তেইশ

 শৈলেশ্বর। নরেন্দ্রনাথ! ভগবান একলিঙ্গের মন্দিরের গোস্বামীগণ যোগবলে মানব-হৃদয় জানিতে পারেন। নবেন্দ্রনাথ! তুমি পাপ-হৃদয়ে এ পবিত্র মন্দিরে প্রবেশ করিয়াছ। তোমার মনে পাপচিন্তা আছে।

 নরেন্দ্র। আপনি কে জানি না, আপনার কথার উত্তর দিতে বাধ্য নহি।

 শৈলেশ্বর। আমি ভগবান একলিঙ্গের মন্দিরের গোস্বামী, মন্দির-কলুষিতকারীকে প্রশ্ন করিবার আমার অধিকার আছে।

 নরেন্দ্র। আপনি আমাকে কিরূপে চিনিলেন, জানি না। আপনি আমার কি পাপ দেখিয়াছেন, জানি না।

 শৈলেশ্বর। এ মন্দিরে প্রতারণা অনাবশ্যক। একটা রমণীর প্রেমে মুগ্ধ হইয়া সেই নারীকে পুনরায় পাইবার লালসায় তুমি এই স্থানে আসিয়াছ।

 নরেন্দ্র। যদি তাহাই হয়, তাহাতে পাপ কি? গোস্বামীগণ যদিও রমণীপ্রেমে বঞ্চিত, তথাপি রমণীপ্রেম আকাঙ্ক্ষা পাপ নহে। স্বয়ং শূলপাণি অর্পণার প্রেম আকাঙ্ক্ষা করেন।

 শৈলেশ্বর। নরেন্দ্র! এ প্রবঞ্চনার স্থান নহে। তুমি কেবল রমণীর প্রেমাকাঙ্ক্ষী নহ, তুমি পরস্ত্রীর প্রেমাকাক্ষী! জগতে এরূপ যন্ত্রণা কি আছে, নরকে এরূপ অগ্নি কি আছে যাহাতে এ পাপের প্রায়শ্চিত্ত হয়?

 নরেন্দ্র। আমি যখন একটি বালিকাকে ভালবাসিতাম, তখন সে অববাহিত ছিল। এক্ষণে যদি সে বিবাহিতা হইয়া থাকে, তবে সে আমার অস্পৃশ্যা।

 শৈলেশ্বর। নরেন্দ্রনাথ! আপনাকে ভুলাইও না, আমাকে ভুলাইবার চেষ্টা করিও না। যে ঘোর পাপে লিপ্ত হইয়াছে, তাহা বিশেষ করিয়া আলোচনা কর সুন্দর জাহ্নবীকুলে সেই সুন্দর অট্টালিকা স্মরণ কর। পবিত্রাত্মা শ্রীশচন্দ্র, পবিত্রহৃদয়া হেমলতা, পবিত্র সংসার। পাপিষ্ঠ, তোমার মনোরথ কি? সেই সংসার ছারখার হয় সেই শ্রীশচন্দ্রের সর্বনাশ হয়, সেই হেমলতা তোমার হয়। সেই শ্বেতপদ্মসন্নিভা পুণ্যহৃদয়া হেমলতা বালাকালে সে তোমার সহিত খেলা করিয়াছিল, এখনও সহোদরা অপেক্ষা তোমাকে যে স্নেহ করে, তোমার জন্য চিন্তা করে, সেই স্নেহময়ী পতিব্রতা নারী কুলটা হইয়া তোমার সেবা করে? সতীর ললাটে কুলকলঙ্কিনী দুশ্চারিণী শব্দ অনপনেয় অঙ্কে অঙ্কিত হয়? তাহার দুগ্ধফেননিভ শ্বেত অঙ্গে অঙ্গারবর্ণ দেদীপ্যমান হয়? তোমার জন্য সে সংসার ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়? হা নরেন্দ্রনাথ! আপনাকে ভুলাইও না। সত্য তুমি এতদুর ভাব নাই, কিন্তু তোমার মনোরথ পূর্ণ হইলে ইহা ভিন্ন আর কি ফল হয়? এই পাপ মনোরথে তুমি এই পবিত্র মন্দিরে আসিয়াছ।

