মানিনী/পঞ্চম পরিচ্ছেদ

পঞ্চম পরিচ্ছেদ।


 প্রায় দেড় মাস কাল জেলের মধ্যে বাস করিয়া বিপিন আপন বাড়ীতে প্রত্যাগমন করিলেন। কিন্তু বাড়ীতে আসিয়া যাহা দেখিলেন, তাহাতে তাঁহার মস্তক ঘুরিয়া গেল। বাড়ীতে সামান্য তৈজসপত্র ও অন্যান্য দ্রব্যাদি যাহা কিছু রাখিয়া গিয়াছিলেন, তাহার চিহ্নমাত্র নাই, এবং তাঁহার শিক্ষিতা বনিতা মানিনীকেও দেখিতে পাইলেন না। দেখিলেন যে, সেই বাড়ী এখন অন্য লোক দ্বারা অধিকৃত। তাঁহাদিগকে মানিনীর কথা জিজ্ঞাসা করাতে কেহই তাঁহার কথার উত্তর প্রদান করিতে পারিলেন না। সকলেই কহিলেন, তাঁহারা যখন সেই বাড়ী ভাড়া লয়েন, তখন বাড়ীতে কেহই ছিলেন না, বা কোন দ্রব্যাদিও ছিল না, বাড়ীটা সম্পূর্ণরূপেই খালি ছিল।

 ভাড়াটিয়াদিগের নিকট হইতে যখন তিনি এই সকল কথা জানিতে পারিলেন, তখন মনে মনে ভাবিলেন, “আমাকে যখন জেলের ভিতর অবস্থান করিতে হইয়াছিল, তখন মানিনী একাকী কিরূপে এই স্থানে অবস্থিতি করিবেন। বোধ হয়, তিনি তাঁহার বন্ধুর বাড়ীতে গমন করিয়াছেন, এবং যে পর্য্যন্ত আমি প্রত্যাগমন না করি, সেই পর্য্যন্ত তিনি সেইস্থানেই বাস করিতেছেন। সেইস্থানে গমন করিলেই আমি মানিনীকে দেখিতে পাইব।”

 এই ভাবিয়া দ্রুতগতি তিনি সেই বন্ধুর বাড়ীতে গমন করিলেন। তথায় অনুসন্ধান করিয়া জানিতে পারিলেন যে, মানিনী সেইস্থানে গমন করেন নাই। ডাক্তার বাবু যদি মানিনীর কোন কথা বলিতে পারেন, এই ভাবিয়া বিপিন তাঁহার অনুসন্ধান করিতে লাগিলেন; কিন্তু ডাক্তার বাবুর সহিত তাঁহার সাক্ষাৎ হইল না। জানিতে পারিলেন যে, বিপিন ধৃত হইবার দুই এক দিবস পরেই ডাক্তার বাবু তাঁহার দেশে গমন করিবেন বলিয়া সেইস্থান পরিত্যাগ করিয়া চলিয়া গিয়াছেন; সেই সময় পর্য্যন্ত প্রত্যাগমন করেন নাই।

 তখন অনন্যোপায় হইয়া যে বাড়ীতে বিপিন বাস করিতেন, সেই বাড়ীর অধিকারীর নিকট গমন করিয়া তাঁহাকে জিজ্ঞাসা করিবার ইচ্ছা করিলেন। যে স্থানে বিপিন বাস করিতেন, সেইস্থান হইতে বাড়ীওয়ালার বাড়ী বহুদূর নহে। সেইস্থানে গমন করিয়া তিনি যাহা জানিতে পারিলেন, তাহাতে তাঁহার মন আরও অস্থির হইল। জানিতে পারিলেন যে, তাঁহার জেলে গমন করিবার দুই তিন দিবস পরেই বাড়ীওয়ালা বিপিনের বাড়ীতে গমন করিয়াছিলেন। সেইস্থানে গমন করিয়া দেখিতে পাইলেন যে, বাড়ীর সদর দ্বার খোলা, এবং ঘরগুলি উন্মুক্ত অবস্থায় রহিয়াছে। উহার ভিতর দ্রব্যাদি কিছুই নাই, এবং মানিনী বা অপর লোকজন কেহই নাই। এই অবস্থা দেখিয়া সহজেই তিনি অনুমান করিলেন যে, এই বাড়ী পরিত্যাগ করিয়া মানিনী অন্য কোন স্থানে উঠিয়া গিয়াছেন। এইরূপ অবস্থায় উক্ত বাড়ী আরও দুই তিন দিবস পড়িয়া থাকার পর, বর্ত্তমান ভাড়াটিয়াকে উহা ভাড়া দিয়াছেন।

