॥ ষোল॥

 যুদ্ধের পূর্বদিশায় রাজপুত-শিবির পাঠক দর্শন করিয়াছ। একবার সেই দিশায় মোগলশিবির দর্শন কর।

 আওরংজীব পূর্বেই সেইস্থানে পৌছিয়াছিলেন, মোরাদের জন্য অপেক্ষা করিতেছিলেন দুই-তিন দিন পরে মোরাদ সসৈন্যে আওরংজীবের সহিত যোগ দিলেন, দুই-তিন দিনের মধ্যে যদি যশোবন্তসিংহ আওরংজীবকে আক্রমণ করিতেন, আওরংজীব অবশ্যই পরাস্ত হইতেন। কোন কোন ইতিহাসবেত্তা বলেন যে, আওরংজীবের অল্পমাত্র সৈন্য আছে এ কথা যশোবন্তসিংহ জানিতেন না, সেইজন্য আক্রমণ করেন নাই, আবার কেহ কেহ বলেন, মহানুভব রাজপুত সেনাপতি সে কথা জানিয়াও অল্পসংখ্যক সৈন্যের সহিত যুক্ত করা রীতিবিরুদ্ধ এইজন্যই অপেক্ষা করিয়াছিলেন।

 আজি আওরংজীব ও মোরাদ দুই ভ্রাতার সাক্ষাৎ হইয়াছে, কালি যুদ্ধ হইবে; জয় জয় নাদে দেশ পরিপূর্ণ হইতেছে। পট্টবস্ত্রমণ্ডিত উৎকৃষ্ট দীপালোকশোভিত একটি প্রশস্ত শিবিরে দুই ভ্রাতা ভোজন করিতে বসিয়াছে, চারিদিকে জগদ্বিমোহিনী নর্তকী ও গায়কগণ নৃত্যগীতাদি করিয়া রাজপুত্রয়ের মনোরঞ্জন করিতেছে। মোরাদের প্রশস্ত ললাট, বিশাল বক্ষস্থল, বীর আকৃতি ও অকপট হৃদয়; আওরংজীবের ললাট কুঞ্চিত, দৃষ্টি তীক্ষ্ণ ও তীব্র মন সর্বদাই সহস্র চিন্তায় অভিভূত। তথাপি আওরংজীব কি সুন্দর সরল হাসিই হাসিতেছেন, কি সম্মান সহকারে মোরাদের সহিত বাক্যালাপ করিতেছেন, যেন ভ্রাতাকে দেখিয়া তিনি আর অনিন্দ রাখিতে পারিতেছেন না, যেন ভ্রাতার কার্যসাধন অপেক্ষা জগতে তাঁহার অন্ধ আমোদ বা অন্য কোনও প্রকার উদ্দেশ্য নাই।

 ভোজন সাঙ্গ হইল, ভৃত্যেরা ফল ও মদিরা লইয়া আসিল। গায়কীগণ পুনরায় সপ্তস্বরে গান আরম্ভ করিল, শিবির আমোদিত হইল। কেশের হীরকের সহিত কটাক্ষদৃষ্টির জ্যোতি মিশিয়া যাইতে লাগিল, সুললিত গানের সহিত সুমিষ্ট হাস্যধ্বনি মিশিয়া যাইতে লাগিল, মোরাদ একেবারে বিমোহিত হইলেন। অবশেষে আওরংজীবের ইঙ্গিতে নর্তকীগণ চলিয়া গেল।

 আওরংজীব সুবর্ণ-পাত্রে মদিরা ঢালিয়া মোরাদের হস্তে দিয়া বলিলেন, -আজি সেবায় আপনাকে তুষ্ট করিতে পারিয়াছি, আজি আমার জীবন সার্থক।”

 মোরাদ। আওরংজীব, আপনার ন্যায় অমায়িক ভ্রাতা আমি পাইব না। একটু মদিরা আপনার জন্য লউন।

 আওরংজীব। ক্ষমা করুন, আপনি জানেন, আমার জীবনে সুখের বাঞ্ছা নাই। হৃদয়ে বড় মানস আছে, আপনার মতো বীরপুরুষকে পিতৃসিংহাসনে একবার দেখিব, ইহা ভিন্ন আর দ্বিতীয় ইচ্ছা নাই। পৈগম্বর যদি এই এরাদা সফল করেন; তাহা হইলে সন্তুষ্ট মনে ফকিরি গ্রহণ করিয়া মক্কায় যাইব।—এই বলিয়া আওরংজীব আর এক পাত্র মদিরা দিলেন।

 মোরাদ। আওরংজীব, আপনি যথার্থই ধার্মিক, তাহা না হইলে আমার জন্য আপনি এরূপ যত্ন করিবেন কেন?