 শৈলেশ্বরের কথা সাঙ্গ হইল, কিন্তু সে বজ্রধ্বনি তখনও নরেন্দ্রের কর্ণমুলে কম্পিত হইতে লাগিল। নরেন্দ্রনাথ অনেকক্ষণ অধোবদনে রহিলেন, তাহার শরীর কম্পিত হইতেছিল। চিন্তা করিতে করিতে তাহার ক্রোধ লীন হইল, নয়ন হইতে দুই-একটি অশ্রুবিন্দু নিপতিত হইল। অনেকক্ষণ পর দীর্ঘনিঃশাস মোচন করিয়া ধীরে ধীরে বলিলেন, —"স্বামিন! আমি পাপিষ্ঠ! আমাকে সমুচিত দণ্ডবিধান করুন।”

 শৈলেশ্বর। বৎস! এ সংসারে এরূপ ব্যাধি নাই, যাহার ঔষধি নাই, এরূপ পাপ নাই, যাহার প্রায়শ্চিত্ত নাই। আমি তোমার সংশোধন কামনা করি, দণ্ডবিধান কামনা করি না।

 নরেন্দ্র। স্বামিন্! আমি দয়ার উপযুক্ত নহি; পাপিষ্ঠ হেমলতার ন্যায় পবিত্রপুত্তলীর অপকার কামনা করে, তাহার ইহজীবনে প্রায়শ্চিত্ত নাই।

 শৈলেশ্বর। নরেন্দ্র, তুমি আপনাকে যতদূর পাপী বিবেচনা করিতেছ ততদূর পাপী নহ। আমার নিকট কিছুই অবিদিত নাই। তুমি হেমলতাকে পাইবার আর মানস কর নাই, জীবনে আর একবার তাহাকে দেখিবে, এইরূপ মানস প্রকাশ করিয়াছিলে, সেই মানসেই দেবালয়ে আসিয়াছিলে। কিন্তু তুমি বালক, জান না, হেমলতাকে আর একবার দেখিলে তাহার সর্বনাশসাধন হইবে।

 নরেন্দ্র। প্রভো! আপনি যাহা আদেশ করিলেন যথার্থ, হেমলতার হানি করা দূরে থাক, তার শরীরে একটি কণ্টক বিমোচন করিবার জন্য আমি জীবন দিতে পারি, ভগবান অন্তর্যামী, তিনি তাহা জানেন।

 শৈলেশ্বর। তবে তাহার যে হৃদয়ে কণ্টকটি তুমিই স্থাপন করিয়াছ, সেই কণ্টকটি তুলিতে যত্নবান হও না কেন?

 নরেন্দ্র। কিরূপে? আদেশ করুন।

 শৈলেশ্বর। বাল্যকালাবধি তুমি তাহার হৃদয়ে প্রেমস্বরূপ কণ্টক রোপণ করিয়াছ, সেটি তুমি উৎপাটন কর, না হইলে তাহা উৎপাটিত হইবে না, হেমলতা জীবন্মৃতা থাকিবে। হেমলতা এক্ষণে সচ্চরিত্র ধর্মপরায়ণ স্বামী পাইয়াছে, সংসারকার্যে ব্রতী হইয়াছে, কেবল সময়ে সময়ে তোমার চিন্তা তাহার মনে উদয় হয়, কেবল সেই সময়ে স্বামীর প্রতি হৃদয়ে বিশ্বাসঘাতিনী হয়। সেই চিন্তা তুমি দূর কর।

 নরেন্দ্র। কিরূপে দূর করিব? আপনি বলিতেছেন, তাহার সহিত দেখা করিলে তাহার সর্বনাশ হইবে।

 শৈলেশ্বর। উপায় আছে। হেমলতার সহিত একেবারে চির-জন্মের মত বিচ্ছেদ ঘটান অবশ্যক। নরেন্দ্র, তুমি যদি যথার্থ হেমলতাকে ভালবাস যদি যথার্থ তাহার কণ্টকোদ্ধারের জন্য প্রাণ দিতে সম্মত থাক, তবে যোগী হইয়া নারী-সংসর্গ ত্যাগ কর কিংবা মুসলমান হইয়া মুসলমান-কন্যা বিবাহ কর। হেম যখন শুনিবে যে নরেন্দ্র আমার বাল্যকালের ভালবাসা ভুলিয়া যোগী হইয়াছে, অথবা বিধর্মী হইয়া অন্য স্ত্রীকে গ্রহণ করিয়াছে, তখন অবশ্যই তাহার হৃদয় ক্রমে ক্রমে পরিবর্তিত হইবে। মানব-হৃদয় লতার মত শুষ্ককাষ্ঠে জড়াইয়া থাকে না। সে বুঝিবে যে, যে তাহাকে একবার বিস্মিত হইয়াছে, যাহার অন্য আশা, অন্য প্রেম, অন্য উদ্দেশ্য, অন্য চিন্তা, তাহার প্রতি অনুরক্তি কখনও চিরকাল থাকে না। নরেন্দ্র। তোমার বিষম পাপের এই বিষম প্রায়শ্চিত্ত।