 যে যে স্থানে মানিনীর যাতায়াত ছিল, এবং যাহার যাহার সহিত তাঁহার আলাপ পরিচয় ছিল, ক্রমে বিপিন সেই সকল স্থানে মানিনীর অনুসন্ধান করিলেন। কিন্তু কোন স্থানে তাঁহার কোনরূপ সন্ধান না পাইয়া মনের দুঃখে দিনযাপন করিতে লাগিলেন।

 ইতিপূর্ব্বে বিপিন স্বপ্নেও মনে করেন নাই যে, যাহাকে তিনি প্রাণের সহিত ভালবাসেন, এবং যাহার নিমিত্ত তিনি আপন সহোদরকে পর্য্যন্ত পরিত্যাগ করিয়াছেন, সেই প্রাণের মানিনী তাঁহাকে এইরূপ ভাবে পরিত্যাগ করিয়া চলিয়া যাইবেন।

 এখন আর বিপিনের স্থান নাই। যাঁহাদিগকে বন্ধু বলিয়া তাঁহার মনে বিশ্বাস ছিল, এখন আর তাঁহারা তাঁহাকে আপন বাড়ীতে স্থান প্রদান করেন না। অথচ বিনাদোষে যে ভ্রাতাকে পরিত্যাগ করিয়া আসিয়াছেন, সামান্য পরিমাণ অর্থ দিয়া যাহার বিপদের সময় সাহায্য করিতে উপেক্ষা করিয়াছেন, আজ কি প্রকারে সেই ভ্রাতার নিকট গমন করিবেন, এবং সেই রাজকিশোরীকে কিরূপে আপন মুখ দেখাইবেন?

 যে ভ্রাতার সহিত নিতান্ত অসদ্ব্যবহার করিয়া বিপিন আপন স্ত্রীকে লইয়া চলিয়া আসিয়াছিলেন, নিতান্ত অনন্যোপায় হইয়া পুনরায় তাঁহাকে সেই ভ্রাতার নিকট গমন করিতে হইল। যে সময় বিপিন ভ্রাতার বাড়ীতে গমন করিলেন, সেই সময় রজনীকান্ত বাড়ীতে ছিলেন না, কার্য্যবশত স্থানান্তরে গমন করিয়াছিলেন। অশিক্ষিতা রাজকুমারী অতীব যত্নের সহিত আপন বাড়ীতে বিপিনের স্থান করিয়া দিলেন। বিপিন সেইস্থানে অবস্থান পূর্ব্বক আপনার শিক্ষিতা বনিতার অনুসন্ধান করিয়া বেড়াইতে লাগিলেন।

 এইরূপে প্রায় এক মাসাধিক কাল অতীত হইয়া গেল, কিন্তু বিপিন তাঁহার শিক্ষিতা বনিতা মানিনীর কোনরূপ সন্ধান করিয়া উঠিতে পারিলেন না। অথচ তাঁহার আশাকে হৃদয় হইতে একবারে দূরীভূত করিতে পারিলেন না। বিপিনের দৃঢ়বিশ্বাস ছিল যে, মানিনী প্রাণের সহিত তাহাকে ভালবাসেন, সুতরাং অবিশ্বাসিনীর কার্য্য তাঁহার দ্বারা কখনই হইতে পারে না। তা’ই মনে করিলেন যে, কোনরূপ বিপদে পতিতা হইয়া মানিনী তাঁহাকে কোনরূপ সংবাদ প্রদান করিতে সমর্থ হইতেছেন না। অনুসন্ধান করিলে নিশ্চয়ই তাঁহার কোন না কোন সন্ধান প্রাপ্ত হওয়া যাইবে।

