মানিনী/ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ

ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ।


 যে বাটীতে এখন তিনি বাস করিতেন, প্রথমে তিনি সেই বাটীতে উপস্থিত হইলেন। বাটীতে গমন করিয়া সম্মুখে রাজকিশোরীকে দেখিতে পাইয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, মানিনী আসিয়াছে কি?”

উত্তরে রাজকিশোরী বলিলেন, “না। কেন, তাহার কোনরূপ সন্ধান পাইয়াছ কি?”

 বিপিন রাজকিশোরীর এই কথার উত্তর প্রদানে আর সময় পাইলেন না; যে গাড়ীতে করিয়া তিনি আসিয়াছিলেন, সেই গাড়ীর গাড়িবানকে দ্রুতগতি ডাক্তার বাবুর বাড়ীতে গমন করিতে কহিলেন।

 আদেশ প্রতিপালিত হইল। কিন্তু ডাক্তারবাবুর বাটীতে গিয়া জানিতে পারিলেন যে, ডাক্তার বাবু তখনও প্রত্যাগমন করেন নাই। সুতরাং তাঁহার অপেক্ষায় বিপিন সেইস্থানেই বসিয়া ছিলেন। বলা বাহুল্য, এই গাড়ীভাড়া প্রদানের ভার, পরিশেষে রজনীকান্ত বা রাজকিশোরীর উপর অর্পিত হইয়াছিল।

 যে সময় বিপিন ডাক্তার বাবুর বাটীতে গিয়া উপস্থিত হইলেন, সেই সময় রাত্রি আটটায় অধিক হয় নাই। সুতরাং ডাক্তার বাবুর প্রত্যাশায় তিনি তখন সেইস্থানেই অপেক্ষা করিতে লাগিলেন।

 নয়টা বাজিয়া গেল, ডাক্তার বাবু প্রত্যাগমন করিলেন না; তথাপি বিপিন নিতান্ত চিন্তিত অন্তঃকরণে সেইস্থানে বসিয়া রহিলেন। ক্রমে দশটা, এগারটা, বারটা বাজিয়া গেল, তথাপি ডাক্তার বাবুর সাক্ষাৎ নাই। বিনা আহারে সেইস্থানে বসিয়া বিপিন রাত্রি অতিবাহিত করিতে লাগিলেন, এবং মনে মনে ভাবিতে লাগিলেন, এত রাত্রিতেও যখন ডাক্তার বাবু বা মানিনী প্রত্যাগমন করিলেন না, তখন কি তাঁহারা আর কোন স্থানে গমন করিয়াছেন? মানিনীর এমন বন্ধু আর কে আছে যে, এই অসময়ে তিনি মালিনীকে স্থান প্রদান করিবেন?

 এইরূপে ক্রমে রাত্রি দুইটা বাজিয়া গেল। দুইটার পর ডাক্তার বাবু একখানি গাড়ী ভাড়া করিয়া আপন বাসায় আসিয়া উপস্থিত হইলেন। মানিনীর সহিত যে গাড়ীতে ডাক্তার বাবুকে বিপিন পূর্ব্বে দেখিয়াছিলেন, বর্ত্তমান গাড়ী সেই গাড়ী নহে। উহার নম্বর ৩২৬১।

 ডাক্তার বাবু গাড়ী হইতে অবতরণ করিবার সময় সম্মুখেই বিপিনকে দেখিতে পাইলেন। বিপিনকে দেখিবামাত্র তাঁহার মনে এক অপূর্ব্ব ভাবের উদয় হইল। কিন্তু তিনি তাঁহার মনের ভাব গোপন করিয়া কহিলেন, “কি হে বিপিন! এত রাত পর্য্যন্ত এইস্থানে বসিয়া আমার অপেক্ষা করিতেছ নাকি? একটী রোগীকে লইয়া আমি অত্যন্ত ব্যস্ত ছিলাম বলিয়া, বাসায় আসিতে আমার এত রাত্রি হইয়া গিয়াছে। কি সংবাদ? সমস্ত মঙ্গল ত?”

