পঁয়ত্রিশ

আমাদের আখ্যায়িকা শেষ হইল, কেবল আখ্যায়িকার নায়ক-নায়িকাদিগের সম্বন্ধে দুই একটি কথা বলিতে বাকি আছে।

 পূর্বেই বলা হইয়াছে, শাসুজা বঙ্গদেশ হইতে দ্বিতীয়বার যুদ্ধার্থে আগমন করিতেছিলেন। শীতকালে প্রয়াগের নিকট সুজা ও আওরংজীবের মধ্যে মহাযুদ্ধ হয়। দুই দিনের যুদ্ধের পর সুজা পরাস্ত হইয়া পলায়ন করিলেন, যশোবন্তসিংহ এই যুদ্ধে আওরংজীবের বিরুদ্ধাচরণ করিতে চেষ্টা করিয়াছিলেন, কিন্তু সেই তীক্ষ্ণবুদ্ধি মহাযোদ্ধারও অধিক ক্ষতি করিতে পারিলেন না, ক্ষোভে রাজস্থানে প্রত্যাবর্তন করিলেন।

 সুজা প্রয়াগ হইতে পাটনা, পাটনা হইতে মুঙ্গের, মুঙ্গের হইতে রাজমহল এবং তথা হইতে গঙ্গা পার হইয়া তণ্ডায় পলায়ন করিলেন। আওরংজীবের পুত্র মহম্মদ এবং সেনাপতি আমীর জুমলা তাহার পশ্চাদ্ধাবন করিতেছিলেন। তণ্ডায় রাজপুত্র মহম্মদ, সুজার কন্যাকে বিবাহ করিয়া সুজার পক্ষাবলম্বন করিলেন; কিন্তু উভয়েই আমীর জুমলার নিকট পরাস্ত হইলেন। তৎপুরে মহম্মদ পিতার কপটপত্রে বিশ্বাস করিয়া সস্ত্রীক সুজার পক্ষ ত্যাগ করিলেন। অভাগা সুজা আরাকানে পলায়ন করিলেন। তথাকার রাজার সহিত বিরোধ হওয়ায় সুজা সসৈন্যে হত হইলেন, তাঁহার কন্যাকে রাজা বিবাহ করিলেন। কথিত আছে, সুজার রূপবতী সহধর্মিণী প্যারিবানু বিষাদে আত্মহত্যা করিলেন। যিনি বিংশতি বৎসর বঙ্গদেশ শাসন করিয়াছিলেন, যিনি যুদ্ধে সাহস, শাসনে দয়া ও হিন্দুদিগের প্রতি বদান্যতার জন্য খ্যাত হইয়াছিলেন, যাঁহার খাসমহলের প্রাসাদ মর্ত্যে ইন্দ্রপুরী ছিল ও দিবারাত্র আনন্দলহরীতে ভাসিতেন, তিনি মুত্যুকালে মস্তক রাখিবার স্থান পাইলেন না, বিদেশে শত্রুহস্তে সবংশে বিনষ্ট হইলেন।

 দারা শ্যামনগর অথবা ফতে-আবাদের বুকে পরাজয়ের পর সিন্ধুদেশে পলায়ন করিয়াছিলেন, আওরংজীবের সৈন্য তথা হইতে দারাকে দিল্লী হইয়া আইসে। নৃশংস সম্রাট জোষ্ঠকে যথেষ্ট অপমান করিয়া পরে হত্যা করেন। কারারুদ্ধ মোরাদও অচিরাৎ রাজাজ্ঞায় হত হইলেন। ভ্রাতৃরক্তে স্নাত হইয়া আওরংজীব ভারতবর্ষের রাজসিংহাসনে আরোহণ করিলেন।

 যেদিন মথুরায় হেমের সহিত নরেন্দ্রের সাক্ষাৎ হইয়াছিল, তাহার পর নরেন্দ্র নিরুদ্দেশ হইলেন।

 হেমলতা বঙ্গদেশে প্রত্যাবর্তন করিয়া নরেন্দ্রেরে অনেক অনুসন্ধান করাইলেন, মহানুভব শ্রীশচন্দ্র দেশে-দেশে সংবাদ পাঠাইলেন যে, নরেন্দ্র ফিরিয়া আসিলেই তাঁহাকে তাঁহার পৈতৃক জমিদারির অর্ধ-অংশ ছাডিয়া দিবেন; কিন্তু সেইদিনের পর নরেন্দ্রকে আর কেহ কোথাও দেখিতে পাইল না।