 এদিকে ডাক্তার বাবু—যিনি আপন দেশে গমন করিতেছেন বলিয়া সেই স্থান পরিত্যাগ করিয়াছিলেন, তিনিও এ পর্য্যন্ত প্রত্যাগমন করিলেন না, বা তাঁহার কোনরূপ সংবাদও পাওয়া গেল না। সেই অবস্থা দেখিয়া বিপিনের মনে ইহাও একবার উদয় হইল, “হয় ত দুরবস্থায় পড়িয়া মানিনী ডাক্তার বাবুর সহিত তাঁহার দেশে গমন করিয়াছেন। কিন্তু কোনরূপ সুযোগ না পাওয়ায় প্রত্যাগমন করিতে পারিতেছেন না, এবং আমার বর্ত্তমান ঠিকানা জানিতে না পারায় পত্রাদিও লিখিতে পারিতেছেন না। ডাক্তার বাবু যে সময় এই স্থানে আগমন করিবেন, সেই সময় মানিনী তাঁহার সহিত নিশ্চয়ই আগমন করিবেন।”

 এইরূপ নানাপ্রকার ভাবনা ভাবিতে ভাবিতে বিপিন ক্রমে দিনযাপন করিতে লাগিলেন। দেনা পরিশোধ বা কোনরূপ কাজ-কর্ম্মের কোন চেষ্টাই করিলেন না। তাহার নিজের খরচ পত্র এখন রজনীকান্তের উপরে পতিত হইল।

 এইরূপে আরও কিছুদিবস অতীত হইয়া গেল, এক দিবস জানিতে পারিলেন যে, ডাক্তার বাবু তাঁহার দেশ হইতে প্রত্যাগমন করিয়াছেন। এই সংবাদ পাইবামাত্র দ্রুতগতি তাঁহার বাড়ীতে গমন করিলেন। ইচ্ছা—সেইস্থানে গমন করিবামাত্রই মানিনীর সহিত সাক্ষাৎ হইবে।

 বিপিন মনে যাহা ভাবিয়াছিলেন, ডাক্তার বাবুর নিকট গিয়া তাহার বিপরীত অবস্থা অবগত হইলেন। জানিতে পারিলেন যে, মানিনী ডাক্তার বাবুর সহিত গমন করেন নাই, বা তিনি কোথায় আছেন, তাহাও ডাক্তার বাবু অবগত নহেন। যে দিবস বিপিন জেলে গিয়াছিলেন, সেইদিবস হইতে মানিনীকে ডাক্তার বাবু দেখেন নাই, বা তাহার কোনরূপ সংবাদ অবগত হয়েন নাই।

 বিপিনের নিকট হইতে মানিনীর বিষয় কিছুমাত্র অবগত হইতে না পারিয়া ডাক্তার বাবু বিপিনের তখনকার দুঃখে বিশেষ রূপ সহানুভূতি দেখাইয়া দুঃখ প্রকাশ করিতে লাগিলেন, এবং তন্ন তন্ন করিয়া মানিনীকে অনুসন্ধান করিবেন বলিয়া বিপিনের নিকট প্রতিশ্রুত হইলেন।

 এই রূপে আরও কিছুদিবস অতীত হইয়া গেল। একদিবস সন্ধ্যার সময় বিপিন রাস্তা দিয়া গমন করিতেছেন, এরূপ সময় একখানি দ্বিতীয় শ্রেণী ঘোড়ার গাড়ীর প্রতি তাহার নয়ন আকৃষ্ট হইল। তিনি দেখিলেন যে, সেই গাড়ীর ভিতর দুইজন বসিয়া রহিয়াছেন, তাহার মধ্যে একজন পুরুষ ও অপরটী স্ত্রীলোক। এই স্ত্রীলোকটীকে হঠাৎ দেখিয়া মানিনীর মত অনুমান হইল, এবং পুরুষটীকে ডাক্তার বাবু বলিয়া বিবেচনা হইল। এই ব্যাপার দেখিয়া তিনি আরও উত্তমরূপে দেখিবার নিমিত্ত সেই দিকে যেমন লক্ষ্য করিবেন, অমনি গাড়ীর ঝিলমিল গাড়ীর ভিতর হইতে উঠাইয়া দেওয়া হইল, ও গাড়ী আরও দ্রুতবেগে চলিয়া গেল।

