মায়াবাঁশী/তপস্বী
তপস্বী
এসিয়া মহাদেশে অতি প্রাচীন কালে বাবিলন রাজ্য ছিল। আজ বাবিলনের নাম মাত্র আছে। সে ধন-দৌলত সৈন্য-সামন্তের চিহ্নমাত্র নেই। এক সময়ে বাবিলনের রাজা ছিলেন মোয়াবদার। তাঁর সময়ে রূপবান, গুণবান ও ধনী এক যুবক, জডিগ তার নাম, সেই দেশে বাস করত। সংসারের শোকতাপ পেয়ে তার মনে হঠাৎ দারুণ বৈরাগ্যের উদয় হ'ল; সে লোটা আর লাঠি হাতে বাড়ীঘর ছেড়ে বেরিয়ে একেবারে ইউফ্রেতিস নদীর ধার দিয়ে চলতে আরম্ভ করল। ইউফ্রেতিস প্রকাণ্ড নদী। আজ যদি কেউ তোমরা পারশ্য দেশ দেখতে যাও, তবে সে নদী দেখতে পাবে। সকালে সে চলতে সুরু করত, সন্ধ্যা পর্য্যন্ত একটানা সমান চ’লে যেত—কোথাও থামত না। তার উদ্দেশ্য ছিল, তত্ত্বজ্ঞান লাভ করা। কিছুদিন ভ্রমণের পর সে দেখলে যে, তত্ত্বজ্ঞানের পরিবর্ত্তে সে দারুণ বাতব্যাধি লাভ ক’রেছে। তখন জডিগ দিন কয়েকের জন্য বিশ্রাম করবার মৎলব ক’রে এক গ্রামের দিকে চলল। গ্রামে ঢুকতেই সে দেখে যে এক সাধু একটি খেজুর গাছের নীচে ব’সে প্রকাণ্ড একখানা পুঁথি খুলে বসে খেজুর খাচ্ছেন। একরাশ সাদা লম্বা চুল তাঁর ঘাড়ের উপর এসে পড়েছে। মাথার চুল থেকে পরণের পায়জামাটি পর্য্যন্ত তাঁর ধবধবে সাদা। দেখে জডিগের মনে বড় ভক্তি হ’ল। সে সাধুর কাছে গিয়ে নমস্কার করে বললে, “প্রভু, প্রকাণ্ড কেতাব খানা কি?” “এটা হচ্ছে, অদৃষ্টের পুঁথি। তুমি তো বাপু তত্ত্বজ্ঞান লাভ করবার জন্য ঘুরে মরছ; দেখ দেখি বুঝতে পার কি না।” বলে সাধু বইখানা জডিগের হাতে তুলে দিলেন। খাতা খুলেই জডিগের চক্ষু স্থির! পৃথিবীর অনেকগুলি ভাষা সে জানত, কিন্তু এ রকম অদ্ভুত অক্ষর কোনো দিন তার চোখে এ পর্য্যন্ত পড়েনি।
“কিছুই তো বুঝতে পারলাম না, প্রভু,” ব’লে জডিগ বইটা সাধুর হাতে দিল।
“বুঝবে হে বাপু, বুঝবে। দিনকতক থাক আমার সঙ্গে, সব তোমাকে বুঝিয়ে দেব।”
“আমারও তাই ইচ্ছা। আপনার সেবা ক’রেই জীবন কাটাতে ইচ্ছা ক’রেছি।”
“তা বেশ ভাল কথা। তবে একটি কথা এই যে আমার কোনও ব্যবহার যদি অদ্ভুত ঠেকে তবে আমাকে কিছু বোলো না। শুধু দেখে যেও। যদি কিছু বল, কিম্বা আমার কোনও কাজে বাধা দেও, তবে আর আমাকে দেখতে পাবে না!“
“আচ্ছা তাই হবে” ব’লে জডিগ সাধুর সেবায় মন দিল।
দিন কয়েক এম্নি ক’রে কাটল। একদিন সাধু বললেন, “চলহে, দেশ-ভ্রমণ ক’রে আসা যাক। কেমন যাবে?”