 বিপিন। সংবাদ আপনার কাছে। আপনি প্রত্যাগমন করিলেন, কিন্তু মানিনীকে কোথায় রাখিয়া আসিলেন। তাঁহারই সংবাদ জানিবার নিমিত্ত রাত্রি আটটা হইতে এ পর্য্যন্ত আমি আপনার এখানে বসিয়া আছি। আপনি কোথায় তাঁহাকে ছাড়িয়া আসিলেন, কোথায় গেলে এখন তাঁহার সহিত আমার সাক্ষাৎ হইবে? আমি যে এখন আমার ভ্রাতার সহিত এক বাটীতে বাস করিতেছি, এ কথা তাঁহাকে বলেন নাই কি?

 ডাক্তার। আমি তাঁহাকে কোন কথাই বলি নাই। তাঁহার সহিত আমার দেখা হইবার পরই তুমি আসিয়া উপস্থিত হও; সুতরাং আমি তাঁহাকে কোন কথা জিজ্ঞাসা করিবার অবসর পাই নাই। বিশেষতঃ তোমার উপর তিনি যেরূপ ব্যবহার করিলেন, তাহাতে আমার কোন কথা জানিবার ইচ্ছা হইল না। আর তাঁহাকে কোন কথা বলিবার পূর্ব্বেই সে গাড়িবানকে গাড়ী হাঁকাইতে কহিল; সুতরাং কোন কথা বলিতেও পারিলাম না, অথচ গাড়ী হইতে অবতরণ করিতেও সমর্থ হইলাম না। গাড়ী কিয়দ্দূর গমন করিলে যখন দেখিলাম, গাড়ীর গতি ক্রমে কমিয়া আসিয়াছে, তখন আমি গাড়িবানকে কহিলাম, “গাড়ী থামাও।” গাড়ী থামিল। আমি তাঁহাকে আর কোন কথা না বলিয়া, গাড়ী হইতে অবতরণ করিলাম। গাড়ী পুনরায় চলিয়া গেল। কোথায় গেল, তাহা বলিতে পারি না। দেখিলাম, আমার সহিত তাহার এতদিবসের বন্ধুত্ব তিনি ভুলিয়া গিয়াছেন। আমি গাড়ী হইতে অবতরণ করিবার পর, তিনি একবার আমার দিকে দৃষ্টিপাতও করিলেন না, অবলীলাক্রমে চলিয়া গেলেন।

 ডাক্তার বাবুর কথা শ্রবণ করিয়া বিপিন আরও বিস্মিত হইলেন, এবং পুনরায় জিজ্ঞাসা করিলেন, “তবে কি আমার মানিনী কোন্ স্থানে গমন করিয়াছে, তাহা আপনি অবগত নহেন?”

 ডাক্তার বাবু কহিলেন, “না, তাহার কিছুই আমি অবগত নহি।”

 বিপিন সেইস্থানে বসিয়া পড়িলেন। ডাক্তার বাবু বিপিনকে সেইরূপ অবস্থায় সেই স্থানে পরিত্যাগ করিয়া, আপনার বাড়ীর ভিতর প্রবেশ করিলেন।

 এইরূপ অচেতন অবস্থায় কিয়ৎক্ষণ সেইস্থানে উপবেশন করিয়া বিপিন পরিশেষে নিতান্ত দুঃখিত অন্তঃকরণে আপন বাসা-অভিমুখে গমন করিলেন।

