॥ পনের॥

 ১৬৫৮ খৃঃ অব্দে বসন্তকালে প্রাচীন উজ্জয়িনী নগর ও তরঙ্গ-বাহিনী সিপ্রানদীর অপরূপ দৃশ্য দর্শন করিল। চন্দ্র উদিত হইয়াছে তাহার উজ্জ্বল কিরণে সিপ্রা নদীর উভয় কূলে যতদূর দেখা যায়, শুভ্র শিবিরশ্রেণী দেখা যাইতেছে। একদিকে রাজা যশোবন্ত ও তাঁহার সহযোদ্ধা কাসেম খাঁর অসংখ্য সেনা চন্দ্র-করোজ্জল শিবিরশ্রেণীর ভিতর বিশ্রাম করিতেছে, অপর তীরে এক পর্বতোপরি আওরংজীব ও মোরাদের মোগল সৈন্যদল রহিয়াছে। মধ্যে কলনাদিনী সিপ্রা নদী প্রস্তরশয্যার উপর দিয়া বহিয়া যাইতেছে, যেন মোগল ও রাজপুতদিগের যুদ্ধের আয়োজন দেখিয়া ভীত না হইয়া উপহাস করিয়া যাইতেছে। দূরে ভারতবর্ষের কটিবন্ধনম্বরূপ বিন্ধ্যপর্বত চন্দ্রালোকে দেখা যাইতেছে। কল্য ভীষণ যুদ্ধ হইবে, কিন্তু অন্য সমস্ত জগৎ সুপ্ত। কেবল সময়ে সময়ে প্রহরীর স্বর নিস্তব্ধ রজনীতে সুদূর পর্যন্ত শ্রুত হইতেছে, কেবল সিপ্রা নদীর তরঙ্গমালা কেবল দূর হইতে নৈশ শৃগালের শব্দ নদীকূলে ও পর্বতশ্রেণীতে প্রতিধ্বনিত হইতেছে।

 একটি শিবিরে নরেন্দ্র শয়ন করিয়া নিদ্রিত আছেন, তথাপি যুদ্ধের নানারূপ চিন্তা স্বরূপে তাহার হৃদয়ে জাগরিত হইতেছে, তাহার সঙ্গে সঙ্গে পুরাতন কথা হৃদয়ে জাগরিত হইতেছে। সিপ্রা নদীর কল্-কল্ নাদ যেন ভাগীরথীর শব্দ বোধ হইল, সেই ভাগীরথীতীরে, নেই কুঞ্জবন-বেষ্টিত উচ্চ অট্টালিকা দেখিতে পাইলেন। তীরে বালুকারাশি, বালুকারাশিতে দুইজন বালক ক্রীড়া করিতেছে, আর একজন বালিকা দাঁড়াইয়া যেন গান গাহিতেছে, সে প্রেমপুত্তলী কে? সে কোথায়? ভাগীরথীতীরস্থ কুঞ্জবনে সেই তিনটি শিশু রজনীতে ক্রীড়া করিত সত্য, কিন্তু কালের নিষ্ঠুর গতিতে সে চিত্রটি বিলুপ্ত হইয়াছে।

 স্বপ্ন পরিবর্তিত হইল। ভাগীরথীর কল্লোল নহে, এ রমণীর গীতধ্বনি! রমণী না অপ্সরা? উচ্চ প্রাসাদ তাহার ছাদ ও শুভ সুবর্ণ ও রৌপামণ্ডিত তাহার মধ্যে এক অপ্সরা গান করিতেছে। কেবল একজন অপ্সরা গান করিতেছে, সে বড় দুঃখের গীত, জেলেখা দিয়া দিয়া সে দুঃখের গীত গাহিতেছে। ঐ যে জেলেখা দাঁড়াইয়া আছে। ঐ যে তাহার রত্নরাজি-বিভূষিত কেশপাশে উজ্জ্বল বনমণ্ডল কিঞ্চিৎ আবৃত রহিয়াছে; ঐ যে তাহার নয়নদ্বয় হইতে দুই একবিন্দু জল পড়িতেছে।