“আজ্ঞে যাব বৈ কি।”
“তবে চল। কিন্তু আমার উপদেশটা যেন মনে থাকে। আমার কোনও কাজে বাধা দিতে পারবে না।” ব’লে সাধু জডিগকে সঙ্গে নিয়ে বেরোলেন।
দুইজনে সমস্ত দিনমান চ’লে এক রাজ্যে উপস্থিত হলেন। তার সোনার সিংহদ্বারের উপরে হীরার গম্বুজ। তার উপরে লাল পতাকায় মুক্তার ঝালর। সিপাহী শান্ত্রীদের পোষাকে সব জরির কাজ করা। জডিগ দেখে অবাক হ’য়ে গেল। সাধুকে জিজ্ঞাসা করলে, “এদেশের নাম কি প্রভু?” সাধু বললেন, “দেশের নাম, সোনার দেশ। এ দেশের মত ঐশ্বর্য্য আর কোন দেশের নেই।” সাধু সিংহদ্বার দিয়ে নগরে প্রবেশ করলেন। জডিগ ভয়ে ভয়ে তার সঙ্গে চলল। খানিক দূর গিয়ে জডিগ দেখলে যে প্রকাণ্ড বাড়ী, তার চারি পাশে হাজার হাজার লোক;—কেউ গান গাচ্ছে, কেউ খেলছে, কেউ বাজাচ্ছে—এই রকম। কারো যে কোনরূপ চিন্তা আছে দেখে তা বোধ হয় না।
বাড়ীর দরজায় রূপার চৌকাটে সোণার কবাট, তাতে নানা রকম হীরা মাণিক বসানো। দরজার দুপাশে দুটি সিংহ দুটি পোষা কুকুরের মত ব’সে আছে। তাদের দেখেই জডিগ ভয়ে থমকে গেল।
“ভয় কি হে, চলে এস।” ব’লে সাধু একেবারে জডিগের হাত ধ’রে যে ঘরে বাড়ীর কর্ত্তা ভোজে ব’সেছিলেন সেই ঘরে গিয়ে উপস্থিত। তাঁরা যেতেই চাকর এসে দু’জনকে এক রূপার টেবিলের ধারে বসিয়ে দিল। টেবিলের উপর রাজ্যের ফল মূল, নানারকম সুখাদ্য ব্যঞ্জন। সারাদিন হেঁটে হেঁটে জডিগের বেশ ক্ষুধা বোধ হ’য়েছিল। সাধুর জন্য অপেক্ষা করবার আর তার সবুর সইল না। সে খেতে বসে গেল। আহার শেষ হ’লে তাঁদের হাত ধোবার জন্য তক্মাপরা এক চাপরাশী এসে সোনার ঘটিতে জল দিয়ে গেল। বাড়ীর কর্ত্তা কিন্তু আপন মনে বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে গল্প ক’রে যাচ্ছেন, যেন এই অতিথিদের সঙ্গে কথা বলবারও তাঁর ফুরসৎ নেই। সমস্ত কাজ কলের মত হ’য়ে যাচ্ছে। খানিকক্ষণ পরে রাত্রি যখন গভীর হয়ে এল, তখন এক চাকর এসে সাধু আর জডিগকে একটা প্রকাণ্ড আয়নামোড়া ঘরে ডেকে নিয়ে গেল। সেখানে সোনার পালঙ্কে পালকের গদী। পালঙ্কের ধারে কার্পেটের পাপোষ। ঘরের কোণে টেবিলের উপর সোনার ঘটিতে মুখ ধোবার জল। সমস্ত ঘরে সোনা রূপার জিনিসের ছড়াছড়ি। দেখে জডিগ কেবলই অবাক হয়ে ভাবছিল, আর সাধু হাসছিলেন। এই ঘরে তাঁদের রেখে চাকর চলে গেল। তখন সাধু জডিগকে বললেন, “এখন চল বেরিয়ে পড়া যাক।” “এত রাত্রে কোথায় যাবেন?”—জডিগ বললে। “যে দিকে দুই চক্ষু যায়, চল।” ব’লে জডিগের হাত ধরে সাধু চোরের মত ঘরের পিছনের দরজা দিয়ে পথে বেরিয়ে পড়লেন, যাবার সময় ঘরের সোনার ঘটীটা ঝোলার ভিতর নিয়ে গেলেন।
লডিগ দেখলে, কিন্তু কোনও কথা বললে না। মনে কিন্তু তার বড় রাগ হ’ল। লোকটা চর্ব্বচোষ্য দিয়ে পেট ভরে খাওয়ালে, আর কিনা তারই জিনিস চুরি করা! কিন্তু মুখ বন্ধ। কিছু বলবার যে নেই। কাজেই মনের রাগ মনে চেপে সাধুর সঙ্গে সে চলতে লাগল।
পথে পথেই সারা দিনমান কাটল। সন্ধ্যাকালে এক গ্রামে এসে দুজনে উপস্থিত হলেন। সেখানে এক বাড়ীর দরজায় দাঁড়িয়ে সাধু হাঁকলেন, “কে আছ? দরজা খুলে দাও।” প্রথম ডাকে কেউ সাড়া দিল না। তারপর সাধু জোরে দরজায় এক ধাক্কা দিতেই ভিতর থেকে কেউ নাকিসুরে বললে, “বাড়ীতে কেউ নেই।”
সাধু হেসে বললেন, “কি রকম কথা! এই যে কথা বলছ!”
