॥ তের॥

 নরেন্দ্রের বিস্ময়ের পরিসীমা রহিল না। সে স্থানটি তিনি পূর্বে কখনও দেখেন নাই। সেই স্থান একটি প্রকাণ্ড সরাইয়ের মত বোধ হইল। মধ্যস্থানে একটি প্রশস্ত প্রাঙ্গণ, তাহার চারিপার্শ্বে দ্বিতল হর্ম্যশ্রেণী, প্রত্যেক প্রকোষ্ঠেই দুই একটি করিয়া লোক আছে। সে সমস্ত লোক অধিকাংশই সম্ভ্রান্ত পারস্য, উসবেক, পাঠান বা হিন্দু বাণিজ্য-ব্যবসায়ী লোক, প্রথমে নগরে আসিয়া এই সরাইয়ে বাস করিয়া আছে। সকল লোক সরাইয়ে আসিলে নিশার দ্বার রুদ্ধ হইয়াছিল, এক্ষণে প্রাতঃকালে পুনরায় সরাইয়ের বহির্দ্বার উদ্‌ঘাটিত হইল, লোকে গমনাগমন করিতে লাগিল।

 এক বৃদ্ধ পারস্যদেশীয় সেখ একটি প্রকোষ্ঠে বসিয়া তামাক খাইতেছিল। নরেন্দ্র যাইয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, “সেখজী, এটি কোন্ স্থান? আমি এখানে নূতন আসিয়াছি, কিছু বুঝিতে পারিতেছি না।” সেখজী বলিলেন “বৎস, আমিও বাণিজ্যকর্মে এই শহরে কল্য আসিয়াছি, শহরের বিশেষ কিছু জানি না।”

 নরেন্দ্র। আপনি আমার অপেক্ষা অধিক জানেন। এই স্থানের কথা আমাকে কিঞ্চিৎ বলুন।

 সেখজী। আমি যথার্থই বলিতেছি, এ শহরের কিছুই জানি না। তবে শুনিলাম এই স্থানটি বেগম সাহেবার সরাই। সম্রাটের জ্যেষ্ঠা কন্যা বাদশা-বেগম শহর নূতন আগন্তুকের থাকিবার সুবিধার জন্য এই উৎকৃষ্ট সরাই নির্মাণ করিয়া দিয়াছেন। আমি সুমরকন্দ ও বোখারা দেখিয়াছি, দিরাজ ও ইস্পাহান দেখিয়াছি, কিন্তু এমন সুন্দর শহর দেখি নাই।

 নরেন্দ্র। এ শহরের নাম কি? বাদশা-বেগমই বা কে?

 বৃদ্ধ বণিক্ অনেকক্ষণ স্থির-দৃষ্টিতে যুবকের দিকে চাহিয়া একজন ভৃত্যকে ডাকিয়া বলিলেন,—“এ কাফের দেখিতেছি জ্ঞানশূন্য, পাগলটাকে তাড়াইয়া দাও, পাগলামী চড়িলেই এইক্ষণেই কি করিয়া বসিবে।”

 নরেন্দ্র গতিক মন্দ দেখিয়া সে স্থান হইতে সরিয়া গেলেন। পরে তিনি দেখিলেন, একজন পাঠান-স্ত্রী কতকগুলি ফলমুল লইয়া বিক্রয়ার্থ ধনী বণিকদিগের নিকট যাইতেছে। নরেন্দ্র তাহার কাছে যাইয়া জিজ্ঞাসা করিলেন,—“বিবি, এ শহরের নাম কি, এ স্থানকেই বা লোকে কি বলে?” বৃদ্ধা বিস্মিত হইয়া ক্ষণেক নরেন্দ্রের প্রতি চাহিয়া থাকিয়া পরে উত্তর করিল,—“কাফের, আমার সে বয়স নাই, উপহাস করিতে হয়, অন্য স্থানে যাও, এ খুবসুরত মুখ দেখিলে অনেক খঞ্জনীও ভুলিয়া যাইবে।”

 নরেন্দ্রনাথ অপ্রতিভ হইলেন, দেখিলেন, একজন রাজপুত সৈনিক-পুরুষ দাড়াইয়া রহিয়াছেন, একজন ভৃত্য তাহা অশ্বের সেবা করিতেছে, সৈনিক সলজ্জ হইয়া ভৃত্যকে শীঘ্র কার্য সমাধা করিতে বলিতেছেন। নরেন্দ্র জিজ্ঞাসা করিলেন, “আমি এই স্থানে নূতন আসিয়াছি, এ স্থানটির নাম কি, জানি না। আপনি বোধ হয়, অনেকদিন এ স্থানে আছেন, আমাকে এ নগরের কথা সব কিছু বলিতে পারেন?”

