মায়া-মৃগ/দ্বিতীয় দৃশ্য

দ্বিতীয় দৃশ্য।

চিত্রকূট পর্ব্বত। পর্ণকুটীর।


[রাম, লক্ষ্মণ ও সীতা যথা স্থানে,এবং ষণ্মুখে ভারত, শত্রুঘ্ন, বশিষ্ঠ ও জাবালি উপস্থিত।]


 রাম। বৎস ভারত।—বৎস শত্রুঘ্ন। তোমরা নিতান্ত শিশু। তোমাদের এ অশেষ আপদাকীর্ণ অরণ্যে আগমনের আবশ্যকতা কি?

 ভরত। আর্য্য! জননীর- (রামের চরণ ধরিয়া রোদিন।)

 রাম। (ভারতের হস্ত ধারণ করিয়া সান্ত্বনা পূর্ব্বক) ও কি ভরত! রোদন কর কেন? স্থির হও।

 ভরত। (বদ্ধাঞ্জলি পুটে) আর্য্য! এ দাস কৈকেয়ীর পুত্র, আপনার ও পবিত্র চরণ স্পর্শনে আর অধিকারী নয়। অনুগ্রহ ক’রে এ অপরাধ মার্জ্জনা ক’র্ব্বেন্‌।

 রাম। ভ্রাতঃ! এরূপ অসঙ্গত বাক্য প্রয়োগ ক’চ্ছ কেন? তোমরা সততই আমার স্নেহের পাত্র; তোমাদের প্রতি আমার কি কখনো ভিন্ন ভাব হ'তে পারে?

 ভারত। (সবিষাদে) আর্য্য! সেই সাহসেই ভরত আবার আজ্‌ আপনাকে মুখ দেখা'তে সাহসী হ’য়েছে। এখন প্রার্থনা এই, আপনি রাজধানীতে প্রত্যাগত হ’য়ে, রাজশ্রী পরিগ্রহ ক’রে, প্রকৃতিপুঞ্জ পরিপালন ও জননীব কলঙ্কাপনয়ন করুন্‌। অন্যথা, আমার এই লোক-নিন্দিত ঘৃণিত ভারভূত জীবন, কালের কারাল কবলে কবলিত করাই কর্ত্তব্য।—হায়! আমার অগ্রজ অকারণে আমার জন্য এত কষ্ট পাচ্ছেন! যিনি অমাত্যমণ্ডলী ও পৌরজন পরিবৃত হ’য়ে সর্বদা সভাস্থল সমুজ্জ্বল ক’র্ত্তোন, তিনি আজ বন্য-পশুপূর্ণ অবণ্যে ব্যাধের ন্যায় অবস্থান ক’চ্ছেন! মহামূল্য মণি মুক্তা খচিত কারু-কার্য্য শোভিত। সুচারু বাজ-পরিচ্ছদ, যা’র শরীবের শোভা সম্পাদন ক’র্ত্ত্যা, মুনিজন-ব্যবহৃত বৃক্ষবস্কল। আজ তা’র সেই পরিচ্ছদ স্থানীয় হ’য়েছে! যিনি সতত সুশোভন বত্ন সিংহাসনে উপবিষ্ট থা'ক্‌তেন, তিনি আজ্‌ তাপসাসান হরিণাজিনে আসীন র’য়েছেন। যিনি সুরম্য হর্ম্মে শত শত দাস দাসী পরিসেবিত ছিলেন, তিনি আজ্‌ পত্নী ও অনুজ সমভিব্যাহারে পর্ণকুটীর আশ্রয় ক’রেছেন। যাঁ’র শিরোদেশ মণিমণ্ডিত কনক কিরীটে সুশোভিত থা’ক্‌ত, তাঁ’র সেই শিরোদেশ আজ্‌ জঘন্য জটাজুট-জড়িত হ’য়ে র'য়েছে। যাঁ’র দূর্ব্বা-দল-শ্যামল বিমল বাপু অনুক্ষণ অগুরু অনুলিপ্ত থাক্‌ত, ধূলি ও ভস্মরাশি আজ্‌ তাঁর অঙ্গরাগ হ’য়েছে।—হা ধিক্‌! অগ্রাজের ঈদৃশ বিসদৃশ বেশও আমাকে দর্শন ক’র্ত্ত্যে হ’ল!-হা নৃশংসে জননী। আর্য তোমার কি অপকার ক’রেছিলেন? তোমার কি কিছুমাত্রও লোকনিন্দা ও অধর্ম্মের ভয় হ'ল না? তোমার জীবনে ধিক্‌!