 হেমলতা বীরনগরে শ্রীশচন্দ্রের সহিত বাস করিতে লাগিলেন, মথুরা মন্দিরে যে অঙ্গীকার করিয়াছিলেন, হেম তাহা বিস্মৃত হয়েন নাই, পতিসেবায় ধর্মপরায়ণা হেমের অদ্য চিন্তা তিরোহিত হইল, পতিভক্তি ভিন্ন অন্য ধর্ম তিনি জানিতেন না। ক্রমে শ্রীশচন্দ্রের ঔরসে তাঁহার হেমন্তকুমারী ও সরযূবালা নামক দুইটি কন্যা ও প্রতাপ নামক একটি পুত্র জন্মিল। বিংশতি বৎসর পূর্বে শ্রীশ, নরেন্দ্র ও হেমলতা সায়ংকালে গঙ্গাতীরে যেরূপ খেলা করিত, বাষ্পোৎফুল্ললোচনে হেমলতা দেখিলেন, তাহার পুত্রকন্যাগণ সেইস্থানে সেইরূপ খেলা করিতেছে, দৌড়াদৌড়ি করিতেছে, আনন্দধ্বনিতে চারিদিকের কুঞ্জবন প্রতিধ্বনিত হইতেছে। সংসারের এই গতি, এক দল যাইতেছে, অন্য দল আসিতেছে। শিশুদিগের ললাট পরিষ্কার, নয়ন উজ্জল, মুখমণ্ডল চিন্তাশূন্য এখনও মানবজীবনের চিন্তা সে স্বর্গীয় অবয়বে অঙ্কিত হয় নাই।

 হেমলতার বিবাহের প্রায় দশ বৎসর পর হেমলতা পুত্রকন্যা গুলিকে লইয়া একটি সন্ন্যাসীর আবাস দেখিতে গেলেন। বীরনগর হইতে কয়েক ক্রোশ দূরে একটি প্রসিদ্ধ শিমুলবৃক্ষ ছিল। শিমুল-বৃক্ষের গুঁড়ি হইতে প্রায়ই তিনদিকে তিনটি দেওয়ালের মত পাট বাহির হয়, এই বৃক্ষের সেই পাটগুলি এত বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হইয়াছিল, বোধ হইত, যেন একটি উন্নত ঘর হইয়াছে। সেই অপরূপ ঘরে একজন সন্ন্যাসী কয়েক বৎসর অবধি বাস করিতেছিলেন। পল্লী-গ্রামস্থ গৃহিণী ও বালিকাগণ সস্নেহে সেই সন্ন্যাসীকে প্রত্যহ দুগ্ধ ও ফলমূল আনিয়া দিত, তাহাতেই তিনি জীবনধারণ করিতেন। সমস্ত দিন তিনি প্রায় ধ্যানে রত থাকিতেন, সায়ংকালে সেই গ্রামের ভিতর গৃহে গৃহে যাইতেন, শোকবিদগ্ধকে সান্ত্বনা করা, পীড়িতকে শুশ্রূষা করা, দুর্বলকে সাহায্য করা, মানবের কষ্ট নিবারণ করা তাহার জীবনের কার্য। গভীর রজনী পর্যন্ত এই কার্য করিয়া আবার তিনি সেই তরুগৃহে ফিরিয়া আসিতেন, তথায় ঘাসের উপর কি শীত, কি গ্রীষ্ম, কি বর্ষা সকল কালেই তিনি সমভাবে নিদ্রা যাইতেন। সেই তরুগৃহ ও সেই সন্ন্যাসীকে দেখিবার জন্য অনেক দেশ হইতে অনেক লোক আসিত।

 হেমলতা বৃক্ষের কিঞ্চিদ্দুরে নৌকা হইতে অবতরণ করিলেন, ধীরে ধীরে পদব্রজে তরুর নিকট যাইয়া সন্ন্যাসীকে উপলক্ষ করিয়া একটি প্রণাম কহিলেন, পরে অপিন শিশুটিকে ক্রোড়ে লইয়া দণ্ডায়মান হইয়া সেই সন্ন্যাসীর দিকে দেখিতে লাগিলেন। সেদিক হইতে অর নয়ন ফিরাইতে পারিলেন না, নিস্পন্দভাবে দেখিতে লাগিলেন। সন্ন্যাসীও হেমলতার দিকে স্থিরদৃষ্টিতে চাহিতেছিলেন, তিনি প্রীত-নয়নে হেমলতাকে প্রণাম করিতে দেখিলেন, সতৃষ্ণনয়নে হেমলতার কমনীয় কন্যাপুত্রের দিকে চাহিয়া রহিলেন। বোধ হইল, যেন দেখিতে দেখিতে সন্ন্যাসীর হৃদয় একবার আলোড়িত বোধ হইল; চক্ষু একবিন্দু জলে অবৃিত হইল, অবশেষে সন্ন্যাসী ধীরে ধীরে হেমের নিকটে আসিয়া শিশুদিগের মাথায় হাত দিয়া আশীর্বাদ করিলেন, পরে হেমলতার দিকে স্থিরদৃষ্টিতে অবলোকন করিয়া বলিলেন, “আমি আশীর্বাদ করিতেছি, তোমার দেবতুল্য স্বামীতে যেন তোমার অচলা ভক্তি থাকে, জনমে-মরণে যেন চির পতিব্রতা হইয়া থাক।”

 সন্ন্যাসী ধীরে ধীরে চলিয়া গেলেন। তাহার পর আর কেহ সে তরুতলে সন্ন্যাসীকে দেখিতে পাইল না, সন্ন্যাসী যে সে গ্রাম হইতে কোথায় চলিয়া গেলেন, কেহ আর জানিতে পারিল না।