 যে দিবস বিপিন এই ঘটনা দেখিলেন, সেই দিবসই গিয়া তিনি ডাক্তার বাবুর সহিত সাক্ষাৎ করিলেন, এবং যাহা দেখিয়াছিলেন, তাহাও তাঁহার নিকট প্রকাশ করিয়া বলিলেন। উত্তরে ডাক্তার বাবু সে সমস্ত কথা অস্বীকার করিলেন ও কহিলেন যে, সেই দিবস সন্ধ্যার সময় তিনি কোন গাড়ীতে কোনস্থানে গমন করেন নাই।

 ডাক্তার বাবুর কথা এবার বিপিন বিশ্বাস করিলেন। কিন্তু পরক্ষণেই ভাবিলেন যে, যাহাকে আমি মানিনীর সহিত একত্র একগাড়ীর ভিতর দেখিয়াছি, তাঁহার কথা আমি কিরূপে বিশ্বাস করিতে পারি? আবার ভাবিলেন, ডাক্তার বাবু, আমার ও মানিনীর পরম বন্ধু, তাঁহাকেই বা অবিশ্বাস করি কি প্রকারে?

 এইরূপ নানাপ্রকার ভাবনা চিন্তার পর বিপিন বাড়ীতে প্রত্যাগমন করিলেন; কিন্তু তাঁহার মনের গোলযোগ মিটিল না; তথাপি নানাস্থানে তিনি মানিনীর অনুসন্ধান করিয়া বেড়াইতে লাগিলেন, কিন্তু কোনস্থানেই তাঁহার সন্ধান পাইলেন না।

 একদিবস সন্ধ্যার পূর্ব্বে বিপিন মনে করিলেন, সমস্ত কার্য্য পরিত্যাগ করিয়া রাত্রি দিন মানিনীর অনুসন্ধান করিয়া বেড়াইতে বেড়াইতে ক্রমেই শরীর দুর্ব্বল ও মন অস্থির হইয়া পড়িতেছে; আজ ময়দানে গমন করিয়া কিয়ৎক্ষণ পরিষ্কার বায়ু সেবন করিয়া দেখি, তাহাতেই যদি মনের অবস্থার কিছু পরিবর্ত্তন হয়।

 এই ভাবিয়া বিপিন ধীরে ধীরে পদব্রজে ক্রমে গড়ের মাঠে গিয়া উপনীত হইলেন, এবং ক্রমে ক্রমে ইডেন উদ্যানের নিকট গমন করিলেন। যে সময় তিনি ইডেন উদ্যানে গিয়া উপস্থিত হইলেন, সেই সময় সন্ধ্যা উওীর্ণ হইয়া গিয়াছে। উদ্যানের ভিতর কেল্লার গোরাগণ সমবেত হইয়া ব্যাণ্ড বাজাইয়া সমাগত ব্যক্তিগণের আনন্দ উৎপাদন করিতেছে। যাঁহারা গাড়ী করিয়া সন্ধ্যার সময় বায়ুসেবনে বহির্গত হইয়াছিলেন তাঁহাদিগের গাড়ী সমূহ উদ্যানে পশ্চিম পার্শ্বে সমবেত হইয়াছে। তাঁহারা গাড়ীর ভিতর উপবেশন করিয়াই মনোহর বাদ্য শ্রবণ করিতেছেন!

