মায়া-মৃগ/প্রথম দৃশ্য
মায়া-মৃগ।
দৃশ্যকাব্য।
প্রথম দৃশ্য।
চিত্রকূট পর্ব্বত। পর্ণকুটীর।
(তাপসীবেশে রামলক্ষণ ও সীতা আসীন।)
রাম। বৎস লক্ষমণ! সুমন্ত্র বোধ হয় এত দিবস অযোধ্যায় প্রত্যাগত হ’য়ে থা'ক্বে। আহা! শূন্য রথ দর্শনে পৌরবর্গ, মহারাজ, ও পুত্রবৎসলা স্নেহময়ী জননীরা, না জানি, কতই বিলাপ ও পরিতাপ ক’চ্ছেন। সীতা বিরহে তদ্গতিপ্রাণা নব বধূরা, না জানি, কতই আক্ষেপ ক’চ্ছেন। বিমাতা কৈকেয়ী, সকলের নিকট নিন্দিত হ’য়ে, না জানি, কতই লজ্জিতা হ’চ্ছেন। এই সকল দুশ্চিন্তা, যুগপৎ হৃদয়ে উদয় হ’য়েই, আমার চিত্ত বৈকল্য সম্পাদন ক’চ্ছে।
লক্ষণ। আর্য্য! শারদীয় নীল নৈশ নভোমণ্ডলের উজ্জ্বল মণি, লোচনানন্দকর পূর্ণ সুধাকর, সহসা রাহু-গ্রস্ত হ’লে কা’র মনে না। দুঃখোদয় হয়? আপনার এই বনাগমনে পুরবাসীরা যে একেবারেই শোক-সাগরে নিমগ্ন হ’বে, ত’তে আর সংশয় কি?
সীতা। (রামের প্রতি) আর্য্যপুত্র! শ্বশ্রূ কৈকেয়ীর মনে যদি লোকাপবাদ ও লজার ভয় থাক্ত, তা’ হ’লে তিনি এমন নিষ্ঠুর আচরণ কখনো ক’র্ত্ত্যে পার্ত্যেন না।
রাম। না প্রিয়ে! আমাদের বিদায় কালে বিমাতা কৈকেয়ী ও আশ্রু বিসর্জ্জন ক’রেছেন।
সীতা। নাথ! হরিণ-শিশু বধে কি কিরাতীর কখনো করুণার উদয় হয়?—সে। তাঁ’র শোকাশ্রু নয়-আনন্দশ্রু!!
লক্ষণ। আর্য্যে! আপনি যথার্থ উক্তি ক’রে- ছেন। সপত্নী-পুত্রকে বনবাস দিয়ে স্বপুত্রকে রাজ্যেশ্বর করা অপেক্ষা, তাদৃশ কুটিল হৃদয়ার পক্ষে আর কি আনন্দের বিষয় আছে?
সীতা। বৎস লক্ষণ! আর্য্যপুত্র বনবাসী হ’লেন, শ্বশ্রূ কৈকেয়ী এখন সপুত্র নিরাপদে রাজসুখ সম্ভোগ করুন্!! এত দিনের পর তিনি পূর্ণ মনোরথ হ’লেন।—হা হত বিধে! তোমার মনে কি এই ছিল? যে আর্যপুত্র নব রাজ্যে অভিষিক্ত হ’য়ে কোথায় আজ প্রকৃতিপুঞ্জ পরিপালন ক’র্ব্বেন্, পুববাসিদের অশেষ সুখ সংবর্দ্ধন ক’র্ব্বেন্, পূজ্যপাদ জনক জননীর আনন্দ বর্দ্ধন ক’র্ব্বেন্, রাজ্যের সমৃদ্ধি সম্পাদন ক’র্ব্বেন্, যাগ যজ্ঞের অনুষ্ঠান ক’রে দেব দ্বিজের তৃপ্তি সাধন ক’র্ব্বেন্, বাহুবলে রিপু, গর্ব্ব খর্ব্ব ক’রে লব্ধপ্রতিষ্ঠ হ’বেন্, সেই অমিত-তেজা আর্য্যপুত্র, এখন কি না সামান্য তাপস বেশে অটাবী-অটন-ব্রতচারী হ’য়েছেন! কি পরিতাপ! —হা বিধাতঃ! তোমার বিচার কি অন্যায়! তুমি যখন পদ্মনালে কণ্টক, কুসুমে কীট, চন্দন তরুতে কাল সাপের আশ্রয় ও পূর্ণশশীকে রাহুর আহার ক’রেছ, তখন আর্য্যপুত্রের বনবাস বিধানে তোমাকে আর অধিক কি ব’ল্বো?
