মাধবীকঙ্কণ/পাঁচ
এইরূপে কিছুকাল অতিবাহিত হইল। একদিন সায়ংকালে শ্রীশ ও নরেন্দ্র একখানি নৌকায় আরোহণ করিয়া গঙ্গায় বিচরণ করিতেছিল। নরেন্দ্র আপন বলপ্রকাশ অভিলাষে দাঁড়ীকে উঠাইয়া দিয়া দুই হাতে দুইটি দাঁড় ধারণ করিয়া নৌকা চালাইতেছে, শ্রীশ স্থিরভাবে বসিয়া প্রকৃতির সায়ংকালীন শোভা দর্শন করিতেছিল। শ্রীশ ও নরেন্দ্রের মধ্যে কখনই যথার্থ প্রণয় ছিল না, অল্প অল্প কথা লইয়া তর্ক হইতে লাগিল। নরেন্দ্রের হস্ত হইতে সহসা একটি দাঁড় স্খলিত হওয়াতে নরেন্দ্র পড়িয়া গেল, শ্রীশ উচ্চহাক্ত হাসিয়া বলিল, “যাহার কাজ, তাহাকে দাও বীরত্বে আবশ্যক নাই।”
সেই সময়ে তীরস্থ অট্টালিকা হইতে হেমলতা দেখিতেছিল, হেমলতার সম্মুখে অপদস্থ হইয়া নরেন্দ্র মর্মান্তিক কষ্ট পাইয়াছিল, তাহার উপর শ্রীশের রহস্যকথা সহ্য হইল না, অতিশয় কঠোর উক্তিতে প্রত্যুত্তর করিল। ক্রমে বিবাদ বাড়িতে লাগিল, নরেন্দ্র অতি শীঘ্র ক্রোধে প্রজ্জ্বলিত হইয়া উঠিল এবং অতিশয় অন্যায় কটুভাষায় শ্রীশকে তিরস্কার করিল। শ্রীশ এবার ক্রোধ সংবরণ করিতে পারিল না, বলিল, “তোমার মত অভদ্র লোকের সহিত কলহ করিলেও অপমান আছে।”
এই অপমানসূচক কথায় নরেন্দ্রের ললাটের শিরা স্ফীত হইল, নয়ন প্রজ্বলিত হইল, সে শ্রীশকে প্রহার করিতে উঠিল; শ্রীশও উঠিয়া দাঁড়াইল। জ্ঞানশূন্য নরেন্দ্র সহসা শ্রীশকে ঠেলিয়া জলে ফেলিয়া দিল। “বাবু জলে পড়িল, জলে পড়িল” বলিয়া মাল্লারা চিৎকার করিয়া উঠিল, একজন ঝাঁপ দিয়া জলে পড়িল এবং শ্রীশকে প্রায়-অজ্ঞান অবস্থায় নৌকায় উঠাইল।
সন্ধ্যার সময় নবকুমার নরেন্দ্রকে ডাকাইয়া যথেষ্ট ভর্ৎসনা করিয়া বলিলেন, “তুমি নাকি শ্রীশকে মাঝগঙ্গার জলে ফেলিয়া দিয়াছিলে? মাল্লারা না থাকিলে সে আজ ডুবিয়া মরিত?”
নির্বোধ জ্ঞানশূন্য নরেন্দ্র উত্তর করিল, “সে আমার সহিত কলহ করিতে আসে কেন?”
নবকুমার, শ্রীশের সহিত কলহ করিতে তোমার লজ্জা হয় না? জান না, তুমি কে আর শ্রীশ কে? তুমি কি শ্রীশের সমান।
নরেন্দ্র ক্রোধকম্পিত-স্বরে বলিল, “আমি শ্রীশের সমান নহি; আমি জমিদার বীরেন্দ্র সিংহের পুত্র, শ্রীশ পথের কাঙ্গালী, পরের অন্নে পালিত, তাহার সমান আমি কিরূপে?”
নবকুমার এরূপ উত্তর কথন শুনেন নাই; বিস্মিত ও ক্রুদ্ধ হইয়া বলিলেন, “কাহার সহিত কথা কহিতেছ, জান?”
নরেন্দ্র। জানি, যে দরিদ্র সন্তান, আমার পিতা কর্তৃক পালিত হইয়া কালসর্পের ন্যায় তাঁহাকে দংশন করিয়াছে, এক্ষণে তাঁহার বিষয়টি লইয়াছে, সেই নবকুমারবাবুর সহিত কথা কহিতেছি।
নবকুমার এক মুহূর্তের জন্য নিরুত্তর হইলেন। কি বিষয় তাঁহার স্মরণ হইতেছিল, বলিতে পারি না। পরক্ষণেই বলিলেন, “কৃতঘ্ন বালক। তোর পিতা নিজ দোযে জমিদারি হারাইয়াছে, অনাথকে এতদিন পালন করিলাম, তাহার এই ফল। আজ শ্রীশকে ডুবাইয়াছিলি, কাল আমার গলায় ছুরি দিবি। তুই আজই আমার বাড়ি হইতে দুর হ!”
