মায়াবাঁশী/মায়াবাঁশী
মায়াবাঁশী
সেকালে এক রাজা ছিলেন। তাঁর বিপুল ঐশ্বর্য্য, বিরাট রাজত্ব, প্রচুর সৈন্যবল ছিল; আর ছিল এক পরম রূপবতী কন্যা, আর কোন সন্তান ছিল না।
রাজকন্যার ষোল বৎসর বয়স। বিবাহ দিতে হবে। রাজা ঘোষণা করলেন যে যারা রাজকন্যাকে বিবাহ করতে চায় তাদের সংক্রান্তির দিন রাজবাড়ীর মাঠে উপস্থিত হতে হবে।
একে রূপবতী রাজকুমারী, তার উপর রাজার মৃত্যুর পর তিনি হবেন রাজ্যের রাণী; খবর শুনে দলে দলে লোক রাজধানীতে এসে জুটতে লাগল। কত রাজপুত্র, কত বিদ্বান, কত বীর,—রাজধানীতে আর স্থান হয় না। সকলে মাঠে উপস্থিত হ’লে রাজা প্রচার করলেন যে, রাজকন্যা একটা সোণার আতা ছুঁড়বেন, সেই আতা যে ধরতে পারবে তাকে তিনটি কাজের ভার দেওয়া হবে; সেই কাজ যদি সে সময়মত শেষ করতে পারে, তবে তার সঙ্গে রাজকন্যার বিবাহ হবে; নৈলে নয়। ঘোষণা শুনে ভীরু যারা, তারা পিছিয়ে পড়ল। শুধু দাঁড়িয়ে রইল দুশো রাজপুত্র, দুশো পণ্ডিত আর একজন রাখাল। রাখাল গরীব বটে, কিন্তু তার চেহারা রাজপুত্রদের কারো চেয়ে খারাপ ছিল না। কিন্তু রাখাল রাজকন্যাকে বিয়ে করতে চায়,—তার স্পৰ্দ্ধা দেখে মন্ত্রী পারিষদ সব হেসেই খুন। সে কিন্তু কোন দিকে ভ্রূক্ষেপ না করে চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল।
রাজকুমারী আতা ছুঁড়লেন, ধরলেন এক রাজপুত্র। কিন্তু সেই পর্য্যন্তই। তাঁর উপর এক কাজের ভার দেওয়া হল। তিনি কিন্তু শুনেই ঘোড়ায় চড়ে বাড়ীমুখো হলেন। আরও দুবার রাজকন্যা সোণার আতা ছুঁড়লেন। এবার যে দু’জন ধরলেন, তাঁরাও কেউ রাজার ফরমায়েসী কাজ করতে সাহস পেলেন না। শেষে চার বারের পর সোণার আতা পড়ল রাখালের হাতে। রাখাল বুক ফুলিয়ে রাজার সামনে এসে বললে, “কি কাজ করতে হবে, মহারাজ, হুকুম করুন।” মন্ত্রী পারিষদ সবাই রাখালের অহঙ্কারে আশ্চর্য্য হয়ে গেল। রাজা বললেন, “আমার দক্ষিণের আস্তাবলে একশো খরগোষ আছে। কাল সকালে তাদের ছেড়ে দেবে, আবার সন্ধ্যাকালে ফিরিয়ে আনতে হবে। হুঁসিয়ার, একটিও যেন না হারায়। একটা কম হলে তোমার প্রাণ যাবে, এই হচ্ছে প্রথম কাজ।”
