কুলী

 সে অনেক দিনের কথা। ঠিক কত দিনের কথা ইতিহাসও তা বলতে পারে না। জাপানের বড় সহরে এক কুলী ছিল। তার কাজ ছিল রাস্তায় বসে পাথর ভাঙ্গা। রোদ নেই, বৃষ্টি নেই সে কেবলই পাথর ভাঙ্গছে। রোদে মুখ কালো হ’য়ে গিয়েছিল, আর বেশী বৃষ্টিতে মাথার সব চুল উঠে গিয়েছিল, তবু তার কাজের বিরাম ছিল না। দারুণ রোদে সবাই সরবৎ খাচ্ছে আর খোলার ঘরে ঘুমুচ্ছে, বেচারী খোলা রাস্তায় রোদে ঘামছে, পিপাসায় প্রাণ বেরিয়ে যাচ্ছে, তবু তার হাতুড়ী চলছে খট্‌ খট্‌।

 একদিন হঠাৎ তার মনে বড় দুঃখ হল। সে বিড়্‌ বিড়্‌ ক’রে বকতে সুরু করলে, “ভগবানের কি অন্যায়! সেই কোন ভোরে রাস্তায় বসেছি পাথর ভাঙ্গতে, আর উঠব সেই এক প্রহর রাতে—এর মধ্যে খাওয়া নেই, বিশ্রাম নেই। যদি বড় লোক হতে পারতাম! সকাল বেলা কাজের কোন তাড়া নেই, ন’টার সময় ঘুম ভাঙ্গল, চাকর-বাকর সব সামনে খাবার নিয়ে হাজির আছে, ভাল ভাল ফলমূল খেয়ে দিব্যি আরামে ঘুমুতে লাগলাম; চাকর বাতাস করতে লাগল। পিপাসার সময় গেলাসখানেক আপেলের রস খেলাম; সন্ধ্যার সময় ফুলেল আতর মেখে তাঞ্জামে চেপে ঘুরে এলাম, তার পরেই ভরপেট খেয়ে এক ঘুম। তার পরদিন আবার বেলা নটা। কি স্ফূর্ত্তিই হ’ত তাহলে।”

 আকাশ দিয়ে দেবদূত যাচ্ছিলেন। কুলীর কথা শুনতে পেলেন। তাঁরা দেবদূত, অতি ছোট কথাও শুনতে পান। এমন কি মানুষের মনের কথা পর্য্যন্ত। তাই কুলীর মনের কথা শুনে বললেন, “আচ্ছা তাই হোক।”

 হঠাৎ কুলীর মনে হ’ল, হাত খালি হাতুড়ী নেই। চার পাশে চেয়ে দেখে, লোকেরা কেউ বাতাস কচ্ছে, কেউ খাবার হাতে ক’রে দাঁড়িয়ে আছে। কোথায় হাতুড়ী, আর কোথায় পাথর! সে বসে আছে নরম গালিচার উপর। হাতে হাতুড়ীর বদলে মসলা ভরা একটী সোনার পানের ডিবে। দেখে শুনে কুলীর মন খুসী হ’য়ে উঠল। ছিল কুলী হ’ল জমিদার। সে কেবলই হুকুম চালাতে লাগল।

আকাশ দিয়ে দেবদূত যাচ্ছিলেন
 সন্ধ্যার সময় হাজার পাইক বরকন্দাজ সঙ্গে মিকাডো যাচ্ছেন। জাপানের সম্রাটকে ‘মিকাডো’ বলে। মিকাডোর সামনে রসুনচৌকী বাজাতে বাজাতে লোকজন চলেছে। কত হাতী ঘোড়া লোক লস্কর। কুলীর হিংসা হল। সে জিজ্ঞাসা করলে, “এত সোরগোল করে যায় কে হে, আমার বাড়ীর সামনে দিয়ে?” চাকর জবাব দিল, “উনি হচ্ছেন এদেশের রাজা, মিকাডো।” “মিকাডো কি আমার চেয়ে বড়?” “আজ্ঞে হ্যাঁ, হুজুর।”

 “বটে! আমার চেয়ে বড় লোকও এদেশে আছে দেখছি। হায়, হায়! জমিদার না হয়ে একেবারে মিকাডো হ’তে চাইলেই তো ভাল হোতো। একেবারে দেশের রাজা হতাম, কারো তোয়াক্কা রাখতাম না।”

 আকাশে দেবদূত ছিলেন, বললেন “তাই হবে।”

 হঠাৎ কুলীর বোধ হল হাতে আর মাথায় মস্ত বোঝা। চেয়ে দেখে হাতে সোনার ডিবের বদলে প্রকাণ্ড এক সোনার ডাণ্ডা;—মাথায় টাকের উপর দু’সের এক সোনার মুকুট! গালিচার জায়গায় এক সিংহাসনে সে ব’সে, আর সামনে চাকর বাকরের জায়গায় মন্ত্রীরা সব সার-বেঁধে দাড়িয়ে। তার পেছনেই সৈন্য-সামন্তের দলে দলে পায়চারি করে বেড়াচ্ছে। দু’জন দাসী, দুদিকে চামর ঢুলাচ্ছে। আর এক সিপাহী প্রকাণ্ড এক হীরে বসান সোনার ছাতা মাথার উপর ধরে আছে। কুলী একটু অবাক হয়ে সামনের দাড়ীওয়ালা মন্ত্রীকে জিজ্ঞাসা করলে, “আমি কে হে?”

