চৌত্রিশ

 দেবালয়ের সমস্ত দীপ তখন নির্বাণ হইয়াছে ও সমস্ত লোক সুপ্ত অথবা চলিয়া গিয়াছে। স্তম্ভ ও প্রকোষ্ঠের উপর সুন্দর চন্দ্রালোক পতিত হইয়াছে ও সারি সারি স্তম্ভছায়া ভূমিতে পতিত হইয়াছে। পাশে বিশাল যমুনা নদী চন্দ্রকরে নিস্তব্ধে বহিয়া যাইতেছে ও রহিয়া রহিয়া শীতল যমুনার বায়ু মন্দিরের ভিতর দিয়া বহিয়া যাইতেছে। সেই সুস্নিগ্ধ রজনীতে পবিত্র মন্দিরের একটি স্তম্ভছায়াতে নিস্তব্ধ নরেন্দ্র ও হেম দাঁড়াইয়া রহিয়াছে।

 হেম স্থিরভাবে বলিল, “নরেন্দ্র! অনেকদিন পর আমাদের দেখা হইয়াছে, আবার বোধ হয়, অনেকদিন দেখা হইবে না, আইস, আমাদেব মনের যে কথা, তাহাই কহি। নরেন্দ্র! বাল্যকালে আমরা দুইজনে গঙ্গাতীরে খেলা করিতাম, কত স্বপ্ন দেখিতাম। এক্ষণে তুমি সৈনিকের কার্যে ব্রতী হইয়াছ, আমি পরের স্ত্রী। নরেন্দ্র, বাল্যকালের স্বপ্ন একেবারে বিস্মৃত হও।”

 হেমলতা ক্ষণেক নিস্তব্ধ হইয়া রহিল, আবাব বলিল, “বিধাতা যদি অন্যরূপ ঘটাইতেন, তবে আমাদের জীবন অন্যরূপ হইত, বাল্যকালের স্বপ্ন সফল হইত। কিন্তু নরেন্দ্র, আমরা যেন ভ্রমেও বিধাতার নিন্দা না করি। যিনি তোমাকে পরাক্রম দিয়াছেন, যশ দিয়াছেন তাঁহার নাম লও, অবশ্য তোমাকে সুখী করিবেন। যিনি আমাকে এই সংসারে স্থান দিয়াছেন, দেবতুল্য স্বামী দিয়াছেন, শৈবলিনীর ন্যায় ননদিনী দিয়াছেন, ধন-ঐশ্বর্য দিয়াছেন তিনি দয়ার সাগর, তাহাকে আমি প্রণাম করি।”

 হেমলতা গলায় বস্ত্র দিয়া করজোড়ে বিশ্বের আদি-পুরুষকে লক্ষ্য করিয়া প্রণাম করিল। তার মুখমণ্ডল উজ্জ্বল, পবিত্র, শাস্তি-রসে পরিপুর্ণ।

 নরেন্দ্র বিস্মিত হইয়া হেমলতার মুখের দিকে চাহিল, তাহার বাক্যস্ফূর্তি হইল না। হেমলতা আবার বলিতে লাগিল, “নরেন্দ্র, আমি শুনিয়াছি, তুমি অনেক যুদ্ধ করিয়াছ, অনেক দেশ ভ্রমণ করিয়াছ, সকল দেশেই সুখ্যাতি লাভ করিয়াছ। তুমি পুণ্যাত্মা, জগদীশ্বর তোমাকে সুখে রাখুন। কিন্তু যদি যুদ্ধে শ্রান্ত হইয়া বিশ্রাম আকাঙ্ক্ষা কর, যদি বিপদ বা দারিদ্রে পতিত হও, আবার বীরনগরে যাইও, তুমি যাইলে সকলেই আহ্লাদিত হইবে। আমার স্বামীর হৃদয় আমি জানি, তিনি তোমাকে কনিষ্ঠের ন্যায় ভালবাসেন, সর্বদাই সস্নেহে তোমার কথা কহেন, তুমি যাইলেই তিনি অতিশয় আহ্লাদিত হইবেন।”

