॥ সাত॥

 নরেন্দ্র অতিশয় সন্তরণপটু ছিলেন। সেই রাত্রিতে সন্তরণ দিয়া গঙ্গা পার হইয়া অপর পারে উপস্থিত হইলেন। সম্মুখে অনেক দূর পর্যন্ত কেবল বালুকা, তাহার পর কেবল অনন্তু প্রান্তর দেখা যাইতেছে। নরেন্দ্র সেই অন্ধকার নিশীথে সিক্তশরীর ও সিক্তবস্ত্রে সেই বালুকা-ক্ষেত্রে বিচরণ করিতে লাগিলেন।

 নরেন্দ্র গঙ্গার অপর পাশের দিকে দৃষ্টি করিলেন। অন্ধকারেও বীরনগরের শেতপ্রাসাদ ঈষৎ দৃষ্ট হইতেছে, নরেন্দ্র সেইদিকে দেখিলেন, আবার চক্ষু ফিরাইয়া বিচরণ করিতে লাগিলেন। আবার স্থির হইয়া সেইদিকে চাহিলেন। নিস্তব্ধ অন্ধকারে গঙ্গার কলকল শব্দ শুনা যাইতেছে, সময়ে সময়ে পেচকের ভীষণ রব শুনা যাইতেছে, আর এক একবার দূরে শৃগালের কোলাহল শ্রুত হইতেছে। নরেন্দ্র গঙ্গা দেখিতে ছিলেন না, নরেন্দ্র পেচক রা শৃগালের ধ্বনি শুনিতেছিলেন না, তিনি নিঃশব্দে অন্ধকারে বিচরণ করিতেছিলেন। অনেকক্ষণ পর আবার বীরনগরের দিকে চাহিয়া দেখিলেন, ঘোর অন্ধকারে আর সে গৃহ দেখা যায় না। নরেন্দ্র একটি দীর্ঘনিঃশ্বাস পরিত্যাগ করিয়া ফিরিলেন। সম্মুখে যে পথ পাইলেন, সেইদিকে চলিলেন।

 কোথায় যাইতেছেন নরেন্দ্র জানেন না। উপরে অসীম গগন, নীচে অসীম প্রান্তর, নরেন্দ্রের চিন্তাও অসীম ও অনন্ত, নরেন্দ্র যেদিকে পাইলেন চলিলেন। পথ-পার্শ্বে বটবৃক্ষ হইতে নিশাচর পক্ষী নরেন্দ্রকে দেখিয়া কুলায় ছাড়িয়া পলায়ন করিল, নিশাবিহারী শৃগাল পাল নরেন্দ্রকে দেখিয়া চীৎকার করিতে লাগিল, নরেন্দ্র তাহা গ্রাহ্য করিলেন না।

 অনেক দূরে যাইয়া একটি গ্রামে আসিলেন। গ্রাম নিস্তব্ধ, সকলেই সুপ্ত। কৃষ্ণবর্ণ বৃক্ষশ্রেণীর নীচে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কুটীর দেখা যাইতেছে ও বৃক্ষপত্রমধ্যে কোন কোন স্থানে খদ্যোতমালা ঝিকমিক করিতেছে। নরেন্দ্রকে দেখিয়া গ্রাম্যকুকুর শব্দ করিতে লাগিল; দুই একজন গৃহস্থ ঘরের দ্বার খুলিয়া চাহিয়া দেখিল; নরেন্দ্র কোনদিকে চাহিলেন না, পথ অতিবাহন করিতে লাগিলেন। গ্রামের পথ ঠিক জানেন না, স্থানে স্থানে বৃক্ষের নীচে ও ঝোপের ভিতর দিয়া যাইতে নরেন্দ্রের শরীর ক্ষত-বিক্ষত হইল। নয়ে গ্রাহ করিলেন না, কতক্ষণে গ্রাম পার হইয়া আবার এক প্রান্তরে পড়িলেন।

 আবার প্রান্তর পার হইলেন, অন্য গ্রামে পড়িলেন। আবার নিঃশব্দে গ্রাম পার হইয়া গেলেন। সেই রজনীযোগে কত গ্রাম অতিক্রম করিলেন, কত দূরে যাইলেন, জানি না, নরেন্দ্রও বলিতে পারেন না।

 সমস্ত রজনী ভ্রমণ করিয়া নরেন্দ্রনাথ দূর প্রান্তরে একটি আলোক দেখিতে পাইলেন, সেই আলোেক অনুসরণ করিয়া চলিতে লাগিলেন, প্রায় এক ক্রোশ যাইয়া আলোকের নিকট পৌছিয়া দেখিলেন, কতকগুলি লোক একটি শবদাহ করিতেছে। নরেন্দ্রনাথ তখন একবার দাড়াইলেন। শব দেখিয়া একবার দাইলেন। কাষ্ঠের অগ্নি একবার জলিয়া উঠিতেছিল; আবার মধ্যে মধ্যে নিস্তেজ হইয়া যাইতেছিল। ঐরূপ স্তিমিত আলোকে নরেন্দ্রের আকৃতি ও বিকট মুখমণ্ডল এক একবার দেখা যাইতে লাগিল। যাহারা শবদাহ করিতে আসিয়াছিল, তাহারা নরেন্দ্রকে দেখিতে পাইল; শ্রান্ত পথিক মনে করিয়া নিকটে আসিতে বলিল, নরেন্দ্র নিকটে গেলেন না; পরিচয় জিজ্ঞাসা করিল, নরেন্দ্র পরিচয় দিলেন না। শবদাহিগণ ক্ষণেক নরেন্দ্রের অচল, দীর্ঘ অবয়ব ও বিকৃত মুখমণ্ডলের দিতে দৃষ্টিপাত করিয়া শব ছাড়িয়া ঊর্ধ্বশ্বাসে পলায়ন করিল।

 প্রত্যুষে গ্রামের স্ত্রীলোকের কলস লইয়া ঘাটে যাইতেছিল, এক দীর্ঘাকার গৌরবর্ণ বিকৃত মনুষ্যমূর্তি পথে শয়ান দেখিয়া সভয়ে পাশ কাটিয়া গেল।

 প্রাতঃকাল হইল। গ্রামের লোক সমবেত হইয়া অপরিচিত ঘোর নিদ্রাভিভূত পুরুষকে জাগাইয়া পরিচয় জিজ্ঞাসা করিলে, সে ধীরে ধীরে উত্তর দিল, “আমার নাম নাই, আমার নিবাস নাই, আমি জগতে একাকী।” নরেন্দ্র ঘোর উন্মত্ত।