 নরেন্দ্র। ভগবান জানেন, আমি তাহার জন্য অনেক ক্লেশ স্বীকার করিতে পারি, কিন্তু আপনি যে ব্যবস্থা করিলেন, তাহা অসহ্য। স্বামিন! ঐ ঔষধ অতিশয় তিক্ত, অন্য ঔষধের ব্যবস্থা করুন।

 শৈলেশ্বর। উৎকট রোগে উৎকট ঔষধ আবশ্যক।  নরেন্দ্র। স্বামিন্। আপনি পরম ধার্মিক শৈব হইয়া আমাকে মুসলমান-ধর্ম অবলম্বন করিবার আদেশ করিতেছেন?

 শৈলেশ্বর। পাপের জন্য মনুষ্য গো-জন্ম পর্যন্ত প্রাপ্ত হয়, কেবল জাতিনাশে ভীত হইতেছ?

 দুইজনে অনেকক্ষণ নিস্তব্ধ হইয়া রহিলেন। নরেন্দ্রনাথ হস্তে গণ্ডস্থল স্থাপন করিয়া সেই অগ্নিস্ফুলিঙ্গের দিকে চাহিয়া একমনে চিন্তা করিতে লাগিলেন শৈলেশ্বর সেই পর্বতগহ্বরে ধীরে ধীরে বিচরণ করিতে লাগিলেন।

 অনেকক্ষণ পরে শৈলেশ্বর গম্ভীরস্বরে বলিলেন,—“নরেন্দ্রনাথ, তুমি আমাকে বিশ্বাস কর?”

 নরেন্দ্র। আমার খড়্গ গ্রহণ করুন, আর কি প্রমাণ দিব?

 শৈলেশ্বর। তবে একটি কথা শুন। প্রেম নারীর একমাত্র অবলম্বন, প্রেম নারীর জীবন; পুরুষের তাহা নহে। পুরুষের অনেক আশা, অনেক অভিলাষ, অনেক মহৎ উদ্দেশ্য আছে। তুমি যুবক, সাহসী, অভিমানী, এ প্রশস্ত জগতে কি আপন অসি সহায় করিয়া আপনার যশের পথ পরিষ্কার করিতে পার না? স্ত্রীলোকের মত কি কেবল ক্রন্দন করিয়া জীবন অতিবাহিত করিতে চাও? শুনিয়াছি, তোমাদের বঙ্গদেশ বীরশূন্য—যশশূন্য। যাও, নরেন্দ্রনাথ! সেই দূর বঙ্গদেশে যশোস্তম্ভ স্থাপন কর, যাও দেশের গৌরবসাধন কর, সিংহবীর্য প্রকাশ করিয়া আপন কীর্তি স্থাপন কর; এ মহৎ উদ্দেশ্যে তোমার জীবন সমর্পণ কর। আকাশে এরূপ দেবতা নাই; যিনি এ মহৎ উদ্দেশ্যে তোমার সহায়তা না করিবেন। স্বয়ং ব্রজপাণি পুরন্দর, স্বয়ং শূলপাণি মহাদেব তোমার মনস্কামনা পূর্ণ করিবেন।

 শৈলেশ্বর নিস্তব্ধ হইলেন। নরেন্দ্রের নয়নদ্বয় জ্বলিতে লাগিল। তিনি একদৃষ্টিতে সেই অপূর্ব শৈবের দিকে চাহিয়া রহিলেন। পূর্বে একদিন এই শৈবকে যেরূপ যুদ্ধনিপুণ দেখিয়াছিলেন অন্য মানবহৃদয়জ্ঞানে তাঁহাকে সেইরূপ নিপুণ দেখিলেন।

