মাধবীকঙ্কণ/ছয়
সায়ংকালীন অবকারাচ্ছন্ন গঙ্গাতীরে বসিয়া একটি ত্রয়োদশবর্ধীয়া বালিকা অসংখ্য উর্মিরাশির দিকে কি জন্য চাহিয়া রহিয়াছে? যতদূর অন্ধকারে দেখা যায় বীচিমালা উঠিতেছে, পড়িতেছে, তাহার পর একটি ঈষৎ ধূসর রেখা, তাহার পর আর অন্ধকারে দেখা যায় না। দেখিতে দেখিতে হেমের চক্ষু জলে পরিপূর্ণ হইল, হেম কিছু দেখিতে পাইল না। রজনী গাঢ় হইয়া আসিল, ক্রমে আকাশে তারা ফুটিতে লাগিল, তথাপি হেমের দেখা শেষ হইল না।
রজনীতে জমিদারের বাড়ির সকলে নিদ্রিত হইল। হেমলতার পক্ষে সে রজনী কী ভীষণ! বালিকা ধীরে ধীরে শয্যা হইতে উঠিয়া গবাক্ষের নিকট আসিল, ধীরে ধীরে গবাক্ষ উদঘাটন করিয়া বাহিরে দেখিল; তারা-পরিপূর্ণ অন্ধকার আকাশের নীচে বিশাল গঙ্গা অনন্তস্রোতে ভাসিয়া যাইতেছে। সেই নৈশ-গঙ্গার দিকে দেখিতে দেখিতে কি হৃদয়বিদায়ক ভাব হেমলতার হৃদয়ে জাগরিত হইতে লাগিল। বাল্যকালের ক্রীড়া, কিশোর-বয়সের প্রথম ভালবাসা, কত কথা, কত কৌতুক একে একে জাগরিত হইয়া বালিকায় দলিত করিতে লাগিল। এক একটি কথা মনে হয়, আর হৃদয়ে দুঃখ উথলিয়া উঠে, অবিরল অশ্রুধারায় চক্ষু ও বক্ষঃস্থল ভাসিয়া যায়। আবার বালিকা শান্ত হইয়া গঙ্গার দিকে দেখে, আবার একটি কথা স্মরণ হয়, শোকবিহ্বলা হইয়া অজস্র রোদন করে; কাঁদিয়া কাঁদিয়া বালিকা অবসন্ন হইল, হায়! সে ক্রন্দনের শেষ নাই, সে ক্রন্দন অবারিত অশান্তিপ্রদ। রজনী একপ্রহর, দ্বিপ্রহর হইল, তথাপি বালিকা গবাক্ষর নিকট দণ্ডায়মানা অথবা ভূমিতে লুষ্ঠিত হইয়া নীরবে রোদন করিতেছে।
শোকের প্রথম বেগের উপশম হইল, কিন্তু শোকচিন্তা-পরম্পরা নিবারণ হইবার নহে। গণ্ডস্থলে হাত দিয়া একাকিনী গবাক্ষপার্শ্বে বসিয়া হেমলতা ভাবিতে লাগিল। এক একবার হেমলতার নয়নে একবিন্দু জল আসিতে লাগিল, ধীরে ধীরে সেটি গড়াইয়া পড়িল আবার একবিন্দু জড় হইতে লাগিল। সে বিন্দু-পরম্পরা শুকায় না, সে চিন্তা-পরস্পর শেষ হয় না।
রজনী শেষ হইল, পূর্বাকাশে রক্তিমচ্ছটা দেখা যাইতে লাগিল, মলিনা তখনও গণ্ডে হস্ত দিয়া গবাক্ষপার্শ্বে বসিয়া আছে তখনও চিন্তা-সূত্র শেষ হয় নাই। জীবনে কি শেষ হইবে?