“তাতে কি তোমার? আমি যদি দরজা না খুলি।”
“দরজা তোমাকে খুলতেই হবে। যদি না খোল তবে এমন ধাক্কা দেব যে, দরজা কেন তোমার বাড়ীশুদ্ধ ভেঙ্গে পড়বে।”
অমনি ভিতর থেকে সেই নাকিসুর চীৎকার ক’রে উঠল, “এই খুলছি, খুলচি, দরজা ভেঙ্গ না, দরজা ভেঙ্গ না।”
সরাই আছে সেইখানে যাও এই বলতে বলতে একজন লম্বা এবং রোগা গোছের ভদ্রলোক বেরিয়ে এলেন। তাঁর গায়ে একটা ছেঁড়া জামা, একটা হাতা লম্বা, আর একটা ইঁদুরে কেটে অর্দ্ধেক করে ফেলেছে। মুখ শুকনো। প্রকাণ্ড গোঁফ জোড়াটি সিন্ধু-ঘোটকের দাঁতের মত নীচের থেকে ঝুলে প’ড়েছে। তিনি দুটি অপরিচিত লোককে দেখেই জিজ্ঞেস করলেন, “এত রাতে কি চাও তোমরা?“
সাধু একটা নমস্কার করে বললেন, “মহাশয়ের নাম শুনেছি। আজ রাত্রের মত একটু আশ্রয় চাই।“
“আশ্রয়? ও সব এখানে হবে না। সরাই আছে, সেইখানে যাও।“
সাধু বললেন, “পয়সা নেই, মশাই, কাজেই সরাইমুখো আর হইনি। তা মহাশয়ের এখানেই আজ রাতে—কি বল জডিগ?“
জডিগ তার কি বলে? কর্ত্তার মুখ দেখেই তার ক্ষুধা পালিয়ে গেছে। তবুও কাষ্ঠ হাসি হেসে বললে, “কাজেই।“
তখন সাধু ঘরে ঢুকতেই বাড়ীর কর্ত্তা দরজা দুহাতে আগুলে বললেন, “বেরোও আমার বাড়ী থেকে! বেরোও—ভণ্ড তপস্বী, চোর জোচ্চোর!“আরো বোধ হয় কিছু তার বলবার ইচ্ছা ছিল, কিন্তু জডিগের রুক্ষমূর্ত্তি দেখে কিছু বলতে পারলে না। সাধু ইতিমধ্যে ঘরে ঢুকেই দেখেন যে, টেবিলের উপর খানদুই পোড়া রুটী আর এক গেলাস জল। তখন আর বাক্যব্যয় না করে একখানা রুটী মুখে দিয়েই ইসারায় জডিগকে ডাকলেন। জডিগ এসে রাকী একখানা গালে পুরে চুপচাপ বসে রইল। বাড়ীর কর্ত্তার তো চক্ষুস্থির! এরকম অদ্ভুত রকমের অতিথি তাঁর ভাগ্যে পূর্ব্বে আর জোটেনি। সাধু হেসে কর্ত্তাকে বললেন, “আপনি ব্যস্ত হবেন না। আমাদের শোবার বন্দোবস্ত আমরা নিজেরাই করে নিচ্ছি।” এই বলেই একেবারে ঘরের কোণে খাটিয়ায় খড়ের যে বিছানা পাতা ছিল তারই উপর গিয়ে শুয়ে পড়লেন। জডিগ চারদিকে চেয়ে দেখ্লে, শোবার মত বিছানা আর কোথাও নেই। সে তাড়াতাড়ি টেবিলের উপর থেকে রেকাবী আর গেলাসটা সরিয়ে রেখে সেইখানে গায়ের চাদরটা বিছিয়ে সটান শুয়ে পড়ল। অতিথিদের ব্যবহার দেখে কর্ত্তাবাবু একেবারে হতভম্ব। কি আর করবেন? জডিগের পালোয়ানের মত চেহারা দেখে আর তাঁর গালাগালি দিতে সাহস হচ্ছিল না। কাজেই বিড় বিড় করতে করতে তিনি সদর দরজা বন্ধ করতে গেলেন। এদিকে সমস্ত দিনের পরিশ্রমের পর তপস্বী আর জডিগ ঘুমিয়ে পড়ল।