 রাজপুত অনেকক্ষণ নরেন্দ্রের দিকে দেখিয়া উত্তর করিলেন,—“বালক, তোমার মুখ আমি পূর্বে দেখিয়াছি, তুমি বঙ্গদেশ হইতে আসিয়াছ, না? হাঁ, স্মরণ ইয়াছে, তুমি আমাকে ইহার মধ্যে বিস্মৃত হইয়াছ?”

 নরেন্দ্র তখন রাজপুতকে ভাল করিয়া দেখিয়া বলিলেন,—“না, “বিস্মৃত হই নাই, গজপতি, তুমি কাশীর যুদ্ধের পর আমার জীবন রক্ষা করিয়াছ, জীবন থাকিতে আমি তোমাকে বিস্মৃত হইতে পারি না।”

 দুইজন অনেকক্ষণ আলাপ-পরিচয় হইতে লাগিল। বিস্মিত হইয়া নরেন্দ্র জানিলেন যে, নগর হিন্দুস্থানের রাজধানী প্রসিদ্ধ দিল্পী নগরী: কথায় কথায় গজপতি প্রকাশ করিলেন,—“আমি মহারাজ জয়সিংহের নিকট হইতে কতিপয় পত্রাদি লইয়া মহারাজ, যশোবন্তসিংহের নিকট যাইতেছি। তিনি আপাতত উজ্জয়িনীতে আওরংজীবের সহিত যুার্থে গিয়াছেন, যুদ্ধ না হইতে হইতে আমি তথায় পৌছিতে পারলেই মঙ্গল। তুমি যদি ইচ্ছা কর তবে আমার সঙ্গে আইস, আমি মহারাজকে রলিয়া তোমাকে অশ্বারোহীর কার্যে নিযুক্ত করিয়া দিব। নরেন্দ্র সে দেশে বন্ধুহীন ও অর্থহীন, ভাবিয়া-চিন্তিয়া সেই প্রস্তাবে সম্মত হইলেন। তৎপরে দুইজনে দিল্পী নগরী ভ্রমণে বাহির হইলেন।

 মহাভারতে বিবৃত ইন্দ্রপ্রস্থ নগর যেস্থানে ছিল, ভারতবর্ষের শেষ হিন্দু-সম্রাট্, পৃথুরায়ের রাজধানী দিল্লী নগরী যেস্থানে ছিল, এই আখ্যায়িকা-বিবৃত সময়ের

কয়েক বৎসর পূর্বে সম্রাট, শাজাহান সেইস্থানে মূল রাজধানী স্থাপন করিয়া ও সুন্দর প্রাসাদ ও দুর্গ নির্মাণ করিয়া নগরের শাজাহানবাদ নাম দেন। কিন্তু নগরের সে নাম কেহ জানে না। অদ্যাপি শাজাহানের নগর নূতন দিল্লী নামে বিখ্যাত। পৃথুরাজের সময়ের হিন্দু নাম অদ্যাপি পরিবর্তিত হয় নাই।

 দিল্লী একদিকে যমুনা নদী ও অন্য তিনদিকে অর্ধগোলাকৃতিরূপে প্রাচীর দিয়া বেষ্টত। সে প্রাচীর প্রশস্ত ও তাহার উপর দিয়া যাতায়াতের একটি পথ ছিল। যমুনা ও এই প্রাচীরের মধ্যে দিল্লী নগরী সন্নিবেশিত, কিন্তু প্রাচীরের বাহিরেও তিনচারিটি বৃহৎ বৃহৎ পল্লী ও ধনাঢ্য ওমরাহ ও হিন্দুরাজগণের অট্টালিকা ও বাগান অনেক অবধি দেখা যাইত দিল্লীর ভিতরে যমুনার অনতিদূরে প্রস্তাব-প্রাচীর-পরিবেষ্টিত দুর্গ আছে, তাহার ভিতর সম্রাটের প্রাসাদ ও জগতে অতুল্য মর্মর-নির্মিত হর্ম্যাবলী।