রাখাল ভাবল, এ আবার কি! গরু, মোষ, ভেড়া, ছাগল পাঁচ বছর বয়স থেকে চরিয়েছি কিন্তু খরগোষ তো কখনও চরাইনি। এটা দেখছি নূতন রকমের কাজ। আচ্ছা দেখা যাক। এই ভেবে রাখাল বললে, “মহারাজ, কাল দিনটা আমায় ভাববার সময় দিন। কাল বিকেলে জবাব দেব।” ভালয় ভালয় আপদ বিদায় হয় ভালই, এই ভেবে রাজা বললেন, “আচ্ছা বেশ, এক দিন তোমাকে ভাববার সময় দিলাম।”
রাখাল বিদায় নিয়ে ভাবতে বসল। রাজকন্যাকে বিয়ে করতে এসে এমন বিপদে পড়বে, সে আগে ভাবেনি। এখন কি করা যায়! ভাবতে ভাবতে রাখাল বনের দিকে চলল। কাঁটায় পা ছিঁড়ে রক্ত পড়তে লাগল, গাছের ডালে লেগে ছেঁড়া জামা একেবারে টুকরো টুকরো হয়ে গেল। সেদিকে খেয়াল নেই, রাখাল কেবলই চলছে। সহসা পায়ের শব্দে চমকে উঠে রাখাল দেখলে সামনে এক বুড়ী। বয়স হবে একশো বছর। সবগুলো দাঁত পড়ে গেছে। গায়ে কতকগুলো কাঁথা, মাথায় ধুচুনীর মত মস্ত একটা টুপী। সুন্দর ছেলেটার মলিন মুখ দেখে বুড়ী জিজ্ঞেস করলে, “তুমি কি ভাবছ বাছা?”
“আর বলো না মাসী, রাজকন্যা বিয়ে করতে এসে মহা মুস্কিলে পড়েছি।” এই বলে সব কথা রাখাল বুড়ীকে খুলে বলল। বুড়ী বললে, “এই তো? আচ্ছা, আমি এর উপায় কচ্ছি; তুমি ভেবো না। এই বাঁশীটা নাও।” বলে বুড়ী টুপীর ভেতর থেকে একটা হাতীর দাঁতের বাঁশী বের করে রাখালের হাতে দিলে। সুন্দর বাঁশী, দুধের মত রং। বাঁশী হাতে নিয়ে মুখ তুলতেই রাখাল দেখলে বুড়ী আর নেই। রাখাল খানিকক্ষণ “বুড়ী” “বুড়ী” ক’রে ডাকল। কেউ সাড়া দিল না। বাঁশী দিয়ে কি করতে হবে ভেবে না পেয়ে রাখাল ধীরে ধীরে ফিরে গেল। সমস্ত দিনের পরিশ্রমে আর অনাহারে ক্লান্ত হ’য়ে সে বাঁশী হাতে করে ঘুমিয়ে পড়ল।
পরদিন সকালবেলা ঘুম ভাঙ্গতেই রাখাল দেখলে হাতের মুঠোর ভিতর বাঁশী, দেখেই আগেকার দিনের সব কথা মনে পড়ে গেল; আমনি ছুটে গিয়ে সে রাজসভায় হাজির। বললে, “মহারাজ! কোথায় আপনার খরগোষ? আমি রাজী আছি।” সভাসদেরা বললে, “ভেবে দেখো হে খোকা, শেষে লোভে পড়ে প্রাণ হারাবে?”