 আওরংজীব। কাহার জন্য করিব? তৈমুরের সিংহাসনে অধিরূঢ় হইবার উপযুক্ত আর কে আছে। সুজা বিলাসপ্রিয় ও ভীরু, সুজা তৈমুরের সিংহাসন কলঙ্কিত করিবে। আত্মাভিমানী মূর্খ কাফের দারা তৈমুরের সিংহাসন কলুষিত করিবে। তাহা অপেক্ষা পুনরায় হিন্দুস্থান কাফেরদিগের হাতে যাউক, তৈমুরের নাম বিলুপ্ত হউক। ইহাদের জন্য আমি যুদ্ধ করিব না; যাহার সাহস অপরিসীম, যাহার যশোরাশিতে ভারতবর্ষ

পরিপূর্ণ হইয়াছে, যিনি মোগল সিংহাসনে স্তম্ভস্বরূপ, যিনি মোগলকুলের কুলতিলকস্বরূপ, তাঁহার জন্য যুদ্ধ করিব। আমি আপনার সম্মুখে আপনার সুখ্যাতি করিতে চাহি না, কিন্তু যখন আমি আপনাকে দেখি, আমার যথার্থই বোধ হয় যেন আপনার উদার ললাটে ‘সম্রাট’ শব্দ খোদিত রহিয়াছে, আপনার বিশাল বক্ষস্থল ও দীর্ঘ বাহতে যোদ্ধা শব্দ অঙ্কিত রহিয়াছে। আমার জীবন ধন্য যে এই বীরপুরুষের কার্য-সাধনে আমি লিপ্ত হইয়াছি। এই বলিয়া আওরংজীব সুবর্ণপত্রে আর একবার মদিরায় পরিপূর্ণ করিলেন।

 মোরাদ। আওরংজীব, আমি, যথার্থই আপনার বাক্যে পরিতুষ্ট হইলাম। কাল যুদ্ধ হইবে, সৈন্য সকল প্রস্তুত আছে?

 আওরংজীব। আমি তিন-চার দিন হইতেই প্রস্তুত আছি কিন্তু যুদ্ধব্যবসায়ে আমি এখনও অপরিপক্ব, একাকী সাহস হয় না। আপনি নিকটে থাকিলে আমার যেন বোধ হয় আমি পর্বত-পার্শ্বে নিরাপদে আছি, আমার সাহস দ্বিগুণ হয়।

 মোরাদ এরূপ আত্মাভিমানী ছিলেন যে, প্রবঞ্চনা এবং চাটুবাক্যও তাহার সত্য বলিয়া জ্ঞান হইত। বিশেষতঃ এক্ষণে অধিক মদিরা সেবনে কিয়ৎপরিমাণে জ্ঞানশূন্য হইয়াছিলেন? আওরংজীবের প্রশংসাবাক্যে সন্তুষ্ট হইয়া বলিলেন,—"ভ্রাতঃ! আপনিও কালে রণপণ্ডিত হইবেন, এক্ষণে কিছুদিন আমার উপর নির্ভর করুন। আর আমি—আমি জগতে কাহারও উপর নির্ভর করি না, কেবল আমার সাহস ও এই অসির উপর ভরসা করি।”—এই বলিয়া মোরাদ অসি নিষ্কাষিত করিলেন, দীপালোকে অসি ঝকঝক্ করিয়া উঠিল। পুনরায় অসি কোষে রাখিতে গেলেন, কিন্তু অতিশয় মদিরা সেবনে দৃষ্টি স্থির ছিল না, অসি মৃত্তিকায় পড়িয়া গেল। আওরংজীব হাস্য সংবরণ করিয়া আর এক পাত্র মদিরা দিলেন, মোরাদ তাহাও শেষ করিলেন।