নরেন্দ্র। চলিলাম। কিন্তু যদি ইহজন্মে কি পরজন্মে বিচার থাকে, তুমি তাহার ফলভোগ করিবে।
সায়ংকালে গঙ্গাতীরে হেমলতা একাকী বিচরণ করিতেছিল। যে যে ঘটনা হইয়াছিল, হেমলত সমন্ত শুনিয়াছিল। হেমলতাকে দেখিয়া নরেন্দ্র একবার দাঁড়াইল; দেখিল হেম চক্ষুতে বস্ত্র দিয়া ঝরঝর করিয়া কাঁদিতেছে।
নরেন্দ্রের ক্রোধ গেল, সে হেমের নিকট আসিয়া তাহার হাত ধরিয়া বলিল, “হেম, তুমি কঁদিতেছ কেন?”
কাতররে হেম উত্তর করিল, নরেন্দ্র, নরেন্দ্র, আমার হাত ঘডিয়া দাও। শ্রীশকে আমি দাদার ন্যায় মান্য করি, তাহাকে তুমি জলে ফেলিয়া দিয়াছিলে? আমার পিতাকে তুমি কালসর্প বলিয়া গালি দিলে? আমাদের তুমি ঘৃণা কর? নরেন্দ্র। আমার হাত ছাড়িয়া দাও”
শ্রীশকে জলে ফেলিয়া দিয়াও ক্রুদ্ধ নরেন্দ্রের সংজ্ঞা হয় নাই, নবকুমারের তিরস্কারেও তাহার সংজ্ঞা হয় নাই, কিন্তু এখন হেমের চক্ষুতে জল দেখিয়া ও বালিকার কয়েকটি কাতর কথা শুনিয়া নির্বোধ যুবকের সংজ্ঞা হইল। ধীরে ধীরে হেমের চক্ষুর জল মুছাইয়া দিয়া, ধীরে ধীরে তাহার হত ধরিয়া, নরেন্দ্র কাতর-স্বরে বলিল, ‘হেম, ক্ষমা কর, আমি অপরাধ করিয়াছি। শ্রীশ শান্ত, ধীর ও নির্দোষ, তাহাকে জলে ফেলিয়া দিয়া আমি নির্বধের ন্যায় কার্য করিয়াছি; তোমার পিতাকে গালি দিয়া আমি চণ্ডালের ন্যায় কার্য করিয়াছি; কিন্তু হেম, তুষ আমাকে ক্ষমা কর, তুমি ভিন্ন স্নেহ-পূর্বক কথা কহিবার এ জগতে আমার আর কেহ নাই আজি আমি দেশত্যাগী হইতেছি, যাইবার পূর্বে তোমার দুইটি স্নেহের কথা শুনতে ইচ্ছা করি হেম, আমাকে ক্ষমা কর।”
হেম ক্ষমা করিল, নরেকে গঙ্গাতীরে বসাইল, আপনি নিকটে বসিল, অশ্রুজল মুছিয়া কথাবার্তা আরম্ভ করিল। “নরেন্দ্র, কেন দেশত্যাগী হইতেছে? পিতা রাগ করিয়া একটি কথা বলিয়াছেন বলিয়া, নরেন্দ্র কেন বীরনগর ত্যাগ করিবে। হেম নিজে পিতার নিকট অনুবোধ করিয়া পিতার ক্রোধ অপনোদন করিবে। নরেন্দ্র, তুমি বীরনগর ছাড়িয়া যাইও না।”
কিন্তু হেমলতার এ অনুনয় ব্যর্থ হইল। উদ্ধত নরেন্দ্র হেমলতার অশ্রুজল দেখিয়া ক্ষমা প্রার্থনা করিয়াছে, কিন্তু তাহার হৃদয়ে আজ যে ব্যথা লাগিয়াছে, তাহার শান্তি নাই। নরেন্দ্র বলিল, ‘হেমলতা, তোমার অনুরোধ বৃথা, বস্তুতঃ বীরনগরে আমার স্থান নাই। কয়েক মাস অবধি আমি এই পৈতৃক ভবনে যে যাতনা ভোগ করিতেছি, তাহা তুমি বুঝিতে পারিবে না, সে যাতনা তোমার স্নেহ, তোমার ভালবাসার জন্য সহ্য করিয়াছি। যে দেশে আমার প্রাতঃস্মরণীয় পিতা রাজা ছিলেন, সে দেশে পরপালিত ঘৃণিত, পদদলিত হইয়া বাস করিয়াছি, সে কেবল তোমার দেহের জন্য। হেম, তোমারই স্নেহের জন্য, তোমার ভালবাসার জন্য, তোমারই আশায় এতদিন ছিলাম, সে আশাও সাঙ্গ হইয়াছে। আশা ছিল, তোমার পিতা আমার সহিত তোমার বিবাহ দিবেন। আমার কথায় রাগ করিও না, লজ্জা করিও না, লজ্জা বা রাগ করিবার এখন সময় নাই। তোমার পিতার মন বুঝিয়াছি, বিনীত শ্রীশচন্দ্রকে তিনি স্নেহ করেন, আমি তাহার চক্ষের শূল। শ্রীশচন্দ্রকে তিনি কন্যাদান করিবেন, তাহা কি আমি চক্ষে দেখিব? তাহা দেখিয়া এই গৃহে বাস করিব? হেমলতা, মনুষ্য সে আঘাত সহ করিতে পাবে না, অথবা মুনি-ঋষির সেরূপ সহিষ্ণুতা আছে। হেমলতা, আমি ঋষি নহি। হেম, আমাকে বিদায় দাও, বীরনগরে আমার স্থান নাই”
