তেত্রিশ

 সায়ংকালে শান্তপ্রবাহিনী যমুনাকূলে মথুরা নগরী বড় সুন্দর দেখাইতেছিল। সূর্য অনেকক্ষণ অস্ত গিয়াছে, গগনে নক্ষত্র এক একটি করিয়া প্রস্ফুটিত হইতেছে, যমুনার বিশাল বক্ষের উপর দিয়া সন্ধ্যার বায়ু রহিয়া রহিয়া বহিয়া যাইতেছে, সমস্ত জগৎ শীতল ও শান্ত। মথুরায় প্রস্তর-বিনির্মিত ঘাটশ্রেণী জল পর্যন্ত নামিয়াছে। বৃক্ষ ও কুঞ্জবনের ভিতর দিয়া মথুরার গোলোকনাথের মন্দির দেখা যাইতেছে।

 ক্রমে রজনী অধিক হইল, হেমন্তকালের চন্দ্রালোকে নদী, গ্রাম, বৃক্ষ ও মন্দির অতি সুন্দরকান্তি ধারণ করিল। নীল গগনে সুধাংশু যেন ধীরে ধীরে আসিতেছে। নদীবক্ষে এই একখানি ক্ষুদ্র তরী ভাসমান রহিয়াছে। নদীর দুই পাশে নিবিড়কৃষ্ণ বৃক্ষশ্রেণী নিঃশব্দে দণ্ডায়মান রহিয়াছে; বোধ হইতেছে যেন চন্দ্রের সুধাবর্ষণে সমগ্র জগৎ তৃপ্ত হইয়া সুখে নিদ্রিত রহিয়াছে।

 সহসা নগরের মধ্যে সায়ংকালীন পূজা আরম্ভ হইল, শত শত দেবালয় হইতে শঙ্খ-ঘণ্টা নিনাদ শ্রুত হইতে লাগিল। সায়ংকালীন বায়ুহিল্লোলে সুদুরশ্রুত সে নিনাদ কী সুমধুর, কী মিষ্টি। সেই ঘণ্টারব ধীরে ধীরে নদীর বক্ষে ও নগরের চতুর্দিকে বিস্তৃত হইতে লাগিল, ধীরে ধীরে সেই নীল অনন্ত নৈশ গগনে উত্থিত হইতে লাগিল, উপাসকাদগের মন যেন মুহূর্তের জন্য ও পৃথিবীর চিন্তা বিস্মৃত হইয়া সেই পবিত্র ঘণ্টা রবের সহিত গগনের দিকে প্রবাহিত হইতে লাগিল।

 নদীকূলে একটি প্রস্তর-বিনির্মিত সোপানশ্রেণীর উপরেই গোলোকনাথের মন্দির; সেই দেবমন্দিরে আরতি হইতেছিল। বহুসংখ্যক ব্রাহ্মণ ও পূজক উচ্চৈঃস্বরে সায়ংকালীন গীত গাহিতেছিল, অনেক যাত্রী সে পূজায় উপস্থিত যাত্রীদিগের মধ্যে স্ত্রীলোকই অধিক, বহু দূর হইতে, বহুদেশ হইতে এই পুণ্যস্থানে সমবেত হইয়া অদ্য মন্দির দর্শন করিয়া যেন জীবন চরিতার্থ করিল।

 আরতি শেষ হইল যাত্রিগণ নিজ নিজ গৃহে চলিয়া গেল, কেবল দুইজন স্ত্রীলোক সেই মন্দিরপার্শ্বে একটি বৃক্ষতলে দণ্ডায়মান হইয়া কথোপকথন করিতেছিল।

 হেমলতা ঈষৎ হাসিয়া বলিল, “দিদি মুসলমানী বলিয়াছিল, আজ এই মন্দিরে এক প্রহর রাত্রির সময় নরেন্দ্রের সঙ্গে দেখা হইবে, কৈ, তাহা হইল না।”

 শৈবলিনী অতিশয় বুদ্ধিমতী, হেমের কথা শুনিয়া বুঝিতে পারিল যে, যদিও হেম হাসিতে হাসিতে ঐ কথা জিজ্ঞাসা করিল, তথাপি হেমের হৃদয় যথার্থই উদ্বেগে পরিপূর্ণ। সেই আশায় হেমের হৃদয় আজি সজোরে আঘাত করিতেছে, হেমের শরীর এক-একবার অল্প অল্প কম্পিত হইতেছে।