রাম। প্রিযে! বিলাপ সংবরণ কর। তোমার মুখে আক্ষেপেক্তি শুন্লে, হৃদয় বিদীর্ণ হয়।
লক্ষণ। আর্য্য! দেখুন, ব্যাধ-বাণ-বিদ্ধ কুরঙ্গীর করুণ আর্ত্তস্বরে কি সদয়-হৃদয় তাপসের মন কখনো অক্ষুব্ধ থাকে? দেবীর মুখে এরূপ সকরুণ বাক্য শ্রবণ ক’লে সহজেই মনে দুঃখোদয় হয়। আরো দেখুন্ কল্লোলিনী যখন সহসা উন্মুক্ত পথ হ’য়ে শৈল শিখর হ’তে কল কাল শব্দে নিম্নে প্রধাবিত হয়, তখন কে তা’র গতি রোধ ক’র্ত্ত্যে পারে? আর্য্যা, দারুণ মন কষ্ট পেয়েই ঈদৃশ উক্তি ক’চ্ছেন।
রাম। ভ্রাতঃ! তা' আিম বিলক্ষণ অবগত আছি। পতিপ্রাণা জানকী, আমার এই দুরদৃষ্টে নিদারুণ মর্ম্ম বেদনা পেয়েছেন। আহা! কোথায় পাটেশ্বরী হ’য়ে সিংহাসন সমুজ্জ্বল ক’র্ব্বেন, না, এখন স্বামীর সঙ্গে বনবিহারিণী হ’য়েছেন! দুগ্ধফেনা-নিভা কোমল কুসুম-শয্যায় শয়নে ও যাঁর কষ্ট বোধ হ’ত, এখন তিনি কঠিন মৃত্তিকা-পৃষ্ঠে অকাতরে পর্ণ-শয্যায় সুষুপ্তি লাভ ক’চ্ছেন। —হায়! আমি কি মন্দভাগা। প্রাণাধিকা প্রণয়িনীর ঈদৃশ বিসদৃশ দশাও আমাকে দর্শন ক’র্ত্যে হ’ল!!আহা। প্রেয়সী সকল সুখে জলাঞ্জলি দিয়েও আমার অনুবর্ত্তিনী হ’য়েছেন।
সীতা। নাথ! সংসারে স্বামীই সতীর সার সুখ। সেই অমূল্য সুখে বঞ্চিত হ’য়ে কি সামান্য গৃহ-সুখে আসক্তমনা থাকা, কুলকামিনীর পক্ষে সম্ভব?—মীন কি কখনো বারিাহীন সরোবরে প্রাণ ধারণ ক’র্ত্ত্যে পারে? যখন জীবন-সর্বস্ব পতিরমণীর একমাত্র আশ্রয় —বনগামী হ’লেন্, তখন কি আর আমি ছার গৃহ-ধর্ম্মে অনুরক্তা থাক্তে পারি?
