস্বামীর সহিত কলহ করিও না, গোস্বামীর চিরজীবন কেবল পূজাকার্যে অতিবাহিত হয় নাই, সে-ও যুদ্ধ-ব্যবসার কিছু কিছু জানে।”

 নরেন্দ্র কর্কশস্বরে বলিলেন,—“রাজপুত! আমি তোমার নিকট জীবন-ভিক্ষা চাহি না। তোমার যাহা ইচ্ছা, যাহা সাধ্য কর, আমি অনুগ্রহ চাহি না।”

 গোস্বামী তথন গম্ভীর স্বরে উত্তর করিলেন,—“যোদ্ধা আমিও যুদ্ধ-ব্যবসায় করিয়া থাকি, যোদ্ধার নিকট ভিক্ষা করিতে যোদ্ধার কোন অপমান নাই। নরেন্দ্র, আমি তোমাকে জানি, তুমিও আমাকে শীঘ্র জানিবে, আমার নিকট একটি ভিক্ষা গ্রহণ করিতে কোনও অপমান নাই। তিন দিবসের মধ্যে আমাদের আবার সাক্ষাৎ হইবে সেদিন আমিও তোমার নিকট একটি ভিক্ষা প্রার্থনা করিব। আমার নাম শৈলেশ্বর।”

 এই বলিয়া গোস্বামী সহসা অন্ধকারে অদৃশ্য হইলেন। নরেন্দ্র বিস্মিত হইয়া চাহিয়া রহিলেন।