 রাত্রির অবশিষ্টাংশ মানিনীর চিন্তাতেই বিপিন অতিবাহিত করিলেন। যে ভাবনা তাঁহার অন্তঃকরণ হইতে সময়ের গতিক্রমে অনেক কমিয়া আসিয়াছিল, পুনরায় সেই চিন্তা সবেগে তাঁহার হৃদয়ে প্রবেশ করিল। কিন্তু আপনার মনের কথা রজনীকান্ত বা রাজকিশোরীকে বলিতে পারিলেন না। তাঁহার অবস্থা দেখিয়া বরং রাজকিশোরী দুই একবার জিজ্ঞাসা করিলেন, কিন্তু বিপিন তাঁহার কথায় কোনরূপ উত্তর প্রদান করিতে পারিলেন না। বিপিনের একজন বাল্যবন্ধু ছিল। পরদিবস প্রাতঃকালে তাঁহার নিকট গমন করিয়া আপনার মনের সমস্ত কথা ব্যক্ত করিলেন। বন্ধু তাঁহার কথায় নিতান্ত দুঃখিত হইলেন। কিন্তু মানিনীকে সন্ধান করিবার অপর কোন উপায় দেখিতে না পাইয়া পূর্ব্বকথিত ২৫৯ নম্বরের গাড়ীর অনুসন্ধানে বহির্গত হইলেন, এবং সমস্ত দিবস অনেক পরিশ্রম করিয়া রাত্রি প্রায় দশটার পর সেই গাড়িবানের সহিত তাঁহাদিগের সাক্ষাৎ লইল। পূর্ব্বদিবস ইডেন উদ্যানের নিকট মানিনী বিপিনের সহিত যেরূপ ব্যবহার করিয়াছিল, তাহা গাড়িবানকে স্মরণ করাইয়া দেওয়ার পর সে কহিল, “যে স্থান হইতে আমি সেই স্ত্রীলোকটী ও পুরুষটীকে আনয়ন করিয়াছিলাম, এবং পরিশেষে তাঁহাদিগকে যে স্থানে রাখিয়া আসিয়াছি, তাহার ঠিক ঠিকানা আমি এইস্থান হইতে বলিয়া দিতে পারি না, তবে আমি দেখাইয়া দিতে পারি।”

 গাড়িবানের এই কথা শুনিয়া বিপিন ও তাঁহার বন্ধু তাহারই গাড়ী ভাড়া করিয়া তাহার ভিতর গিয়া উপবেশন করিলেন। গাড়িবান তাঁহাদিগকে লইয়া, যে বাড়ীতে মানিনীকে রাখিয়া আসিয়াছিল, সেই বাড়ীর সম্মুখে গিয়া উপনীত হইল ও কহিল, এই বাড়ীতে তাঁহারা গমন করিয়াছিলেন। গাড়িবানের কথা শুনিয়া বিপিন ও তাঁহার বন্ধু সেই গাড়ী হইতে অবতরণ করিয়া আস্তে আস্তে সেই বাড়ীর ভিতর প্রবেশ করিলেন। বাড়ীর ভিতর প্রবেশ করিয়া দেখিলেন, উহা বেশ্যালয়; উক্ত বাড়ীতে অনেকগুলি বেশ্যা বাস করিয়া থাকে। বাড়ীর ভিতর প্রবেশ করিবার সময় সম্মুখেই একটী স্ত্রীলোকের সহিত তাঁহাদিগের সাক্ষাৎ হইল। মানিনীর কথা তাহাকে জিজ্ঞাসা করিলে সে কহিল, “তিন তালায় গমন করুন, সেইস্থানে তাহাকে দেখিতে পাইবেন।”

 এই স্ত্রীলোকটীর কথা শ্রবণ করিয়া তাঁহারা উভয়েই একবারে তিন তলায় গমন করিলেন। সেই তিন তলায় কেবলমাত্র দুইখানি মাত্র ঘর ছিল। তাহার একখানিতে প্রবেশ করিয়া তাঁহারা দেখিলেন, মানিনী নূতন সাজসজ্জায় সজ্জিত হইয়া, ডাক্তার বাবু ও আরও কয়েকজন লোকের সহিত একত্র একশয্যায় উপবেশন করিয়া সুরাদেবীর আরাধনায় কায়মনোবাক্যে নিযুক্ত আছে! হাসি-তামাসার মধ্যে একটী একটী গীতও গাইতেছে।