রাম। প্রিয়ে। তোমার ন্যায় পতিরতা প্রমদার মুখেই ঈদৃশ বাক্য পরম শোভা পায়।
লক্ষণ। (সবিষাদে)। হা অনার্য্যে কৈকেয়ি! তোমার মনে কি এই ছিল? আর্য্যকে বনবাস দিয়ে তুমি আপনার মনোবাসনা চরিচার্থ কল্যে? যে আর্য্যের ভুজবল, ক্ষত্রিয়কুল-নিহস্তা ভগবান পরশুরামও সহ্য ক’র্ত্ত্যে পারেন নাই; যিনি অনায়াসেই দুর্ভ্যেদ্য হর-ধনু ভঙ্গ কবে ভূতলে অতুল কীর্ত্তি লাভ ক’রেছেন; সমস্ত লোকে যাঁ’রে নর-রত্ন স্বরূপ জ্ঞান করে; যাঁ’র যশোরশ্মি শরচ্চন্দ্র-মরীচিবৎ জগদুজ্জ্বলকারী; যিনি যাদৃচ্ছাক্রমে গৃহ-বহির্গত হ’লে সহস্র সহস্র রথাশ্ব গজ প্রভৃতি অনুগমন ক’র্ত্ত্য; সেই লোকাভিরাম আর্য্য রামচন্দ্র এখন সামান্য ভিক্ষুক বেশে বনে বনে ভ্রমণ ক’চ্ছেন্!! কি পরিতাপ! যে আর্য্যা জানকী কখনো ক্লেশের লেশ মাত্রও জানেন্ না, তিনি এখন বনাচারিণী হ’য়ে দারুণ দুঃখ ভোগ ক’চ্ছেন।—হায়! মহারাজ এতকাল বিষম ভ্রমে কৈকেয়ী কালসপিণীকে দুগ্ধ দ্বারা পোষণ ক’রেছেন!! এত দিনের পর মহারাজের বিমল চরিত্রে স্ত্রৈণাপবাদ হ’ল! এত দিনের পর অযোধ্যার সুখ-রবি অস্তমিত হ’ল! এত দিনের পর রঘু-কুল-রাজশ্রী হীনশ্রী হ’ল! এত দিনের পর-
রাম। ভ্রাতঃ লক্ষ্মণ! বিরত হও। গুরু জনের নিন্দা ক’র্ত্ত্যে নাই। বিমাতার দোষ কি বল? সকলই আপনি অদৃষ্টাধীন।
লক্ষ্মণ। আর্য্য! বিমতা যখন নিরপরাধে আপনার প্রতি এরূপ নির্দ্দয়াচরণ ক’রেছেন, তখন এত তাঁর নিন্দায় অধরর কি? তাঁ'র এ কলঙ্ক-পঙ্ক দুরপনেয়; কখনই আপনীত হ’বে না -পাষণের রেখা কি কখনো ধৌত হ’লে বিলুপ্ত হয়?
রাম। ভ্রাতঃ! আমি পিতৃ-সত্য পাবন অনুরোধেই বানচারী হ’য়েছি; বিমাতার কোনো দোষ নাই।
লক্ষণ। আর্য্য। তিনিই সকল অনিষ্টপাতের মূল।
রাম। বৎস। কুটিল হৃদয়া মন্থরাই এর প্রকৃত কারণ; বিমাতা আমার নিরপরাধা। মন্থরার কুমন্ত্রণাতেই তিনি এরূপ কার্য্যে প্রবৃত্তা হন।
লক্ষণ। স্বপুত্রস্নেহ ও সপত্নী-বিদ্বেষই এর প্রধান কারণ। ক্রুরা মন্থরা উপলক্ষ মাত্র।
রাম। না ভ্রাতঃ! এ তোমারই ভ্রান্তি। বিমাতা কৈকেয়ী, স্বগর্ভজ সন্তান নির্বিশেষে আমাদের সকলকেই সমান স্নেহ করেন্। তাঁ’র মনে কোনো ভিন্ন ভাব নাই; বরং ভারত অপেক্ষা আমার প্রতি তাঁ'র স্নেহ অধিকতর দেখা যায়।
লক্ষণ। (হাস্য করিয়া) আর্য্য! এর প্রকৃষ্ট প্রমাণ, ভারতের রাজ্য ভোগ ও আপনার এই তাপস বেশে বনে বনে ভ্রমণ দ্বারাই সুন্দর উপলক্ষিত হ’চ্ছে!!
সীতা। (ঈষদ্ধাস্যে)। দেবর লক্ষণ! অতি দুঃখের সময়ে ও হাস্যোদয় হ’ল। আর্য্যপুত্রের প্রতি যদি শ্বশ্রূ কৈকেয়ীর সমধিক স্নেহ না থা’ক্বে তা’ হ’লে কি আর এত অল্পকালেই বানপ্রস্থ-ধর্ম্মের অপূর্ব্ব সুখ আমাদের অদৃষ্টে ঘটনা হয়?—হা দুরদৃষ্ট!!
লক্ষণ। দেবি। আপনি যথার্থই অনুমান ক’রেছেন। আর্য্যের মনে এখনও বিষম ভ্রম আছে।
সীতা। আর্য্যপুত্র সরল-হৃদয়; আপনার মত সকলকেই ভাবেন। বিমাতাকে আপনি সবিশেষ ভক্তি শ্রদ্ধা করেন্, সেই জন্যই সেই প্রকার স্নেহ ও প্রত্যাশা করেন্।—হা কষ্ট! কোথায় রাজ্যভিষেক, কোথায় বনবাস!!
