মাধবীকঙ্কণ/নয়
পূর্বোক্ত ঘটনার তিন বৎসর পর ১৬৫৭ অব্দে সেপ্টেম্বর মাসের প্রারম্ভে একদিন ভারতবর্ষের রাজধানী দিল্লী আগ্রানগরে বড় হুলস্থূল পড়িয়া গেল। আগ্রার বাজার লোকে সমাকীর্ণ, সমস্ত নগরবাসী ভীত ও শশব্যস্ত, বাজারদোকান সমস্ত বন্ধ, মন্সবাদার, রাজপুত, মোগল, পাঠান, সকলেই অস্থিরচিত্ত ও চিন্তাবিহবল। কার্যকর্ম বন্ধ হইল, সকলেই ভীত ও উৎসুক। সম্রাট শাজাহান কয়েকদিন অবধি পীড়ায় শয্যাগত ছিলেন। আজি সংবাদ রটনা হইল যে তিনি কালগ্রাসে পতিত হইয়াছেন।
মিথ্যা সংবাদে শীঘ্রই সমুদয় ভারতবর্ষ আচ্ছন্ন হইল। বঙ্গদেশ হইতে সুজা, দক্ষিণ হইতে আরংঞ্জীব, গুজরাট হইতে মুরাদ রণসজ্জায় বহিষ্কৃত হইলেন; পিতৃবিয়োগে সকলেই সিংহাসনারোহণে লোলুপ হইলেন। পরে যখন প্রকৃত সংরাদ জানা গেল যে, শাজাহান জীবিত আছেন, তখন রাজপুত্রগণ রণোদ্যম হইতে নিরস্ত হইলেন না। তাহার এক কারণ এই যে ইতিপূর্বে কয়েক মাস হইতে সম্রাট, পীড়াবশতঃ রাজকার্য করিতে অক্ষম হইয়াছিলেন। তাহার জ্যেষ্ঠ পুত্র দারা এই অবসরে সমস্ত রাজকার্য আপনি করিতে লাগিলেন, কোন বিষয়ে পিতার মত লইতেন, না, জন্মের মত পিতাকে রুদ্ধ রাখিয়া আপনি রাজকার্য করিবেন, এইরূপ আচরণ করিতে লাগিলেন। কেহ কেহ শঙ্কা করিয়াছিল যে বিষপ্রয়োগ দ্বারা যুবরাজ অপন সিংহাসনের পথ নিষ্কণ্টক করিবেন। দারার ভ্রাতৃগণ পিতার শাসনে সম্মত ছিলে, কিন্তু জোষ্ঠ ভ্রাতার শাসনে সম্মত ছিলেন না এইজন্য সমগ্র ভারতবর্ষে যুদ্ধানল প্রজ্জলিত হইল।
১৬৫৭ খ্রীঃ অব্দের শেষে বারাণসীর যুদ্ধ হইল। যুদ্ধক্ষেত্র শীতকালের সায়ংকালীনআলোকে ভীষণ রূপ ধারণ করিয়াছে। অশ্ব, হস্তী, উষ্ট ও শবরাশিতে ক্ষেত্র পরিপূর্ণ হইয়া রহিয়াছে। কোথাও মৃতদেহ সমুদয় পড়িয়া যেন আকাশের নক্ষত্রের দিকে স্থিরদৃষ্টি করিতেছে; কোথাও মুমূর্ষু অবস্থায় অঙ্গহীন সিপাহী ক্ষীণস্বরে “জল-জল” করিয়া চীৎকার করিতেছে; কোথাও দুই একজন সেনা নিজ নিজ ভ্রাতা বা বন্ধুর অনুসন্ধান করিতেছে; হায়! এ জগতে আর তাহাদিগকে ফিরিয়া পাইবেন না। দুই একজন তস্কর বহুমূল্য বস্তু বা স্বর্ণালঙ্কার রা অস্ত্রাদির অন্বেষণে ফিরিতেছে, ক্ষণে ক্ষণে পেচকের ভীষণ রব শুনা যাইতেছে এবং শৃগালগণ মহাকোলাহলে রব করিয়া যুদ্ধক্ষেত্রের দিকে আসিতেছে। দুই এক স্থানে অগ্নিশিখা দেখা যাইতেছে ও ক্ষণে ক্ষপে আলোকটায় ক্ষেত্র ও শবরাশি উজ্জ্বল করিতেছে। দূরে গঙ্গার পবিত্র জল কল্-কল্, শব্দে প্রবাহিত হইছে। নদীর বিশাল বহল শান্ত বিস্তীর্ণ ও উজ্জ্বল, ক্ষুদ্র মানবের সুখ বা দুঃখ, জয় বা পরাজয়ে বিচলিত হয় না।
ক্রমে রজনী গভীর হইল, চন্দ্র উদিত হইল, তাহার নির্মল নিষ্কলঙ্ক কিরণে মানবের কলঙ্কের কথা প্রকাশ করিতে লাগিল। প্রতিদ্বন্দ্বী ভ্রাতৃগণ পরস্পরের শোণিতপাণে লোলুপ হইয়া এই যুদ্ধানল প্রজ্বলিত করিয়াছে; শৃগাল, ব্যাঘ্র, ভল্লুকও স্বজাতির উপর হিংসা করে না। সেই চন্দ্রলোকে দুইজন রাজপুত কোন বন্ধুর অনুসন্ধানে যুদ্ধক্ষেত্রে আসিয়াছিল। একস্থানে কতকগুলি শব পড়িয়াছিল, তাহার মধ্য হইতে যেন বেদনসূচক স্বর বহির্গত হইল। রাজপুত সেনাদ্বয় দেখিল, একজন যুবক মুমূর্ষু অবস্থায় পড়িয়া শব্দ করিতেছে। হৃদয়ে আঘাত পাইয়াছে ও সেই ক্ষতস্থান হইতে অনবরত শোণিত নির্গত হওয়ায় সে প্রায় অচেতন হইয়াছে, কিন্তু মৃত্যুর আশু সম্ভাবনা নাই।