 নরেন্দ্র নিস্তব্ধ হইয়াছিল, হেমের কথাগুলি তাঁহার কর্ণে অপূর্ব সঙ্গীতধ্বনির ন্যায় বোধ হইতেছিল। তাঁহার হৃদয় পরিপূর্ণ, তাঁহার নয়ন দুটিও পরিপূর্ণ।

 হেম আবার বলিতে লাগিল, “আর তুমি যাইলে শৈবলিনীও কত আহ্লাদিত হইবেন। আর হেমলতা যতদিন জীবিত থাকিবে, কনিষ্ঠা ভগিনীর ন্যায় তোমার সেবাশুশ্রূষা করিবে। ভাই নরেন্দ্র। আমি তোমাকে যখন দেখিব, তখনই আহ্লাদিত হইব।”  এই স্নেহবাক্য শুনিয়া নরেন্দ্রের চক্ষুতে আবার জল আসিল, আবার দুইজনে অনেকক্ষণ নিস্তব্ধ হইয়া রহিল।

 শেষে হেম ঈষৎ গম্ভীরস্বরে বলিল, “নরেন্দ্র, আর একটি কথা আছে, কিছু মনে করিও না, আমার দোষ গ্রহণ করিও না। নরেন্দ্র, আমাদের বিদায়কালে প্রণয়চিহ্নস্বরূপ আমাকে একটি দ্রব্য দিয়াছিলে, সেটি এখন পরিধান করিতে আমি অধিকারিণী নাহি। নরেন্দ্র, সেটি ফিরাইয়া লও।”

 হেমলতা আপন হস্তের বস্ত্র তুলিয়া লইল, নরেন্দ্র দেখিল, যে মাধবীকঙ্কণ নরেন্দ্র দিয়াছিল, তাহা এখনও রহিয়াছে। লতা শুষ্ক হইয়া খণ্ড খণ্ড হইয়া গিয়াছে, হেমলতা সেই অসংখ্য খণ্ডকে একে একে সুতার দ্বারা গ্রথিত করিয়া রাখিয়াছিল, অদ্য তাহাই পরিধান করিয়া আসিয়াছে।

 উভয়ের পূর্বকথা মনে আসিতে লাগিল, উভয়ের হৃদয় বিষাদচ্ছায়ায় আচ্ছন্ন হইল, উভয়েই অনেকক্ষণ নিস্তব্ধ হইয়া রহিল। নবেন্দ্র হেমলতার সেই সুন্দর বাহু ও সেই মাধবীকঙ্কণ দেখিতে লাগিলেন, দেখিতে দেখিতে তাঁহার নয়ন জলে পরিপূর্ণ হইল, আর দেখিতে পারিলেন না। অবশেষে দরবিগলিত ধারায় অশ্রুবারি পড়িয়া হেমলতার হস্ত ও বাহু সিক্ত করিল। অবশেষে নরেন্দ্র একটি নিঃশ্বাস পরিত্যাগ করিয়া বলিলেন, “হেম তবে কি জন্মের মত আমাকে বিস্মৃত হইবে?”

 হেম বলিল, “জীবিত থাকিতে তোমায় বিস্মৃত হইব না; চিরকাল সহোদরের ন্যায় তোমার কথা ভাবিব। কিন্তু এই কঙ্কণ অন্য প্রণয়ের চিহ্নস্বরূপ আমাকে দিয়াছিলে, নরেন্দ্র অমি সে প্রণয়ের অধিকারিণী নহি। নরেন্দ্র মনে ক্লেশবোধ করিও না, আমি এই কয় বৎসর এ কঙ্গণটি পূজা করিয়াছি, হৃদয়ে রাখিয়াছি, উহা ত্যাগ করতে আমার যে কষ্ট হইতেছে, তাহা তুমি জান না। কিন্তু এটি উন্মোচন কর, ইহাতে আমার অধিকার নাই। নরেন্দ্র আমি অবিশ্বাসিনী পত্নী নহি।”