 এই অবস্থা দেখিয়া বিপিন ও তাঁহার বন্ধুর মনের ভাব যে কিরূপ হইল, তাহা আর এই স্থানে বর্ণন করিবার প্রয়োজন নাই। পাঠকগণ আপনাপন মনেই তাহা স্থির করিয়া লইবেন।

 যে সময় তাঁহারা উভয়ে সেইস্থানে প্রবেশ করেন, সেই সময় মানিনী তাহা দেখিতে পাইল। দেখিবামাত্র মানিনী দ্রুতপদে তাঁহাদিগের নিকট আসিয়া উপস্থিত হইল, এবং ভয়ানক চীৎকারস্বরে বলিতে লাগিল, “এই স্থানেও তোরা আমাকে জ্বালাতন করিতে আসিয়াছিস্? নির্জ্জনে আসিয়াও তোদের হাত হইতে আমার নিস্তার নাই। ভাল চাস ত, এখনই এখান হইতে বাহির হইয়া যা; নতুবা পদাঘাতে এইস্থান হইতে বাহির করিয়া দিব।”

 এই কথা শ্রবণ করিয়াও বিপিন সেইস্থান হইতে তখনই প্রস্থান করিতে যেন একটু ইতস্ততঃ করিতে লাগিলেন। ইচ্ছা—মানিনীকে দুই একটী কথা জিজ্ঞাসা করেন; কিন্তু মানিনীর তাহা সহ্য হইল না। তাঁহার মুখের কথা কার্য্যে পরিণত করিল। লিখিতে লজ্জা হয়, সে প্রকৃতই বিপিনকে পদাঘাত করিল, এবং ভয়ানক চীৎকার করিয়া উঠিল। হঠাৎ পদাঘাতে বিপিন দূরে গিয়া পতিত হইলেন। সেই সময় মানিনীর ঘরে বসিয়া যাহারা আমোদ প্রমোদে ব্যস্ত ছিল, তাহারা বহির্গত হইয়া পদাঘাতে পতিত সেই বিপিন ও তাঁহার বন্ধুকে নির্দ্দয়রূপে প্রহার করিতে করিতে বাটী হইতে বহির্গত করিয়া দিল। মানিনী সেইস্থানে দণ্ডায়মান হইয়া হাসিতে হাসিতে কহিতে লাগিল, “বেটাদের যেমন কর্ম্ম—তেমনি ফল।”

 এই ঘটনার পর বিপিনকে কেমন কেমন বোধ হইতে লাগিল। তিনি আসিয়া আপনার ঘরে প্রবেশ করিলেন, সে ঘর হইতে আর বাহির হইলেন না। তিনি কোন স্থানে গমন করিতেন না, কোন লোকজনের সহিত সাক্ষাৎ করিতেন না; রাত্রিদিন নির্জ্জনে থাকিতেই ভালবাসিতেন।

