বাইশ

 রাজস্থানে নূতন নূতন দেশ ও নূতন নূতন আচার ব্যবহার দেখিয়া নরেন্দ্রনাথের হৃদয় কিছুদিন শান্ত হইয়াছিল, কিন্তু প্রস্তরে যে অঙ্ক খোদিত হয় তাহা একেবারে বিলুপ্ত হয় না। বঙ্গদেশ হইতে উদয়পুর শত শত ক্রোশ অন্তর, কত নদ-নদী, পর্বত, মরুভূমি পার হইয়া নরেন্দ্রনাথ ভারতবর্ষের প্রান্ত হইতে প্রান্ত পর্যন্ত আসিয়াছেন। তথাপি প্রাতঃকালে যখন পূর্ব দিকের আকাশে রক্তিমচ্ছটা অবলোকন করিতেন, তখন সেই পূর্বদেশবাসিনী বালিকা নরেন্দ্রনাথের হৃদয়ে জাগরিত হইত। রজনীতে যখন নরেন্দ্রনাথ একাকী ছাদের উপর অন্ধকারে বিচরণ করিতেন, বোধ হইত যেন, সেই প্রণয়প্রতিমা তাহার জ্যোতিতে নরেন্দ্রনাথের উপর প্রেমদৃষ্টি করিতেছে। কোথায় বীরনগরের বাটী, কোথায় কলনাদিনী ভাগীরথী, আর কোথায় নরেন্দ্রনাথ? কিন্তু স্বদেশ হইতে পলায়ন করিলে কি চিন্তা হইতে পলায়ন করা যায়? মৃত্যুর আগে আর একবার সেই হেমলতাকে দেখিবেন, প্রাতঃকালে সায়ংকালে নিশীথে তিনি যে চিন্তা করেন, হেমলতাকে একবার সেই সমস্ত কথা বলিবেন, নরেন্দ্রনাথের কেবল এই ইচ্ছা। মৃত্যুর আগে কি আর একবার দেখা হইবে না? নরেন্দ্রনাথ দেওয়ানের নিকট শুনিলেন, ভগবান একলিঙ্গের মন্দিরের কোন এক গোস্বামী ভবিষ্যৎ বলিতে পারেন; নরেন্দ্রনাথ একদিন সেই মন্দিরে যাত্রা করিলেন।

 রজনী এক প্রহরের পর নরেন্দ্র মন্দিরের নিকট উপস্থিত হইলেন, মন্দিরের যে শোভা দেখিলেন, তাহাতে তিনি বিস্মিত হইলেন। মন্দির একটি উপত্যকায় নির্মিত, তাহার চারিদিকে যতদূর দেখা যায়, কেবল অন্ধকারময় পর্বতরাশি অন্ধকার আকাশের সহিত মিশ্রিত হইয়াছে, চারিদিকে যেন প্রকৃতি অলঙ্ঘনীয় প্রাচীর দিয়া রুদ্রের উপযুক্ত গৃহ নির্মাণ করিয়াছেন।

 রজনী দ্বিপ্রহরের সময় নরেন্দ্র সেই প্রকাণ্ড মন্দিরে প্রবেশ করিলেন। সারি সারি শ্বেতপ্রস্তর-বিনির্মিত সুন্দর স্তম্ভের মধ্য দিয়া সেই বিস্তীর্ণ প্রস্তরালয়ে প্রবেশ করিলেন। সম্মুখে মহাদেবের ষণ্ড ও নন্দীর পিত্তল প্রতিমূর্তি রহিয়াছে, ভিতরে শুভ্র-প্রকোষ্ঠ ও স্তম্ভসারি উজ্জ্বল সুগন্ধ দীপাবলীতে ঝলমল করিতেছে মধ্যে ভোলানাথের প্রস্তর-বিনির্মিত প্রতিমূর্তি প্রতিষ্ঠিত রহিয়াছে। মন্দিরের একজন দীর্ঘকায় তেজস্বী জটাধারী গোস্বামী এক-প্রান্তে উপবেশন করিয়া আছেন, প্রশস্ত ললাটে অর্ধ-শশাঙ্কের ন্যায় চন্দনরেখা, বিশাল স্বন্ধে যজ্ঞোপবীত লম্বিত রহিয়াছে। অন্য দুই-চারি জন গোস্বামী এদিক ওদিক বিচরণ করিতেছেন। ঐ মন্দিরের প্রধান গোস্বামী চিরকাল অবিবাহিত থাকেন, তাঁহার মৃত্যুর পর শিষ্যের মধ্যে একজন ঐ পদে নিযুক্ত হন। মন্দিরের সাহায্যার্থে অনেকসংখ্যক গ্রাম নির্দিষ্ট ছিল, তাহা ভিন্ন যাত্রীদিগের দানও অল্প ছিল না।

 দ্বিপ্রহরের ঘণ্টারব সেই সুন্দর শিবমন্দিরে প্রতিধ্বনিত হইল বম্ বম্ হর হর শব্দে মন্দিরে পরিপূরিত লইল ও তৎপরে যন্ত্র সম্মিলিত উচ্চ গীতধ্বনিতে ভোলানাথের স্তব আরম্ভ হইল। প্রৌঢ়যৌবনসম্পন্না নর্তকীগণ তালে তালে নৃত্য করিতে লাগিল, গায়কগণ সপ্তস্বরে মহাদেবের অনন্ত গীত গাইতে আরম্ভ করিল। ক্ষণেক পরে গীত সাঙ্গ হইল, সেই জটাধারী গোস্বামী ইঙ্গিত করায় নর্তকীগণ চলিয়া গেল, গায়কগণ নিস্তব্ধ হইল, দীপাবলী নির্বাপিত হইল, পূজা সাঙ্গ হইল। নরেন্দ্রনাথ সে অন্ধকারে ইতিকর্তব্যবিমূঢ় হইয়া দণ্ডায়মান হইয়া রহিলেন।