 রাম। ভ্রাতঃ। জননীর প্রতি দোষারোপ ক’রো না। মাতৃনিন্দায় নিরন্তর নিদারুণ নিরয় নিলয়ে নিবসতি ক’র্ত্যে হয়। জননীর কোনো দোষ নাই; আমি পিতৃসত্য পালন জন্যই অরণ্যচারী হ’যেছি।

 শক্রত্ন। আর্য্য! আমরা তৎকালে উপস্থিত থাক্‌লে, কৈকেয়ী মাতা এরূপ কদর্য্য কার্য্য ক’র্ত্ত্যে কখনই পার্ত্যেন না। আর সেই কুমন্ত্রণাদায়িনী পাপিনী ত্রুরা মন্থরাকেও সমুচিত শাস্তি সমর্পণ ক’রেছি।

 রাম। বৎস শত্রুঘ্ন! তুমি নিতান্তই নির্দ্দয়ের ন্যায় কার্য্য ক’রেছ। মন্থরার প্রতি শাস্তি বিধান ক’ল্যে কেন? স্ত্রীজাতি সহস্র অপরাধ ক’র্ল্যেও দণ্ডনীয় নয়।

 শত্রুঘ্ন। আর্য্য! ক্রোধোদয়ে ধর্ম্মাধর্ম্মের বিচার থাকে না।

 রাম। রিপুর দমন করাই জ্ঞানবানের কার্য্য। আর অতি ক্রোধে ধৈর্য্যাবলম্বনই বিধেয়।

 ভরত। আর্য্য! এ দাসের প্রতি প্রসন্ন হ’ন্‌। এখন আমাদের সকলেরই প্রার্থনা যে, আপনি রাজ্যভার গ্রহণ করুন্‌।

 রাম। বৎস! ধর্ম্ম সঞ্চয়ই সংসারে সার। আমি পিতৃ-সত্য-পালন-ব্রত-পরায়ণ হ’য়েই বনাচারী হ’য়েছি। সেই সত্যব্রতের আজও উদ্‌যাপন হয় নাই। তবে এখন রাজধানীতে প্রতিগমন ক’রে, কেমন ক’রে অনুষ্ঠিত ব্রত ভঙ্গ কর্ত্যে পারি? আমি পিতার আদেশের অনুরূপ কার্য্য প্রাণপণে সম্পন্ন ক’র্ব্বো। আর রাজ্যভার গ্রহণে তোমার প্রতি মহারাজের আজ্ঞা আছে। তুমি তাঁ’র কথার কদাচ অন্যথাচরণ ক'রো না; পিতৃ আঞগা লঙ্ঘনে সন্তানের অধর্ম্ম সঞ্চার হয়। এখন তুমি সত্বর রাজধানীতে প্রতিগমন করি, মহারাজের আদেশানুরূপ কার্য্য ক’রে তাঁ’র সেবা শুশ্রীষায় তৎপর হও। তোমাদের আর এখানে বিলম্ব করা বিধেয় বোধ হয় না। আমরা কেউ নিকটে নাই, মহারাজের যথেষ্ট কষ্ট হ’চ্ছে।

 ভারত। (সরোদনে) আর্য্য। আর আমরা পিতার পরম পবিত্র পাদপদ্ম সেবন ক’র্ত্যে পা’ব না। আপনাদের বনাগমনে, দুঃহস পুত্রবিরহ সহ্য ক’র্ত্ত্যে সমর্থ না হ’য়ে, মহারাজ বিগতপ্রাণ হ’য়েছেন। আমরা——

 রাম। কি! পিতা পরলোক যাত্রা ক’রেছেন!! (পতন।)

 লক্ষ্মন। হা পিতঃ! হা পিতঃ! (পতন ও রোদন।)

 সীতা। হা তাত অযোধ্যানাথ! হা দেব পুত্রবৎসল! হা আর্য্য ধার্ম্মিকচূড়ামণি!