যুবকের আকৃতি দেখিয়া রাজপুত দুইজন বিস্মিত হইল। বয়ঃক্রম অতিশয় অঙ্গ, বোধহয় অষ্টাদশ বৎসরের অধিক নহে। মুখমণ্ডল অতিশয় সুন্দর ও উজ্জ্বল, যেরূপ সৌন্দর্য ও উজ্জ্বল স্ত্রীলোকের সম্ভবে, পুরুষের প্রায় সম্ভব না। চিন্তা অথবা বয়সের একটি রেখাও এ পর্যন্ত ললাটে অঙ্কিত হয় নাই, ললাট পরিস্কার ও উন্নত। সমস্ত বদনমণ্ডল দেখিলে যোদ্ধা বলিয়া বোধ হয় না, বালক বলিয়া বোধ হয়, বাল্যাবস্থাতেই হতভাগ্য স্বজন ও স্বদেশ হইতে বহু দূরে আসিয়া আজি প্রাণ হারাইতে বসিয়াছে।
রাজপুতসেনা দুইজনেরই যুদ্ধব্যবসায়ে হৃদয়ের স্বাভাবিক দয়া অনেক হ্রাস হইয়াছে, বালককে দেখিয়া তাহারা হাস্য করিয়া এইরূপে কথোপকথন করিতে লাগিল,—
প্রথম সেনা। এ বালক। এই বয়সেই যুদ্ধ করিতে আসিয়াছে?
দ্বিতীয় সেনা। দেখিতেছি সুজার পক্ষের সেনা। বালক যুদ্ধে পরান্মুখ নহে, আমাদের রেখা পর্যন্ত আসিয়া যুদ্ধ করিয়াছে। এ কোন্ দেশের লোক?
প্রথম সেনা। জানি না।
দ্বিতীয় সেনা। আমার বোধ হয়, বঙ্গদেশের হিন্দু। মোগল বা পাঠান হইলে এরূপ বেশ হইত না।
প্রথম সেনা। হা হা হা। সুজা এই বাঙালী শিশু লইয়া মহারাজ জয়সিংহ ও সুলাইমানের সহিত যুদ্ধ করিতে আসিয়াছিলেন? পুনরায় যখন আসিবেন, আমরা যুদ্ধে না আসিয়া আমাদের বালকদিগকে পাঠাইয়া দিব। চল. এখানে আর কেন? আমাদের বন্ধুর অন্বেষণ করি।
দ্বিতীয় সেনা। এ লোকটা জীবিত আছে, একটু সাহায্য করিলে বোধ হয় বাঁচিবে, ইহাকে ত্যাগ করিয়া যাইব?
প্রথম সেনা। শত্রুকে বাঁচাইতে গেলে আমাদের সময় থাকে না। আমি একদণ্ডে ইহার দফা শেষ করিতেছি।
এই বলিয়া প্রথম সেনা অসি নিষ্কাষিত করিল। দ্বিতীয় সেনা তাহাকে নিবারণ করিয়া বলিল,—“না না, মুমূর্ষু লোকের প্রাণনাশ করিতে আমাদের প্রভু মহারাজ যশোবন্তুসিহ নিষেধ করিয়াছেন, তুমি যাও, আমি ইহাকে বাঁচাইব।
প্রথন সেনা হাসিতে হাসিতে চলিয়া গেল, দ্বিতীয় সেনা জলসেচন দ্বারা মুমুর্ষ যুবকে জীবিত করিল। যুবা নেত্র উন্মীলিত কবিয়া দেখিল, চারিদিকে শব পড়িয়া রহিয়াছে, আকাশে চন্দ্র উদয় হইয়াছে, যুদ্ধ শেষ হইয়াছে, জগৎ নিস্তব্ধ। যুবক জিজ্ঞাসা করিল— “বন্ধু, তুমি আমার জীবন রক্ষা করিয়াছ, তোমার নাম কি? কোন্ পক্ষের জয় হইয়াছে, সুজা কোথায় গিয়াছেন?”
সেনা বলিল, “আমার নাম গজপতিসিংহ আমি মহারাজ যশোবন্তুসিংহের একজন সেনানী, এক্ষণে মহারাজ জয়সিংহের আজ্ঞাধীন। তোমার সুজা অতিশয় বিলাসপ্রিয়, তিনি এতক্ষণ বেগমদিগের বিচ্ছেদে পীড়িত হইয়া উধ্বশ্বাসে বঙ্গদেশাভিমুখে চলিয়া গিয়াছেন, হা-হা।
যুবক অতিশয় ক্ষুন্ন হইয়া ভূমির দিকে অবলোকন করিতে লাগিল। খনেক পরে বলিল,—“তুমি আমার শত্রু, কিন্তু আমার জীবন রক্ষা করিয়াছ, এক্ষণে আমাকে আর একটু সাহায্য কর। একটু জল দাও, আর দুই একদিন থাকিবার স্থান দাও। আমার দেশ অনেক দূর, এখানে আমার একজনও বন্ধু নাই, আমার নাম নরেন্দ্রনাথ দাত্ত দাও,—জল দাও।”
নরেন্দ্রের বালকাকৃতি দেখিয়া গজপতিসিংহের দয়ার আবির্ভাব হইয়াছিল, বালকের কাতরোক্তি শুনিয়া একটু মমতা হইল, শুশ্রুষা করিয়া শিবিরে লইয়া গেলেন।