 শৈব আবার বলিতে লাগিলেন, “নরেন্দ্র। এই ঘোর রজনীতে তুমি বিদেশে ভগবান একলিঙ্গের মন্দিরে পূজা দিতে আসিয়াছ কি জন্য? দেশের হিতসাধনের জন্য আসিয়াছ? কোন্ বীরব্রতে ব্রতী হইয়া আসিয়াছ? কোন্ দেবোচিত মহদুদ্দেশ্যসাধনার্থ আসিয়াছ? ধিক্‌ নরেন্দ্র! তোমার ন্যায় বীরপুরুষ একটি বালিকার মুখ দেখিবার জন্য জীবনের মহৎ উদ্দেশ্য ভুলিয়া থাকে? প্রেমচিন্তা দূর কর; অথবা যদি প্রেম বিনা জীবন শুষ্ক বোধ হয় তবে বীরোচিত প্রণয়ে বদ্ধ হও। পুরুষসিংহ! সিংহী গ্রহণ কর।

 নরেন্দ্র। ভগবান। আদেশ করুন।  শৈলেশ্বর। এ জগৎ অনুসন্ধান কর। পীড়ার সময় সাবিত্রীর ন্যায় তোমার সেবা করিবে, বিপদের সময় নৃমুণ্ডমালিনীর ন্যায় তোমার পাশে অসিহস্তে দাঁড়াইবে, কুশলের সময় বিমল প্রণয়দানে তোমার হৃদয় তৃপ্ত করিবে, যুদ্ধের সময় যশোগীতে তোমার শরীর কণ্টকিত করিবে, এরূপ রমণী যদি পাও, তাহাকে গ্রহণ কর।

 নরেন্দ্র। এরূপ নারী কি জগতে আছে?

 শৈলেশ্বর। স্বয়ং দেখিতে পাইবে। নরেন্দ্র। তোমার যোগবল মিথ্যা নহে, এরূপ নারী না থাকিলে আমি বৃথা তোমাকে এই গহ্বরে আহ্বান করি নাই। আর একটি কথা শুন। যে নারীর কথা আমি বলিতেছি, সে হেমলতা অপেক্ষা তোমাকে ভালবাসে, এ নারীকে তুমি পূর্বে দেখিয়াছ।

 নরেন্দ্র। স্মরণ নাই।

 শৈলেশ্বর। অদ্য স্বপ্নে দেখিবে। আমি চলিলাম, এই কলসে যে মদিরা আছে, পান করিয়া আজ এই গহ্বরে শয়ন কর। এই নির্বাণপ্রায় অগ্নির দিকে দেখ, যখন শেষ অগ্নিকণা সমস্ত ভস্ম হইয়া যাইবে, তখন সেই স্বপ্ন দেখিবে। যে নারীকে দেখিবে সেই এই জগতের মধ্যে তোমার প্রেমাকাঙ্ক্ষিনী, তোমার ন্যায় অভিমানিনী। বীরপুরুষ! সেই তোমার উপযুক্ত বীরনারী।

 নরেন্দ্র। মহাশয়, আপনার কথায় বিস্মিত হইলাম।

 শৈলেশ্বর। আর একটি কথা আছে, এটি মন দিয়া শুন। এই স্বপ্ন দেখিয়া কাল প্রাতে তুমি এই গহ্বর হইতে বাহিরে যাইও। তিনদিন তোমাকে সময় দিলাম, স্বপ্নদৃষ্টা নারীকে বিবাহ করিবে কি না, তিনদিনের মধ্যে স্থির করিবে। যদি সম্মত হও, তবে তিনদিন পরে শ্বেতচন্দনরেখা ললাটে ধারণ করিয়া অমাবস্যার সায়ংকালে আমার সহিত এই গহ্বরে সাক্ষাৎ করিও, কিরূপে সে কন্যা পাইবে, তাহার উপায় বলিয়া দিব। যদি এ বিবাহে সম্মত না হও, তবে রক্তচন্দনের রেখা ললাটে ধারণ করিয়া ঐ অমাবস্যার সায়ংকালে এ স্থানে আমার সহিত সাক্ষাৎ করিও, তোমার পাপের প্রায়শ্চিত্ত বিধান করিব। ইহাতে প্রতিশ্রুত হও, নচেৎ কালী তোমাকে স্বপ্ন দিবেন না।

 নরেন্দ্র। প্রতিশ্রুত হইলাম, তিন দিন পর অমাবস্যার সন্ধ্যায় আপনার সহিত এই গহ্বরে সাক্ষাৎ করিব। ইহাকে যে প্রকার অঙ্গীকার করিতে বলেন, করিতে প্রস্তুত আছি।

 শৈলেশ্বর। তুমি বীরপুরুষ, তোমার কথাই অঙ্গীকার। রজনী তিন-প্রহর হইয়াছে, আমি বিদায় হইলাম।