(রোদন।)

 রাম। (সরোদনে) হায়। এত দিনের পর অযোধ্যাপুৱী শূন্য হ’ল!-জানকি! তোমার শ্রদ্ধাস্পদ শ্বশুর পরলোক যাত্রা ক'রেছেন! ভ্রাতঃ লক্ষণ। আমরা পিতৃহীন হ’য়েছি! আর আমি জনক পরিহীন শ্রীহীন অযোধ্যায় প্রতি গমন ক’র্ব্বো না। আর আমি সুহৃৎ সমবেত হ’য়ে গার্হস্থ্য সুখ সম্ভোগ ক’র্ব্বো না। আর আমি স্নেহময়ী জননীদের সেবা শুশ্রূষা ক’র্ত্ত্যে পা’ব না। আর আমি সুপবিত্র পিতৃ সম্বোধনে রসনাকে পরিতৃপ্ত ক’র্ত্যে পা’র্ব্বো না।—হায়! আমাদের হৃদয় কি বজ্রলেপাময়? নতুবা, জনকের জীবনান্ত শ্রবণে এখনো কেন বিদীর্ণ হ’ল না? পিতা আমাদের বনগমনে প্রাণ পরিত্যাগ ক’ল্যোন, আমরা তাঁ’র পরলোক গমনে এখনো পর্য্যন্ত জীবিত আছি!! আমাদের জীবনে ধিক্‌! যে পিতা বর্ত্তমান ছিলেন ব'লে আমরা নিশ্চিন্ত ও সুখে ছিলাম, যাঁ’র ভয়ে স্বেচ্ছাচারী হ’তে পার্ত্যেম না, কুপথে পদার্পণ ক’র্ত্ত্যে পার্ত্যেম না, এখন সেই পিতা কোথায়?—কে আর আমাদের শাসন ক’র্ব্বে? কে আর আমাদের সমস্ত ভার গ্রহণ ক’র্ব্বে? কে আর আমাদের সুখ স্বচ্ছন্দে রা'খ্‌বে? কে আর আমাদের প্রতি স্নেহ মমতা ক’র্ব্বে? কে আর আমাদের উন্নতিতে উল্লাসিত হ’বে? কে আর আমাদের জন্য জীবন দানেও অকাতর হ’বে?—হায়! এত দিনের পর আমরা দারুণ দুঃখর্ণবে নিমগ্ন হ’লেম। এত দিনের পর আমাদের নিশিচন্ততা গত হ’ল! এত দিনের পর আমরা অনাথ হ’লেম। আর আমাদের জীবনে প্রয়োজন কি?

 বশিষ্ঠ। বৎস রাম! ধৈর্য্যাবলম্বন কর; মৃতের নিমিত্ত শোক করা অতি অকর্ত্তব্য। এই পঞ্চভৌতিক ক্ষণভঙ্গুর দেহের সহিত জীবাত্মার সম্বন্ধ স্বল্প ক্ষণ স্থায়ী। আত্মা অবিনশ্বর, তা’র ধ্বংস নাই। লোকে যেমন জীর্ণ গৃহ পরিত্যাগ ক’রে আবার নূতন গৃহ আশ্রয় করে, জলৌকা যেমন এক তৃণ পরিত্যাগ ক’রে পুনরায় তৃণান্তর অবলম্বন করে, জীবাত্মাও সেই রূপ এক দেহ ত্যাগ ক’রে পুনর্ব্বার দেহান্তর আশ্রয় করে; তবে তা’র মৃত্যু কোথায়?—বৎস! তুমি সকল শাস্ত্রজ্ঞ, তোমাকে আর অধিক বলা বাহুল্য। এক্ষণে, আত্মার আবিনশ্বরতা, দেহের অনিত্যতা ও সংসারের অসারতা প্রভৃতি পর্য্যালোচনা ক’রে চিত্তের স্থৈর্য্য সম্পাদনা কর।