ভোরের দিকে জডিগ হঠাৎ চমকে উঠে দেখলে সাধু তাকে ডাকছেন, “উঠে পড়, পালাই চল।” “এবারও কিছু চুরি নাকি?” “না, এবার দান। এই দেখ, বলে যে সোনার ঘটিটা চুরি করে এনেছিলেন সেটা টেবিলের উপর রেখে জডিগের হাত ধরে সাধু পথে বেরিয়ে পড়লেন। যে লোকটা এত অসম্মান করল তার উপর সাধুর এই অদ্ভুত অনুরাগের কারণ কিছু না বুঝতে পেরে জডিগ হাঁ করে চেয়ে রইল। সাধু জডিগের মনের ভাব বুঝে বললেন, “চুপ! যা করি দেখে যাও। একটা কথাও বোলো না।”
এ দিনটাও পথে পথে কাটল। সন্ধ্যাকালে একটি ছোট গাঁয়ে দু’জনে এসে উপস্থিত হ’লেন। সেখানে ছোট একটি কুঁড়ের দরজায় এসে সাধু ডাকলেন, “ওগো, আমরা দুটি অতিথি।” কথা শেষ হতে না হতেই একটি বুড়ো লোক এসে দরজা খুলে দিল। তারপর হাত জোড় ক’রে বললে, “আসুন, ভিতরে আসুন, গরীবের বাড়ী দয়া করে এসেছেন, যৎকিঞ্চিৎ ফলমূল আছে গ্রহণ করুন।”
বুড়োর আগ্রহ দেখে দুজনে বড় খুসী হলেন। ঘরে ঢুকে দেখলেন, ঘরখানি ছোট বটে কিন্তু বেশ পরিস্কার। ছোট একখানি টিপাইয়ের উপরে গুটি কয়েক বনের ফল। বুড়ো এসে ফল কয়টি দুজনকে ভাগ করে দিল। দুজনে খেতে খেতে বুড়োর জীবনের কাহিনী শুনতে লাগলেন। বুড়োর চার ছেলে চার মেয়ে। স্ত্রী অনেক দিন মারা গেছে। ছেলে চারটি জাহাজে চাকুরী করে; অল্প-স্বল্প মাইনে পায়। মেয়ে কয়টি বড় লক্ষ্মী, শ্বশুরবাড়ী আছে। জামাইদের ভাল রকম যৌতুক দিতে পারেনি ব’লে, তারা মেয়েদের ছেড়ে দেয় না। সেই দুঃখেই বুড়ো মরার মত হয়ে আছে। সাধু সব কথা শুনলেন। নিজে একটি কথাও বললেন না। আহার শেষ হলে বুড়ো কোথা থেকে এক ঝুড়ি শুকনো পাতা নিয়ে এসে ঘরের মেঝেতে বিছিয়ে দিল। তার উপরে নিজের গায়ের ছেঁড়া কম্বলখানি বিছিয়ে শীতে হি হি ক’রে কাঁপতে লাগলো। জডিগ বাধা দিতে যাচ্ছিল, সাধু ইঙ্গিতে তাকে নিষেধ করলেন। বুড়ো তখন বললে, “আপনারা এখন বিশ্রাম করুন, কেউ এখানে বিরক্ত করবে না। সকালে এসে আমি ডেকে ঘুম থেকে তুলব।”
শেষ রাত্রে সাধুর ডাকে জডিগের ঘুম ভেঙ্গে গেল। সাধু বলছেন, “তোলো তোমার তল্পী-তল্পা, বেরোও।”