 শৈবলিনী মনে মনে ভাবিল আজ না জানি কি কপালে আছে; হেম বালিকা মাত্র, নরেন্দ্রকে দেখিলে আবার পূর্বকথা মনে করিবে সে অসহ্য যাতনা বালিকা কি সহ্য করিতে পারিবে? প্রকাশ্যে বলিল, “সে পাগলিনীর কথায় কি বিশ্বাস করে? নরেন্দ্র কোথায় কোন্ দেশে আছে, তাহার সহিত মথুরায় দেখা হইবার আশা করিতেছ?”

 হেমলতা। কিন্তু দিদি জেলেখার জন্য কথাগুলি তো ঠিক হইয়াছিল।

 শৈবলিনী। ঐ প্রকারে উহারা মিথ্যা আশা জন্মায়, দু'টা সত্য কথা বলে, একটা মিথ্যা কথা বলে। কৈ, আমাদের দাসী আসিল না? আমি যে পথ ঠিক চিনি না, না হইলে আমরা দুইজনেই বাড়ি যাইতাম।

 হেম। দেখ দিদি, আমার বোধ হইতেছে, যেন এই আমাদের বীরনগর যেন এই গঙ্গা। আর বাল্যকালে চন্দ্রালোকে গঙ্গাতীরে খেলা করিতাম। তোমার সহিত খেলা করিতাম, অরি—আর —আর, সকলের সহিত খেলা কবিতাম, সেই কথা মনে পড়িতেছে।

 শৈবলিনীর মুখ আবার গম্ভীর হইল, দাসীর আসিতে বিলম্ব হইতেছে বলিয়া শৈবলিনী যৎপরোনাস্তি উৎসুক হইল। হেম তাহা লক্ষ্য না করিয়া আবার বলিতে লাগিল, “দেখ দিদি ঐ নৌকাখানি কেমন তীরের মত আসিতেছে। উঃ! মাঝিরা কী জোরে দাঁড় বহিতেছে! উঃ! যেন উডিয়া আসিতেছে।”

 শৈবলিনী সেইদিকে দেখিল; তাহার ভয় দ্বিগুণ হইল। শৈবলিনী যাহা ভয় করিতেছিল, তাহাই হইল,—নৌকা ঘাট হইতে চারি হস্ত দূরে থাকিতে একজন সৈনিক লম্ফ দিয়া ঘাটে পড়িল, সৈনিক নরেন্দ্রনাথ!

 হেম বৃক্ষের ছায়ায় ছিল, নরেন্দ্র তাহাকে না দেখিতে পাইয়া মন্দিরের ভিতর যাইলেন। কিন্তু হেম নরেন্দ্রকে দেখিয়াছিল, সেই মুহূর্তে যেন শরীরের সমস্ত রক্ত হেমের মুখমণ্ডলে দৃষ্ট হইল, চক্ষু কর্ণ, ললাট, স্কন্ধ একেবারে বক্তবর্ণ হইয়া গেল। পর-মুহূর্তে সমস্ত মুখমণ্ডল পাণ্ডুবর্ণ হইল, শরীর কাঁপিতে লাগিল, ললাট হইতে স্বেদবিন্দু বহির্গত হইতে লাগিল।

 শৈবলিনী সভয়ে হেমকে ধরিল। হেম কিঞ্চিৎ আরোগ্যলাভ করিলে শৈবলিনী গম্ভীরস্বরে বলিল,—“হেম, আমি তোমাকে ভগিনী অপেক্ষা ভালবাসি। আমি বলিতেছি, আজ নরেন্দ্রের সহিত দেখা করিও না, বাড়ি চল। তুমি আমাকে ভগিনী অপেক্ষা ভালবাস, আমার এই কথাটি শুন, বাড়ি চল। তুমি বালিকা, আপনার মন জান না, নরেন্দ্রের সহিত অদ্য তোমার কথোপকথন হইলে কি বিপদ ঘটিবে, ভগবান জানেন।”