 রাম। (বাষ্পগদগদ স্বরে) ভগবান! শোক করা আকর্ত্তব্য, আর শোক তাপ পরতন্ত্র হ’লে অনর্থক কষ্ট পেতে হয়, তা' আমি বিলক্ষণ অবগত আছি। কিন্তু কি করি, পিতৃস্নেহ আমাকে একান্ত অভিভূত ক’বেছে।

 লক্ষ্মণ। হায়! পিতার আসন্নকালে তাঁ'র সেবা শুশ্রূষা ক’র্ত্ত্যে পার্লেম না, এ দুঃখ যাবজ্জীবনই থা'ক্‌বে। আমাদের দ্বারা যদি তাঁ’র শেষ দশায় কোনো উপকার না হ’ল, তবে আমাদের জন্ম গ্রহণই বৃথা।

 বশিষ্ঠ। রাজকুমার। ও সকল আপন প্রাক্তনের লিখন; তজ্জন্য পরিতাপ ক’রো না। এক্ষণে শান্তচিত্ত হও।

 লক্ষণ। ভগবন্‌! দাব-দগ্ধ কুরঙ্গ কি কখনো ক্রীড়া কৌতুকে বিচরণ ক’র্ত্ত্যে পারে? পিতৃশোক অতি অসহনীয়। পিতৃহীন যুবকের পক্ষে জগৎ শূন্যময়।

 বশিষ্ঠ। বৎস! শোক মাত্রই অতি অকিঞ্চিৎ কর। শোকের যদি মূল থাক্‌ত, তবে ক্রমশঃ হ্রাস না হয়ে বরং বর্দ্ধমান হ’ত। অতএব, অমূলক শোকের বশীভূত হওয়া অনুচিত। এক্ষণে যত্নে মনের সান্ত্বনা সম্পাদন কৱ।

 রাম। ভগবন্‌! অকস্মাৎ পিতৃশোক-সুতীক্ষছুরিকা হৃদয়-কন্দরে প্রবিষ্ট হ’লে, অন্তঃকরণ কি আর স্থির থাকতে পারে?—ওঃ! থেকে থেকে হৃদয়-নিলয় যেন জ্ব’লে জ্ব’লে উঠছে।

 বশিষ্ঠ। বৎস রাম! তুমি জ্ঞানবান্‌ হ’য়েও অজ্ঞানের ন্যায়। এরূপ শোকবিমূঢ় হ’চ্ছ কেন? যদি ভবাদৃশ ব্যক্তি শোক-সাগরে নিমগ্ন হ’বে, তবে তা' হ’তে কে আর উত্তীর্ণ হ’তে পা'র্ব্বে?—সারবান্‌ পাষাণ কি কখনো জল-প্রবাহে ভাসমান হয়?—হিমাদ্রি কি কখনো সামান্য বায়ুভরে বিচলিত হয়?—গভীরার্ণব কি কখনো অল্প কারণে আকুলিত হয়? অতএব শোকাবেগ সংবরণ ক’রে লোকের দৃষ্টান্ত স্থানীয় হও। পারত্রিক কার্য্যের অনুষ্ঠান ক’রে পিতার পুত্র-কামনা পূর্ণ করা। আর দেখ, পিতা মাতা ক’রে চির দিন জীবিত থাকেন না; মহারাজও চির দিন পিতৃমান্‌ হ'য়ে রাজ্য পালন ক'র্ত্ত্যে পারেন নাই।

  রাম। ভগবন্‌। আপনার উপদেশ সমুদয়ই সারগর্ভ। এখন আপনি কর্ত্তব্য কার্য্যের নির্দ্দেশ করুন। আমি হৃদয় হ’তে সমস্ত শোক অপসারিত ক’র্ল্যেম।

 বশিষ্ঠ। বৎস। নিশাবসানে তোমরা ভাগীরথীর পবিত্র সলিলে স্নান তর্পণ ক’রে পুতকলেবর হও। ভরত যথাবিধি শ্রাদ্ধাদি সম্পন্ন ক’রেছে।