“বুড়োর সঙ্গে দেখা না করে?” “ফিরবার পথে দেখা কোরো। তখন অনেক কথা বলতে পারবে, চল।” এই ব’লে জডিগের হাত ধ’রে ঠেলে পথে নিয়ে এলেন।
জডিগ পথে বেরিয়ে ফিরে দেখে বুড়োর ঘরে আগুন। ‘আগুন’ বলে চেঁচিয়ে উঠবে, এমন সময় গালে পড়ল বিরাশী শিক্কা ওজনের সাধুর এক চড়। জডিগ রুখে উঠতেই সাধু বললেন, “আগুন দিয়েছি আমি নিজে। কেন দিয়েছি জিজ্ঞাসা কোরো না।“জডিগের মন একেবারে ছোট হয়ে গেল। এত আদর যত্ন যে লোকটা করলে, একখানা রুটীর যার সংস্থান নেই, তার যথাসর্ব্বস্ব কুঁড়েখানা পুড়িয়ে সাধুর কি পরমার্থ লাভ হল! মনে মনে বললে, নেমকহারাম জানোয়ার। চেয়ে দেখে যে তিনি হাসছেন। দেখে তার পা থেকে মাথা পর্য্যন্ত রাগে জ্বলে উঠলো, কিন্তু মুখে কিছু বললে না।
সমস্ত দিন সাধু কতরকম হাসির গল্প করতে করতে চললেন। জডিগের সে দিকে কান ছিল না। শুধু ভাবছিল সাধুর অদ্ভুত ব্যবহারের কথা। সাধুর এই নৃশংস আচরণ দেখে তার মনে দারুণ ঘৃণা বোধ হচ্ছিল। একবার মনে হয়েছিল, সেই মুহূর্ত্তেই সাধুর সঙ্গ ছেড়ে সে চলে যায়। কিন্তু শেষ অবধি না দেখে আর এই ভণ্ড তপস্বীকে একবার সায়েস্তা না করে সে যাবে না। এই রকম একটা ছোট সঙ্কল্পও সে মনে মনে করে নিয়েছিল।
রাত্রের আঁধার যখন ঘনিয়ে এল, তখন সাধু একটা ছোট বাড়ীর সামনে এসে দাঁড়ালেন। তারপর বাড়ীর খোলা দরজা দিয়ে একেবারে ঘরে ঢুকে গেলেন। জডিগ তাঁর পিছু নিল। সে বাড়ীটা একটী বুড়ীর। সে তার এক বোনপোকে নিয়ে সেই বাড়ীতে থাকে। সাধুকে দেখে বুড়ী তার হাতের কাজ ফেলে উঠে এল। তারপর নমস্কার করে আসন এনে দিল। সাধু বসে বুড়ীর সঙ্গে নানা রকম আলাপ করতে লাগলেন। তার বোনপো এসে জডিগের সঙ্গে গল্প জুড়ে দিল। জডিগ একবার করে কথা বলছিল আর সাধুর দিকে চাইছিল। মনে ভয় ছিল পাছে সাধু বুড়ীকে গলা টিপে মেরে ফেলে। বুড়ী আর তার বোনপোর আদর যত্নে জডিগের তাদের উপর অত্যন্ত মমতা হল। সাধু ঘুমুলে সে রাতভোর জেগে রইল, পাছে সাধু বুড়ীর ঘরে আগুন লাগিয়ে দেন, এই আশঙ্কায়। সারারাত সাধু নাক ডাকিয়ে ঘুমুলেন। সকালবেলা উঠে মুখ হাত ধুয়ে বুড়ীর কাছথেকে সাধু বিদায় নিলেন। বুড়ীর বোনপো তাঁদের এগিয়ে দিতে সঙ্গে গেল।