 হেমলতা মুখ নত করিয়া এই কথা শুনিল, অনেকক্ষণ ভূমির দিকে দৃষ্টি করিতে লাগিল, নয়ন হইতে দুই এক বিন্দু স্বচ্ছ অশ্রু স্বচ্ছ বালুকায় পড়িয়া অদৃশ্য হইল। আবার ধীরে ধীরে মুখখানি তুলিল। তখন উদ্বেগের লেশমাত্র চিহ্ন নাই; হেমের মুখখানি শান্ত, নির্মল, স্থির। নয়নে কেবল একবিন্দু অশ্রুজল।
 হেম শৈবলিনীর দিকে চাহিয়া বলিল, “দিদি, তুমি আমার প্রাণের অপেক্ষা প্রিয়, তুমি আমাকে অবিশ্বাস করিও না। দিনে দিনে, মাসে মাসে, তুমি আমাকে কত ধর্ম উপদেশ দিয়াছ, আমি তাহা ভুলি নাই। দিদি, আমি অবিশ্বাসিনী নহি। আজি এইমাত্র দেবপূজা সাঙ্গ করিলাম, এই পূণ্যভূমিতে দাঁড়াইয়া এই পূণ্য দেবমন্দিরে আমি অবিশ্বাসিনী হইব না। যদি আমার প্রধান দেবতুল্য স্বামী আমাকে ভালবাসেন, আমার জীবনের যিনি সর্বস্বধন, জীবন থাকিতে এ দাসী তাঁহার অবিশ্বসিনী হইবে না। দিদি, আমাকে সন্দেহ করিও না, আমাকে মন্দ ভাবিও না, তুমি আমাকে মন্দ ভাবিলে এ সংসারে অভাগিনীকে কে ভালবাসিবে?”

 হেমলতার নয়ন হইতে ঝর-ঝর করিয়া জল পড়িয়া সমস্ত মুখমণ্ডল সিক্ত হইতেছিল।

 তখন শৈবলিনীর মন শান্ত হইল, শৈবলিনীরও চক্ষুতে জল আসিল। শৈবলিনী সস্নেহে হেমের চক্ষু মুছাইয়া বলিল, “হেম, আমাকে ক্ষমা কর। তুমি ধর্মপরায়ণ, তুমি পতিব্রতা, আমি যে মুহূর্তের জন্যও তোমাকে সন্দেহ করিয়াছিলাম, সেজন্য ক্ষমা কর।”

 হেম: দিদি, তুমি ক্ষমা চাহিও না, তোমাব দয়া, তোমার ভালবাসা, তোমার ঋণ আমি ইহজন্মে পবিশোধ করিতে পারিব না। জন্মে জন্মে যেন তোমার ভগিনী হই, আর আমার কিছু প্রার্থনা নাই।

 আবার দুইজনে দুইজনকে ধরিয়া ক্ষণেক নিস্তব্ধ হইয়া রহিল, দুইজনের চক্ষু দিয়া জল পড়িতেছিল। পরে শৈবলিনী বলিল, “রাত্রি হইতেছে, যাও, নরেন্দ্রের সহিত দেখা করিয়া আইস।”

 শৈবলিনী সেই বৃক্ষতলে অপেক্ষা করিতে লাগিল, হেমলতা মন্দিরে প্রবেশ করিল। হেমলতার এক্ষণে উদ্বেগ নাই, ধীরে ধীরে নরেন্দ্রেব নিকট আসিয়া দাঁড়াইল ও নম্রভাবে মৃত্তিকার দিকে চাহিয়া রহিল।

 এতদিনের পর হৃদয়ের হেমকে পাইয়া নরেন্দ্রের হৃদয় উদ্বেগপূর্ণ হইল। নরেন্দ্র কথা কহিতে পারিলেন না, কেবলমাত্র হেমের হাত ধরিয়া পিপাসিতের ন্যায় সেই অমৃতমাখা মুখখানি দেখিতে লাগিলেন, শরীর কঁপিতে লাগিল। হেম আর সহ্য করিতে পারিল না, মস্তক নত করিয়া রহিল। তাহার নয়ন ছলছল করিতেছিল।

 অনেকক্ষণ পর হেমলতা নরেন্দ্রের দিকে স্থিরদৃষ্টি করিয়া বলিল “নরেন্দ্র।”

 নরেন্দ্র দেখিলেন, হেমের মুখে আর উদ্বেগের চিহ্ন নাই, লজ্জার চিহ্ন নাই, মুখমণ্ডল নির্মল ও পরিষ্কার। ধীরে ধীরে হেমলতা বলিল, “নরেন্দ্র”!