 বুড়ো মন্ত্রী জবাব দিলে, “আপনি? আপনি পৃথিবীর ঈশ্বর। মহিমান্বিত জাপানের সম্রাট। আপনার ইচ্ছাই পৃথিবীর আইন, আপনার ইঙ্গিতেই আদেশ—সমস্ত পৃথিবী তা মেনে চলতে বাধ্য! আমরা সকলে আপনার দাসানুদাস,—আদেশের প্রার্থী, করুণার প্রার্থী।”

 “বেশ, ভাল! ভাল! আমি তা হলে মিকাডো। জাপান আমার, পৃথিবী আমার কি বল? এই সৈন্য-সামন্ত এরাও আমার?”

 “হাঁ রাজরাজেশ্বর।”

 “তবে এদের হুকুম দাও, পৃথিবীতে জাপান ছাড়া যত দেশ আছে সব জয় করে আস্থক।” “যে আজ্ঞা।” মন্ত্রী সম্রাটের আদেশ জানালে সেনারা জয়ধ্বনি করতে করতে যাত্রা করলো।

 এদিকে দিন কয়েক থেকে দারুণ রোদে পৃথিবী শুদ্ধ লোকজন অস্থির। একমাস মোটে বৃষ্টি নেই। গাছপালা সব রোদে কালো হয়ে গেছে। নদীতে জল নেই, সমুদ্রের তল পর্য্যন্ত দেখা যাচ্ছে।

 সেদিন দরবার। দেশের গণ্যমান্ত লোকজনদের নিমন্ত্রণ হয়েছে। মিকাডো মন্ত্রী পারিষদ সঙ্গে ক’রে অপেক্ষা করে বসে আছেন,—কেউ আর আসে না। দূত এসে খবর দিলে কেউ আজ আসবে না।

 মিকাডো গরম হয়ে বললেন, “আসবে না কেউ? কেন?”

 “সম্রাট! রোদে কারো বেরোবার যে নেই। গাছপালা সব পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। পথ-ঘাট তেতে আগুন।”

 “বটে। এতদূর আস্পর্দ্ধা সূর্য্যের। যাও উজীর বল সূর্য্যকে যে, মিকাডো তাকে আকাশ থেকে চলে যেতে হুকুম করলেন।”

 মন্ত্রী গিয়ে ফিরে এসে বললেন, “সম্রাট ভয় হচ্ছে, সূর্য্য আপনার আদেশ গ্রাহ্যই করলে না।”

 “বটে, নিয়ে যাও ফৌজ; বেটাকে বেঁধে নিয়ে এস।”

 খানিকক্ষণ পরে মন্ত্রী ও ফৌজ সব ফিরে এল। মন্ত্রী মুখ নীচু করে বল্লেন, “সম্রাট তাজ্জব ব্যাপার! সূর্য্য বেটাকে ধরা গেল না। অনেক উঁচুতে রয়েছে সে। যতই উঁচুতে উঠছি ততই আরও উঁচুতে উঠে যাচ্ছে। এখন কি আদেশ হয়?”

 মিকাডোর বড় দুঃখ হল, বললেন, “এরকম রাজত্ব ক’রে লাভ কি? একটা আকাশের জোনাকি, সেও স্বচ্ছন্দে আমার হুকুম অগ্রাহ করলে! আশ্চর্য্য! একবার সূর্য্য হতে পারলে” কথা শেষ না হতে হতেই কুলী হু হু শব্দে আকাশে উঠতে লাগল। দেবদূত দূর থেকে হাসতে লাগলেন।

 ছোটলোক যদি হঠাৎ বড় হয়, তা হলে তার মনের অবস্থা কেমন হয়, তা তোমরা জান। আকাশে উঠেই কুলী আপনার প্রতাপ প্রকাশ করা হুরু করে দিল। লোকের প্রাণ যায়। ভোর না হতেই কুলী এমন প্রচণ্ড রোদ ছাড়তে আরম্ভ করে দিল, তা দেখে আসল সূর্য্যেরও মুখ কালী হয়ে গেল। গাছপালা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেল। মানুষ, পশু পক্ষীর গায়ের রক্ত শুকিয়ে গেল। মাটি ফেটে চৌচির হয়ে গেল।