 রাম। আপনার আদে্য্যশ অবশ্য সম্পাদ্য।

 ভরত। (গাত্রোত্থান করিয়া বদ্ধাঞ্জলিপুটে) আর্য্য! এখন এ দাসের একটী নিবেদন আছে। আপনি সর্ব্বজ্যেষ্ঠ; জ্যেষ্ঠই রাজা হ’য়ে থাকেন, এই আমাদের কুলধর্ম্ম। আপনি সেই কুলক্রমাগত রাজধর্ম্মের অনুসরণ ক’রে স্বয়ং রাজ্যেশ্বর হ’ন্‌। পিতা এখন আর বর্তমান নাই; আমি বালক, দুর্ব্বহ রাজ্যভার বহনে নিতান্ত অযোগ্য।

 রাম। বৎস ভারত! তুমি সমস্তই জেনে শুনেও কোন বালকের মত কথা ক’চ্ছ? পিতাকে ধর্ম্মচ্যুত কার্ব্বার জন্যই কি পুত্র-কামনা? পিতার প্রাণপণে সন্তান লালন পালনের কি এই পরিণাম? তুমি ধার্ম্মিকশ্রেষ্ঠ মহারাজ দশরথের পুত্র হ’য়ে অধর্ম্মপথে পদার্পণ ক’র্ত্ত্যে কেন উদ্যত হ’চ্ছ? মহারাজ কেবল মাত্র ধর্ম্মানুরোধে প্রাণ পরিত্যাগ ক’র্ল্যেন, আর তুমি সেই ধর্ম্ম ভঙ্গ ক’র্ত্ত্যে একেবারে দৃঢ় অধ্যবসায় হ’চ্ছ? অতএব এরূপ বালক-বুদ্ধি পরিত্যাগ কর। এখন তুমি সত্বর রাজধানীতে প্রত্যাগমন ক’রে রাজ্যাভিষিক্ত হ’য়ে, রাজকার্য্য পর্য্যালোচনা ও জননীদের সেবা শুশ্রূষা কর। আমি সত্য-ব্রত পালন ক’রে চতুর্দ্দশ বৎসরান্তে আবার অষোধ্যায় প্রতিগমন ক’র্ব্বো। এখন এ বিষয়ে বারংবার অনুরোধ ক’র্ল্যে, যার পর নাই অসন্তুষ্ট হ’ব। ধর্ম্ম রক্ষার নিমিত্ত, রাম, প্রাণ ত্যাগেও ক্ষুব্ধ নয়।

 জাবালি। (শিরঃকম্পন পূর্ব্বক বাগাড়াম্বর সহকারে)। রাজকুমার! মহারাজ। আপনাকে বনে বাস ক’র্ত্ত্যে অনুমতি দিয়েছিলেন, তা' আপনি উপবনে বাস ক’রেও তাঁ’র বাক্য পালন ক’র্ত্ত্যে পারেন্‌। বন আর উপবনও কিছুই প্রভেদ নাই। তরুসমষ্টির নাম বন, উপবনও বৃক্ষ সমষ্টি ভিন্ন আর কিছুই নয়; এতাবতা উপবনই বন। বন হিংস্র জন্তপূর্ণ, তা’ মহারাজের উপবনেও নানা জাতি পালিত পশু আছে; অতএব আপনার উপবন-বিহার অযৌক্তিক ব’লে বোধ হয় না। আর দেখুন্‌, মহারাজ। আপনাকে প্রথমেই রাজ্যভার দেন, পরে মহিষীর অনুরোধে বনে যেতে বলেন; প্রথম আদেশ প্রথমে পালন, দ্বিতীয় নিদেশ তৎপরে সমাধা ক’র্ত্ত্যে হয়। আপনি এই ক্রম অতিক্রম ক’রে, মহারাজের প্রথম আদেশের প্রতি লক্ষ্য না ক’রে, তা’র দ্বিতীয় বাক্য রক্ষা ক’র্ত্যে যত্নবান হ’চ্ছেন, এ ন্যায় ও যুক্তিবিরুদ্ধ। অতএব মহারাজের প্রথম আদেশক্রমে রাজ্যভার গ্রহণ করুন্‌, পরে দ্বিতীয় নিদেশের অনুষ্ঠান ক'র্ব্বেন্‌। জটা বল্কল ধারণ করা ত রঘুবংশীয়দের কুলধর্ম্ম; আপনি শেষ বযসে মহারাজের শেষ নিদেশ পালন ক’র্ব্বার জন্য বানপ্রস্থধর্ম্ম অবলম্বন ক’র্ব্বেন্। এ হ’লে উভয় পক্ষ রক্ষা হ’বে, এবং আমাদেরও মনোরথ পূর্ণ হ’বে। অতএব, এক্ষণে রাজধানীতে চলুন, মহাসমারোহে পিতৃশ্রাদ্ধ সম্পন্ন করুন্‌; অনেক মুনি ঋষি ব্রাহ্মণ পণ্ডিতেরা আশান্বিত হ’য়ে আপনাদের আগমন-প্রতীক্ষায় আছেন। এতে সকল ধর্ম্ম বজায় থা'ক্‌বে।