রজনী প্রভাত হইল, প্রথম সূর্যালোকে হেমলতা চকিত হইয়া উঠিল। চক্ষু কোটরপ্রবিষ্ট, বদনমণ্ডল মলিন, শরীর অবসন্ন। ধীরে ধীরে বালিকা গবাক্ষপার্শ্ব হইতে উঠিল, শূন্য-হৃদয়ে শূন্যগৃহে গৃহকার্যে প্রবৃত্ত হইল।
সেই কি একদিন? দিনে দিনে, সপ্তাহে সপ্তাহে, মাসে মাসে বালিকা সেই গবাক্ষ-পাশে বসিত, যে গঙ্গাতীরে নরেন্দ্র বিদায় লইয়াছে, সেই গঙ্গার দিকে দেখিত। প্রাতঃকালে, মধ্যাহ্নে, সায়ংকালে, গভীর রজনীতে শূন্যহৃদয়া বালিকা সেই গঙ্গার দিকে চাহিয়া থাকিত, কত ভাবিত, কত কথা মনে আসিত, কে বলিবে? একদিন নরেন্দ্রনাথ হেমের কানে কানে কি বলিয়াছিল, একদিন ওপার হইতে হেমের জন্য কি আনিয়াছিল, একদিন গাছ হইতে আম্র পাড়িয়া হেম ও নরেন্দ্র লুকাইয়া খাইয়াছিল, একদিন পিতাকে না বলিয়া হয় সন্ধ্যার সময় নরেন্দ্রের সহিত নৌকায় চড়িয়াছিল, একদিন হেম নরেন্দ্রকে ফুলের মালা পরাইয়া দিয়াছিল,একদিন নরেন্দ্র হেমের কেশ ফুল দিয়া সাজাইয়া দিয়াছিল, সহস্র সহস্র কথা একে একে নদীজলের হিল্লোলের ন্যায় হেমের হৃদয়ে উঠিত। দ্বিপ্রহর হইতে সায়ংকাল পর্যন্ত, কখন কখন সন্ধ্যা হইতে গভীর রজনী পর্যন্ত হেমলতা ভাবিত, এক একবার চক্ষু জলে পরিপূর্ণ হইত, পাছে কেহ দেখিতে পায় এই ভয়ে বালিকা জল মুছিয়া ফেলিত। নবকুমারের বিপুল সংসারে সে দুঃখের ভাগিনী কে হইবে? হেম কাহাকেও মনের কথা মুখ ফুটিয়া বলিত না। বালিকা সকলের নিকটেই সঙ্গোপন করিত, বাড়ীর লোকদিগের নিকট হইতে সরিয়া আসিয়া ভাবিত। কখন কখন শোক-পারাবার উথলিলে গোপন করিতে পারিত না, নয়ন হইতে অবিরল বারিধারা বহিত।
ক্রমে বসন্তকালের পর গ্রীষ্মকাল আসিল। প্রকৃতি বঙ্গদেশকে সুস্বাদু ফল, সুদৃশ্য ফুল, সুকণ্ঠি পক্ষী দ্বারা পরিপূর্ণ করিল। নবপল্লবিত বৃক্ষগণ সুমন্দ বায়ুতে মধুর গান করিতে লাগিল, তাহার সঙ্গে সুন্দর পক্ষিগণ আনন্দে গান করিয়া নিজ নিজ কুলায় নির্মাণ করিতে লাগিল। মধ্যাহ্নে ছায়াপ্রদায়ী বৃক্ষমূলে উপবেশন করিয়া, পত্রের মর্মর শব্দ শুনিয়া পক্ষিশাবক ও পক্ষিদম্পতীর দিকে চাহিয়া বালিকা হন্তে গণ্ড স্থাপন করিয়া চিন্তা করিত, যতক্ষণ না সন্ধ্যার গাঢ় ছায়া সেই বৃক্ষাবলী আবৃত করিত, হেমলতার চিন্তাসূত্র ছিন্ন হইত না। তাহার পর বর্ষা আসিয়া সমস্ত দেশ প্লাবিত করিল, বর্ষা শেষ হইল। কৃষকগণ আনন্দে ধান্য কাটিতে লাগিল। গ্রামে, গৃহে, গোলায় ধান্য পরিপূর্ণ হইল জগৎ আনন্দিত হইল, কিন্তু হেমের নিরানন্দ হৃদয় শান্ত হইল না। সুন্দর আশ্বিন মাসে পূজার রব উঠিল, চারিদিকে আনন্দধ্বনি উঠিল, আকাশ পরিষ্কার হইল, কিন্তু হেমলতর হৃদয়াকাশ তমসাচ্ছন্ন। আবার শীতকাল আসিল, আনন্দে কৃষকগণ আবার ধান্য কাটিল, আনন্দে সংসারী, গৃহ, ধনী, কাঙ্গালী সকলেই পৌষ-পার্বণ করিল, হেমলতা পার্বণের দিন কি ইহজন্মে আর আসিবে?
নবকুমারের বিপুল সংসার। কাহারও কিছু ক্ষোভ নাই অভাব নাই, দুঃখ নাই সেই সংসারে স্নেহপালিতা একমাত্র দুহিতা বিষন্ন। বিপুল সংসারেও হেমলতা একাকিনী।