 দেবতারা প্রমাদ গণলেন। তাঁরা যুক্তি করে প্রকাণ্ড একখানা মেঘকে হুকুম করলেন, “যাও তো হে, তুমি এক বার সূর্য্য বেটাকে ঢেকে খানিকটা বৃষ্টি করে দিয়ে এস, নৈলে যে সৃষ্টি রসাতলে যায়।” মেঘ “যে আজ্ঞা” বলে এসে সূর্য্যকে আড়াল করে বৃষ্টি আরম্ভ করে দিল। লোকের প্রাণ বাঁচল। সকলে রাশি রাশি ফুল ফল এনে মেঘকে পূজা কর্ত্তে বসল। দেখে কুলীর মাথা হয়ে গেল গরম। “বটে! একটা ফড়িং মেঘ,—হাওয়া লাগলে উড়ে যাবেন সাত সমুদ্দর পারে; বেটার আস্পর্দ্ধা ত কম নয়! এও দেখছি আমাকে গ্রাহ্য করে না। সূর্য্য না হয়ে যদি মেঘ হতাম—” যেই বলা অমনি কুলী দেখলে যে শরীরটা অনেকখানি হালকা হয়ে গেছে। চোখ মেলে দেখলে যে আকাশের মাঝখানে প্রকাণ্ড একখানা মেঘ হয়ে সে দাঁড়িয়ে আছে। “আচ্ছা রোসো, এইবার দেখছি কোন্‌ বেটা মেঘ আমার সঙ্গে টক্কর দেয়, এমন জলই ঢালব—” বলেই কুলী বৃষ্টি আরম্ভ করল। সাতদিন সাতরাত বৃষ্টি আর থামে না, রাস্তা ভেসে নদী হল। খাল বিল ভরে গেল। সমুদ্র ছেপে উঠে দেশ ভাসিয়ে দিল। জীব-জন্তু সব জলে ভাসতে লাগল। দেশে হাহাকার উঠল। শস্য নষ্ট হল। দেশে দুর্ভিক্ষ হল। রাজরাজড়া ভিখারী হলেন। তবুও বৃষ্টি থামে না। এমন সময় কুলী দেখলে যে এত বৃষ্টিতেও একটা পাহাড় কিছুতে গলছে না। বড় বড় গাছপালা ভেসে গেল, দালান-কোঠা খসে পড়ল। কিন্তু পাহাড় সেই যে চুপচাপ বসে রয়েছে—যেন পৃথিবীতে কিছুই হচ্ছেনা। তখন কুলীর বড় অপমান বোধ হল। সে বলে উঠল, “হায়রে! এত করেও পৃথিবীর সমস্ত জিনিষগুলো একসঙ্গে জব্দ করতে পারলাম না। যদি পাহাড় হতাম! দেবদূত দূরে দাঁড়িয়েছিলেন, হেসে বললেন, “তথাস্তু!” কুলী একেবারে আকাশ থেকে ঝুপ করে একটা পাহাড় হয়ে রাস্তার ধারে পড়ে গেল। বৃষ্টি থামল, সৃষ্টি বাঁচল।

 পাহাড় হয়ে কুলী ভাবল, “এই ঠিক, এই আমার বেশ হয়েছে। কত বাঘ ভালুক—যাদের দেখলে বড় বড় জোয়ান আঁৎকে উঠে—তারা বুকের উপর দিয়ে চলে যাচ্ছে, মনে হচ্ছে যেন পিঁপড়ে। আমার মত বীর কে?” কুলী খুলী হয়ে কিছু দিন রইল। এই রকমে দিন যায়। কুলী নিশ্চিন্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়ল।

 এমন সময় সহরে নতুন রাস্তা তৈরী হবে। মিকাডো রাজ্যের যত পাথর ভাঙ্গতে হুকুম দিলেন। লাখ কুলী শাবল আর হাতুড়ী দিয়ে যত পাহাড় ভাঙ্গতে সুরু করে দিল। হঠাৎ কুলীর ঘুম ভেঙ্গে গেল। পায়ে যেন কে খোঁচাচ্ছে। চোখ মেলে দেখে তারই আগেকার চেহারার মত এক কুলী বিড়ি টানতে টানতে হাতুড়ী দিয়ে তাকেই ভাঙ্গছে। কুলী চটে লাল হয়ে গেল। আমাকে ভাঙ্গে! কিন্তু করবেন কি? হাত-পা নাড়বার যো নাই। হাতুড়ী পড়ছে খট্‌ খট্‌। নাঃ—আর না—এর চেয়ে কুলী হওয়াই ভাল। তা হ’লে শাবল দিয়ে যাকে ইচ্ছা তাকে—অমনি দেবদূত অট্টহাস্য করে বললেন, “তাই হোক! ঘুরে ফিরে তাই হও, সেই তোমার ভাল। কিছুতে যার সন্তোষ নেই, তার উন্নতি কোন মতে হয় না। এইটে ভেবে রেখো।” বলে দেবদূত আকাশে চলে গেলেন। কুলী সেই রাস্তার ধারে রোদে বসে হাতুড়ী শাবল নিয়ে পাথর ভাঙ্গতে লাগল। এবার আর তার কোন আপত্তি ছিল না। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্য্যন্ত রোদে পুড়ে, বৃষ্টিতে ভিজে সে পাথর ভাঙ্গত। কোন দিক চাইত না—কারে উপর আর হিংসা করত না।


 ফরাসী গল্পলেখক কোরেত্রেল হইতে