 কিয়ৎক্ষণ উদ্যানের ভিতর ভ্রমণ করিবার পর আর তাহা বিপিনের ভাল লাগিল না, তিনি উদ্যানের পশ্চিম দ্বার দিয়া বহির্গত হইয়া যে স্থানে গাড়ী সকল দণ্ডায়মান ছিল, সেই স্থান দিয়া গমন করিতে লাগিলেন। কিয়দ্দূর গমন করিবার পর একখানি দ্বিতীয় শ্রেণীর গাড়ীর প্রতি তাহার নয়ন আকৃষ্ট হইল। তাঁহার বেশ বোধ হইল যে, সেই গাড়ীর ভিতর প্রাণের শিক্ষিতা মানিনী, এবং পরম বন্ধু ডাক্তার বাবু বসিয়া আছেন। এই ব্যাপার দেখিয়া তাঁহার মনের গতি যে কি হইল, তাহা পাঠকগণ সহজে অনুমান করিয়া লউন। বিপিন আস্তে আস্তে গাড়ীর নিকট গমন করিলেন। তাঁহাকে দেখিবামাত্রই ডাক্তারবাবু বিশেষরূপ লজ্জিত হইলেন ও কহিলেন, “কে, বিপিন! তুমি কোথা হইতে এখানে আগমন করিলে? তোমার সহিত সাক্ষাৎ হইবার পর হইতেই আমি সমধিক যত্ন ও পরিশ্রম করিয়া মানিনীর অনুসন্ধান করিয়া ঘুরিয়া বেড়াইতেছিলাম; কিন্তু এতদিবস কোনরূপে ইহাঁর কোনরূপ সন্ধান পাই নাই। আজ আমি একজন যোগীকে দেখিবার নিমিত্ত গমন করিয়াছিলাম। সেইস্থান হইতে প্রত্যাগমন করিবার সময় পথিমধ্যে মানিনীর সহিত সাক্ষাৎ হইল। এতদিবস পর্য্যন্ত ইনি কোথায় ছিলেন, জানিবার নিমিত্ত আমার মনে বিশেষরূপ কৌতূহল জন্মিল। আমি ইহাঁর গাড়ী দাঁড় করাইয়া সেই গাড়ীতেই উঠিলাম, এবং ইহাঁর সহিত কথা বলিতে বলিতে ক্রমে এইস্থানে আসিয়া উপস্থিত হইয়াছি।”

 অনেক দিবস পরে মানিনীকে দর্শন করিয়া বিপিনের মনের গতি যেরূপ হইয়াছিল, তাহাতে উক্ত ডাক্তার বাবু যাহা কহিলেন, তাহা তিনি শুনিতে পাইলেন, কি না, এবং যদি শুনিতেও পাইলেন তাহা হইলে তাহার অর্থ সংগ্রহ করিতে পারিলেন কি না, জানি না। কিন্তু সকলে দেখিলেন যে, মানিনীকে দর্শন করিবার পর বিপিনের মুখ হইতে একটা কথাও বহির্গত হইল না, তিনি গাড়ী ধরিয়া কিয়ৎক্ষণ স্থিরমনে দণ্ডায়মান রহিলেন। আর ডাক্তার বাবু পূর্ব্ববর্ণিত কথাগুলি বর্ণন করিতে লাগিলেন।

 এইরূপে কিয়ৎক্ষণ অতিবাহিত হইলে বিপিন কহিলেন, “মানিনী! তুমি এতদিবস কোথায় ছিলে? তোমার অদর্শনে ও তোমার পত্রাদি না পাইয়া আমি যে কিরূপ কষ্ট ভোগ করিয়া আসিতেছি, তাহা আর তোমাকে কি বলিব মানিনী! তোমার নিমিত্ত আমাকে সর্ব্ব কর্ম্ম পরিত্যাগ করিতে হইয়াছে, এবং এ পর্য্যন্ত কোন কর্ম্ম না করিয়া নানাস্থানে কেবল তোমারই অনুসন্ধান করিয়া ঘুরিয়া বেড়াইতেছি, তুমি ভাল ছিলে ত?”

 উত্তরে মানিনী কহিল, “মানিনীর নাম মুখে আনিতে তোর লজ্জা করিতেছে না। রাত্রি দিন কেবল তারই অনুসন্ধান করিয়া বেড়াইতে তুই একটু কুণ্ঠিত হইতেছিস না। যাহাকে একমুষ্টি অন্ন দিবার সংস্থান তোর নাই, যাহার একসুট পোষাক খরিদ করিয়া দিতে তুই অসমর্থ, তাহাকে স্ত্রী বলিতে ও তাহার অনুসন্ধান করিতে তোর একটু লজ্জাও হইতেছে না? আমি ভদ্রলোকের কন্যা ও শিক্ষিতা, তা’ই বিশেষরূপ কষ্ট ভোগ করিয়াও কিছুদিবস তোর অনুগত হইয়াছিলাম। কোন অশিক্ষিতা স্ত্রীলোক হইলে দেখ্‌তিস, তিন দিবসের মধ্যে তোকে পরিত্যাগ করিয়া কোথায় চলিয়া যাইত। কিন্তু আমি ততদূর করি নাই, আমার ধর্ম আমি রাখিয়াছি। সবিশেষ কষ্টে পড়িয়াও একাদিক্রমে কয়েক বৎসর তোর সহবাসে কাল কাটাইয়াছি। প্রথম হইতে যদি আমি বুঝিতে পারিতাম যে, আমার খরচ পত্রের সংস্থান করিবার ক্ষমতা তোর নাই, তাহা হইলে এত সময় আমি কখন কি নষ্ট করিতাম? না তোর নিকট থাকিয়া এত কষ্ট অনুভব করিতাম? এখন তোকে বলিতেছি, তুই আমার সম্মুখ হইতে প্রস্থান কর, এবং আমার আশা পরিত্যাগ করিয়া কোন অশিক্ষিত স্ত্রীলোকের চেষ্টা দেখ্‌।”