রাম। প্রিয়ে! দুঃখ সংবরণ করা। গতানুশোচনায় কোনো ফল নাই, বরং আরো কষ্টবৃদ্ধি। অদৃষ্টলিপি খণ্ডন করা কা'র সাধ্য? আহা! তৎকালে আমার সঙ্গে বনানুগমন না ক’রে যদি গৃহে থাক্তে, তা’ হ’লে এ দুঃসহ ক্লেশভার তোমাকে সহ্য ক'র্ত্ত্যে হ'ত না।
সীতা। নাথ! বিশাল রসাল উন্মুলিত হ’লে, আশ্রিতা মাধবী লতা কি আর উর্দ্ধে থেকে থাকে? প্রভু যখন পর্ণকুটীর আশ্রয় ক’লেন, দাসী তখন কি আর সুধাধবলিত সৌধ-শিখরে সুখে থাকতে পারে? রাম। (সহর্ষে) সীতা নিতান্তই পতিগতপ্রাণা। ঈদৃশ ভার্য্যা-রত্ন লাভ করা, পর সৌভাগ্যের বিষয়।
সীতা। (কথঞ্চিৎ সন্ধুচিত ভাবে) আর্য্যপুত্র! পুরবাসীরা আমাদের প্রতি কত অনুরক্ত দেখেছেন? তা’রাও অযোধ্যা পরিত্যাগ ক’রে বন পর্যন্ত ং আমাদের অনুগমন ক’রেছিল।
রাম। প্রিয়ে! সে দিবস তমসানদীর তীরে যদি ও রূপ কৌশল অবলম্বন না করা হ’ত, তা' হ’লে তা’রা কখনই আমাদের সঙ্গ পরিত্যাগ ক’র্ত্ত্য না।
সীতা। বোধ হয়, নিদ্রা ভঙ্গ হ’লে রথ-চক্রচিহ্ন অযোধ্যা মুখে দেখে, সকলে আমাদের রাজধানীতে প্রত্যাগমন আনুমান ক’রে, স্ব স্থানে প্রত্যাগত হ’য়ে থা'ক্বে।
রাম। সেই উদ্দেশ্যেই তৎকালে তাদৃশ উপায় উদ্ভাবন করা হ’য়েছিল।
লক্ষণ। (দণ্ডায়মান হইয়া) আর্য্য! অনুমতি হয় তা এক্ষণে ফলমূল আহরণে গমন করি?
রাম। ভ্রাতঃ! তোমাকে একাকী সর্ব্বদা স্বাপদ সন্ধুল সঙ্কট স্থলে প্রেরণ ক’র্ত্ত্যে আমার মনঃপ্রত্যয় হয় না। বৎস! তুমিই আমার একমাত্র অরণ্যসহায়।
লক্ষণ। (ঈষদ্ধাস্যে) আর্য্য! এ দাস কি এতই হীনবল যে আত্ম রক্ষণেও সমর্থ নয়? জীবন রক্ষার্থে সামর্থ্য না থাকলে অনর্থক এ বিপুল দেহভার বহনে প্রয়োজন কি? আপনি প্রসন্ন মনে অনুমতি করুন্; কোনো চিন্তা নাই।
রাম। বৎস! তবে এক্ষণে স্বাভীষ্টোদ্দেশে গমন কর, কিন্তু সত্বর প্রত্যাগমন ক’রো।
লক্ষণ। যে আজ্ঞা। আশীর্ব্বাদ করুন্। (প্রণাম)
রাম। বন-দেবতারা তোমাকে রক্ষা ক’র্ব্বেন্!