 কোন্ সময়ে যে অবস্থার কিরূপ পরিবর্ত্তন হয়, তাহা কেহই বলিতে পারেন না। এইরূপ কিছুদিবস অতিবাহিত হইবার পর সঙ্গে সঙ্গে রজনীকান্তের অবস্থার পরিবর্ত্তন হইতে লাগিল। বিনাদোষে সাহেব সন্দেহ করিয়া তাঁহাকে চাকরী হইতে জবাব দিল। অনন্যোপায় হইয়া রজনীকান্ত নানাস্থানে ঘুরিয়া চাকরীর যোগাড় করিতে লাগিলেন; কিন্তু এক বৎসরের মধ্যে কোন স্থানেই তিনি কোনরূপ চাকরীর যোগাড় করিয়া উঠিতে পারিলেন না। এত দিবস পর্য্যন্ত তিনি যাহা কিছু সংগ্রহ করিয়াছিলেন, প্রথমতঃ তাহা ব্যয়িত হইয়া গেল। রাজকিশোরী যখন দেখিলেন যে, সঞ্চিত অর্থ সমস্তই ব্যয় হইয়া গেল, তখন এক এক খানি করিয়া আপনার গাত্র হইতে অলঙ্কার সকল উন্মোচিত করিয়া তাহা বিক্রয় করিতে লাগিলেন, এবং খরচ যতদূর কম করিবার সম্ভাবনা, তাহা করিয়া নিতান্ত কষ্টের সহিত সংসার চালাইতে লাগিলেন। কিন্তু এত কষ্টে থাকিলেও একদিবসের জন্য তাঁহার মুখে কেহ কখনও কষ্টের চিহ্ন দেখিতে পাইলেন না। সময়ে সময়ে তিনি আপনি না খাইয়া স্বামী ও দেবরের সেবা করিতে লাগিলেন। ইহার অবস্থা দেখিয়া, ইহার চরিত্র দেখিয়া, ইহাঁর স্বামী-ভক্তি দেখিয়া ও সর্ব্বদা ইহার মুখে মিষ্ট কথা শুনিয়া সেই সময় বিপিন একদিন আপনার মনের ভাব প্রকাশ করিয়া ফেলিলেন ও কহিলেন, “শিক্ষিত ও অশিক্ষিত স্ত্রীলোকের মধ্যে যে কি প্রভেদ, তাহা আমি এখন বুঝিতে পারিতেছি; কিন্তু ইহা যদি পূর্ব্বে বুঝিতে পারিতাম, তাহা হইলে আমার আজ এ দশা ঘটিত না।”

 এইরূপ কষ্ট একবৎসর কাল অতীত হইতে না হইতেই রজনীকান্তের উপর ঈশ্বর পুনরায় প্রসন্ন হইলেন। পূর্ব্বের চাকরী অপেক্ষা এবার তাঁহার একটী ভাল চাকরী জুটিল। অতি অল্প দিবসের মধ্যেই তিনি তাঁহার অবস্থার পরিবর্ত্তন করিয়া ফেলিলেন। অলঙ্কার-পত্র প্রভৃতি যে সকল দ্রব্যাদি তাঁহাকে বিক্রয় করিতে হইয়াছিল, অনতিবিলম্বেই তিনি তাহা পুনরায় প্রস্তুত করাইলেন, এবং পূর্ব্বে যাহা কিছু ছিল, এবার তাহা অপেক্ষা অনেক অধিক হইল। ক্রমে নিজে একখানি বাটী খরিদ করিয়া তাহাতে গিয়া বাস করিতে লাগিলেন। বিপিন তাঁহার সঙ্গেই রহিলেন। তিনি মনে করিয়াছিলেন, এবার দেখিয়া শুনিয়া পুনরায় তিনি বিপিনের বিবাহ দিবেন, কিন্তু সে প্রস্তাবে বিপিন কিছুতেই সম্মত হইলেন না।

 এদিকে বেশ্যামহলে মানিনীর নাম জাঁকিয়া উঠিল। তৈজসপত্র, অলঙ্কার, বস্ত্র প্রভৃতি নিত্য নূতন দ্রব্য সকল তাহার ঘরে আসিয়া ঘরের শ্রী সম্পাদন করিতে থাকিল। একখানি বাড়ীও হইল। কিন্তু দুঃখের বিষয়, এইরূপে পাঁচ সাত বৎসর অতীত হইতে না হইতেই পুনরায় সকলে শুনিলেন যে, মানিনীর অবস্থা ক্রমে শোচনীয় হইয়া গিয়াছে। কোন কোন দুষ্ট ব্যক্তি মানিনীকে ফাঁকি দিয়া তাহার বাড়ী ঘর প্রভৃতি আত্মসাৎ করিয়াছে; অলঙ্কারপত্র চুরি করিয়া লইয়া গিয়াছে, দেনার দায়ে তৈজসপত্র বিক্রয় হইয়া গিয়াছে!