 আওরংজীব বলিলেন,—"ভ্রাতঃ। তবে বিদায় হই, রণক্ষেত্রে আবার আপনার দর্শন পাইব।”

 মোরাদ। যাও, আওরংজীব, যাও, আমি আপনার উপর বড়ই পরিতুষ্ট হইলাম, আইস আলিঙ্গন করি।

 মোরাদ আলিঙ্গন করিতে উঠিলেন, কিন্তু অধিক মদিরা সেবন বশতঃ ভূমিতে ঢলিয়া পড়িলেন।

 আওরংজীবের মুখের ভাব তখন পরিবর্তিত হইল, ভ্রাতাকে যে সহাস্য মুখ দেখাইয়াছিলেন, এক্ষণে তাহা পরিবর্তিত হইল। মুখ গম্ভীর ভাব ধারণ করিল, ললাটে দুই তিনটি ভীষণ রেখা অঙ্কিত হইল; নিঃশব্দে সেই শিবির মধ্যে পদসঞ্চার করিতে লাগিলেন; মধ্যে মধ্যে এক-এবার হঠাৎ দণ্ডায়মান হয়েন, স্থিরদৃষ্টিতে এক-একবার দেখেন, যেন সম্মুখে কোন দ্রব্য দেখিতে পাইতেছেন, আবার পদসঞ্চারণ করিতে থাকেন। এক একবার মুখে ঈষৎ হাস্য লক্ষিত হয়, আবার বদনমণ্ডল কঠোর ভাব ধারণ করে, ললাট কুঞ্চিত হয়।

 একবার স্থিরভাবে দণ্ডায়মান হইয়া, একদিকে স্থিরদৃষ্টি করিয়া অর্ধস্ফুট বচনে বলিতে লাগিলেন,—“উজ্জ্বল মণিময় মুকুট, ময়ূর-সিংহাসন প্রশস্ত ভারতভূমি পিতার দুর্বল হস্ত হইতে স্খলিত হইতেছে। কে লইবে? দারা, সাবধান! তোমার সাহস আছে, বল আছে, কিন্তু আমিও দুর্বল হস্তে অসি ধারণ করি নাই, পথ ছাড়িয়া দাও, নচেৎ অসিহস্তে পথ পরিষ্কার করিব। তুমি আত্মাভিমানী, দর্পী, কিন্তু তোমা অপেক্ষা ভীষণ দর্প ও দৃঢ়তর ব্রত সহাস্য বদনের ভিতর লুক্কায়িত থাকে। মোরাদ! তুমি সাহসী বীর। সিংহাসনে বসিবে? তবে শূকর যেমন কর্দমে পড়ে, সেইরূপ তুমি ধরাতলে লুটাইয়া পড়িলে কেন? বন্যশূকরেরও তোমার ন্যায় সাহস আছে। অচেতন? কল্য যুদ্ধ হইবে, অদ্য বিলাসবিহ্বল? যত দিন আবশ্যক, তোমার দ্বারা আমার কার্যসিদ্ধি করিব, তাহার পর এইরূপ পদাঘাত করিয়া তোমাকে দূরে ফেলিয়া দিব। কল্য যুদ্ধ হইবে, ললাটের লিখন কি আছে? পিতার হস্ত হইতে রাজদণ্ড কাড়িয়া লইতে প্রবৃত্ত হইয়াছি, ভ্রাতার শোণিতে দেশ প্লাবিত করিতে প্রবৃত্ত হইয়াছি। ভীষণ উদ্যমে প্রবৃত্ত হইয়াছি, অনেক দূর অগ্রসর হইয়াছি, আর ফিরিবার উপায় নাই। হৃদয়! সাহসে নির্ভব কর, আরও অগ্রসর হইব। অসিহস্তে কণ্টকময় পথ পরিষ্কার করিব, আবশ্যক হয়, উজ্জয়িনী হইতে আগ্রা পর্যন্ত পথ নর রক্তে রঞ্জিত করিব, কিন্তু এ ভীষণ প্রতিজ্ঞা বিচলিত হইবে না। পিতামহ তৈমুর। তোমার মুকুটে এই ললাট শোভিত করিব, নচেৎ কল্য হৃদয়শোণিতে সিপ্রাবারি রঞ্জিত করিব।”