“দেখেছি মশাই। প্রাণ তো যাবেই একদিন, না হয় আজই যাক।” ব’লে রাখাল রক্ষীর সঙ্গে আস্তাবলের দিকে চলল। আস্তাবলের দরজা খুলতেই তিড়িং করে এক খরগোষ লাফ দিয়ে রাখালকে ডিঙ্গিয়ে দিল ছুট। সঙ্গে সঙ্গে আরো গোটা দশ পনের, কোন্ দিক দিয়ে যে ছুটে গেল, তা রাখাল দেখতেই পেল না। একশো খরগোষ গুণবে কি, পঁচিশটা গুণতেই আস্তাবল খালি হয়ে গেল। ব্যাপার দেখে রাখালের মাথায় একেবারে বজ্রাঘাত হ’ল। কি করে, ফেরবার তো উপায় নেই।
এদিকে রাখালের অবস্থা দেখে সভাসদের সব হেসে লুটোপুটি। কেউ কেউ দুঃখ করে বললে, “গরীবের ছেলে রাজত্বের লোভে প’ড়ে শেষে প্রাণটা খোয়াল দেখছি।” রাখাল যেদিকে খরগোষ গেছে ভাবতে ভাবতে সেই দিকে চললো। গিয়ে দেখে, দু-চারটে খরগোষ মাত্র এদিক ওদিক ঘুরে বেড়াচ্ছে, বাকীগুলোর চিহ্নও নেই। তখন ভাবতে ভাবতে রাখালের মনে পড়ে গেল বুড়ীর দেওয়া বাঁশীর কথা। তখন জামার ভিতর থেকে বাঁশীটা বের ক’রে জোরে ফুঁ দিতেই যেখানে যত খরগোষ ছিল সব লাফিয়ে ঝাঁপিয়ে রাখালের চারপাশে এসে জুটল। রাখালের মুখ হাসিতে ভরে উঠল। এইবার! আর চাই কি! রাজকন্যা আর রাজত্ব। আর ঠকাবার যো নেই।
এদিকে রাজকন্যা তেতালার জানলা খুলে দেখলেন, একশো খরগোষ রাখালের চার পাশে ঘুরে বেড়াচ্ছে। দেখেই তাঁর মুখ শুকিয়ে গেল। সর্ব্বনাশ! শেষে রাজকন্যার বিয়ে হবে গরুর রাখালের সঙ্গে! কি লজ্জার কথা! কি করবেন ভেবে না পেয়ে দাসীকে ডেকে ছেঁড়া জামা আর ভিক্ষার ঝুলি আনতে হুকুম করলেন। সেই ভিক্ষার ঝুলি কাঁধে করে আর ছেঁড়া জামা গায়ে দিয়ে রাজকন্যা চললেন রাখালের কাছে।
রাখাল তখন নিশ্চিন্ত হয়ে ঘুমুচ্ছে, আর খরগোষগুলো কেউ মাথার কাছে, কেউ হাতের উপর শুয়ে আছে। রাজকন্যা এসে ডাকলেন। ধড়মড় ক’রে উঠে রাখাল চেয়ে দেখেই বুঝতে পারলে যে রাজকন্যা এসেছেন ভিখারিণীর বেশে।
“কি চাও তুমি?” রাখাল জিজ্ঞাসা করলে। রাজকন্যা বললেন, “একটা খরগোষ দেবে আমাকে? বেশী নয় একটা, দাম দেব।”
“কত দেবে?”
“পাঁচ হাজার টাকা।”
“ও দামে পাওয়া যায় না।”
“দশ হাজার”
“তাতেও না।”
রাখাল চেয়ে দেখেই বুঝতে পারলে “তবে কত চাও?”
“শোন ঠাকরুণ রাজার রাজত্ব পেলেও এ খরগোষ আমি বেচবো না। তবে তুমি যদি চাও তবে দিতে পারি। কিন্তু—”
“কিন্তু আবার কি?”