 বিশ্বস্ত বন্ধু ডাক্তার বাবুর উপর ঈশ্বর যে অসন্তুষ্ট হইলেন, তাহা আর বলিতে হইবে না। যে সময় মানিনীর অবস্থার উন্নতি হইয়াছিল, সেই সময় ডাক্তার বাবু বিষম রোগে আক্রান্ত হন। তাহার শরীরের এক অঙ্গ পতিত হইয়া যায়। কয়েক বৎসরকাল সেই অবস্থায় শয্যাগত থাকিয়া সবিশেষ কষ্ট ও যন্ত্রণা অনুভব করিয়া পরিশেষে ইহজীবন পরিত্যাগ করেন।

 শিক্ষিতা স্ত্রীর ব্যবহার দেখিয়া বিপিনের মন একবারে ভঙ্গ হইয়া গেল। অনেক চেষ্টা করিয়াও কোনরূপে তিনি আপন মনকে অন্য পথে চালিত করিতে পারিলেন না। ক্রমে তাঁহার অঙ্গ সকল শিথিল হইয়া পড়িতে লাগিল, এবং পরিশেষে ইহধাম পরিত্যাগ করিয়া চলিয়া গেলেন। জীবনের শেষ মুহূর্ত্তে তিনি যাহা বলিলেন, তাহা শ্রবণ করিয়া শ্রোতামাত্রেরই চক্ষুতে জল আসিল। মৃত্যুকালে বিপিন বলিয়াছিলেন, “এ দেশে কেহ যেন স্ত্রীকে শিক্ষিতা না করেন, বা শিক্ষিতা স্ত্রীলোকগণকে কেহ যেন আপনার হৃদয়ে স্থান প্রদান না করেন। পূর্ব্ব হইতে আমাদিগের যে প্রথা চলিয়া আসিতেছে, বৃদ্ধঋষিগণ নিঃস্বার্থভাবে যে প্রকার নীতি-পদ্ধতি প্রচলন করিয়া গিয়াছেন, কেহ যেন তাহার বিপর্য্যয় না করেন। স্বামী-সেবাই যাঁহাদিগের জীবনের প্রধান কার্য্য, গৃহের আবশ্যকীয় কার্য্যাদি লইয়া যাহাদিগের সর্ব্বদা ব্যস্ত থাকা আবশ্যক, তাঁহারা তাঁহাদিগের সেই সকল কর্ম্ম পরিত্যাগ করিয়া শিক্ষার প্রভায় অভিমানিনী হইলে, পরিশেষে তাঁহাদিগের যে কিরূপ শোচনীয় দশা হয়, আমার শিক্ষিতা স্ত্রীই তাহার জাজ্জ্বল্যমান্ প্রমাণ। শিক্ষিতার মায়ায় মুগ্ধ হইয়া যাঁহারা শিক্ষিতা স্ত্রীকে আপন হৃদয়ে স্থাপন করেন, তাঁহাদিগের দশা আমার মত হওয়াই উচিত।”

 মানিনীর নাম যশ, খ্যাতি প্রতিপত্তি, রূপ যৌবন, সমস্তই ফুরাইয়া গিয়াছে, সে অকালে বৃদ্ধত্ব প্রাপ্ত হইয়াছে। আর কেহ তাহার অনুসন্ধান করে না। কেহ তাহাকে ফিরিয়াও দেখে না। সাধিয়া কথা কহিলেও তাহার সঙ্গে কেহ বাক্যালাপ করিতে ভালবাসে না। সুতরাং বাল্যে শিক্ষিতা, যৌবনে গণিকা-প্রধানা মানিনী এখন অতি হেয়, ঘৃণ্য, নগণ্য হইয়া পড়িয়াছে। জীবিত থাকিলেও সে এখন অস্তিত্বহীন হইয়া পড়িয়াছে। কেহ তাহার সন্ধান লয় না, সুতরাং আমরাও এখন তাহার কোন সন্ধান পাইলাম না।