 স্বপ্ন পরিবর্তিত হইল। এ জেলেখা নহে, সেই তাতার-বালক গীত গাহিতেছে। যে ব্যর্থ প্রেম করিয়া প্রেমের প্রতিদান পায় নাই, সে দেওয়ানা হইয়া দেশে দেশে বেড়াইতেছে, তাহারই গান। গান শুনিতে শুনিতে নরেন্দ্রের নিদ্রাভঙ্গ হইল। তিনি শিবির হইতে বাহিরে আসিলেন। জগৎ নিস্তব্ধ, দ্বিপ্রহর নিশার বাযু রহিয়া রহিয়া বহিয়া যাইতেছে, চন্দ্রকিরণে নদী, পর্বত, শিবির ও মাঠ দৃষ্ট হইতেছে, আর সেই অভাগা দেওয়ান তাতারবালক শিবিরে বসিয়া উচ্চৈঃস্বরে গান করিতেছে। সপ্তম্বর-মিলিত সে গান বায়ুতে বাহিত হইয়া নৈশ গগনে উখিত হইতেছে ও চারিদিকে আকাশে বিস্তৃত হইতেছে।

 নরেন্দ্র সাশ্রুনয়নে বালকের হস্তধারণ করিয়া তাহার অশ্রুজল মুছাইয়া দিয়া জিজ্ঞাসা

করিলেন-“তুমি কি যথার্থই প্রেমের জন্য দেওয়ানা হইয়াছ? তোমার হৃদয়ে কি কেন গভীর দুঃখ আছে? তা যদি হয়, আমাকে বল, আমি তোমার দুঃখের সমদুঃখী ইইব। মন খুলিয়া আমায় সমস্ত কথা বল।

 বালক একদৃষ্টিতে নরেন্দ্রের দিকে চাহিতে লাগিল, শরীর কঁপিতে লাগিল। ক্ষণেক পর হৃদয়ের বেগ সংবরণ করিয়া ধীরে ধীরে করুণ স্বরে বলিল,—“মার্জনা করুন, আমি দেওয়ানা, যখন যাহা মনে আইসে তাহাই গান করি।” নরেন্দ্র অনেক প্রবোধবাক্য প্রয়োগ করিয়া বার বার তাহার দুঃখের কারণ ও এই অল্পবয়সে ফকিরি গ্রহণের কারণ জিজ্ঞাসা করিলেন। বালক তার উত্তর দিল না, কেবল বলিল- “আমি দেওয়ানা।”

 নিশা অবসানে নরেন্দ্র রণসজ্জা করিয়া আপন বন্ধু গজপতি সিংহের শিবিরে গেলেন, দেখিলেন, তিনিও যোদ্ধার কার্য করিতেছেন; আপন তরবারি, বর্ম প্রভৃতি স্বয়ং শানাইতেছেন; অস্ত্রগুলি রৌপের মত উজ্জল হইয়াছে, তথাপি আরও উজ্জ্বল করিতেছেন। দেখিয়া নরেন্দ্র কিছু বিস্মিত হইলেন। পরে শয্যার দিকে চাহিয়া দেখিলেন, গজপতি সমস্ত রাত্রি শয়ন করেন নাই, সমন্ত রাত্রিই এই কার্য করিয়াছেন। তাঁহার বদনমণ্ডল অতিশয় পাণ্ডুবর্ণ, চক্ষুদ্বয়, ঈষৎ কালিমাবেষ্টিত। কেন? নরেন্দ্র গত কয়েক দিন অবধি গজপতি যে ভাবগতিক দেখিয়াছিলেন তাহাতে কারণ কিছু কিছু বুঝিতে পারিলেন। দেওয়ানা বালক হাত দেখা অবধি গজপতি স্থির নিশ্চয় করিয়াছিলেন, উজ্জয়িনীর যুদ্ধে তাহার নিধন হইবে। বোধ হয়, গত নিশায় মৃত্যুর জন্য প্রস্তুত হইয়াছেন, শয়নের অবসর পান নাই।