 রাম। (সহাস্যমুখে) ভগবন্‌! আপনি স্থির হ’ন্‌। আপনার তর্কশক্তি যথেষ্ট আছে তা’র পরিচয় পাওয়া যা'চ্ছে। নিরর্থক হেতুবাদে ধর্ম্ম লোপ ক’র্ত্ত্যে পার্ব্বো না। আমি পিতার আজ্ঞা পালনে ক’রো অনুরোধ উপরোধ শুন্‌ব না; আপনার কেন নিরর্থক প্রয়াস পান্‌? ভরত বালক, তা'রে সঙ্গে ল’য়ে রাজধানীতে গমন করুন; য’তে রাজ্য নিরাপদে থাকে, এরূপ সুপরামর্শ সর্ব্বদা দেবেন্‌।

 ভরত। (বশিষ্ঠের প্রতি) কুলগুরো! অগ্রজ ত কোনো ক্রমেই রাজশ্রী পরিগ্রহ ক’র্ল্যেন না, এক্ষণে আমার কর্তব্য কি? একদিকে, লোকনিন্দা, অপর দিকে, পিতার কথার অন্যথাচরণ ও অগ্রাজের আজ্ঞা অপালন। সর্ব্বথা আজ আমি বিষম বিপদে প’ড়্‌লাম। এখন কি করি, আমাকে উপদেশ দিন্‌।

 বশিষ্ঠ। (ক্ষণেক চিন্তার পর) রাজকুমার! ক্ষত্রিয়ের পক্ষে প্রজা পালনই পরম ধর্ম্ম, তা’ই রক্ষা করা যুক্তিযুক্ত ও কর্তব্য। অতএব অগ্রজের অনুমতি ল’য়ে রাজধানীতে প্রতিগমন কর।

 ভবত। (বামের প্রতি) আর্য্য! আপনকার আদেশ অনুসারে আমি আপনার অনুপস্থিতি কাল পর্য্যন্তই রাজ্যের রক্ষণাবেক্ষণ ক’র্ব্বো। এখন আমাকে আপনার পাদুকাদ্বয অর্পণ করুন্‌; শ্রীপদপাদুকা হেমপীঠে স্থাপিত ক’রে, সেই বলেই আমি রাজকার্য্য নির্বাহ ক’র্ব্বো।

 রাম। (হৃষ্টচিত্তে বশিষ্ঠের প্রতি) ভগবন্‌। এ অবস্থায় পাদুকা-পরিগ্রহ করা যায় কি না? ভরত আমার পাদুকা-যুগল প্রার্থনা ক’চ্ছে।

 বশিষ্ঠ। বৎস! কুশ-রচিত সমুদয় বস্তুই সকল সময়ে ব্যবহাব করা যেতে পাবে। তুমি? দর্ভময় পাদুকাদ্বয় পরিগ্রহ ক’রে ভরতেরে অর্পণ কর।

 রাম। ভগবন্‌! আপনার আদেশ অবশ্যই অখণ্ডিতভাবে সম্পাদিত হ’বে। এক্ষণে নিশাবসানপ্রায়, পিতার পারিত্রিক কার্য্য সমাধার জন্য পবিত্রসলিলা ভাগীরথীতে আমাদের ল’য়ে চলুন।

 বশিষ্ঠ। হাঁ! অবশ্য —তবে চল।

    [সকলের প্রস্থান।

ইতি দ্বিতীয় দৃশ্য।