 বিপিন অসময়ে ইহজীবন পরিত্যাগ করিলেন সত্য, কিন্তু রজনীকান্ত ও রাজকিশোরীকে অনেক দিবস বাঁচিতে হইয়াছিল। এখন তাঁহাদিগের অবস্থার পরিবর্ত্তনের সঙ্গে সঙ্গে রাজকিশোরীর কষ্টও দূর হইয়াছিল; এখন আর তাঁহাকে স্বহস্তে অন্নাদি পাক করিতে হইত না। এখন একজন পাচিকার উপর সে কার্য্যের ভার পড়িয়াছিল, গৃহ কার্য্যের নিমিত্ত একজন পরিচারিকাও নিযুক্ত হইয়াছিল, তদ্ব্যতীত রজনীকান্তের নিজ কার্য্যের নিমিত্ত একজন পরিচারকও ছিল।

 যে পরিচারিকা সর্ব্বদা গৃহকার্য্যে নিযুক্ত থাকিত, পরিবার বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে তাহার দ্বারা এখন সমস্ত কর্ম্ম নির্ব্বাহ হওয়া এক প্রকার কঠিন হইয়া পড়িল। সেই সময় আর একটী চাকরাণী আবশ্যক হইল। পুরাতন চাকরাণী, এই কথা জানিতে পারিয়া, একদিবস কথায় কথায় রাজকিশোরীকে কহিল, “যে স্থানে আমরা বাস করিয়া থাকি, সেইস্থানে নিতান্ত দরিদ্র একটী স্ত্রীলোক বাস করে। ভিক্ষাই তাহার একমাত্র উপজীবিকা। কিন্তু তাহাও সকল দিবস প্রাপ্ত হয় না বলিয়া প্রায় তাহাকে উপবাস করিয়া দিনযাপন করিতে হয়। যদি কেবলমাত্র আপনি তাহাকে খাইতে দেন, তাহা হইলে সে আপনাদের বাটীতে দাস্যবৃত্তি করিতে প্রস্তুত আছে।”

 পরিচারিকার কথা শুনিয়া রাজকিশোরীর অন্তরে দয়ার উদ্রেক হইল। তিনি তাহাকে আনিবার নিমিত্ত পরিচারিকাকে আদেশ প্রদান করিলেন। আদেশ পাইবামাত্র পরিচারিকা একটা জীর্ণ শীর্ণ ও ছিন্নবস্ত্রপরিহিত স্ত্রীলোককে আনিয়া উপস্থিত করিল। ইহার অবস্থা দেখিয়া রাজকিশোরীর হৃদয়ে দয়ার উদ্রেক হইল। সেইদিবস হইতেই তিনি তাহাকে পরিচারিকার কার্য্যে নিযুক্ত করিলেন।

 পাঠক মহাশয়! এই দাসী-বেশিনী রামাকে চিনিতে পারিয়াছেন কি? ইনিই আমাদিগের পূর্ব-পরিচিতা সেই শিক্ষিতা রমণী মানিনী, মানিনীকে দেখিয়া রজনীকান্ত বা রাজকিশোরী চিনিতে পারিলেন না; কিন্তু মানিনী তাঁহাদিগকে চিনিতে পারিল। সুতরাং কোন কথা না বলিয়া পেটের দায়ে সেইস্থানেই দাস্যবৃত্তি করিতে লাগিল।

 রজনীকান্ত এখন অতুল বিভবশালী এবং দান ধ্যানে সর্ব্বদা নিযুক্ত। অনেক গরিব অসহায় লোক এখন তাঁহার অন্নে প্রতিপালিত। সংসারের পুত্র কন্যা, জামাতা বধূ, পৌত্র দৌহিত্র প্রভৃতিতেও এখন তাঁহার বহু পরিবার; এত পরিবার লইয়াও এক সঙ্গে অতীব সুখে তিনি এখন কালাতিপাত করিতেছেন।

সম্পূর্ণ।

চিত্র


⇒ আশ্বিন মাসের সংখ্যা

“কাল-পরিণয়”

যন্ত্রস্থ।