 ক্ষণেক পর বোধ হইল, যেন অন্ধকারে সেই থকায় জটাধারী গোস্বামী তাহাকে ইঙ্গিত করিতেছেন। নরেন্দ্রনাথ সেইদিকে যাইলেন। জিজ্ঞাসা করিলেন, “মহাশয় কি এ মন্দিরের একজন গোস্বামী?” গোস্বামী কিছুমাত্র না বলিয়া ওষ্ঠের উপর অঙ্গুলি নির্দেশ করিলেন। তৎপরে গোস্বামী অঙ্গুলি দ্বারা দূরে এক দিক্‌ নির্দেশ করিলেন। নরেন্দ্র সেইদিকে চাহিলেন; নিবিড় দুর্ভেদ্য অন্ধকার ভিন্ন আর কিছুই দেখিতে পাইলেন না। আবার চাহিলেন, বোধ হইল যেন অন্ধকারে একটি দীপশিখা দেখা যাইতেছে। গোস্বামী নরেন্দ্রনাথকে ইঙ্গিত করিয়া অগ্রে অগ্রে চলিলেন নরেন্দ্রনাথ কিছুই বুঝিতে না পারিয়া পশ্চাৎ পশ্চাৎ চলিলেন।

 দুইজনে অনেক পথ সেই অন্ধকারে অতিবাহিত করিলেন। এ অন্ধকারে এই মৌনাবলম্বী যোগীপুরুষ কে? ইহার উদ্দেশ্য কি? শৈবগণ কখন কখন নরহত্যার দ্বারা পূজাসাধন করে, এ দীর্ঘকায় বলিষ্ঠ বিকট যোগীর কি তাহাই উদ্দেশ্য? একবার নরেন্দ্রনাথ দাঁড়াইলেন, আবার খড়্গে হাত দিয়া ভাবিলেন, “আমি কি কাপুরুষ? এই প্রশান্তমূর্তি যোগীর সহিত যাইতে ভয় করিতেছি? আবার গোস্বামীর সঙ্গে সঙ্গে সেই দুর্ভেদ্য অন্ধকারে পথ অতিবাহন করিতে লাগিলেন। অনেকক্ষণ পর শৈব গোস্বামী এক পর্বতগহ্বরে প্রবেশ করিলেন। তাহার ভিতর যাহা দেখিলেন, তাহাতে নরেন্দ্র আরও বিস্মিত হইলেন। সম্মুখে করালবদনা কালীর ভীষণ প্রতিমূর্তি, তাহার নিকট কয়েকখানি কাষ্ঠ জ্বলিতেছে, তাহার আলোক সেই গহ্বরের শিলার চারিদিকে প্রতিহত হইতেছে। অগ্নির পার্শ্বে কয়েকখানি হস্তলিপি, একখানি শোণিতাক্ত খড়্গ ও স্থানে স্থানে প্রস্তরখণ্ড শোণিতে রঞ্জিত হইয়াছে। দূরগত-জল-স্রোতের ন্যায় একটি শব্দ সেই গহ্বরে শ্রুত হইতেছিল।

 গোস্বামীর আকৃতি অপূর্ব। ঈষৎ শ্বেত শ্মশ্রু বক্ষঃস্থল পর্যন্ত লম্বিত রহিয়াছে, কেশের জটাভার পৃষ্ঠে দুলিতেছে, শরীর অতিশয় দীর্ঘ, অতিশয় বলিষ্ঠ, অতিশয় তেজোময় বলিয়া অনুভব হয়। নয়নদ্বয় সেই অগ্নির আলোকে ধক্-ধক্ করিয়া জ্বলিতেছে। উন্নত ললাটে অধচন্দ্রাকৃতি চন্দনরেখা শোভা পাইতেছে।

 গাস্বামী জ্বলন্ত কাষ্ঠ নির্বাণ করিলেন পরে তাহার অপর পার্শ্বে যাইয়া সেই রক্তাক্ত খড়্গ হস্তে তুলিয়া লইলেন। বিকিরণ অগ্নিকণাতে তাঁহার মুখমণ্ডল ও দীর্ঘ অবয়ব আরও বিকট বোধ হইল, নরেন্দ্রনাথের হৃদয় স্তম্ভিত হইল। তিনি অগত্যা এক পদ পশ্চাতে যাইয়া শিলারাশিতে পৃষ্ঠ দিয়া দাঁড়াইলেন, অগত্যা তিনি কোষ হইতে অসি বাহির করিলেন। সাহসে ভর করিয়া তিনি স্থির হইয়া দাঁড়াইলেন, কিন্তু তাহার হৃৎকম্প একেবারে অবসান হইল না।

 অতি গম্ভীরস্বরে গোস্বামী ডাকিলেন, “নরেন্দ্রনাথ!”

 নরেন্দ্রনাথ এতক্ষণে বুঝিলেন, শৈব সেই উদয়পুরের যোদ্ধা—শৈলেশ্বর!