 নরেন্দ্র আর কোন কথা কহিলেন না। নিঃশব্দে হেমলতার হস্ত হইতে কঙ্কণ খুলিয়া লইলেন।

 তখন হেমলতা বলিল, “নরেন্দ্র! আমি চলিলাম, তুমি ধর্মপরায়ণ, বাল্যকাল হইতে ধর্মে তোমার আস্থা আছে, সে ধর্ম কখনও বিস্মৃত হইত না, জগদীশ্বর তোমাকে সুখে রাখিবেন। তিনি যাহাকে যাহা করিয়াছেন, যেন আমরা সেইরূপ থাকিতেই চেষ্টা করি। পুষ্পটি দুই একদিন সুগন্ধ বিস্তার করিয়া শুষ্ক হইয়া যায়, পক্ষীটি আলোকে প্রফুল্ল হইয়া গান করে, তাহাদের সেই কার্য। নরেন্দ্র, তুমি বীরপুরুষ, শত্রুকে জয় কর, দেশের মঙ্গল কর, পদাশ্রিত ক্ষীণের প্রতি দয়া করিও। আর ভগবান আমাকে দেবতুল্য স্বামী দিয়াছেন, তিনি আমার সহায় হউন, সেই স্বামীর যেন কখনও ত্রুটি না করি সেই স্বামীতে যেন আমার অচলা ভক্তি থাকে, আমি যেন তাঁহারই চির-পতিব্রতা দাসী হইয়া থাকি। নরেন্দ্র! ভাই নরেন্দ্র! বাল্যকালে তুমি আমাকে ধর্মশিক্ষা দিয়াছিলে, এই পবিত্র দেবমন্দিরে আবার সেই শিক্ষা দাও। তাই আমরা প্রতিশ্রুত হই, ধর্মপথ কখনও ত্যাগ করিব না, আমি জনমে-মরণে চির-পতিব্রতা হইয়া থাকিব।”—কথা সাঙ্গ করিয়া হেমলতা দেবপ্রতিমূর্তির সম্মুখে প্রণতা হইল; নরেন্দ্রও নিঃশব্দে প্রণত হইলেন।

 উঠিয়া আবাব সযত্নে নরেন্দ্রের হাত ধরিয়া হেমলতা বলিল, “ভাই নরেন্দ্র, এক্ষণে রাত্রি অধিক হইয়াছে, বিদায় দাও, আমি চিরকাল তোমাকে জ্যেষ্ঠ ভ্রাতার ন্যায় ভালবাসিব, তুমিও তোমার কনিষ্ঠা ভগিনীকে মনে রাখিও।”

 একবিন্দু জল নয়ন হইতে মোচন করিয়া হেমলতা ধীরে ধীরে মন্দির হইতে নিষ্ক্রান্ত হইল। যতক্ষণ দেখা যাইল, নরেন্দ্র হেমেব দিকে চাহিয়া রহিল। তাহার পর? তাহার পর এ জগতের মধ্যে নিতান্ত দুর্ভাগা লোকও নরেন্দ্রের সে রজনীর শোক ও বিষাদ দেখিলে বিষণ্ণ হইত। অভাগার হৃদয় আজ শূন্য হইল, অভাগার প্রণয়-ইতিহাস আজ সমাপ্ত হইল।

 মাধবীকঙ্কণটি হৃদয়ে ধারণ করিয়া নরেন্দ্র যমুনাতীরে বসিয়া ছিলেন। হেমলতার কথাগুলি তাহার মনে বার বার উদয় হইতে লাগিল—"এটি উন্মোচন কর, ইহাতে আমার অধিকার নাই, নরেন্দ্র আমি অবিশ্বাসিনী পত্নী নহি।” নরেন্দ্রর কি সে প্রণয় নিদর্শনটি রাখিবার অধিকার আছে? সমস্ত রজনী নরেন্দ্র সেটি হৃদয়ে ধারণ করিয়া রহিলেন, প্রাতঃকালে শূন্য হৃদয়ে সেটি বিসর্জন দিলেন, যমুনার জলে ভাসিতে ভাসিতে শুষ্ক কঙ্কণটি অদৃশ্য হইয়া গেল।