“আমার পাশে আধঘণ্টা ব’সে গল্প করতে হবে।”
রাজকন্যার মুখ লজ্জায় লাল হয়ে উঠল। রাখালের পাশে মাটীতে ব’সে, আবার তারই সঙ্গে গল্প করতে হবে। উপায় কি! আধঘণ্টা একসঙ্গে ব’সে গল্প করলেই যদি একটা খরগোষ পাওয়া যায়, তাও ভাল। নৈলে সারাজীবন এই রাখাল ছোঁড়াটার সঙ্গে একত্র বাস করতে হবে যে। ভেবে রাজকন্যা বললেন, “আচ্ছা তোমার কথাতেই রাজী।” এই ব’লে রাখালের পাশে এসে বসলেন। আধঘণ্টা গল্প-গুজবের পর রাখাল রাজকন্যার হাতে একটা খরগোষ তুলে দিল। রাজকন্যার বড় অপমান বোধ হ’ল। কিন্তু কি করবেন? উপায় নেই। খরগোষটি তুলে নিয়ে ঝুলিতে পুরে রাজবাড়ীর দিকে চললেন। খানিকটা দূর যেতেই রাখাল দিল বাঁশীতে ফুঁ। অমনি রাজকন্যার ঝুলি ছিঁড়ে খরগোষ রাখালের কোলের উপর এসে হাজির। রাজকন্যা মাথা হেঁট ক’রে ধীরে ধীরে চ’লে গেলেন।
এদিকে আবার রাজা চর পাঠিয়ে খবর নিলেন। চর এসে বললে মহারাজ, একশো খরগোষ রাখালের আশে পাশে চ’রে বেড়াচ্ছে। রাখাল দিব্যি আরামে নাক ডাকিয়ে ঘুমুচ্ছে। শুনে রাজা অবাক হয়ে গেলেন, ‘রাখাল যে অসম্ভব সম্ভব করলে দেখছি! রাজার মর্য্যাদা যায়। রাখাল শেষে রাজার জামাই হবে! দেখা যাক কি হয়।’ এই ভেবে চাষার বেশ পরে, গাধায় চেপে রাজা চললেন রাখালের কাছে। রাখাল চাষার বেশে রাজাকে চিনতে পেরেই ব’লে উঠল, “কি চাও হে তুমি?” রাজার আপাদমস্তক রাগে জ্বলে উঠল। ইচ্ছা হল তখনই রাখালের মাথা কেটে নেন। কিন্তু কি করবেন? সোরগোল করলেই লোকজন এসে পড়বে। এ রকম বেশে রাজাকে দেখলেই প্রজারা সব হাসবে। রাজা মুখে হেসে বল্লেন, “একটা খরগোষ দেবে হে, ছোকরা? দাম পাবে।”
“কত?”
“পঞ্চাশ হাজার টাকা।”
“বড় লম্বা-চৌড়া কথা বলছ দেখছি। নিজের জোটে না দুবেলা ভাত, কথা বলছ লাখ টাকার!”
“তুমি দেবে কিনা?”
“দিতে পারি, যদি একটা কাজ করতে পার।”
“কি কাজ বল?”
“তোমার গাধার লেজে যদি বার তিনেক চুমো দিতে পার।”
রাজার মুখ কালী হ’য়ে গেল। যদি কেউ দেখে ফেলে তবেই সর্ব্বনাশ!
কি করেন? মানের দায় বড় দায়। “আচ্ছা দেখি” বলে রাজা ভয়ে ভয়ে চারদিক চেয়ে দেখলেন, কেউ নেই।
তখন আস্তে আস্তে গাধার লেজটা মুখের কাছে তুলে প্রথম চুমো দিলেন। যে গন্ধ! চুমে খেয়েই রাজা “ওয়াক থুঃ” ক’রে উঠলেন। রাখাল খিল খিল করে হেসে উঠলো, “বেশ বন্ধু, আর দুবার, তাহ’লেই বড় খরগোষটা তোমার।” রাজা কটমটিয়ে চেয়ে কোন মতে আর দুটি চুমো দিয়ে খরগোষটাকে ঝোলায় পুরে গাধায় চেপে চললেন। খানিক দূর যেতেই রাখাল বাঁশীতে দিল ফুঁ। খরগোষও লাফিয়ে এসে রাখালের বুকের উপর পড়ল।
রাগে অপমানে রাজার শরীর জ্বলতে লাগলো। কোন মতে মনের রাগ মনে চেপে রাজা চললেন মেয়ের সঙ্গে পরামর্শ করতে। কিন্তু কেউ কারো কাছে নিজের দুর্দ্দশার কথা ভাঙ্গলেন না। নতুন কোন উপায়ে রাখালের হাত থেকে বাঁচা যায় কিনা, সেই পরামর্শ চলতে লাগল।
সন্ধ্যাকালে রাখাল হাসতে হাসতে রাজসভায় এসে দাঁড়িয়ে বললে, “মহারাজ, আজকের কাজ তো শেষ হ’ল। কাল কি করতে হবে ফরমায়েস করুন।”
রাজা আগেই মন্ত্রীর সঙ্গে পরামর্শ ক’রে কাজ ঠিক ক’রে রেখেছিলেন। মন্ত্রী রাজার আদেশ জানালেন।
“রাজার গোলায় এক গোলা ধান আর চাল মেশান আছে। বেশী নয়—হাজার মণ ধান আর হাজার মণ চাল। কাল রাতের মধ্যে ধান আর চাল পৃথক করতে হবে। পারবে?”