(ধনুঃশর হস্তে লক্ষণের প্রস্থান।)
রাম। (ক্ষণেক নিঃশব্দে অবস্থিতির পর) প্রিয়ে জানকি! নিসাদাধিপতির কেমন সৌজন্য ও সাধু স্বভাব দেখেছি? কেবল গুণেতেই বশীভুত হ’য়ে আমি তা’র সঙ্গে মিত্রতা-পাশে বদ্ধ হ’য়েছি। গুহকের মন সততই সরলতাপূর্ণ।
সীতা। নাথ! সদ্গুণই মানবের অলঙ্কার। নীচ জাতি হ’লে হয় না, গুণেই জগৎ যশ হয়। শবররাজের আচরণে আমর অপয়ায় আনন্দ লাভ হ’য়েছে।
রাম। হাঁ প্রিয়ে! আচার ব্যবহারেই নীচ ও উচ্চ। জাতিগৌরব সামান্য লৌকিক প্রথা মাত্র।
সীতা। (প্রফুল্ল মনে)- আর্য্যপুত্র! আমরা এখন চিত্রকূটে পরম সুখে আছি। চিত্রকূট অতি মনোহর স্থান! হিংস্র শ্বাপদ বা দুরাচার নিশাচরের আপদ আশঙ্কা নেই। অনেক তপস্বী সস্ত্রীক হ’য়ে এখানে নির্ভয়ে কাল যাপন ক’চ্ছেন। নানাপ্রকার সুস্বাদু ফলমূলও যথেষ্ট পাওয়া যায়। বিশেষতঃ, সতত মুনিপত্নীদের সহবাসে আমার মনে অতি আনন্দোদয় হয়। বনবাস আমার পক্ষে এখন আর তেমন ক্লেশকর বোধ হয় না। মহর্ষি ভরদ্বাজ, আমাদের অবস্থানের জন্য, অতি সুন্দর স্থানই নির্দ্দেশ ক’রে দিয়েছিলেন।
রাম। প্রিয়ে! একালে প্রকৃতি সতী অতি অপূর্ব্ব শোভাই ধারণ করেন্। বিশেষতঃ, চিত্রকূট পরম রমণীয় স্থল। এখানে সমস্তই শান্তিময় ও মনোহর -ঐ দেখ, সুদীর্ঘ তালতরুরা শিরে জটাভার ধারণ ক’রে প্রকৃতি দেবীর আরাধনা ক’চ্ছে। লতা-কুঞ্জ পুষ্পপুঞ্জে সুশোভিত হ’য়ে প্রকৃতি দেবীর উপর বিচিত্র চন্দ্রাতপ ধারণ ক’রেছে। সত্যত মলয়-মারুিত সঞ্চালিত হ’য়ে তরুতল সন্মার্জনী-পরিস্কৃত ক’রে রেখেছে। মহীরুহেরা করা-শাখা সঞ্চালন পূর্ব্বক বিমানচারী বিহঙ্গদিগকে ইঙ্গিতে আহ্বান ক’রে আতিথ্যব্রতে যথা সাধ্য সুস্বাদু ফলে পরিতুষ্ট ক’চ্ছে; যদি কোনো ফল অতিথির মুখে বিস্বাদু বোধ হয়, অমনি তা' ভূতলে নিক্ষেপ ক’র্ত্ত্যে তরুরাজি অনুরোধ ক’চ্ছে। বিহগেরাও পাদপপুঞ্জের আতিথ্যসৎকারে পরম পরিতুষ্ট হ’য়ে, তা'দের যশোগান ক’র্ত্যে ক’র্ত্ত্যে, অম্বর পথে উড্ডীন হ’চ্ছে! কুরঙ্গকুল ক্রীড়া কৌতুকে ইতস্ততঃ বিচরণ ক’চ্ছে। শাল্মীলী-তলে শুক-মুখ-ভ্রষ্ট নীবার-কণা মুষিকেবা ভক্ষণ ক’চ্ছে। -প্রিয়ে। আর ঐ দেখ, মাধবী স্বভাবের ভাবে মোহিত হ’য়ে সহকারের অঙ্গে ঢ’লে প’ড়েছে!! (অঙ্গুলি দ্বারা নির্দ্দেশ।)
সীতা। (সহস্যমুখে) নাথ! স্ত্রীজাতি সতত পুরুষেরই আশ্রিত; প্রভঞ্জন প্রভাবে ছিন্ন ভিন্ন হ’বার ভয়েই, মাধবী, সহকারের আশ্রয় নিয়েছে।
রাম। আর সহকারও মাধবীরে আদরে আপন বক্ষে স্থান দান ক’রেছে।
সীতা। মাধবীর পরম সৌভাগ্য ব’লতে হ’বে; কেন না সে—
(নেপথ্যে উচ্চৈঃস্বরে)
কি! এততেও দুরাত্মার মন পরিতৃপ্ত হ’ল না? আজ্ আমি এর সমুচিত প্রতিফল প্রদান ক’র্ব্বে।
সীতা। (সচকিতে) অ্যাঁ! এ আবার কি? (উগ্রভাবে লক্ষণের পুনঃপ্রবেশ।)
রাম। (সবিস্ময়ে) বৎস লক্ষ্মণ! সমাচার কি? তোমার এ রূপ উগ্র মূর্ত্তি দেখ্ছি কেন? ত্বরায় কারণ নির্দ্দেশ কর।
লক্ষণ। (উগ্র ভাবে) আর্য্য! সত্বর ধনুঃশর ধারণ করুন, সম্মুখে বিষম বিভ্রাট উপস্থিত। আর্য্যা জানাকীকে বানান্তরালে গোপনে রেখে, অরণ্য-পরিসরে সত্বর অগ্রসর হ’ন্। ঐ দেখুন্, মাতঙ্গের বৃৎহিত, তুরঙ্গের হ্রেষারব ও সৈন্য-কোলা হলে বনস্থ বিহঙ্গেরা বিমানে উড্ডীন হ’চ্ছে; হরিণকুল ভয়াকুল হ’য়ে বেগে পলায়ন ক’চ্ছে; বনস্থল হুলুস্থলময় হ’য়েছে।
রাম! প্রাতঃ! বোধ হয়, কোন রাজা বা রাজকুমার মৃগয়া মানসে আটাবীতে আগমন ক’রে থা'ক্বে; তা'তে আমাদের আশঙ্কা কি?
