মাধবীকঙ্কণ/দশ
একটি প্রকাণ্ড শিবিরে অভ্যন্তরে দুইজন মহাবীর বসিয়া কথোপকথন করিতেছিলেন। একজন রাজপুত রাজা জয়সিংহ অপরজন তাহা পরম সুহৃদ দেবের খাঁ,জাতিতে পাঠান।
রাজার বয়ঃক্রম অনেক হইয়াছে, কিন্তু এখনও মুখমণ্ডল যৌবনের তেজে পরিপূর্ণ, শরীর যৌবনের বলে বলিষ্ঠ। সে সময়ে মোগল সম্রাট দিগের প্রধান সেনাপতি অধিকাংশই রাজপুত ছিলেন। রাজপুতদিগের বাহুবীর্যেই মোগলগণ সিন্ধু হইতে ব্রহ্মপুত্র পর্যন্ত সমুদয় ভারতবর্ষ শাসন করিতেন। সেখানে ঘোর বিপদ বা ঘোর সংগ্রাম উপস্থিত, সেইস্থানেই রাজপুত সেনাপতি প্রেরিত হইতেন ও প্রায়ই বিজয় লাভ করিয়া আসিতেন। আখ্যায়িকা-বিবৃতকালে রাজপুতানার রাজদ্বিগের মধ্যে দুইজন বিশেষ ক্ষমতাশালী ও প্রবল পরাক্রান্ত ছিলেন রাজা জয়সিংহ ও রাজা যশোবন্তুসিংহ। সম্রাট শাজাহান উভয়কেই বিশ্বাস করিতেন ও বিপত্তির সময় ইহাদিগকে রণে প্রেরণ করিতেন। সে সময়ে কি পাঠান, কি মোগল, কোন সেনাপতিরই জয়সিংহের ন্যায় প্রতাপ, ক্ষমতা বা রণকৌশল ছিল না। তৎকালীন একজন বিচক্ষণ ও প্রসিদ্ধ ফরাসী ভারতবর্ষে অনেকদিন ছিলেন, তিনি মুক্তকণ্ঠে বলিয়া গিয়াছিলেন যে, জয়সিংহের মত কার্যদক্ষ লোক সে সময়ে ভারতবর্ষে বোধ হয় আর কেহই ছিলেন না। শাজাহান ও যুবরাজ দারা যখন সুলাইমান শেখকে সুলতান সুজার বিরুদ্ধে পাঠান, সঙ্গে জয়সিংহকে তাঁহার রাজপুত সৈন্যের সহিত পাঠাইয়াছিলেন। বারানসীর যুদ্ধে সুজা পরান্ত হইয়া বই দেশাভিমুখে পলায়ন করিয়াছিলেন।
শিবিরে উজ্জ্বল দীপাবলী জলিতেছে, বাহিরে প্রহরী, তাহার চারিদিকে অন্য সে সময়ে রাজার শিবিরের মধ্যে আর কেহ ছিলেন না, কেবল রাজা ও তাহার সুহৃদ দেবের খা ঁগুপ্তকথা কহিতেছিলেন।
দেবের খা বলিলেন,—“যথার্থই জয়সিংহ নাম পাইয়াছিলেন, আপনি যেস্থানে, জন্ম সেস্থানে।”
রাজা বলিলেন,—“অদ্যকার যুদ্ধের কথা বলিতেছেন? যুদ্ধ কোথায়? বঙ্গদেশের সেনার সহিত যুদ্ধ কি যুদ্ধ? সুলতান সুজাও বঙ্গদেশে থাকিয়া বিলাসপ্রিয় হইয়া উঠিয়াছেন। তাহার সহিত যুদ্ধ?”
দেবের। কিন্তু অন্য যুদ্ধের সময় সুলতান সুজা কি সাহস ও বিক্রম প্রকাশ করেন নাই?
রাজা। তাহা স্বীকার করি। যুদ্ধের সময় তিনি সাহসের পরিচয় দেন, কার্যের সময় বিলাস বিস্তৃত হয়েন। কিন্তু কেবল সাহসে কি হয়, রণকৌশল জানেন না।
দেবের। সম্রাট-পুত্রদিগের মধ্যে কাহার অধিক রণ-কৌশল আছে? আপনি আওরংজীবকে কি মনে করেন?