রাখালের মুখ শুকিয়ে গেল। সে ভেবেছিল, খরগোষ চরাবার মতই কোন ফরমাস হবে; কিন্তু এযে দেখছি সাংঘাতিক রকমের হুকুম! এক রাতে হাজার মণ চাল আর ধান আলাদা করতে হবে।
মন্ত্রী রাখালের মুখ দেখে মনের অবস্থা বুঝতে পারলেন, বললেন, “পারবে হে? ভেবে-চিন্তে জবাব দিও। একটা দানা চাল আর ধানেও যদি মিশে থাকে তাহ’লে প্রাণ যাবে।” রাখাল সাহসে বুক বেঁধে বললে, “কি ভয় দেখাচ্ছেন, মন্ত্রীমশায়? পরশু সকাল কেন দুপুর রাতেই দেখবেন, মহারাজের হুকুম অক্ষরে অক্ষরে তামিল ক’রেছি।”
পরদিন রাতে ধানের গোলায় এসেই রাখালের ভয় হ’ল। প্রকাণ্ড গোলা—ধানে আর চালে বোঝাই। একবার মনে হ’ল, দরকার কি রাজকন্যা আর রাজত্ব? পালাই!
তারপর ভাবল, দেখি এবার বুড়ীর বাঁশী কি করে। এই ভেবে রাখাল বাঁশীতে ফুঁ দিল। আওয়াজ থামতে না থামতেই এক ঝাঁকে প্রায় লাখ খানেক চড়ুই এসে ধান আর চাল আলাদা করা সুরু ক’রে দিল। ঘণ্টা খানেকের মধ্যেই রাজার গোলার এক ধারে চাল, আর এক ধারে ধানের পাহাড় হ’য়ে গেল। রাখাল তখন নিশ্চিন্ত হ’য়ে মনের আনন্দে ঘুমিয়ে পড়ল।
পরদিন ভোর না হ’তেই রাজা মন্ত্রী পারিষদ সঙ্গে ক’রে গোলায় এলেন। এসে রাখালের কাণ্ড দেখেই তো চক্ষু স্থির!
ছোঁড়াটা কি যাদু জানে? গণ্ডগোলে রাখালের ঘুম ভাঙ্গলো।
হাসিমুখে রাখাল রাজাকে বললে, “মহারাজ, তিন নম্বরের হুকুমটা এইবার ক’রে ফেলুন।”
“সন্ধ্যাকালে মন্ত্রীর কাছে জানতে পারবে” বলে মুখ হাঁড়ির মত ক’রে রাজা অন্দরে গেলেন রাণী আর রাজকন্যার সঙ্গে পরামর্শ করতে।
সন্ধ্যার সময় মন্ত্রী এসে রাজার হুকুম জানালেন। “ওহে ছোকরা, বার বার এইবার। এতে যদি উৎরে যাও, তাহ’লে রাজকন্যা পাবে। রাজার ভাণ্ডার দেখেছ? খাবার জিনিষে ভাঁড়ার বোঝাই হ’য়ে আছে। আজ রাত্রের মধ্যে খেয়ে ভাড়ার খালি ক’রে দিতে হবে, বুঝলে?”
“কি খাবার আছে, মন্ত্রী মশাই?”
“হরেক রকম! এই ধর, প্রথম নম্বর সন্দেশ পাঁচমণ, দু নম্বর রসগোল্লা পাঁচমণ, সরপুরিয়া সাড়ে তিন মণ, ক্ষীর—”
“থামুন, মন্ত্রী মশাই, থামুন। আমার মুখে জল আসছে কিন্তু একাই খেতে হবে, না লোকজন নিমন্ত্রণ করা চলবে?”