ক্ষণেক পরে নরেন্দ্র পুনরায় ধীরস্বরে কহিতে লাগিল, “হেমলতা, কাঁদিও না, সমস্ত জীবন কঁদিবার সময় আছে, একবার আমার কথা শুন। আমি আজি জন্মের মত চলিলাম। কোথায় যাইতেছি, কি করিব, তাহা আমি জানি না। কিন্তু সে চিন্তা করি না, জগতে লক্ষ লক্ষ প্রাণী রহিয়াছে, আমারও থাকিবার স্থান হইরে। কিন্তু এই জনাকীর্ণ জগতে আমি আজ হইতে একাকী। নানা দেশে নানা স্থানে অনেক লোক দেখিব, তাহাদের মধ্যে আমি বন্ধুশূন্য, গৃহশূন্য, একাকী। জীবনে নরেন্দ্রকে আপনার ভাবিবে, এরূপ লোক নাই, নরেন্দ্রের মৃত্যুকালে শোক করিবে, এরূপ লোক নাই।’
হেমলতার চক্ষুজলে বস্ত্র শরীর সিক্ত হইতেছিল, এক্ষণে আর থাকিতে না পারিয়া উচ্চৈঃস্বরে ক্রন্দন করিয়া উঠিল। নরেন্দ্রের চক্ষু উজ্জল, কিন্তু জলশূন্য, নরেন্দ্র আবার ধীরে ধীরে বলিতে লাগিল, “হেম, ক্ষণেক স্থির হও, কাঁদিও না, আমি এক্ষণে কঁদিতে পারি না। আমার মনে যে ভাব হইতেছে, তাহা ক্রন্দনে ব্যক্ত হয় না; হেম, তুমি আমাকে ভালবাস, জগতের মধ্যে কেবল তুমি এক একবার নরেন্দ্রের প্রতি সস্নেহ-দৃষ্টিতে দেখ, নরেন্দ্রের বিষয় সস্নেহ-চিত্তে ভাব; কিন্তু তোমাকে কিরূপ গাঢ় প্রণয়ের সহিত ভালবাসে, অন্ধকার, সুখশূন্য জীরনাকাশের মধ্যে একটি প্রণয়-তার প্রতি কিরূপ সতৃষ্ণনয়নে চাহিয়া থাকে, তাহা হেমলতা, জান না, বালিকার হৃদয় সে ভাব ধারণ করিতে পারে না; কিন্তু এ স্বপ্ন অদ্য সাঙ্গ হইল, জীবনের একমাত্র আলোক নির্বাণ হইল, অদ্য হইতে অন্ধকারে দেশে-দেশে, অরণ্যে অরণ্যে যাবজ্জীবন পরিভ্রমণ করিব।”
নরেন্দ্র ক্ষণেক নিস্তব্ধ হইয়া রহিল; পরে ধীরে ধীরে বলিল, “হেমলতা, আমার আর একটি কথা আছে। বাল্যকালে আমরা দুজনে এই মাধবীলতাটি পুঁতিয়াছিলাম, আমাদের ভালবাসার ন্যায় লতাটি রাড়িয়াছে, আজ আর ইহার থাকিরার আরশুক কি?”
নরেন্দ্র সেই লতা উৎপাটন করিল ও তদ্বারা একটি কঙ্কণ প্রস্তুত করিল, ধীরে ধীরে হেমলতাকে তাহা পরাইয়া দিয়া বলিল, “হেম, ফুল যত শীঘ্র শুকায়, লতা তত শীঘ্র শুকায় না,বোধ হয়, তুমিও আমাকে কিছুদিন স্মরণ রাখিবে। যদি রাখ, যতনি নরেন্দ্রের জন্যে তোমার স্নেহ থাকিবে, ততদিন এক মাধবীকঙ্কনটি রাখিও, যখন অভাগাকে ভুলিয়া যাইরে, নদীজলে শুষ্কলতা ফেলিয়া দিও।”
শোকবিহ্বলা দগ্ধহৃদয়া হেমলতা বিস্মিত হইয়া নরেন্দ্রের দিকে চাহিয়া দেখিল, নরেন্দ্র স্থির। নরেন্দ্রের স্বর গম্ভীর ও অকম্পিত। নরেন্দ্রের চক্ষুতে জল নাই, কিন্তু অগ্নি জলিতেছে। ধীরে ধীরে হেমের হাত ছাডিয়া নরেন্দ্র চলিয়া গেল। সে অন্ধকার রজনীতে আর নরেন্দ্রকে দেখা গেল না।