 গজপতিও নরেন্দ্র দিল্লীর একটি প্রধান পথ দিয়া দুর্গাভিমুখে যাইতে লাগিলেন। সমস্ত দিল্লীই প্রায় সৈনিকের বাস, সে নগরীতে পঞ্চত্রিংশৎ সহস্র সৈন্তু বাস করিত। সৈনিকগণের স্ত্রী, পরিবার ও বহুসংখ্যক ভৃত্য দিল্লী-নগরীর মৃত্তিকা ও পর্ণকুটীরে বাস করিত, সুতরাং দিল্লী এইরূপ পর্ণকুটীরেই পরিপূর্ণ। যেদিকে দেখা যায়, এইরূপ কুটির শ্রেণীই অধিকাংশ দেখা যায়। খাদ্যদ্রব্য, ও বস্ত্রাদি বিক্রয়ার্থ যে দোকান ছিল, তাহা অধিকাংশ পর্ণকুটীর সর্বদাই অগ্নি লাগিত ও বৎসরে প্রায় বহু সহস্র পর্ণকুটার একেবারে দগ্ধ হইয়া যাইত। নরেন্দ্র দুইধারে এইরূপ কুটীর দেখিতে দেখিতে চলিলেন। দোকানীপশারী নানারূপ দ্রব্য বিক্রয় করিতেছে; পথ লোকারণ্য: অধিকাংশ অতি সামান্য লোক, অতি সামান্য বেশে নিজ নিজ কর্মে যাইতেছে। দিল্লীতে এক্ষণে যেরূপ মধ্যশ্রেণী ব্যবসায়ী ও অন্যান্য লোক ইষ্টকালয় নির্মাণ করিয়া নগর পরিপূর্ণ ও সুশশাভিত করিয়াছে, দুইশত বৎসর পূর্বে তাহা ছিল না। তখন কেবল মহল্লোক বা ইতর লোক ছিল প্রাসাদ বা পর্ণকুটিরে।

 যাইতে খাইতে নরেন্দ্র একটি বড় রাজপথে গিয়া পড়িলেন। সে পথে অনেকগুলি প্রশস্ত ও বড় বড় অট্টালিকা দেখিতে পাইলেন। মন্সবদার, কাজী, বণিক, ওমরাহ, রাজা প্রভৃতি মহল্লোকের শ্রেণীতে পথ সুন্দর দেখাইতেছে। নরেন্দ্র এরূপ অক্ষয় অট্টালিকাশ্রেণী কোথাও দেখেন নাই, প্রাসাদসমূহের পাশ দিয়া যাইতে যাইতে গজপতির সহিত তিনি কথোপকথন করিতে লাগিলেন।

 ক্ষণেক যাইতে যাইতে উভয় প্রসিদ্ধ জুম্মা মস্জিদ দেখিতে পাইলেন। ভারতবর্ষে সেরূপ মস্জিদ আর একটিও ছিল না, বোধ হয় জগতে সেরূপ নাই। নরেন্দ্রনাথ বিস্মিত হইয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, “সম্মুখে ঐ বৃহৎ মস্জিদটির নাম কি?”