গ্রামের বাইরে ছিল একটা ছোট নদী। নদীটা ছোট বটে কিন্তু তাতে স্রোত বড় দারুণ। ছোট্ট একটা বাঁশের সাঁকোর উপর দিয়ে লোকজন এক গাঁ থেকে অন্য গাঁয়ে যাতায়াত করত। সাধু আর সে বুড়ীর বোনপো আগে, আর জডিগ তাদের হাত দশেক পিছনে চলছে। এমন সময় বিকট এক আর্ত্তনাদ শুনে জডিগ চেয়ে দেখে যে বুড়ীর বোনপোর টুঁটি ধরে সাধু তাকে সাঁকোর উপর থেকে নদীতে ফেলে দিচ্ছেন। জডিগ লাফিয়ে গিয়ে সাধুর হাত ধরতেই, শব্দ হল ঝুপ্—আর সেই সঙ্গে বুড়ীর বোনপো চোখ উলটিয়ে নদীর জলে তলিয়ে গেল। তখন জডিদের মাথায় খুন চেপে গেল।
“এইবার ভণ্ড! তোমার পালা এইবার। তোমাকে একবার চুবিয়ে নিই”—এই বলে সাধুর চুল চেপে ধরতেই জডিগ দেখলে সাধু আর নেই সেইখানে, তারই বয়সের একটি ছেলে দাঁড়িয়ে আছে। মুখখানি তার ফুলের মত সুন্দর, চোখ দুটী হাসিতে ভরা। জডিগ চমকে উঠল। এ মূর্ত্তি সে ছবিতে দেখেছে। দেখেই চিনল। একি, দেবদূত গ্রেব্রিয়েল তার সম্মুখে! হাত জোড় করে বললে, “না বুঝে অপরাধ করেছি, দেবদূত ক্ষমা করুন।”
দেবদূত বল্লেন, “শোন জডিগ্, আমার ব্যবহার দেখে তুমি আশ্চর্য্য হয়েছ। সোনার দেশের জমিদারের সোনার ঘটি চুরি করেছি, কেন জান? ভবিষ্যতে তিনি আর তাঁর সোনারূপার জাঁকজমক কাউকে দেখাবেন না। কৃপণ ঘটি পেয়েছে, ভবিষ্যতে এই রকম পাওনার লোভে সে দুটি একটি শ্রান্ত ও ক্ষুধার্ত্ত পথিককে আশ্রয় দেবে। বুড়োর বাড়ী পুড়িয়েছি। বাড়ীর বদলে বুড়ো ছাই সরাতে গিয়ে মাটীতে পোঁতা হাজার পঞ্চাশ মোহর পাবে। আর তোমার বুড়ীর বোনপো? আজ যদি তাকে না মারতাম, তবে সে টাকার লোভে তার বুড়ী মাসীকে দিন তিনেকের মধ্যেই খুন করত—বুঝলে? এই সব বোঝ—আর ভাব যে দুনিয়ায় যা ঘটছে তার পিছনেই মঙ্গল অদৃশ্যভাবে রয়েছে। নিজের অদৃষ্টকে ধিক্কার দিওনা। তুমি এত কষ্ট পেয়েছ ব’লেই সংসার ছেড়েছিলে, তাই আমার সঙ্গেও তোমার দেখা হয়েছিল। আমার সঙ্গে দেখা না হলে, তুমি ঈশ্বরে অবিশ্বাসী হতে, আর তোমার জীবন শেষ হত, আত্মহত্যায়।”
জডিগ মুখ তুলে দেখে, দেবদূত অদৃশ্য হয়ে গেছেন। তখন উদ্দেশে নমস্কার করে সে আবার সংসারে ফিরে চলল; দেবদূতের এই কথায় তার সমস্ত দুঃখ কষ্ট মন থেকে একেবারে চলে গিয়েছিল।
ফরাসী ঔপন্যাসিক ভলটেয়ার হইতে।