 পাঠক, গজপতিকে ভীরু মনে করিতেছ? রাজপুত সকলেই সাহসী, তথাপি তাহাদের মধ্যেও তেজসিংহের পুত্র গজপতি অপেক্ষা সাহসী কেহ ছিল না। তথাপি কল্য নিশ্চয় মৃত্যু জানিলে সাহসীর ললাটেও চিস্তারেখা অঙ্কিত হয়। যোদ্ধা যৌবনমদে মত্ত থাকিয়া, জীবনের সুখে মগ্ন থাকিয়া, যুদ্ধের উৎসাহে প্রফুল্প থাকিয়া, জয়ের আশায় আশ্বস্ত হইয়া মৃত্যুর চিন্তা দূর করে। যুদ্ধ তাহাদের পক্ষে আমোদ মাত্র, অনেক লোক মরিতেছে, তাহারাও একদিন মরিবে, তাহাতে ক্ষতি কি? কিন্তু “কল্য মরিবে” বজ্রধ্বনিতে যদি এই শব্দ সহসা হৃদয়ে আহত হয়, তাহা হইলে সে উৎসাহ ও সে প্রফুল্লতা হ্রাস পায়। গজপতি সে সময়ে সকল লোকের ন্যায় গগনবিদ্যায় দৃঢ়বিশ্বাস ছিল। অঙ্গ যুদ্ধে তিনি মরিবেন, তাহা তাহার বিশ্বাস ছিল। গত রজনীতে অনিদ্র হইয়া মৃত্যুর জন্য প্রস্তত হইয়াছিলেন। অস্ত্র পরিষ্কার করা কেবল কাল কাটাইবার একটি উপায়মাত্র।

 নরেন্দ্র আসিবামাত্র গজপতি উঠিয়া তাহার হস্তধারণ করিয়া ঈষৎ হাসিয়া বলিলেন, “দেখ দেখি, অস্ত্রগুলি পরিষ্কার হইয়াছে কি না?”

 নরেন্দ্র। যথার্থই কি আপনি অন্য যুদ্ধে লিপ্ত হইবেন? দেওয়ানা ফকিরের কথা স্মরণ করুন!

 গজপতি। সম্মুখে রণ করিয়া রাজপুত কখনও পশ্চাতে চাহে না, পিতা তেজসিংহ আমাকে এই শিক্ষা দিয়াছেন।

 গজপতি আরও বলিলেন,—“নরেন্দ্র, এক যুদ্ধে আমি মহারাজা যশোবন্তুসিংহের উপকার করিয়াছিলাম, রাজা সন্তুষ্ট হইয়া আমাকে এই মুক্তাহার প্রদান করেন। সেই অবধি সকল যুদ্ধেই আমি এই হার পরিধান করিয়াছি। অদ্যকার যুদ্ধে তুমি নিস্তার পাইবে, এই হার রাজাকে দিও এবং বলিও, দেশে আমার দুইটি শিশুসন্তান আছে, হতভাগাদের মাতা নাই। মহারাজকে বলিও, যেন অনুগ্রহ করিয়া তাহাদিগের উপর কৃপাদৃষ্টি করেন, বালক রঘুনাথও কালে রাজার আজ্ঞায় পিতার ন্যায় সংগ্রামে জীবন দিতে সক্ষম হয়, ইহা অপেক্ষা অধিক মঙ্গল ইচ্ছা তাহার পিতা জানে না।

 নরেন্দ্র নিস্তব্ধ হইয়া রহিলেন, তাহার নয়ন হইতে একবিন্দু জল পড়িল। গজপতির নয়নদ্বয় শুষ্ক ও অতিশয় উজ্জ্বল।

 সহসা ভেরী-শব্দ শুনা যাইল, আওরংজীব সিপ্রা নদী পার হইবার উদ্যোগ করিতেছেন। গজপতি রণসজ্জা পরিধান করিয়া বাহিরে আসিলেন, লম্ফ দিয়া অশ্বে আরোহণ করিয়া তীরবেগে নদীমুখে চলিলেন।

  নরেন্দ্রও নির্গত হইয়া যুদ্ধাভিমুখে চলিলেন।