“না হে, একা। এখনও বোঝ, সাহস যদি না থাকে ফিরে যাও। যদি ফিরে যাও, রাজা তোমাকে বকশিস দেবেন।”
“না মশাই, এগিয়েছি যখন এতদূর তখন আর ফেরা হচ্ছে না। যা থাকে কপালে; না হয় খেয়েই মরব।”
“দেখো বাবা, তোমার ভাল-মন্দ তোমার কাছে।”
মন্ত্রী ফিরে এলে রাজা জিজ্ঞেস করলেন, “কিহে? এবার রাখাল বেটা বলে কি?”
“এবার যেন একটু ভয় পেয়েছে ব’লে বোধ হ’ল। দেখা যাক।”
দুপুর রাতে ভাঁড়ারে ঢুকেই রাখালের প্রাণ আনন্দে নেচে উঠল। এসব খাবার সে জন্মেও চোখে দেখেনি। একবার একটা রসগোল্লা মুখে ফেলে, কখনও একটা সন্দেশ ক্ষীরে ডুবিয়ে খায়, শেষে যখন পেট ভ’রে গেল তখন সে সারা গায়ে ক্ষীর মাখতে লাগল।
রাজবাড়ীতে দুপুর রাতের দামামা বাজল। সর্ব্বনাশ! সবই তো প’ড়ে রয়েছে! “দোহাই বাবা, বাঁশী, এবার আমার মান বাঁচাও—তোমাকে সোণা দিয়ে মুড়ে দেব” ব’লেই রাখাল বাঁশীতে ফুঁ দিল। সঙ্গে সঙ্গে কোথা থেকে লাখো ইঁদুর এসে ভাঁড়ারে জুটল। “কুট কুট” ইঁদুরের দল ফলার আরম্ভ করে দিল।
হায়! হায়!! এমন সব খাবার ইঁদুরে খেয়ে মাটী কচ্ছে! উপায় কি? রাখালের পেট হ’য়েছে ঠিক জয়ঢাকের মত। আর একটা সন্দেশও পেটে রাখবার জায়গা নেই। রাখাল এক একবার পাগলের মত হ’য়ে ইঁদুর তাড়াতে যায়, আবার ফিরে আসে। ভাবে কচ্ছি কি? ইঁদুর সব যদি রাগ ক’রে পালায়, তা হ’লে আমারই সর্ব্বনাশ। যদি রাজকন্যা বিয়ে করতে পারি তাহ’লে রোজই তো রাজার জামাইয়ের এই সব জুটবে।
এই রকম নানা সুখের কথা ভাবতে ভাবতে রাখাল ঘুমিয়ে পড়ল।
সকাল বেলা চোখ মেলতেই দেখে যে, ভাঁড়ার খালি। মেঠাই কিম্বা ইঁদুরের চিহ্নমাত্রও নেই। এমন সময় মন্ত্রীদের সঙ্গে রাজা এলেন।
আগেই রাজা ভাঁড়ারীর মুখে সব শুনেছিলেন। রাজাকে দেখে রাখাল বলে উঠলে, “তাহ’লে শ্বশুরমশাই, এইবার সম্প্রদানটা ক’রে ফেলুন।”
রাজা বললেন, “আর একটু বাকী আছে। এই যে ঝোলা দেখছ, এটা হ’চ্ছে মিথ্যার ঝুলি। এক ঘণ্টার মধ্যে মিথ্যা কথা ব’লে এই ঝোলা বোঝাই ক’রে দিতে হবে, তা হ’লেই রাজকন্যা তোমার।
“এযে চার নম্বরের ফরমাস। এরকম তো কথা ছিলনা।”
মন্ত্রী বললেন “এটা হ’চ্ছে হুকুমের লেজুড়। লেগে যাও।”
হুকুমের লেজুড়! রাজরাজড়ার সবই অদ্ভুত! গরীবের বাছা বয়সও বেশী নয়, এত মিথ্যা কথা কোত্থেকে জোটাবো? যা হোক দেখা যাক এবার বাঁশী কি করে?” জামা ও কাপড় হাতড়িয়ে রাখাল দেখে বাঁশীও নেই! “সর্ব্বনাশ! এইবার খেয়েছে! শেষে কূলের কাছে এসে নৌকা ডুবল!”