 গজপতি। ওটি জুম্মা মসজিদ। শুনিয়াছি একটি পর্বতের উপরিভাগে সমতল করিয়া তাহার উপর মসজিদ নির্মিত হইয়াছে। উহার আরক্তবর্ণে নয়ন ঝলসাইয়া যাইতেছে, তাহার উপর শ্বেতপ্রস্তরের তিনটি গম্বুজ উঠিয়াছে। বাদশাহ যখন দিল্লীতে থাকেন স্বয়ং ঐ মসজিদে প্রতি শুক্রবার যান, সে সমারোহ তুমি একদিন দেখিলে কখনও ভুলিতে পারিবে না। দুর্গ হইতে মজিদ পর্যন্ত চারি-পাঁচ শত সিপাহী সারি দিয়া দাঁড়ায়। তাহাদের বন্দুকের ওপর হইতে সুন্দর রক্তবর্ণ পতাকা উড়িতে থাকে। পাঁছ ছয় জন অশ্বারোহী পথ পরিষ্কার করিতে করিতে আগে যায়, পরে বাদশাহ হস্তীর উপর জাজ্জল্যখান সিংহাসনে আরোহণ করিয়া যান, তাহার পর ওমরাহ ও মন্সবদারগণ অপরূপ সজ্জা করিয়া মসজিদে গমন করে। কিন্তু আর এ স্থানে দাঁড়াইয়া কি হইবে? চল, আমরা দুর্গের ভিতর যাইয়া রাজবাটী দেখি।

 দূর হইতেই রক্তবর্ণ উন্নত দুগ-প্রাচীরের অপরূপ সৌন্দর্য দেখিয়া নরেন্দ্রনাথ চমৎকৃত হইলেন। সেই সময়ে ভারতবর্ষে যে দেশের যে লোক আসিয়াছেন, তিনি দিল্লীর দুর্গ ও রাজবাটীর শ্বেতপ্রস্তর নির্মিত মসজিদ,প্রাসাদ ও হর্ম্যাবলীকে জগতের মধ্যে অতুল্য বলিয়া বর্ণনা করিয়া গিয়াছেন। দুর্গ-প্রবেশের স্থানে একটি বিস্তীর্ণ প্রাঙ্গণ, তার মধ্যে একজন হিন্দুরাজার শিবিরশ্রেণী রহিয়াছে, রাজা দুর্গের দ্বাররক্ষা করিতেছেন, অশ্বারোহী ও ওমরাহগণ সর্বদাই এদিক ওদিক যাতায়াত করিতেছেন এবং দুর্গের ভিতর হইতে সিপাহীগণ বাহিরে আসিতেছে, আবার ভিতরে যাইতেছে। বিদেশীয় বণিক্গণ দুর্গদ্বারে সমবেত হইতেছে এবং সহস্র সহস্র ইতর লোকও নদীর স্রোতের ন্যায় এদিক ওদিক ধাবিত হইতেছে।

 দেশে দুইটি প্রস্তরনির্মিত হস্তীর আকৃতি, তাহার উপর দুইটি মানুষ্যের প্রতিমূর্তি। নরেন্দ্র উৎসক হইয়া ‘এ কাহার প্রতিমূর্তি’ জিজ্ঞাসা করিলেন। গজপতি বলিলেন, “আপনি হিন্দু, আপনি জানেন না? ইহারা দুইজন রাজপুত বীরপুরুষ। চিতোরের জয়মল্ল ও পত্ত, সম্রাট আকবরের সহিত ভীষণ যুদ্ধ করিয়া সেই দুর্গ রক্ষা করিয়াছিলেন। পরে যখন আর পারিলেন না অধীনতা স্বীকার করিতে অস্বীকৃত হইয়া যুদ্ধে হত হলেন। আমার পিতামহ তিলকসিংহ সেই যুদ্ধে জীবনদান করিয়াছিলেন, পিতা তেজসিংহের নিকট বাল্যকালে সে অপূর্ব কাহিনী শুনিতাম। পত্তের মাতা ও বনিতা বীররমণী ছিলেন, -তাঁহারাও বীরত্ব প্রকাশ করিয়া হত হয়েন। তাঁহাদিগের কীর্তি চিরস্মরণীয় কাবার জন্য সম্রাট আকবর এই প্রতিমূর্তি এই স্থানে স্থাপন করিয়াছেন। পরে গর্বে গজপতি বলিলেন, “কিন্তু রাজপুত রাজদিগের কীর্তি চিরস্মরণীয় করিবার জন্য প্রতিমূর্তির আবশ্যক নাই, যতদিন বীরত্বের গৌরব থাকিবে, রাজপূত নাম কেহ বিস্মৃত হইবে না,

