॥ এগার॥

 তাহার পর কয়েকদিন নরেন্দ্রনাথ অরে অচেতন অবস্থায় থাকিলেন। মধ্যে মধ্যে সহজ হইত, বোধ হইত যেন, তরীতে অতি দ্রুতবেগে গলার উপর দিয়া যাইতেছেন। পুনরায় কি দেশে ফিরিয়া যাইতেছেন? বোধ হইত যেন এক অল্পবয়স্কা রমণী তাহার শুশ্রূষা করিতেছেন। আবার কি হেমলতাকে ফিবিয়া পাইলেন? রোগীর চক্ষে জল আসিল।

 কয়েকদিন এইরূপে অতিবাহিত হইল। রোগের ক্রমশঃ উপশম হইল। যখন সম্পূর্ণ চৈতন্য হইল, দেখিলেন এক অপূর্ব ঘরে একটি দীপ জ্বলিতেছে। তিনি একটি শয্যায় শুইয়া রহিয়াছেন। এরূপ সুরম্য ঘর তিনি কখনো দেখেন নাই। সমস্ত ঘর সুন্দর শ্বেতপ্রস্তর দ্বারা নির্মিত। রৌপ্যের শামাদানে দীপ জ্বলিতেছে ও সমস্ত গৃহ সুগন্ধে আমোদিত করিতেছে। তাহার পালঙ্ক দ্বিরদবদখচিত, সুবর্ণ ও রৌপ্য দ্বারা বিভূষিত। সম্মুখে একটি রৌপ্য-আধারের উপর এক রৌপ্য-পাত্রে জল রহিয়াছে, নীচে শয্যা হইতে কিঞ্চিৎ দূরে একটি বিচিত্র গালিচার উপর এক যবনকন্যা ও এক খোজা বসিয়া অতি মৃদুস্বরে কথোপকথন করিতেছে। যবনকন্যা যুবতী, তনুজী এবং সুন্দরী। মুখে সৌন্দর্য ঝলমল করিতেছে, নয়ন হইতে সৌন্দর্য বিকীর্ণ হহয়াছে, ললিত বাহুলতা ও কমনীয় দেহলতায় সৌন্দর্য প্রবাহিত হইতেছে। হেমলতার অবয়ব নরেন্দ্রের হৃদয়ে অঙ্কিত ছিল, কিন্তু এরূপ উজ্জল সৌন্দর্য নরেন্দ্র কোথাও দেখেন নাই, এরূপ স্বর্গীয় পরীর ন্যায় অবয়ব কখনও দেখেন নাই। যবনকন্যার দৃষ্টি ও অঙ্গভঙ্গীতে যেন তেজ ও দর্পের পরিচয় দিতেছে। যবনকন্যা এক একবার পীড়িত হিন্দুর দিকে চাহিতেছে, এক একবার বিষণ্ণভাবে ভূমির দিকে চাহিতেছে, আবার মৃদুস্বরে খোজার সহিত কথা কহিতেছে। খোজা কৃষ্ণবর্ণ ও বলবান। তাহাদের কি কথা হইতেছিল, নরেন্দ্রনাথ কিছুই বুঝিতে পারিলেন না, কেরল দুই একটা কথা শুনিতে পাইলেন।

 যবনকন্যা বলিতেছিল, -“মসরুর, কেন এ হিন্দুর ও অমার সর্বনাশ করিবে? নির্দোষ নিরাশ্রয় ব্যক্তির জীবননাশে কি তোমাদের আমোদ?”

 মসরুর। জেলেখা, তবে তুমি কাফেরকে এ স্থলে আনিলে কেন?

 জেলেখা। সে আমার দোষ, ইহার কি দোষ? ইনি ত নির্দোষ।

 মসরুর। কেন, এত মায়া কিসের জন্য? এ কাফের কি তোমার আসেক?

 জেলেখা যোদ্ধাকন্যা, সহসা তাহাব বদনে পৈতৃক ক্রোধ ও তেজের আবির্ভাব হইল, রক্তোচ্ছ্বাসে মুখমণ্ডল আরক্ত হইয়া উঠিল। সক্রোধে বলিল,—“মসরুর। যদি তুমি স্ত্রীলোক হইতে, তাহা হইলে, মায়ার কাতরতা বুঝিতে, যদি পুরুষ হইতে, তথাপি হৃদয়ে দয়া থাকিত। তোমার পুরুষত্বের সহিত দয়া অন্তর্ধান হইয়াছে, এক্ষণে তোমার হৃদয় এই প্রস্তর শাণের অপেক্ষা কঠিন ও দুর্ভেদ্য।

 মসরুর হাসিয়া বলিল—“ঐ দেখ, কাফের উঠিয়াছে। আমি চলিলাম।” মসরুর বাহিরে চলিয়া যাইল।

 জেলেখাও উঠিল, শয্যার দিকে আসিবার জন্যই উঠিল, কিন্তু ক্ষণেক স্থির হইয়া ভূমির দিকে স্থির-নয়নে চাহিয়া দাড়াইয়া রহিল। ক্ষণেক পর জেলেখা ধীরে ধীরে নরেন্দ্রের নিকট আসিয়া ক্ষতস্থান পরীক্ষা করিল। ক্ষত প্রায় আরাম হইয়াছে, জ্বরও গিয়াছে, কেরল শরীর দুর্বল। নরেন্দ্রনাথ বিস্মিত হইয়া একদৃষ্টিতে তাহার মুখের দিকে চাহিয়া রহিলেন। জেলেখার মূখ রঞ্জিত হইয়া উঠিল, শরীরের রক্ত বেগে ললাট, চক্ষু ও গণ্ডস্থল আরক্ত করিল।

 পূর্বেও এই গৃহ ও শয্যা দেখিয়া নরেন্দ্র অতিশয় বিস্মিত হইয়াছিলেন। আসিয়াছেন, কে তাহাকে আনিল, কে সেবা করিতেছে। জেলেখা ও মসরুর কথা শুনিয়া ভীত হইয়াছিলেন, এখন জেলেখার আচরণ দেখিয়া আরও বিস্মিত হইলেন। জিজ্ঞাসা করিলেন,—“আমি কোথায় আছি,—এই কি বঙ্গদেশ,—আপনি কে,— আপনার নাম কি?”

 নিস্তব্ধ নিশাযোগে সহসা বজ্রধ্বনি হইলে লোকে যেরূপ চমকিত হয়, জেলেখা সহসা নরেন্দ্রের এই প্রথম কথা শুনিয়া সেইরূপ চমকিত হইল; কোন উত্তব না দিয়া ধীরে ধীরে সূক্ষ্ম ওষ্ঠদ্বয়ে অঙ্গুলিস্থাপন করিল।

 নরেন্দ্র আবার বলিলেন-“আমি অসহায় ও নিরাশ্রয়। আমি কোথায় আছি, অনুগ্রহ করিয়া বলুন।”

 জেলেখা আবার ওষ্ঠে অঙ্গুলি স্থাপন করিয়া সহসা মুখ ফিরাইল। নরেন্দ্রনাথের বোধ হইল, যেন, তিনি জেলেখার উজ্জ্বল চক্ষুতে জল দেখিতে পাইলেন; কিছু বুঝিতে পারিলেন না, চিন্তা কবিতে করিতে আবার নিদ্রিত হইলেন।