 এই বলিয়া গাড়ীর যে পার্শ্বে বিপিন দণ্ডায়মান ছিল, তাহার বিপরীত পার্শ্ব দিয়া আপনার গলা বাহির করিয়া গাড়িবানকে গাড়ী হাঁকাইতে কহিল। আদেশ পাইবামাত্র গাড়িবান বিপিনকে পশ্চাদপদ হইতে কহিয়া আপনার গাড়ী হাঁকাইয়া দিল। কোনরূপে আপনার পা বাঁচাইয়া বিপিনও গাড়ীর পশ্চাৎ পশ্চাৎ “একটু দাঁড়াও একটু দাঁড়াও” বলিতে বলিতে গমন করিতে লাগিলেন; কিন্তু মানিনী গাড়ীর ভিতর হইতে কহিতে লাগিলেন, “জোরসে হাঁকাও।” কাজেই গাড়ী দ্রুতগতি চলিতে লাগিল। অনন্যোপায় হইয়া বিপিন ক্ষান্ত হইলেন; কিন্তু বহুদূর পর্য্যন্ত তিনি সেই গাড়ীর উপর লক্ষ্য করিয়া রহিলেন। গাড়ী ক্রমে অদৃশ্য হইয়া গেল। যে সময় বিপিন একদৃষ্টে গাড়ীর দিকে চাহিয়াছিলেন, সেই সময় সেই ভাড়াটিয়া গাড়ীর পশ্চাৎ সংবদ্ধ নম্বরের উপর তাঁহার দৃষ্টি পড়িয়াছিল। তিনি দেখিলেন, সেই গাড়ীর নম্বর ২৫৯।

 বিপিনের উপর মানিনী যদিও এইরূপ কঠোর বাক্য প্রয়োগ করিয়া চলিয়া গিয়াছিল, তথাপি বিপিন তাহার উপর একবারে অসন্তুষ্ট হইলেন না। ভাবিলেন, মানিনী নিতান্ত কষ্টে পড়িয়াছে বলিয়াই, তাঁহার মুখ হইতে ঐরূপ কঠোর বাক্য নির্গত হইল। উহা মুখের বাক্য মাত্র—অন্তরের নহে।

 আরও ভাবিলেন যে, যখন ডাক্তার বাবু মানিনীর গাড়ীতে আছেন, তখন আর ভাবনা কিসের? আমাকে এইরূপ ভয় প্রদর্শন করিয়া, সে হয়—আমার বাটীতেই গমন করিল, না হয়—এতক্ষণ ডাক্তার বাবুর বাসায় গিয়া উপস্থিত হইল।

 সেইস্থানে গমন করিলে নিশ্চয় তাঁহার সহিত সাক্ষাৎ হইবে, তখন জানিতে পারিব, এতদিবস পর্য্যন্ত তিনি কোথায় ছিলেন, এবং কিরূপ কষ্টে তিনি তাঁহার দিন অতিবাহিত করিয়াছেন।

 মনে মনে এইরূপ ভাবিয়া বিপিন সেইস্থান হইতে দ্রুতপদে চলিতে লাগিলেন; কিন্তু তাহাতেও তিনি সন্তুষ্ট না হইয়া, রাস্তা হইতে একখানি গাড়ী ভাড়া করিয়া আপন বাটীতে গিয়া উপস্থিত হইলেন।