রাজপুতানার প্রত্যেক পর্বতশিখরে রাজপুতের বীরনাম খোদিত আছে, ভারতবর্ষের প্রত্যেক বেগবতী নদীতরঙ্গে রাজপুতের বীরনাম শব্দিত হইতেছে।”

 প্রশস্ত পথ অতিবাহন করিয়া দুইজনে দুর্গের ভিতর প্রবেশ করিলেন। পথের দুই ধারে অট্টালিকা, তাহার উপর রাজকর্মচারিগণ রাজকার্য করিতেছেন। দুর্গের দ্বারের বাহিরে যেরূপ হিন্দুরাজগণ দ্বাররক্ষা করিতেন, ভিতরে এই পথেয় উপর মন্সবদার ও ওমরাহগণ সেইরূপ দ্বাররক্ষা করিতেন।

 দুর্গের ভিতর উভয়ে বড় বড় কারখানা দেখিতে পাইলেন। রাজপরিবারের যে সমুদয় বিচিত্রদ্রব্য আবশ্যক হইত, ঐ স্থানে তাহা প্রস্তুত হইত। এক স্থানে রেশমকার্যের কারখানা, অন্য স্থান স্বর্ণকারদিগের, অপর স্থান চিত্রকরদিগের। ছুতার, দরজী, চর্ম-ব্যবসায়ী, বস্তুব্যবসায়ী প্রভৃতি সকল প্রকার লোকের কারখানা ছিল। দেশে যত উৎকৃষ্ট কারিগর ছিল, তাহারা প্রত্যহ প্রাতঃকাল হইতে সন্ধ্যা পর্যন্ত কার্য করিত ও মাসিক বেতন পাইত।

 সে সমস্ত কারখানা পশ্চাতে রাখিয়া উভয়ে ভিতরে যাইতে লাগিলেন। অনেক সমারোহের মধ্য দিয়া, অনেক বিস্ময়কর হর্ম্য-ও প্রাসাদের পাশ দিয়া যাইয়া অবশেষে জগদ্বিখ্যাত মর্মরপ্রাসাদ, “দেওয়ান-ই খাস” দেখিতে পাইলেন। প্রাসাদের ছাদ সুবর্ণ দ্বারা মণ্ডিত ও রৌদ্র-তাপে ঝলমল করিতেছে। প্রাসাদের ভিতরে সুবর্ণ ও হীরকখচিত দিবালোকে-প্রতিঘাতী রত্ন-বিনিন্দিত রাজ-সিংহাসনের উপর সম্রাট শাজাহান উপবেশন করিয়া রহিয়াছেন, তাঁহার গম্ভীর ও প্রশান্ত মুখমণ্ডল এখনও পীড়ার চিহ্ন অংকিত রহিয়াছে; তিনি এখন সম্পূর্ণ আরোগ্য লাভ করেন নাই। দক্ষিণপাশে জ্যেষ্ঠ পুত্র দারা বসিয়া রহিয়াছেন, তাহার ললাট ও বদনমণ্ডল সুন্দর ও প্রশন্ত, কিন্তু মুখে দুর্দমনীয় দর্প ও অভিমান বিরাজ করিতেছে। বামদিকে পৌত্র সুলতান সোলাইমান দণ্ডায়মান হইয়া রহিয়াছেন; বয়স পঞ্চবিংশতি বর্ষ হইবে, অবয়ব ও আকৃতি সুন্দর ও উন্নত। পশ্চাতে খোজাগণ ময়ূরপুচ্ছ-বিনির্মিত চামর হেলাইতেছে। তলায় চারিদিকে রৌপ্য-নির্মিত রেল আছে, রেলের বাহিরে রাজা, ওমরাহ, মন্সবদার, দূত, সেনাপতি ও ভারতর্ষের প্রধান প্রধান লোক উচিত বেশভূষায় ভূষিত হইয়া কৃতাঞ্জলিপুটে ভূমির দিকে চাহিয়া দণ্ডায়মান হইয়া রহিয়াছেন। সম্মুখস্থ সমভূমি লোকে পরিপূর্ণ কি ধনী, কি নির্ধন, কি উচ্চ, কি নীচ, সেস্থানে যাইয়া রাজাকে দর্শন করিবার অধিকার সকলেরই আছে? সেই অপূর্ব প্রাসাদে যথাই লিখিত রহিয়াছে,—“যদি পৃথিবীতে স্বর্গ থাকে, তবে এই স্বর্গ, এই —এই স্বর্গ।”