লক্ষণ। (সক্রোধে) আর্য্য! সেই কৈকেয়ী কুমার ভারত, রাজ্যাভিষেকে মত্ত হ’য়ে, সমগ্র সৈন্য সামন্ত সজ্জিত ক’রে, আমাদের হিংসা মানসেই, এখানে আগমন ক’রেছে; এ তা’রই সেনা কোলাহল। (আস্ফালন পূর্ব্বক) হা ধিক্! লক্ষণের এই আজানুলম্বিত বাহুযুগল কি কেবল শরীরের শোভা সম্পাদনের নিমিত্তই বিধাতা সৃষ্টি ক’রেছেন? আজ্ আমি অপকারী দুরাচারী আততায়ী ভারতেরে প্রেত-পাতির প্রাঙ্গণে প্রেরণ ক’রে, কৈকেয়ীর অশ্রািজলে ক্রোধানল নিব্বান ক’রবো। আজ্ আমি কেকয়-কুমারীর ফলোম্মুখী। আশা-লতা উন্মলিতা ক’র্বো। আজ্ আমি শরজালে কালানল বৃষ্টি ক’রে পৃথিবী দাহন ক’র্বো। আজ্ আমি—
রাম। (লক্ষণের হস্তদ্বয় ধারণ পূর্ব্বক) ভ্রাতঃ। স্থির হও। স্থির হও। ভরত ত্যোমার কি অপ্রিয় কার্য্য ক’রেছে যে, তুমি তা’র জিঘাংসায় প্রবৃত্ত হ’চ্ছ? ধনুর্ব্বাণ ধারণ ক’রে কি হ’বে? প্রাণাধিক ভারতের উপর কি অস্ত্র চালনা ক’র্ত্যে পার্ব্বে? যা’দের সুখ স্বচ্ছন্দের জন্য রাজ্যভার গ্রহণ কর্ত্যে হয়, তা’দের বিনাশ সাধন করে রাজ্যসুখ ক’রে ভোগ করা’ব? ভারত কিছু আততায়ী নয়, আর আততায়ী হ’লেই বা কে ভ্রাতৃবধ ক’রে থাকে? —আপনার প্রাণ কি কখনো আপনি নষ্ট করা যায়? আমার বোধ হয়, ভ্রাতৃবৎসল ভরত মাতুলালয় হ’তে প্রত্যাগত হ’য়ে, আমাদের আদর্শনে আকুল-চিত্ত ও সুহৃৎসমবেত হ’য়ে এখানে আগমন ক’রেছে; তা’র মনে কোনো অসদভিপ্রায় নাই। রাজধানীতে আমাদের প্রত্যাবর্ত্তন জন্য অনুরোধ কর্ত্যেই, ভরত এখানে উপস্থিত হ’চ্ছে।
লক্ষণ। (বিগতক্রোধ হইয়া) আর্য। আপনি যাই বলুন, কিন্তু আমার মনঃপ্রতীতি হয় না। —কাচমণির আকারে কি পদ্মরাগের জন্ম হয়? রাম। বৎস। ভরতের চরিত্রে কিছু মাত্র সংশয় নাই। এখন চল, আমরা ভরতের প্রত্যুদগমনের নিমিত্ত অগ্রসর হই।
ইতি প্রথম দৃশ্য।