তাহার নাম করিবেন না, সেরূপ তীক্ষ্ণবুদ্ধি সম্পন্ন লোক আমি দেখি নাই, যেরূপ বীরত্ব সেইরূপ কৌশল। শুনিয়াছি, তাহার গতিরোধ করবার জন্য রাজা যশোবন্তুসিংহ নর্মদাতীরে যাইতেছেন। যশোবন্তসিংহ রাণার জামাতাও সেইরূপ যোদ্ধা ও বিক্রমশালী; কিন্তু আওরংজীবের সহিত যুদ্ধে কি হয়, জানি না। যশোবন্তের সাহস আছে, কৌশল নাই। আমার বোধ হয়, এই ভ্রাতৃবিরোধে অবশেষে আওরংজীবের জয় হইবে।
দেবে। আপনি দারাকে পরিত্যাগ করিবেন?রাজা। ইচ্ছামত কখনই নহে, কিন্তু যুদ্ধে যদি অবশেষে আওরংজীবের জয় হয়, তাহা হইলে তাহাকে সম্রাট বলিয়া মানিতে হইরে। আমরা দিল্লীর সম্রাটের অধীন, যিনি যখন সম্রাট হইবেন, তখন তাহার বিরুদ্ধাচারণ রাজদ্রোহিতা।
দেবের। ভাল অদ্য আপনি ইচ্ছা করিলে অনায়াসে সুজাকে বন্দী করিতে পারিতেন। সুজা যখন পলায়ন করিলেন, আপনি অনায়াসে পশ্চাদ্ধাবন করিয়া ধরিতে পারিতেন, তাহা হইলে যুবরাজ দারাও অতিশয় সন্তুষ্ট হইতেন। আপনি সেরূপ করিলেন না কেন?
রাজা। অদ্য সুজাকে পলাইতে দিয়াছি, তাহার কারণ আছে। ভ্রাতায়-ভ্রাতায় যেরূপ বিজাতীয় ক্রোধ, যদি সুজাকে দারা সম্মুখে লইয়া যাইতাম, বোধ হয়, যুবরাজ তাহার প্রাণদণ্ড করিতেন অথবা তাহাকে যাবজ্জীবন কারারুদ্ধ রাখিতেন। তাহা কি বিধেয়? বিশেষ, আমি এই যুদ্ধে আসিবার সময় সম্রাট্, শাজাহান, যুদ্ধ না হয়, এরূপ চেষ্টা করিতে বলিয়া দিয়াছিলেন। সুজার হানি করা তাহার ইচ্ছা নহে। সম্রাটের এই কথা অনুসাবে আমি সন্ধিস্থাপনের কথা বলিয়া পাঠাইয়াছিলাম, সুজাও একপ্রকার সম্মত হইয়াছিলেন। কিন্তু সুলাইমান যুবা পুরুষ আপন বিক্রম দেখাইবার জন্য অধীর হইয়া সহসা গঙ্গাপার হইয়া যুদ্ধ আরম্ভ করিলেন।
এইরূপ কথোপকথন হইতেছে, এরূপ সময় একজন প্রহরী আসিয়া বলিল, “মহারাজ, সেনানী গজপতিসিংহ একবার সাক্ষাৎ করিতে চাহেন।” রাজা আসিতে আজ্ঞা দিলেন। ক্ষণেক পর গজপতিসিংহ আসিয়া বলিলেন,—“মহারাজ। বঙ্গদেশের একজন হিন্দু বন্দী হইয়াছে, সে আহত। তাহার নিকট হইতে বঙ্গদেশীয় অনেক সংবাদ পাওয়া যাইতে পারে।”
রাজা কিঞ্চিৎ চিন্তা করিয়া বলিলেন, “আপাতঃ আমার শিবিরে থাকিতে দাও।”
নরেন্দ্রনাথকে অচেন্ন অবস্থায় শিবিরে লইয়া যাওয়া হইল।
পরে জয়সিংহ গজপতিকে সম্বোধন করিয়া বলিলেন,—“গজপতি, অন্য তুমি যুদ্ধে আমার বিশেষ সহায়তা করিয়াছ, সেজন্য তোমাকে ও তোমার প্রভু যশোবন্ত সিংহকে আমি ধন্যবাদ দিতেছি। এক্ষণে কি কথা বলির জন্য যশোবন্ত তোমাকে আমার নিকট পাঠাইয়াছেন, নিবেদন কর।”
উভয়ে গুপ্ত কথোপকথনে প্রবৃত্ত হইলেন।