 সম্রাটের সম্মুখে প্রথমে সুন্দর আরবদেশীয় অশ্ব প্রদর্শিত হইল। পরে বৃহৎকায়

হস্তিশ্রেণী প্রদর্শিত হইল। হস্তিগণ কর উত্তোলন করিয়া বাদশাহকে “তস্‌লীম” করিয়া চলিয়া গেল। পরে হরিণ, বৃষ, মহিষ, গণ্ডার, ব্যঘ্র প্রভৃতি সকল জন্তু ও তৎপরে নানারূপ পক্ষী একে একে প্রদর্শিত হইল। সম্রাটের বর্মধারী অশ্বারোহিগণ, তৎপরে বহু রণদর্শী কয়েক শত পদাতিক, তৎপরে অন্যান্য সেনাগণ একে একে সম্রাটের সম্মুখ দিয়া চলিয়া গেল, তাহাদিগের পদভরে মেদিনী কম্পিত হইল।

 প্রদর্শন সমাপ্ত হইলে পর বাদশাহ দরখাস্ত গ্রহণ করিতে লাগিলেন। কি নীচ, কি উচ্চ, সকলেই আসিয়া রাজাধিরাজ ভারতবর্ষের সম্রাটের নিকট আপন আপন দুঃখ জানাইতে লাগিল সম্রাট দুই একটি আদেশ দিয়া সকলকের দুঃখ মোচন করিতে লাগিলেন। সম্রাট যে বিষয়ে যে কথা বলিলেন, তৎক্ষণাৎ সকল প্রধান প্রধান ওমরাহগণ “কেরামৎ”, “কেরামৎ” বলিয়া ধন্যবাদ দিতে লাগিলেন।

 দুই ঘণ্টার মধ্যে রাজকার্য সামাধা হইয়া গেল, সম্রাট পূত্র ও কয়েকজন প্রধান প্রধান ওমরাহের সহিত “গোসলখানায়” গেলেন। গোসলখানা কেবল হস্তমুখপ্রক্ষালনের জন্য নির্মিত হয় নাই, তথায় প্রধান প্রধান অমাত্যদিগের সহিত রাজকার্যের গূঢ়মন্ত্রণাদি হইত।

 নরেন্দ্র গোসলখানার পশ্চাতে উচ্চ প্রাচীর দেখিতে পাইলেন, তাহার ভিতরে অনেক হর্ম্য ও প্রাসাদ আছে। গজপতি কহিলেন,—“ঐ প্রাচীরের পশ্চাতে রাজবাটীর বেগমদিগের ভিন্ন ভিন্ন মহল আছে। শুনিয়াছি সে সমস্ত মহল অতিশয় চমৎকার, প্রত্যেক বেগমের মর্মর-প্রাসাদের চারিদিকে উদ্যান ও কুঞ্জবন, গ্রীষ্মকালে দিবায় থাকিবার জন্য মৃত্তিকার অভ্যন্তরে ঘর এবং নিশায় শয়নের জন্য প্রস্তর নির্মিত উচ্চ উচ্চ ছাদ আছে। কিন্তু সম্রাট্ ভিন্ন অন্য পুরুষের নয়ন সে সৌন্দর্য কখনও দেখে নাই, পুরুষের পদচিহ্নে সে রম্যস্থান অঙ্কিত হয় নাই।

 নরেন্দ্রনাথের পূর্বরাত্রির কথা সহসা স্মরণ হইল। তাঁহার বোধ হইল, ঐ প্রাচীরের পশ্চাতে বেগমদিগের প্রাসাদসমূহের সৌন্দর্য তাঁহার নয়ন দর্শন করিয়াছে, তাঁহার পদচিহ্নে সে রম্যস্থান অঙ্কিত হইয়াছে। কিন্তু সে পূর্বরাত্রির বিস্ময়কর কথা তিনি গজপতির নিকট প্রকাশ করিলেন না, আপনিও ঠিক বুঝিতে পারিলেন না।