“ভাবছ কিহে, ছোকরা? লেগে যাও। পাঁচ মিনিট তো হ’য়ে গেল!”
রাখাল নানারকম মিছে কথা বলতে সুরু করল। ঝুলি আর ভরে না! আধ ঘণ্টা হ’য়ে গেল, ঝুলির সিকিও ভরল না। রাজা হাসতে লাগলেন। মন্ত্রীরা সবাই হাসতে লাগল। দোতলার জানালা থেকে রাজকন্যা হাসতে লাগলেন।
তাঁর সখীরা সব বিদ্রূপ আরম্ভ করলে। রাখাল রেগে যা ইচ্ছা তাই বলতে লাগল, কিন্তু তাতেও ঝুলি ভরে না।
আর মাত্র পাঁচ মিনিট বাকী আছে? হঠাৎ রাখালের মাথায় এক বুদ্ধি জাগল, বললে, “সবাই শুনুন মশাই, এই যে রাজকন্যা দেখছেন—উনি একদিন চাষার মেয়ে সেজে আমার কাছে খরগোষ নিতে এসেছিলেন। দামের বদলে আমার গালে দশটা চুমো দিয়ে গেছেন।”
“ছিঃ ছিঃ কি লজ্জার কথা”!
রাজকন্যা চেঁচিয়ে বলে উঠলেন।
“এতে আর বেশী লজ্জা কি রাজকন্যা?” রাখাল বল্লে—“আপনার বাবার কীর্ত্তি যদি শুনতেন!”
রাজা তাড়াতাড়ি বলে উঠলেন, “ওহে ছোকরা, থাক! থাক!!” “থাকবে কি মহারাজ? শুনুন সবাই—আপনাদের এই রাজা আমার প্রথম পরীক্ষার দিন এক চাষা সেজে আমার কাছ থেকে একটা খরগোষ নেন। তার দাম দিয়েছিলেন তাঁর গাধার লেজে তিনবার—”
রাজার মুখ চূণ হ’য়ে গেল—সর্ব্বনাশ বলে কি!”
“তিনবার—শুনুন মন্ত্রীমশাই।”
“ওহে থাম থাম, আর দরকার নেই—হ’য়েছে হয়েছে।”
“হবে কি, মহারাজ? ঝুলি যে এখনও ভরে নি। তারপর মহারাজ তিনবার”—এইবার রাজা সিংহাসন ছেড়ে লাফিয়ে উঠে রাখালের মুখ চেপে ধরে কানে কানে বললেন, “দোহাই বাপ, এত চাকর-বাকরের সামনে আর বুড়োকে অপদস্থ করো না, ক্ষান্ত হও।”
“যে আজ্ঞা! তবে রাজকন্যার আসতে আজ্ঞা হোক।” রাজকন্যা সেজে এলেন। রাখাল রাজার জামাই হ'ল। রাজকন্যার ভয় ভেঙ্গে গেল। দেখলেন রাখাল গুণে কোন রাজপুত্রের চেয়ে খাটো নয়। বিয়ের রাতে রাখালের বুড়ী মা এল; সেই বাঁশী-বুড়ীও এসেছিল।
বাসরঘরে রাজকন্যা তাঁর বাপের গাধার লেজে চুমো দেওয়ার কথা শুনে হেসে লুটোপুটি হলেন। রাখাল রাজার জামাই হ’য়ে পরম সুখে কাল কাটাতে লাগল।
ফরাসী ঔপন্যাসিক ডুনা হইতে।